মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর ২০২১

ফারহানা আকতার এর কলাম : নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ–পর্ব : ৫৪

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম : নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ–পর্ব : ৫৪
মঙ্গলবার, ১২ অক্টোবর ২০২১



নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ–পর্ব : ৫৪

৯. মহান মুক্তিযুদ্ধ :

৭/ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা :
২৫ মার্চ মধ্যরাতে আনুমানিক রাত দেড়টার দিকে গ্রেপ্তার হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। এই ঘোষণাটি ছিলো ইংরেজীতে, যাতে বলা হয় :
Declaration of independence :
‘This may be my last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.’
(সূত্র : হাসান হাফিজুর রহমান (সম্পাদিত ), বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : তৃতীয় খন্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, তথ্য মন্ত্রণালয়, ১৯৮২, পৃ: ১)
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানরে এই বাণীটিই ইপিআর ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পৌঁছে দেয় হয় ৷
আমার শৈশবে ও কৈশরে বহুদিন র্পযন্ত ২৬ র্মাচের স্বাধীনতা দবিসরে ঘোষনাটি আমি বিকৃতভাবে জানতাম এবং তখনকারকার আমলের তৈরী নাটক-মুভিগুলোতেও সে ঘোষনাটি অস্পষ্টভাবে শুনতে পেতাম৷২৬ র্মাচ’ ১৯৭১ এ, যথাক্রমে চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথমে এম এ হান্নান এবং পরর্বতীতে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর লেখা- “স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র” টি তারা তাদের নিজেদের মতো করে ‘বঙ্গবন্ধুর পক্ষইে’ পাঠ করনে র্অথাৎ ১৯৭১ এর মহান মুক্তযুদ্ধে সকলের মতো তারাও ‘বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব্’ মেনে নিয়েছিলেন ( যদিও পরব্তীতে এই ঘোষনা-পাঠ নিয়েই ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়ছিল) ৷ সেই ঘোষনাটি ও এ সর্ম্পকিত বিস্তারিত তথ্য জানবার জন্য পাঠকদরে সমীপে অনুরোধ রইলো এই কলামরে প্রথম র্পবটি আবার একটু পড়ে দেখবার জন্য ৷বস্তুতঃ তখন পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার এমন চরমে পৌছছিল যে, সেই মুর্হূতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষনা ছাড়া বাঙ্গালির সামনে আর কোনো উপায় ছিলনা৷বস্তুতঃ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কারণেই ২৬ মার্চ বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস হিসাবে উদযাপিত হয়।

৮/মুজিবনগর সরকার গঠন :
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের মুজিবনগর সরকার গঠন বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধকে গতিময় ও সুসংহত করা, বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায় ও মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় ও সমন্বিত রূপ দিতে মুজিবনগর সরকার গঠন করা হয়। মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় ১৯৭১ সালের ১০ ও ১১ এপ্রিল। এদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয় ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার আদেশ ‘ । মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরের ভরেপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় আম্রকাননে দেশী-বিদেশী ১২৭ জন সাংবাদিক ও কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতিতে কঠোর নিরাপত্তা ও গোপনীয়তায় শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। শপথ বাক্য পাঠ করান জাতীয় পরিষদ সদস্য অধ্যাপক ইউসুফ আলী। মুজিবনগর সরকারের প্রধান সদর দপ্তর প্রথমে মুজিবনগরে (মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথ তলায়) স্থাপিত হয়। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হওয়ায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী শপথ অনুষ্ঠানের দু’ঘন্টার মধ্যে মুজিবনগরে ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে এবং দখল করে নেয়। এ প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা ও মুক্তিযুদ্ধ নিরাপদে নেতৃত্ব দেয়ার স্বার্থে মুজিবনগর সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থানান্তর করা হয়। শপথ অনুষ্ঠানে প্রবাসী সরকারকে উপদেশ ও পরামর্শ প্রদানের জন্য ন্যাশনাল আওয়ামী পাটির (ন্যাপ-মাওলানা ভাসানী) মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মুজাফফর) অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ, কমিউনিস্ট পার্টির কমরেড মনি সিং কংগ্রেসের সীমনোরঞ্জন ত্বর এবং আওয়ামী লীগের ৫ জন প্রতিনিধি নিয়ে সর্বমোট ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি ‘উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করা হয়। এ উপদেষ্টা পরিষদের আহবায়ক ছিলেন মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ।
প্রধানমন্ত্রীসহ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রীসভার সদস্য ছিলেন ৭ জন। নিম্নে মুজিবনগর সরকারের কাঠামো বর্ণনা করা হলো :
রাষ্ট্রপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক — বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি)। উপ-রাষ্ট্রপতি–সৈয়দ নজরুল ইসলাম (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং পদাধিকারবলে সশস্ত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন), প্রধানমন্ত্রী–তাজউদ্দীন আহমেদ,অর্থমন্ত্রী–এম. মনসুর আলী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী–এ.এই .এম. কামরুজ্জামান, পররাষ্ট্র ও আইন মন্ত্রী–খন্দকার মোশতাক আহমেদ, প্রধান সেনাপতি–কর্নেল (অব.) এম.এ.জি. ওসমানী, চীফ অব স্টাফ এবং ডেপুটি চীফ অব স্টাফ–কর্নেল (অব.) আবদুর রব, বিমান বাহিনীর প্রধান–গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার (বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত) জনপ্রতিনিধিবৃন্দ,সাহায্য ও পুনর্বাসন–অধ্যাপক ইউসুফ আলী .,তথ্য, বেতার ও প্রচার–আবদুল মান্নান, ভলান্টিয়ার কোর– আমিরুল ইসলাম, বাণিজ্য বিষয়ক বিষয়াদি–মতিউর রহমান ৷

৯/মুজিবনগর সরকার গঠনের লক্ষ্য :
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মাত্র ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুজিবনগর সরকার গঠন ছিল অবশ্যম্ভবী । একাধিক লক্ষে এ সরকার গঠিত হয়। নিম্নে তা বর্ণনা করা হলো :
১। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং তা বাস্তবায়নে সামরিক-বেসামরিক ও কূটনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনা।
২।​মুক্তিযুদ্ধকে দক্ষতার সাথে সমন্বিতভাবে পরিচালনা।
৩।​মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন প্রশিক্ষণ প্রদান এবং অস্ত্র সরবরাহ।
৪।​দেশ ও বিদেশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাকান্ড, ধ্বংসলীলা, নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো।
৫।​পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও তাদের এদেশীয় সহযোগীদের অত্যা চারে ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা।
৬।​আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ও বিদেশী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি অর্জন।
৭।​ মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা।
৮।​বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিদানে বিশ্বনেতাদের দ্বারা চাপ প্রয়োগ।
৯।​ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সহমর্মী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা ৷

১০/মুজিব নগর সরকারের কার্যক্রম :
১৯৭০-৭১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী আইনসভার সদস্য দ্বারা (জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ) মুজিব নগর সরকার গঠিত হয়েছিলো। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ছাড়াও বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত সৃষ্টিতে মুজিবনগর সরকার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। নিম্নে মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম আলো না করা হলো:
১।মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠন ও প্রশিক্ষণ : মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর বাংলার স্বাধীনতাকামী জনতা আশার আলো দেখতে পায়। তারা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সংগ্রহের আশায় ভারতে ভীড় জমায়। মুজিবনগর সরকার এসব তরুণদের যাচাই-বাছাই করে ভারতীয় ও বাংলাদেশী সেনাবাহিনী দ্বারা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। তাদের অস্ত্র দিয়ে বাংলাদেশের যুদ্ধ ময়দানে পাঠায়।
২। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা : ২৬ মার্চ সকাল হতেই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বতঃস্ফূর্ত যুদ্ধ হয়েছে। বিপ্লবী মুক্তিকামী জনতা রাজশাহী, বগুড়া, মাগুড়া, নওগাঁ, দিনাজপুর, সৈয়দপুর, ট্টগ্রামের একাংশ, কুষ্টিয়াসহ বেশ কয়েকটি জেলা ‘শত্রুমুক্ত’ করে। তবে পাক সেনা-বাহিনীর সংঘবদ্ধ আক্রমণ ও অত্যাধুনিক অস্ত্রের কারণে এসব এলাকা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে হাতছাড়া হয়ে যায়। এ অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহতভাবে পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের সেনা কর্ম-কর্তাদের সঙ্গে পরামর্শ ক্রমে মুজিবনগর সরকার যুদ্ধক্ষেত্রকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে।
৩। সংগ্রামী জনতার মনোবল রক্ষা : সংগ্রামী জনগণের মনোবল ঠিক রাখার জন্য এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনাকে অক্ষুন্ন রাখার জন্য ‘মুজিবনগর সরকার’ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে ও পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে প্রে ষ্টা চালায়। স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্রের দেশাত্মবোধক গানগুলো এবং ‘ রমপত্র’ অনুষ্ঠানটি মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণকে উদ্দীপ্ত করেছে।
৪। বেসরকারি প্রশাসন গঠন : ‘মুজিবনগর সরকার’ নানা প্রতিকূল অবস্থা সত্তে্ব ও একটি বেসরকারি প্রশাসন গড়ে তুলেছিল।
৫। বহির্বশ্বে বাংলাদেশের পক্ষএ জনমত সৃষ্টি : বহির্বিশ্বে মুজিবনগর সরকারের তৎপরতার অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হচ্ছে কলকাতা, দিল্লি লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহোম সহ বিশ্বের বিভিন্নদেশে বাংলাদেশ সরকারের মিশন স্থাপন এবং ঐসব স্থানে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি নিয়োগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ও সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা। মুজিবনগর সরকার বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে বিশেষদূত নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বনেতাদের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করে। এছাড়াও বাংলাদেশের নাগরিক এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপানসহ শক্তিশালী দেশের সমর্থন লাভে মুজিবনগর সরকার আন্তরিক প্রচেষ্টা চালায়। (চলবে) ৷তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷

ফারহানা আকতারলেখকের নতুন বই

ফারহানা আকতার, পরচিালক ও সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি মেম্বার, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, লেখক ও গবেষক৷

বাংলাদেশ সময়: ১২:৩৩:৫৫   ১৫৩৫ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #