শনিবার, ২ জুলাই ২০২২

সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ২৬ :স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » সীমান্ত ভ্রমণের সাতটি দিন ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা ; পর্ব- ২৬ :স্বপন চক্রবর্তী
শনিবার, ২ জুলাই ২০২২



স্বপন কুমার চক্রবর্তী

বঙ্গ-নিউজ: Facts.bd.com-
ঘাঁটু গান :- বিকৃত লালসার স্বীকার হয়ে ধর্ষিত এক লোকগীতি:
ঘাঁটু গান পশ্চিম বঙ্গের নদী অঞ্চল ও বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের একটি বিলুপ্ত প্রায় পল্লী সংগীত বিশেষ। ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এই গান গাওয়া হয় বলে একে ঘাটু গান বলে। এখনো ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে যেমন ঈশ্বরগঞ্জ , কেন্দুয়া , এবং সিলেটের কিছু এলাকায় ঘাটু গানের নাম শোনা যায়। বিলুপ্ত প্রায় একটি লোক সংগীত হলেও এটিকে কেহ কেহ বৈষ্ণব গানের সাথে গুলিয়ে ফেলে, যা আসলে সঠিক নয়। ঘাঁটু গান ভাটি অঞ্চলের একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধারার গান। এই গানের উৎপত্তি কাল আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দির প্রথম দিকে । ঘাঁটু গানের দলের কেন্দ্র বিন্দু নিম্ন বিত্ত শ্রেণীর ১৪-১৮ বছর বয়েসী বালকেরা মেয়ের বেশে নাচ গান করতো। এই ভাবে দর্শকদের আনন্দ দান করতো। ঘাঁটু গানের দলের কেন্দ্র বিন্দু এই বালককে ঘাঁটু বলা হতো।
ডক্টর শরবিন্দুর বক্তব্য অনুসারে-
” কেবল গীতিকাই লোকনাট্য নয়। জারি ,বারমাসি, ঘাটুগান, গাজন গান, প্রভৃতিও বর্তমানে লোকনাট্য হিসাবে স্বীকৃত। ( ফোকলোর ও লোকসংস্কৃতি, রোদেলা প্রকাশনী,পৃষ্ঠা-৫৬ )
এক সময় নেত্রকোনা জেলায় ঘাঁটু গানের বিপুল জনপ্রিয়তা ছিল। এখানে এটি ঘাঁটু গান, এবং গাডু গান নামেই বহুল পরিচিত। একটু শিক্ষিত শ্রেণীর লোকেরা একে ”ঘাঁটু গান” নামেই বলে। অন্যরা বলেন গাডু গান। এছাড়াও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে বলে ঘাঁডু গান। তাই এই গানকে কোথাও ঘাঁটু গান, কোথাও গাটু গান কোথাও গাডু গান আবার কোথাও গাঁটু গান নামে ডাকে। ময়মনসিংহের পূর্বাঞ্চল ,বৃহত্তর কুমিল্লার উত্তরাঞ্চল ও সিলেট জেলার হাওর অঞ্চল জুড়ে ছিল এই গানের বিস্তৃতি। ঘাঁটু গানের উৎপত্তি সম্পর্কে একাধিক মত পাওয়া যায়।
লোক সাহিত্য গবেষক ডক্টর আশরাফ সিদ্দীকির মতে-
” শোনা যায়, ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগে শ্রীহট্ট ( সিলেট) জেলার আজমিরিগঞ্জ নিবাসী জনৈক আচার্য রাধাভাবের নানা লীলা খেলার মধ্যে তন্ময় হয়ে থাকতেন। ক্রমে তার শিষ্য সংখ্যা বাড়তে লাগলো। নিম্ন শ্রেণীর বহু বালক তার শিষ্যত্ব গ্রহন করলো। এই ছেলেদের রাধিকা ভাব সম্পন্না উক্ত আচার্যের সখি সাজানো হতো। তারা নীরবে নেচে রাধার বিরহের বিভিন্ন ভাব প্রকাশ করতো। পরে বিভিন্ন বিরহ সংগীতের সমবায়ে গড়ে ওঠে ঘাটু গান। “
তিতাস চৌধুরীর মতে:-
” কুমিল্লা জেলার “ গুনিয়াউক” গ্রামেই এই ঘাটু গানের প্রধান ও ইদ উৎস। ব্যরিস্টার আব্দুর রসূলের পিতা- গোলাম রসূলই ছিলেন এই গানের প্রবর্তক। তাঁর উৎসাহ ও উদ্দীপনায় “ ঘাটু গান” বিভিন্ন জেলার সর্বত্র বিস্তার লাভ করে। এই গান গুলো উর্দু –বাংলা পার্সী ও হিন্দী সংমিশ্রণে বিরোচিত। ( লোক সাহিত্যের নানা দিক , শোভা প্রকাশনী দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃষ্ঠা- ৬৬ )
এ বিষয়ে আরও অনেক মতবাদ থাকলেও গবেষক ডক্টর আশরাফ সিদ্দীকির দেয়া তথ্যের সাথে অনেকে একমত হয়েছেন । সুতরাং বলা যায় যে, ঘাঁটু গানের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে সিলেট জেলার আজমিরিগঞ্জ এবং উৎপত্তি কাল ষোড়শ শতকের প্রথম ভাগ।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সাধন পন্থা হিসেবে এই গানের যাত্রা শুরু হয়। তবে উদয় আচার্যের মৃত্যুর পর তা সম্পূর্ণ বিকৃত হয়ে লোক সাহিত্যে পরিণত হয়। রাধা-কৃষ্ণের প্রণয় লীলা ঘাটু গানের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলেও এক পর্যায়ে সেই সীমা রেখা অতিক্রম করে ঘাঁটু গান হয়ে ওঠে বৈচিত্রপূর্ণ । কারণ এই গানের দর্শক শ্রেণীতেও ছিল নানা সম্প্রদায় ও নানা শ্রেণীর মানুষ। তবে উল্লেখ্য যে, এক সময় নিম্ন শ্রেণীর হিন্দু সমাজের লোকজন এই গানের বিকাশ সাধনে প্রধান ভুমিকা পালন করে।
ঘাটে ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে এই গান গাওয়া হতো বলে নাম হয়েছে “ ঘাঁটু গান’” –এই বিষয়ে প্রায় সকলেই একমত । অল্প বয়েসী ছেলেদেরকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো বেশী। তারা মেয়ে সেজে নেচে-গেয়ে দর্শকদের আনন্দ দিতো। ঘাঁটু ছোকড়াদের মাথায় থাকতো লম্বা চুল। তাদের বেশভূষা ছিল মেয়েদের মতো। তারা চুলে খোপা ও বেণী বাঁধতো। পোষাক হিসেবে পড়তো ধূতি ও গেঞ্জি। মাঝে মাঝে ব্লাউজ ও শাড়ী পড়তো। সাথে থাকতো অলংকার। পায়ে থাকতো ঘুঙুর। মূলত রাধার ভূমিকায় থাকতো এই ছোকড়াগণ। ঘাটু গানের পরিচালককে বলা হতো সরকার। এই সরকারগণ ঘাটুদেরকে নাচ, গান অভিনয় ও তত্ব কথায় পারদর্শী করে তুলতেন। যারা পৃষ্ঠপোষক তাদেরকে বলা হতো সমঝদার। দলে অন্য যারা থাকতেন তাদেরকে বলা হতো দোহার। তারা সমস্বরে ঘাঁটুর সাথে পাইল ধরতেন। যন্ত্রপাতি হিসাবে ব্যবহৃত হয় ঢোল, খোল, বেহালা , বাঁশী ,মন্দিরা, করতাল, হারমোনিয়াম দোতারা, ও বাঁশী। ঘাটু গানের বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে এক সময় বিভিন্ন গ্রামে প্রতিযোগীতা মূলক ভাবে এই গানের আয়োজন করা হতো। থাকতো দুটি দলের মধ্যে প্রতিযোগীতা। একটি রাধার ভুমিকায় আর অন্যটি কৃষ্ণের ভুমিকায়। গীত গানের মধ্যে একে অপরকে প্রশ্ন করতো এবং উত্তর দিতো। যেমন, রাধার প্রেরিত সখা এসে সুবলকে বলছে-
” দুঃখে কষ্টে আছেরে শ্যাম তোমার বিধূমূখী
দশম দশায় পড়িয়াছে , মরণ কেবল বাকি।
আমারে পাঠায়ে দিল, যাবে কিনা যাবে বল,
উন্মাদিনী হইয়া গেলো সত্য যুগের লক্ষী ।
কৃষ্ণ বলে:-
” আমি যাইতেও পারি না, মনেও তো মানে না
যাবনা সুবল আমি রাধার খবরে
দেখ সুবল তুমি চিন্তা করে।
আমি তার প্রেমে পোড়া পুড়লাম জন্ম ভরে। “
লেখক অচিন্ত আসিফ:-
পশ্চিম বঙ্গের নদী অঞ্চল ও বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলের বিলুপ্ত প্রায় এক পল্লী সঙ্গীত হলো ঘাটু গান। ষোড়শ শতকের শেষের দিকে প্রচলন ঘটে ঘাটু গানের। প্রথম দিকে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই গান। পরবর্তীতে অশ্লীলতায় ভর করে। পহেলা বৈশাখ নববর্ষ পালনে ঘাটু সংস্কৃতির যোগসূত্র ঘটে। অল্প বয়েসী ছেলেকে মেয়ে সাজিয়ে নাচানো হতো। পায়ে ঘুংঘুর পরানো থাকতো। গগনচুম্বী খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা পায় এই ঘাটু গান। ঘাটুদেরকে কেনা বেচাও করা হতো।
( চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ২০:৩১:৪৬   ৪৫৫ বার পঠিত   #  #  #