মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০১৩
সাকিব যখন হেলিকপ্টারে, সোহাগ গাজী তখন লঞ্চে
Home Page » ক্রিকেট » সাকিব যখন হেলিকপ্টারে, সোহাগ গাজী তখন লঞ্চেদলের সবচেয়ে বড় তারকা সাকিব আল হাসান যখন সস্ত্রীক মাগুরা জেলা স্টেডিয়ামে হেলিকপ্টার থেকে নামছেন, বিশ্বরেকর্ডের মালিক তখন সদরঘাটের ভিড় ঠেলে লঞ্চের দিকে এগোচ্ছেন। আগের দিন চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে যে সময়টায় হ্যাটট্রিক করে টেস্ট ইতিহাসের পাতায় খুলেছেন নতুন এক অধ্যায়, পরের দিন একই সময়ে সোহাগ গাজী কুয়াকাটা-১ লঞ্চের কেবিনে বেঘোরে ঘুমোচ্ছেন!
দুপুর পৌনে ২টায় লঞ্চ ছাড়ার অনেক আগেই তিনি কেবিনের দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘুমে। ফোনটা ধরছিলেন তাঁর সঙ্গী, ‘ভাই তো ঘুমে।’
সেই ঘুম দিয়ে উঠতে উঠতে সন্ধ্যা। নিশ্চয়ই জীবনের সবচেয়ে শান্তির ঘুম দিয়েছেন? এমন প্রশ্নে হাসতে হাসতে বললেন, ‘শান্তির ঘুম নারে ভাই। খুবই ক্লান্ত ছিলাম। আগের দিন ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঢাকার ফ্লাইট ধরার তাড়া। ঢাকায় পৌঁছে বাসায় আসতে আসতে রাত সাড়ে ১১টা। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই আবার লঞ্চ ঘাটে। লঞ্চে উঠেই তাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।’ কিন্তু তাঁর সতীর্থদের অনেকেই এখন হরহামেশা বিমানে যাতায়াত করেন। তাঁর গন্তব্য পটুয়াখালী যেতে না পারুন, বরিশাল পর্যন্ত অন্তত বিমান যোগাযোগ আছে। সেভাবে গেলেই বরং দ্বিতীয় টেস্টের আগে পথের ঝক্কিটা অনেক কম যেত তাঁর ওপর দিয়ে। শুনে যা বললেন, তাতে বোঝা গেল তারকা মর্যাদার উত্তাপটা এখনো এ মাটির মানুষের গায়ে লাগেনি, ‘বরিশালে প্লেন কখন কোন সময়ে যায় আমি আসলে ঠিক জানি না। তা ছাড়া টিকিট পাওয়া যেত কি না তাও তো জানি না।’ টেস্ট সিরিজ শুরুর আগেই তাই কুয়াকাটা-১ লঞ্চের টিকিট কাটিয়ে রেখেছিলেন পরিচিত একজনকে দিয়ে।
এই লঞ্চের বেশির ভাগেরই গন্তব্য তাঁর শহর পটুয়াখালী। কেবিন পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে তাঁদের মুখে ‘পটুয়াখালীর গর্ব’ শুনে খুব আপ্লুত হয়েছেন। তবে আগের দিন চট্টগ্রাম টেস্টের পর নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক ব্রেন্ডন ম্যাককালামের এমন কথা শুনে শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যাওয়া অনুভূতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি, ‘এই ম্যাচটা তো তোমারই।’ একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও হ্যাটট্রিকের অনন্য বিশ্বরেকর্ড গড়ার পরও সব কিছু বুঝে উঠতে একটু সময়ই লাগছে সোহাগের, ‘আসলে মানুষ কখন কোথায় কোন মুহূর্তে কী করে ফেলে, মানুষ নিজেই জানে না। আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না যে কত বড় কী করে ফেলেছি! এটা অবশ্য বুঝতে পারছি যে দেশের জন্য কিছু একটা করতে পেরেছি। যদিও সাকিব ভাইয়ের জন্য বিশ্বের অনেকেই বাংলাদেশকে চেনে। আমার বিশ্বরেকর্ডের কারণে হয়তো বাংলাদেশ এখন আরেকটু পরিচিতি পেল।’
অথচ গত বছরের এই অক্টোবরেই কি না পত্রিকায় নিজের ছবি ছাপার জন্য ‘তদবির’ পর্যন্ত করেছেন সোহাগ! সেবার বরিশাল বিভাগের হয়ে জাতীয় ক্রিকেট লিগের ম্যাচে সেঞ্চুরি যেমন করেছিলেন, তেমনি এক ইনিংসে হ্যাটট্রিকসহ ৭ উইকেটও নিয়েছিলেন। এমন কীর্তির পর তাঁর ছবি ছাপা হতে বাধ্য। তবুও সতীর্থ এক ক্রিকেটারকে দিয়ে ছবি ছাপার অনুরোধ করেছেন সাংবাদিকদের। কাল সন্ধ্যায়ও এক বছর আগে পত্রিকায় নিজের ছবি দেখার কাক প্রতীক্ষা বোঝা গেল তাঁর কথায়, ‘পত্রিকায় একটি ছবি ছাপার জন্য আমি তখন খুব তাড়াহুড়ো করছিলাম। পত্রিকায় একটা ছবি আসবে, দেখতে নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগবে। এই ভেবে শাহীন ভাইকে (বরিশাল বিভাগীয় দলের উইকেটকিপার শাহীন হোসেন) গিয়ে ধরেছিলাম। এরপর উনি বিভিন্ন পত্রিকার পরিচিত সাংবাদিকদের ফোন দিলেন।’ অথচ এক বছর পর কাল দুপুরে কালের কণ্ঠের আলোকচিত্রী তাঁর ঘুম ভাঙালেন ছবি তোলার জন্য। কেবিনের দরজা খুলতেই মোবাইলে সোহাগের ছবি তুলতে তাঁর সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন লঞ্চের অনেক যাত্রীও।
পটুয়াখালীর ইটবাড়ীয়া গ্রামে সোহাগদের আদি নিবাস। তবে এখন বাড়ি করেছেন পটুয়াখালী শহরে কালিকাপুরের কলাতলায়। পরিবারের সঙ্গে সেখানেই ঈদ করে আবার ১৮ অক্টোবর দলের সঙ্গে অনুশীলনে যোগ দিতে হবে। স্বজনদের সান্নিধ্যে ঝরঝরে হয়ে অবশ্য দ্বিতীয় টেস্টের জন্য কোনো পরিকল্পনা নিয়ে ফিরছেন না সোহাগ, ‘কখনোই পরিকল্পনা করে নামি না আমি। এই টেস্টের পর আরো বুঝতে পারছি, পরিকল্পনা করে কিছু হয় না। সেঞ্চুরিও পরিকল্পনা করে হয়নি। হ্যাটট্রিকও নয়। তবে সিরিজ শুরুর আগে থেকেই একটা লক্ষ্য আছে আমার। টেস্ট সিরিজের সর্বোচ্চ উইকেট নেওয়া।’ সেই লক্ষ্যে চট্টগ্রাম টেস্ট তাঁকে এগিয়ে দিয়েছে অনেক দূরই। সেই সঙ্গে নিজের ব্যাটিং নিয়ে দিয়েছে নতুন এক উপলদ্ধিও, ‘আমি কখনোই কোনো জায়গায় এতটা ঠাণ্ডা মাথায় ব্যাটিং করিনি। হঠাৎ করে মনে হলো, ওই মুহূর্তে ঠাণ্ডা মাথায় খেললে দলের অনেক উপকার হবে। আল্লাহর রহমতে হয়েও গেছে। বলতে পারেন, নিজের ব্যাটিং নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে শেখাল এই টেস্ট।’ বাবা মোহাম্মদ শাহজাহান গাজী পুলিশের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছেন বছর চারেক হয়। আর মায়ের নাম বলতে গিয়ে খানিকটা রসিকতাও করলেন সোহাগ, ‘ওনার নাম বর্তমান সরকার প্রধানের নামে, হাসিনা বেগম।’ মা-বাবার কথা শোনাও সাফল্যের অন্যতম রসায়ন বলে জানালেন তিনি, ‘ম্যাচের আগের দিন ওনাদের সঙ্গে কথা না বললে আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগি আমি। সেঞ্চুরি করার আগের রাতেও আম্মা বারবার বললেন, খেলার আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়তে। নামাজ পড়ে মাঠে নামলাম এবং ১০০ মারলাম। হ্যাটট্রিকের দিন অবশ্য পড়িনি। ওটা পরে পড়ে নিয়েছি।’
বাংলাদেশ সময়: ১২:৪৮:১১ ১১৯৫ বার পঠিত