বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০১৩

আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত

Home Page » প্রথমপাতা » আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত
বুধবার, ৯ অক্টোবর ২০১৩



is1.jpgবঙ্গ-নিউজ ডটকমঃ স্বাধীনতাবিরোধী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের নেতা হিসাবে একাত্তরে জয়পুরহাটে রাজাকার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর দায়ে আবদুল আলীমকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।হত্যা, গণহত্যা ও লুটতরাজের মতো অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্য হলেও বয়স ও পঙ্গুত্বের কথা বিবেচনায় নিয়ে ৮৩ বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধীর জন্য এই সাজার আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

জিয়াউর রহমানের আমলের মন্ত্রী আলীম হলেন বিএনপির দ্বিতীয় নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে যার সাজার আদেশ হলো। সাবেক মন্ত্রী হিসাবে এ দিক দিয়ে তিনি তৃতীয়।

বুধবার জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের ১৭টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি ঘটনায় আলীমের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হয়েছে।

এর মধ্যে চারটি ঘটনায় আলীম যেভাবে গণহত্যা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন ‘অত্যন্ত জঘন্য’ অপরাধ।

“কোনো মানুষ, যে ফিজিকালি ও মেন্টালি আনফিট, তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো উচিৎ নয়। কিন্তু আবদুল আলীমের অপরাধ এতোটাই ঘৃণ্য, তাকে মুক্ত রাখলে মানবতার অবমাননা হবে। এ কারণে তাকে কারাগারের চার দেয়ালের মধ্যে বাকি জীবন কাটাতে হবে। তাহলে হয়তো কৃতকর্মের জন্য তার ভেতরে অনুশোচনার সৃষ্টি হবে।”

এসব অপরাধ সর্বোচ্চ শাস্তির যোগ্য হলেও স্বাস্থ্যের অবস্থা বিবেচনা করে ৮৩ বছর বয়সী এই যুদ্ধাপরাধীকে স্বাভাবিক মৃত্যু পর্যন্ত কারাগারে কাটাতে হবে।

এ আদালতের অপর দুই বিচারক বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও শাহিনুর ইসলামও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। তারা ১৯১ পৃষ্ঠার এই রায়ের প্রথম দুটি অংশ পড়েন।

এর আগে একই কারণে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযমকেও মৃত্যুদণ্ডের বদলে ৯০ বছরের জেল দেয় ট্রাইব্যুনাল।

স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার প্রণীত দালাল আইনের আসামী ছিলেন আলীম।

একজন আইনজীবী হয়েও কীভাবে আলীম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে নিয়ে যুদ্ধের নয়টি মাস একের পর এক হত্যা, গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটিয়েছেন, তা উঠে এসেছে এই রায়ে। মামলার শুনানিতে ওইসব ঘটনার জন্য তাকে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবল’ হিসাবে উল্লেখ করে প্রসিকিউশন।

সে সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া কনভেনশন মুসলিম লীগের এই নেতা জয়পুরহাট মহকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে কীভাবে রাজাকার বাহিনীর জন্য সদস্য সংগ্রহ ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন, কীভাবে এক পাট ব্যবসায়ীর গদিঘর দখল করে নির্যাতন শিবির খোলেন- সে বিবরণও এই রায়ে উঠে এসেছে।

তারপরও ফাঁসির রায় না আসায় ট্রাইব্যুনালের বাইরে অপেক্ষায় থাকা কেউ কেউ এবং রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বানে উপস্থিত জনতা অসন্তোষ প্রকাশ করে। আপিলের মাধ্যমে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেয়ারও দাবি জানান তারা।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, পুরো রায় দেখে তারা পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আহসানুল হক হেনা বলেন, তারা আপিল করবেন।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এটি অষ্টম রায়। আগের সাতটি রায়ে জামায়াতের সাবেক ও বর্তমান ছয়জন এবং বিএনপির এক নেতাকে দণ্ডাদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।

এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লাকে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিলেও আপিলের রায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

মুসলিম লীগ থেকে বিএনপি

১৯৩০ সালের ১ নভেম্বর জয়পুরহাটে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল আলীম। তার বাবা আবদুল ওয়াহেদ ছিলেন জয়পুরহাট শহরের থানা রোডের ইসলামিয়া রাইস মিলের মালিক। আদি বসত পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলায় হলেও দেশবিভাগের পর ১৯৫০-৫১ সালে তাদের পুরো পরিবার তখনকার পূর্ব বাংলার (পাকিস্তান) জয়পুরহাটে চলে আসে।

আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেয়ার পর আইন পেশায় যোগ দেন আলীম। ১৯৫৮ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেয়ার চার বছরের মাথায় দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে, আলীম তখন কনভেনশন মুসলিম লীগের একজন প্রভাবশালী নেতা এবং বগুড়া জেলা কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যানের দায়িত্বে। সে সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতার জন্য মহুকুমা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে রাজাকার বাহিনী গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন।

তার নেতৃত্বে সে সময় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ব্যাপক ধরপাক, লুটপাট, নির্যাতন এবং হত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটায়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালাল আইনে একটি মামলাও দায়ের করা হয়েছিল আলীমের বিরুদ্ধে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর এবং ১৯৭৭ সালে দুই দফা জয়পুরহাট পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন আলীম। ১৯৭৯, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে তিনি বিএনপির টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

জিয়াউর রহমানের সরকারে প্রথমে বস্ত্রমন্ত্রী এবং পরে যোগাযোগমন্ত্রী ছিলেন আলীম।

মামলার পূর্বাপর

যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১১ সালের ২৭ মার্চ জয়পুরহাটের বাড়ি থেকে আলীমকে গ্রেফতার করা হয়। ৩১ মার্চ তাকে ১ লাখ টাকায় মুচলেকায় ছেলে টেলিকম খাতের ব্যবসায়ী ছেলে ফয়সাল আলীম ও আইনজীবী তাজুল ইসলামের জিম্মায় জামিন দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর কযেক দফায় জামিনের মেয়াদ বাড়ানোয় ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি ছেলের বাড়িতেই ছিলেন।

গত বছরের ১৫ মার্চ আলীমের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেন প্রসিকিউশন, যাতে হত্যা, লুণ্ঠনসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ২৮টি অভিযোগ আনা হয়। এরই মধ্যে গত বছরের ১৬ এপ্রিল মামলাটি ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ট্রাইব্যুনাল-২ এ স্থানান্তর করা হয়।

গত বছরের ১১ জুন ৭ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের মোট ১৭টি অভিযোগে আলীমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গ নের মধ্য দিয়ে এই বিএনপি নেতার বিচার শুরু হয়।

গতবছর ৬ আগস্ট এ মামলায় প্রসিকিউশনের সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। চলতি বছরের ২২ অগাস্ট প্রসিকিউশনের ৩৫ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়।

অন্যদিকে আসামিপক্ষে তার ছেলে সাজ্জাদ ছাড়াও সাক্ষ্য দেন জয়পুরহাটের বাসিন্দা মো. মামুনুর রশিদ চৌধুরী ও মো. মোজাফফর হোসেন। সাফাই সাক্ষ্য চলে ২৭ আগস্ট থেকে ৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।

৪ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দুই পক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে ট্রাইব্যুনাল।

অষ্টম রায়

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। প্রথম রায়ে গত ২১ জানুয়ারি জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে।

৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়।

ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে গত ২৮ ফেব্র”য়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসি হলে দলটির ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকাগুলোতে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি হিসেবেই পুলিশসহ নিহত হয় ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

এরপর গত ৯ মে চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল।

মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উস্কানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে গত গত ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়।

ষষ্ঠ রায়ে গত ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকেও মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

আর সর্বশেষ গত ১ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের সপ্তম রায়ে সাবেক মন্ত্রী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্র ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪:৪০:১৪   ৩৬৮ বার পঠিত