বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২১
ফারহানা আকতার এর কলাম : নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ–র্পব-৬২
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম : নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ–র্পব-৬২‘নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ—র্পব-৬১’ —থেকে আমরা জেনেছি, সেই সময় (১৯৭১ সালে –বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মিলানওয়ালি জেলে বন্দী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সহবন্দী হয়ছেলিনে ‘রাজা আনার খান’ । আসলে তিনি কয়েদি ছিলেন না, পুলিশের গোয়েন্দা শাখার এই জ্যেষ্ঠ র্কমর্কতা কয়েদির ছদ্মবেশে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর র্সাবক্ষণিক ছায়াসঙ্গী র্অথাৎ পুরোপুরিভাবে তাঁর একজন নিঃর্স্বাথ গোপন-বন্ধু ছিলেন । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের চারিত্রিক মার্ধুযে আকৃষ্ট হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিক হয়েও তিনি তাঁর জীবন রক্ষা করেছিলেন । অথচ আমরা বাঙ্গালির বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে ও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নিজেদের আত্মপরিচয় তথা একটি স্বাধীন দেশ ও ভাষা ফিরে পেয়েও বঙ্গবন্ধুকে শত্রুর হাত হতে বাঁচাতে পারলাম না ! ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলা কালে কেমন কেটেছিল পাকিস্তানের জেলে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সময়? এর কোনো সুস্পষ্ট লিপিবদ্ধ দলিল কোথাও নেই। সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে ‘রাজা আনার খান’ কে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ওপর নজর রাখতে।যার কিছু কিছু অংশ সেই সময়ের পত্র-পত্রকিাতে ছাপা হয়েছিল ৷পরর্বতীতে, ২০১৫ সালের ১৭ ডিসম্বরে, পাকিস্তানের টিভি চ্যানেল ‘দুনিয়া নিউজ’–এর নেওয়া ‘রাজা আনার খান’এর সাক্ষাৎকারে পাওয়া গিয়ছিল ‘১৯৭১ সালরে ২৬ র্মাচ হতে ১৯৭২ সালের জানুয়ারীর ১ম সপ্তাহ র্পযন্ত পাকিস্তানের জেলে বন্দী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বন্দী-জীবনকাহিনী’ সর্ম্পকে একজন প্রত্যক্ষর্দশী হিসেবে তাঁর বিবরণ। সাক্ষাৎকারের শেষের কিছু অংশ পাওয়া যায়নি। তারও অনেক পরে সেই সাক্ষাৎকারটি র্উদু থকেে বাংলায় শ্রুতলিখন করেছেন জাভেদ হুসেন যা এবছর (২০২১এ) বিজয় দিবসে র্অথাৎ ১৬ ডিসেম্বর তারিখে ‘দৈনিক প্রথম আলো’ তে ছাপা হয়ছিল ৷ যারা বাংলাদশে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও বাংলা ভাষাকে প্রকৃতই ভালোবাসেন ও সেই ভালোবাসাকে হৃদয়ে ধারন ও লালন করেন, বিভিন্ন সময়ে তাদের মন অনবরত জানতে চেয়েছে ‘মুক্তিযুদ্ধ-চলাকালীন সময়ে কোথায় ছিলেন তাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং সেখানে কেমন ছিলেন তিনি ? । সেই সমস্ত পাঠকদের বোঝা ও জানার সুবিধারথে সেই সাক্ষাৎকারের সারাংশটুকু আজকের র্পবে তুলে ধরা হলো-
এই সাক্ষাৎকারে ‘রাজা আনার খান’ এর কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আপনার কীভাবে কোথায় প্রথম দেখা হয়? সেলটা কেমন ছিল? আপনি কি তাঁর সেবাদাতা হিসেবে সেখানে গিয়েছিলেন? আপনাদের মধ্যে যখন নৈকট্য বাড়ল, তখন তাকে কেমন মানুষ হিসেবে দেখলেন? এই দায়িত্ব নিয়ে আপনি যখন জেলখানায় এলেন, তখন শেখ সাহেব সর্ম্পকে আপনার কী ধারণা ছিল? শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার যখন রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করলো, তখন তাঁর উকিল কে ছিলেন? আপনার ওপর শেখ মুজিব সর্ম্পকে কি কি নির্দশেনা ছিল ? শুনানি কি জেলের ভেতেরে হতো নাকি বাইরে? বিচারক কি ওখানেই আসতেন? আপনি কি সেই আদালতের ভেতরে থাকতেন? শেখ মুজিব কি উদ্বিগ্ন থাকতেন? উকিলের সঙ্গে দেখা করার সময় কী অবস্থায় থাকতেন? উল্লেখ করার মতো কোনো ঘটনা কি মনে পড়ে? যুদ্ধ তো তখন শুরু হয়েছে? শেখ মুজিব কি জানতেন যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে? সেনা শাসকদের পক্ষ থেকে কিংবা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে কোনো র্বাতা আসনেি কিংবা শেখ মুজিবের সঙ্গে কেউ দেখা করতে আসনেি—কোনো বড় মানুষ? কেউ কোনো যোগাযোগ করনি? উকিল যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন, তখন কি সেখনে আর কেউ থাকতেন? উকিলের সঙ্গে শেখ সাহেবের কী কথা হলো, তা কি পরে আপনি জানতনে? উকিলকে সরকারের পক্ষ থেকে কি কি নির্দশনা দেয়া ছিল? আপনার কি সন্দেহ ছিল যে শেখ মুজিবরের জন্য সাজানো এই রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় তাঁর ফাঁসির সাজা হয়ে যেতে পার? শেখ মুজিব কিভাবে পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন?
উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর কোনোটাই ‘ রাজা আনার খান’ এড়িয়ে যান নি, তিনি তখন যা যা বলছিলেন, তা সংক্ষিপ্ত আকারে নিম্নে তুলে ধরা হলো :
রাজা আনার খান : পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ এল, ‘তিনি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান)এখানে বন্দী, মিয়ানওয়ালি জেলে। আপনাকে কয়কেজন অফিসারসহ সেখানে ডিউটি দিতে হবে। ঘটনা হলো, আমি তাঁর সেলে যাব, কিন্ত যেতে হবে কয়েদির বেশে। মানে আমি যে পুলীশ অফিসার বা অন্য কিছু, এটা যেনো বোঝা না যায়। তো আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। এটা সেই সেল, আগে কোনো এক সময় যেখানে জুলফকিার আলী ভুট্টো ছিলেন। ছোট এক কামরা। সঙ্গে এক চিলতে লনের মতো। বাইরে বারান্দা। ভেতরেই একপাশে একটা বাথরুম আর ছোট একটা রান্নাঘর। ভেতরে বিছানা পাতা ছিল। রাতে তাঁর ঘরে আমি নিজ তালা লাগাতাম। আর চাবিটি বাইরে বালির নিচে কোথাও লুকিয়ে রাখতাম। তবে মনে রাখতাম, ঠিক কোথায় চাবি রেখেছি। শেখ মুজিব কিন্তু প্রথমে আমাকে বিশ্বাস করলেন না। তাঁর সন্দেহ থেকেই গেল। তবে আমিও আমার আচরণে অবিচল রয়ে গেলাম। মানে চেয়ার নিয়ে তিনি বাইরে বসলে আমিও নিচ বালুতে বসতাম। তিনি বলতেন, আরে ভাই, তুমি এই টুলটা নিয়ে বসো। আমি বলতাম, জি না, আমি নিচেইে ঠিক আছি । তিনি যা খেতে চাইতনে, তার সবকিছু ওখানে পাওয়া হতো। তবে এর মধ্যওে কিছু ব্যাপার ছিল। যেমন বাইরে থকেে হয়তো মাংস এল, খবরের কাগজ দিয়ে মোড়ানো। সেই কাগজ বাইরে ফেলে দিয়ে তারপর আমরা মাংস ভেতরে ঢোকাতাম, যাতে তিনি আবার কিছু পড়ে না ফেলেন। খবররে কাগজ, রেডিও, কথা বলার কোনো মানুষ—কিছুই তাঁকে দেওয়া হতো না, তাকে বাইররে সকল ইনফরমেশন থেকে বিছ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল। বাইরে ‘র্পূব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ চলছিল’-সেটা তিনি জানতেন না র্অথাৎ সেট তাকে জানতে দেয়া হয়নি ৷তাঁর কাছে থাকত একটা পাইপ আর এরনিমোর তামাক। তিন-চার মাস পার হওয়ার পর শেখ মুজিব একটু একটু করে আমার সঙ্গে মিশতে শুরু করলেন। এক দিন তিনি বাইরে বসে ছিলনে চেয়রে। আমি নীচে বসেছিলাম। আমাদের মধ্যে কথার্বাতা হচ্ছিল। আমি প্রশ্ন করলাম, ‘বাবা, আপনার দলে বড় নেতা কারা কারা’? তিনি বলতে শুরু করলনে, ইনি আছে, উনি আছে, একজন আছেন তাজউদ্দীন।
তিনি বড় ভালো একজন মানুষ ছিলেন, দরদি মানুষ। অন্যের জন্য মনে সহর্মমতিা ছিল। তবে একটা ব্যাপার, তিনি আর্ন্তজাতিক রাজনীতির নন, ছিলেন আঞ্চলিক রাজনীতির মানুষ। তিনি বলতেন, ‘আমার কী এমন অপরাধ যে এখানে ধরে আনা হলো? এই ইয়াহিয়া খান পুরো পাকিস্তানকে ধংস করছে। তিনি (শখে মুজিবুর রহমান) আক্ষেপ করে বলতনে যে, ‘র্পূব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য আমি অনেক কষ্ট করেছি। নিজের ক্যারিয়ার শেষ করেছি ৷ তিনি আরও বলতেন, ‘দ্যাখো, আমার সম্পত্তি বলতে এখন মাত্র তিন একর জমি, সেখানে আমার ঘর। ওখানে ছোট্ট একটা পুকুর, তাতে আমি মাছ চাষ করি। জমিতে ধানচাষ হয়। পানের বরজও আছে । ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে হাজার পাঁচেক টাকা পাই’। তিনি বাংলার রাজনীতিবিদ ছিলেন, বাংলাই তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রে ছিল। বাংলার উন্নতিই ছিল তাঁর লক্ষ্য। তিনি দেশপ্রেমিক ছিলেন, অথচ তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বানানো হয়েছিল। তাঁকে এমন পরিস্থিতির দিক ঠেলে দেওয়া হয়ছিল, তিনি যুক্তরাজ্য চলে গেলেন। সেখান থেকে বাংলাদশেে গিয় সেখানকার প্রসিডেন্ট হলেন। জেলখানায় বসে তিনি প্রতিদিন ডায়রি লিখতে শুরু করলেন। জেলখানায় তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহতিার মামলা করা হয়, তাঁর উকিল ছিলেন ‘ব্রোহি সাহেব। ‘ব্রোহি সাহেব’ এলে আমি তাঁকে সঙ্গ দিতাম। জেলের ভেতরেই বিচারক, উকিল,সাক্ষীরা আসতেন, সওয়াল-জবাব হতো। পুরো একটা আদালত বলতে যা বোঝায়, তাই৷ আমি শেখ সাহেবকে উকিলের কাছে নিয়ে যেতাম৷ বিস্তারিত কথা বলতেন। নিজের পরার্মশ দিতেন, উকিলের কথাও শুনতেন। তবে কিছু দিন পর একবার তিনি অসহযোগতিা–প্রবণ হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘আমি শুনানিতে যাব না।’ সবাই বিপদে পড়ে গেল। উনি আমাকে ভাইয়ের মতো দেখতেন বলে আমার কথা রাখতেন। আমি তাঁকে ভালোই বাসতাম। মানে,তিনি তো বন্দী ছিলেন। আমার কাজ ছিল তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, তাঁর সঙ্গে থাকা। আমার যে দায়িত্ব ছিল, আমি সেটা পালন করছলিাম।একবার একজন বিগ্রেডিয়ার সাহেব এলেন। তিনি ফিরে যাওয়ার পর শেখ মুজিদ তাঁকে নিয় বিরক্তি প্রকাশ করে আমাকে বললেন, ‘এই বির্গেডিয়ারটি মিথ্যুক। তাঁর সঙ্গে আমার আগে কখনো দেখাই হয়নি’। সরকারের উদ্দেশ্য ছিল যে এই বিগ্রেডিয়ারটিকে শেখ মুজিব রহমানের বিরুদ্ধে সাক্ষী বানাবে ৷ বিগ্রেডিয়ারের নাম জানা নেই। তবে তাঁকে শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে সাক্ষী হিসবেে হাজির করা হয়ছিল। আমি জানতাম। কারণ আমার কাছে ছোট একটা রেডিও ছিল। মিয়ানওয়ালিতে আমি ঘুমাতাম বারান্দায়। শাহিওয়ালে রান্নাঘরের পাশে খোলা জায়গায় চারপাইয়ে শুয়ে থাকতাম।শেখ মুজিবকে কিছুদিন ফয়সলাবাদের সেলেও রাখা হয়েছিল৷ সেখানেও আমি সেলের ভেতরে ঘুমাতাম। সেখানে আমার বিছানা ছিল। সঙ্গে সেই রেডিও ছিল খবর শোনার জন্য । চাবি তো আমার কাছে থাকত। তাই আমার ঘরে আর কারো আসার উপায় ছিল না। আমি সেখানে রেডিও শুনতাম, বিবিসি ৷ কী ঘটছে সবই আমি জানতে পারতাম। শেখ সাহেবের অভিযোগ ছিল, র্পূব পাকিস্তান গরিব, কারণ ইন্ডাস্ট্রির জন্য যে লাইসেন্স দেওয়া হয়, সেগুলো সব পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা নিয়ে যায়। সব শিল্প-কারখানার মালিকানা পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে, বাঙালরি কাছে কিছু নেই। এরা দরিদ্র, ক্ষুর্ধাত। বাঙালিরা ঋণ পায় না। বাইরের ‘যুদধ’ সর্ম্পকে শেখ মুজিবুর রহমানকে এমন অন্ধকারে রাখা হয়েছিল যে, তিনি কিছুই জানতেন না । তাঁর কাছে আমি প্রচুর মিথ্যা বলেছি৷ প্রতিদিন তাঁকে নতুন নতুন কথা বানিয়ে বানিয়ে বলতাম। কোথাও গুলি চললে বলতাম, কাছইে ফায়ারিং রেঞ্জ আছ। ব্ল্যাক আউট হলেও সে রকমই কিছু বলতাম। তিনি মেনে নিতেন৷ বলতেন, আচ্ছা, ঠিক আছে। তাঁর উকিলও তাঁকে এই খবর দিতেন না । সরকারের কাছ থেকে উকিলদের কাছে এই নির্দেশ দেওয়া ছিল যে তারা এ বিষয়ে কিছু জানাবে না, কেবল মামলা নিয়ে কথা বলবে। সব সময়ই আমি শেখ মুজিব সাহবের সঙ্গে থাকতাম। তাঁর উকিল ব্রোহি সাহবেরে সঙ্গে যখন দেখা হচ্ছে, তখন একদিক ব্রোহি সাহেব, আরেক দিক চেয়ারে শেখ সাহেব, আর অন্যদিকে আমি । তাঁরা কথা বলছেন, আমার দায়িত্ব হচ্ছে তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। তাঁদের যাতে কোনো বিপদ না হয়। কেউ যেন তাঁদের মেরে ফেলতে না পারে। আমি তো এ জন্যই ওখানে থাকতাম, যাতে উকিল সাহেব বলে না দেন যে বাইরে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ব্রোহি সাহেব শেখ মুজিবকে বলতেন, ‘এই মামলা একবারে ভিত্তিহীন। আপনি ভরসা রাখুন, ইনশাল্লাহ আপনাকে আমি মুক্ত করে ফেলব।’
আশে-পাশে দু–চারটা বোমা পড়লে তখন এই জলের ওপরওে না হামলা হয়, আমরা সেই বিপদের আশঙ্কা করলাম। তখন ওখান থকেে র্অথাৎ ফয়সালাবাদ থেকে আমাদের নিয়ে আসা হলো। সড়কপথে আমরা আবার মিয়ানওয়ালি গেলাম। রাস্তায় গাড়ি দেখে শেখ সাহেব আমাকে জিজ্ঞসে করলেন, ‘ এই গাড়ীগুলোর কাচে মাটি লেগে আছে, এগুলোতে ক্যামোফ্লাজ কেন’? আমি বললাম, ‘জি, এখন মহড়া চলছে তো, সেনাবাহিনীর মহড়া’। তাঁকে এক সেল থকেে অন্য সেলে নিয়ে যাওয়ার সময় এমন ব্যবস্থা করা হয়ছিল, কম্বল–বালিশ এমন করে ঠেসে ঢোকানো হয়েছিল, যাতে তাঁকে কেউ দেখে না ফেলে, আবার তিনিও যেন কাউকে না দেখতে না পান। তো তাঁকে সেলে রেখে এলাম। এর পর ফিরে এসে আমি রেডিও শুনছি। ওই যে কী যেন জেনারেলের নামটা, (জগজৎি সং অরোরা )। অরোরার পক্ষ থকেে রেডিওতে বারবার ঘোষণা হচ্ছিল, ‘আপনারা অস্ত্র সর্মপণ করুন। আমরা অগ্রসর হচ্ছি ‘। আমি কিছু বু ঝতে পারছিলম না। বারবার ঘোষণা হচ্ছিল, ‘আপনারা আত্মসর্মপন করুন।’ আমি ভাবছি, কী ব্যাপার? কী হচ্ছে? সে রাতে আমার খুব র্সদি হলো। শেখ সাহবে আমাকে ঘর থকেে বের করে আনলেন। বললাম, আমাকে ডাক্তারের কাছে যতেে হবে। আমি পুলিশ লাইনে গেলাম। সেখানে কোর্য়াটার ছিল। র্কমচারীরা থাকতেন। আমি সেখানে রোদে বসে রইলাম। সেখানেই পাকা খবর পেলাম, পাকিস্তানিরা ঢাকায় আত্মসর্মপণ করেছে । আমার মনে আছে জীবনে এর চয়েে বেশী বোধ হয় কখনো কাঁদনিি ! কল্পনাও করতে পারনি যে পাকস্তিানিরা আত্মসর্মপণ করবে !
শেখ মুজিবকে নিয়ে আমরা তখন যেই সেলে ছিলাম, সেখানে হামলার আশঙ্কা ছিল। তাই আমরা একটা পরিখা খনন করালাম। ‘এল’ আকারের পরিখা । সইে পরিখার প্রবশেমুখে প্রথমে মাদুর, তার ওপর কম্বল বিছিয়ে সেখানে শেখ সাহেবকে লুকয়িে রাখা হলো । আপনাদের মনে আছে নিশ্চয়ই, প্রথম বিবিসি একটা অনুষ্ঠানে শেখ সাহেব বলেছিলেন, ‘আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল।’ এটা একটা বিখ্যাত কথা। এটাই আসলে হলো সেই কবর। সেখানে একটা ঘটনা ঘটল। আমি রাতে শুয়ে আছি ৷ রাত তখন দুইটা কি তিনটা হবে। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। খাজা সাহবে জোরে চিৎকার করছেন, ‘রাজা খান! রাজা খান! দরজা খোলো’৷ আমি তো ঘাবড়ে গেলাম। দরজার কাছে গিয়ে প্রশ্ন করলাম, ‘কে’? উত্তর এল, ‘আমি খাজা তুফায়েল, তাড়াতাড়ি দরজা খোলো।’ আমি বললাম, ‘আমি দরজা খুলব না, সিকিউরিটি আছে’ । উত্তর এল, ‘খোদার দোহাই, দরজা খোলো, খুব জরুরী । তোমার আর শেখ মুজিবের প্রাণসংশয়’ । এবার আমি চাবি নিয়ে দরজা খুললাম। দ্বিতীয় চাবি নিয়ে শেখ সাহেবের ঘরের তালা খুললাম। খাজা সাহবে ভেতরে গেলেন। শেখ সাহবে ঘুমাচ্ছিলেন। তাঁকে খাজা সাহবে ডেকে তুললেন। উনি হঠাৎ ঘুম ভাঙানোয় চমকে গিয়েছিলেন। খাজা সাহবে বললেন, ‘শেখ সাহেব, জলদি আপনার জিনিসপত্র গুছিয় নিন’। তিনি একটা ফতুয়া পরা ছিলেন। সময়টা ছিল ফাঁসি দেওয়ার প্রহর। কয়দিদের ফাঁসি দেওয়া হয় এই রাত আড়াইটা-তিনটার দিকে৷ শেখ সাহেব বললেন, ‘আমাকে কি ফাঁসি দিতে নিয়ে যাচ্ছেন’? খাজা সাহেব বললেন, ‘না, ফাঁসি নয়। অন্য ব্যাপার’ । শেখ সাহবে বললেন, ‘না, আমাকে তো ফাঁসি দিতেই নিয়ে যাচ্ছেন’। কয়েকবার এরকম কথার্বাতা হওয়ার পর জিনিসপত্রসহ তাকে সঙ্গে নিয়ে তাকে বাঁচানোর জন্য আমরা মাঠ পার হয়ে একটা ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম । কড়া নাড়া হলো। ‘শেখ আবদুর রহমান’ ভেতরে ছিলেন। দরজা খুলল।আমরা সকলে শেখ মুজিবকে নিয়ে নিরাপদে ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম ৷(সাক্ষাৎকারটি অসর্ম্পূনভাবে তখন প্রকাশিত হয়ছিল)। তথ্যসূত্র : ১৬ ডিসেম্বর’২০২১ ( দৈনিক প্রথম আলো , বাংলাদেশ) ,বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
লেখক: ফারহানা আকতার, পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, আর্ন্তজাতিক রবীন্দ্র গবেষনা ইনষ্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক ৷
বাংলাদেশ সময়: ০:৫৫:১৭ ২৩৬৩ বার পঠিত #কলাম #প্রজন্ম #বঙ্গবন্ধু #মুক্তিযুদ্ধ