মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল ২০২২

হাওরের বন্যা চালের বাজারমূল্যে প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে

Home Page » অর্থ ও বানিজ্য » হাওরের বন্যা চালের বাজারমূল্যে প্রভাবক হয়ে উঠতে পারে
মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল ২০২২




সুনামগঞ্জের বন্যা পরিস্থিতি 

বঙ্গ নিউজঃ       হাওরে বাঁধ ভেঙে তলিয়ে যাচ্ছে একের পর এক বোরো ধানের জমি। সর্বশেষ তথ্য পাওয়া পর্যন্ত শুধু সুনামগঞ্জ জেলায়ই ১০ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেসব জমি এখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় সেগুলো থেকে কাঁচা বা আধাপাকা ফসল কেটে আনছেন কৃষক। হাওরের বর্তমান পরিস্থিতি দেশে এবার চালের বাজারমূল্যে বড় ধরনের প্রভাবকের ভূমিকা রাখতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশে মোট চাল উৎপাদনের বড় একটি অংশ আসে হাওরাঞ্চল থেকে। শুধু বোরো মৌসুমে আবাদ হলেও দেশে চালের সরবরাহ ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় প্রভাবকগুলোর একটি হলো হাওরাঞ্চলের উৎপাদন। বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অতীতেও হাওরের উৎপাদন বিপর্যয়ের ধারাবাহিকতায় দেশে চালের বাজারে অস্থিতিশীলতা নেমে আসতে দেখা গিয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে সংঘটিত হাওরের আগাম বন্যার কারণে ওই বছর দেশে পণ্যটির বাজারে ব্যাপক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছিল।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, বোরো ধানের প্রায় ১০ শতাংশ হাওর এলাকা থেকে আসে। আমাদের চাল উৎপাদনের ৬০ শতাংশই যেহেতু বোরো, সে কারণে হাওরের বন্যার ক্ষতির বেশ প্রভাব পড়তে পারে আমাদের মোট চাল উৎপাদনে। এছাড়া বন্যার প্রভাবে হাওরাঞ্চলে তাত্ক্ষণিক খাদ্যাভাবের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হতে পারে। দেশের কিছু স্থানে তাপপ্রবাহ চলছে। ফলে কিছু জায়গার ধান পুড়ে যাচ্ছে, চিটা হয়ে যাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে আমরা যদি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করি, তাহলে দেখতে পাব বোরো উৎপাদনে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে। এ অনিশ্চয়তা অবশ্যম্ভাবীভাবে আমাদের খাদ্যনিরাপত্তায় বড় ধরনের হুমকি তৈরি করতে পারে।

খাদ্যনিরাপত্তার এ হুমকি সামাল দিতে এখনই সরকারকে প্রস্তুতি নিতে হবে জানিয়ে এ অর্থনীতিবিদ বলেন, যে বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, হয়তো আমদানি করে সেটা সামাল দেয়া যাবে। কিন্তু তার জন্য নীতিনির্ধারকদের এখনই প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। পাশাপাশি আমনে যাতে কোনো ধরনের ক্ষতি না হয়, সেই প্রস্তুতিও নিয়ে রাখতে হবে।

ভারতের মেঘালয় অঞ্চলে অতিবৃষ্টির ফলে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওরের পানি ক্রমেই বাড়ছে। আগাম বন্যায় ভেঙে পড়ছে একের পর এক বাঁধ। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আধাপাকা ধান কেটে ফেলার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে চাল উৎপাদন নিয়েও।

পনি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সামসোদ্দাহা বলেন, উজানে বৃষ্টিপাত হওয়ায় হাওরে পানি বাড়ছে। ২৪ ঘণ্টায় ভারতের মেঘালয়ে ৬৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। গতকাল সকালে সুরমা নদীর পানি বিপত্সীমার দশমিক ৯ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। যদি মেঘালয়ে ভারি বৃষ্টিপাত বাড়ে, তাহলে বন্যা পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। তাতে আরো বেশি হুমকিতে পড়বে হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ। আমরা চেষ্টা করছি যাতে হাওর রক্ষা বাঁধ না ভাঙে।

এখন পর্যন্ত সুনামগঞ্জের দিরাই, শাল্লা, ধরমপাশাসহ সাত উপজেলার ১৭টি হাওরে বাঁধ ভেঙে ফসলি জমিতে পানি ঢুকে পড়ার তথ্য পাওয়া গিয়েছে। রোববার গভীর রাতে উপজেলার জগদল ইউনিয়নের হুরামন্দিরা হাওরের সাতবিলা স্লুইস গেট এলাকায় ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি প্রবেশ করে। তাতে সেখানকার এক হাজার হেক্টর জমি নিমিষেই তলিয়ে যায়। এর আগে সকালে তাহিরপুর উপজেলার টাঙ্গুয়ার হাওরের ওয়াচ টাওয়ার-সংলগ্ন বর্ধিত গুরমার হাওরেও বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে। সব মিলিয়ে জেলার প্রায় ১০ হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এখনো তাহিরপুর, ধরমপাশা, দিরাই, শাল্লাসহ জেলার প্রায় সবক’টি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে। অনেক বাঁধে ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে স্থানীয় প্রশাসন, পাউবো ও কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে হাওরের ধান রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, সুনামগঞ্জের সব হাওর রক্ষা বাঁধ হুমকির মুখে রয়েছে। যেকোনো সময় যেকোনো বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই উপজেলা প্রশাসন, পাউবো, কৃষি বিভাগ, জনপ্রতিনিধিসহ আমরা সবাই মাঠে আছি। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় হাওরের ফসল রক্ষা করতে হবে।

স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এ কারণে এখন একের পর এক বাঁধ ভেঙে পড়ছে। প্রশাসন ও পাউবো তথ্য অনুযায়ী আগাম বন্যার আশঙ্কা থাকায় কাঁচা-আধাপাকা ধান কাটছেন হাওরের কৃষকরা। এবার হাওরে ধান চাষাবাদ হয়েছে ২ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে। এসব জমি থেকে ১৩ লাখ টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্য ছিল। গতকাল সকাল পর্যন্ত জেলার হাওর ও হাওরের বাইরেও ৫০ হাজার হেক্টরের বেশি জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। ধান কাটার জন্য পাঁচ শতাধিক হারভেস্টার মেশিন প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিমল চন্দ্র সোম বলেন, একদিকে হাওরে পানি ঢুকছে, অন্যদিকে আমরা হারভেস্টার মেশিন দিয়ে কৃষকদের দ্রুত ধান কেটে দিচ্ছি। দিরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, কৃষি বিভাগ, পাউবোসহ স্থানীয়রা মিলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছেন। এ পর্যন্ত সুনামগঞ্জ জেলায় মোট ৫৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। আমরা আশা করছি আবহাওয়া অনুকূল থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে হাওরের সব ধান কাটা শেষ হবে।

এর আগে ২০১৭ সালের বন্যায় হাওরে ফসলহানির পর বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। পরে ঠিকাদারি প্রথা বাতিল করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) মাধ্যমে হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজের উদ্যোগ নিয়েছিল পাউবো। এখন পাউবোর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পিআইসির মাধ্যমে করা কাজগুলো মানসম্মত হচ্ছে না। এসব বাঁধে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতি থেকে যাচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পাউবোর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী এসএম শহিদুল ইসলাম বলেন, বাঁধে মাটির কাজগুলো তো পিআইসি করে। পিআইসির কাজগুলো খুব একটা মানসম্পন্ন হয় না। এ কারণে দু-এক জায়গায় বাঁধ ধরে রাখা যায়নি। এর ওপর উপর্যুপরি দুবার বন্যা হলো। প্রথম দফার বন্যায় বাঁধটা দুর্বল হয়ে পড়ে। পরে আরেকবার বন্যা হওয়ার ফলে দু-এক জায়গা ভেঙে যায়।

পিআইসির কাজে পাউবোর তদারকি ছিল কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তদারকি ছিল। কিন্তু অনেক ইকুইপমেন্ট লাগে, অনেক কিছু লাগে, যেটা ছাড়া তদারকি সম্ভব নয়। আমরা আমাদের কাজগুলো করছি। প্রতি বছরই আমরা নিয়মমাফিক ডিজাইন অনুযায়ী কাজ করার চেষ্টা করি। প্রতি বছরই কাজ হয়। প্রতি বছরই আমরা চেষ্টা করি বাঁধগুলো ধরে রাখার। এজন্য বাজেটেরও সমস্যা নেই। কিন্তু বাঁধ মেরামতের কাজগুলো খুব দ্রুত দু-তিন মাসের মধ্যে শেষ করতে হয়। আর মানসম্মত কাজ করার জন্য আরো বড় প্রকল্প নেয়ার প্রয়োজন আছে।

বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনিয়ম তেমনভাবে হয়নি। বাঁধ যেগুলো ভাঙছে সেগুলো আট-দশ বছরের পুরনো। চার বছর বন্যা হয়নি। এবার বন্যা হওয়ায় ঝামেলাটা তৈরি হয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হাওরে আগাম বন্যাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কাও এখন বেশি। এ অবস্থায় হাওর ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসে গিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য সার্বিকভাবে নতুন পরিকল্পনার ভিত্তিতে কাজ এগিয়ে নেয়ার ওপর জোর দিচ্ছেন তারা।

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ এবং ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত বলেন, হাওর ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নতুন করে ভাবতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আগাম বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ধান রোপণের সময় এগিয়ে আনতে হবে, যাতে মার্চের মধ্যে ধান কেটে নেয়া যায়। এছাড়া ধান উৎপাদন ও মাছ চাষের মধ্যে একটা সমন্বয় রাখতে হবে। যাতে দুটির কোনোটিই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। এজন্য বিষয়টি নিয়ে সার্বিকভাবে একটি পরিকল্পনা তৈরি করতে হবে। হাওর রক্ষায় সাবেকি পদ্ধতিতে কাজ করলে হবে না, সেটি বদলাতে হবে। ১৯৫০ বা ১৯৭০ সালের পরিকল্পনায় এ সময়ের হাওর ব্যবস্থাপনা চলতে পারে না। এজন্য স্থানীয় অধিবাসীদের সম্পৃক্ত করে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিয়ে এ প্রাকৃতিক সম্পদ বিষয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

সূত্রঃবণিক বার্তা

বাংলাদেশ সময়: ১২:৪৮:১৯   ৪৯৯ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #