সোমবার, ৪ অক্টোবর ২০২১
ফারহানা আকতার এর কলাম : নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ– র্পব : ৫৩
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম : নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ– র্পব : ৫৩৯. মহান মুক্তিযুদ্ধ :
১. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি :
জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অনিচ্ছার প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া প্রদান করে ছাত্র-জনতা-আইনজীবী-শ্রমিক-পুলিশ অসহযোগ আন্দোলন শুরু করে। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসন পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ে। বাঙ্গালির রাজনৈতিক ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলন অনন্য বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান নির্বিশেষে রাজনৈতিক ঐক্যবদ্ধতার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, বিশ্বে তা নজিরবিহীন। অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া প্রদান করে ছাত্র-জনতা-পুলিশ-শ্রমিক-সরকারী কর্মচারী পাকিস্তানী শাসক চক্রকে রাষ্ট্র পরিচালনায় অসহযোগিতা শুরু করে। এ কারণে ভেঙ্গে পড়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ব্যবস্থা । বস্তুতঃ অসহযোগ আন্দোলনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ইতিহাসে প্রথমবার রাষ্ট্র পরিচালনায় বাঙ্গালির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই এ সময় অফিস-আদালত-ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হতে থাকে। নিম্নে অসহযোগ আন্দোলনের পটভূমি বর্ণনা করা হলো :
১৯৭০ সালের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ সর্বমোট ১৬৭টি আসন লাভ করে এককভাবে সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। জুলফিকার আলীর ভুট্টোর পিপিপি সর্বমোট ৮৮টি আসন লাভ করে। প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করায় দিশেহারা হয়ে পড়ে পাকিস্তানী শাসক চক্র। আওয়ামী লীগ নির্বাচনে ভালো ফলাফল করবে এমনটা ধারণা করা হলেও দলটি সরকার গঠনের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করবে এমনটা পাকিস্তানী সরকার ভাবতে পারেনি। পাকিস্তানের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী নতুন করে চক্রান্ত শুরু করে। আর এ চক্রান্ত গণতান্ত্রিক নেতা হওয়া সত্ত্বেও পিপিপি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো হাত মেলান।
ষড়যন্ত্রের বিষয়টি বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৩ জানুয়ারি, ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের এক শপথ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ সদস্যরা ৬ দফা ও ১১ দফা প্রশ্নে কোন আপোষ না করে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার শপথ গ্রহণ করেন। ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের খসড়া সংবিধান প্রণয়নও এসময় আওয়ামী লীগ সম্পন্ন করে। জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশনে এ সংবিধান পাশের পরিকল্পনা ছিলো বঙ্গবন্ধুর। অত্যন্ত গোপনীয় এ বিষয়টি ফাঁস হয়ে যাওয়ায় ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে আহবানে বিলম্ব করতে থাকেন। অবশ্য তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ‘ভাবী প্রধানমন্ত্রী’ হিসাবে ঘোষণা করেন। জনদাবির প্রেক্ষাপটে জেনারেল ইয়াহিয়া ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। এবার ভুট্টো হাজির হলেন ষড়যন্ত্রের নীল নকশা’ নিয়ে। গণতন্ত্রের রীতি-নীতি ভঙ্গ করে তিনি পাকিস্তানে দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল’ (আওয়ামী লীগ ও পিপিপি) তত্ত¡ উপস্থাপন করে রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদারিত্ব দাবি করেন। এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের কেউ যদি অধিবেশন যোগ দেন, তিনি তার পা ভেঙ্গে দেয়ার হুমকি দেন। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘোষণা দেন, ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হলে তা কসাইখানায়’ পরিণত হবে। আসলে এসব ঘোষণা ছিলো ভুট্টো-ইয়াহিয়ার আঁতাতের ফল। সাজানো নাটক। এরই অংশ হিসাবে, ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ ভুট্টোর ঘোষণাকে অজুহাত হিসাবে ব্যবহার করে জাতীয় পরিষদের আসন্ন ৩ মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কোনরূপ আলোচনা না করে অধিবেশন স্থগিত করায় পূর্ব বাংলার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
২/ বঙ্গবন্ধুর অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা :
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারা পূর্ব - পাকিস্তানে হরতালের ডাক দেন। বস্তুতঃ ১ মার্চ হতেই পূর্ব বাংলায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলন পরিণত হয় স্বাধীনতা আন্দোলনে। জয়বাংলা’পদ্মা-মেঘনা-যমুনা/ তোমার আমার ঠিকানা’, জনগণের এক দফা/ বাংলার স্বাধীনতা’ তোমার নেতা, আমার নেতা/ শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’বীর বাঙ্গালি অস্ত্র ধর/ বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ প্রভৃতি শ্লোগানে ঢাকার রাজপথ তো বটেই, গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত মুখরিত হয়ে ওঠে। সান্ধ্যআইন ও কার্ফ্যু ঘোষণা করেও পাকিস্তানী শাসক চক্র বাঙ্গালিকে দমন করতে পারেনি। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ মার্চ শত শত লোক হতাহত হয়।
পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ৩ মার্চ ঢাকার পল্টন ময়দানে আহূত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনের’ ডাক দেন। তিনি ঘোষণা করেন ‘খুনী ইয়াহিয়া’ সরকারের হঠকারী ও পাশবিক অত্যাচারের প্রতিবাদে আজ থেকে শান্তি পূর্ণ ‘অসহযোগ আন্দোলন’ চলতে থাকবে। কল-কারখানা বন্ধ থাকবে, অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে, রেলগাড়ির চাকা বন্ধ থাকবে, খাজনা-ট্যাক্স দেওয়া চলবে না। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বাংলার অবিসংবাদিত নেতার ডাকে সাড়া দেন। অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি সর্বত্র শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হতে থাকে। জনগণের মারমুখি মনোভাব ও অসহযোগ আন্দোলনে ভীত হয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৬ মার্চ ঘোষণা করেন, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে’। তিনি বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডিতে আহূত ১০ মার্চের সর্বদলীয় বৈঠকে বসার আহবান জানান। বঙ্গবন্ধু জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহবান জানিয়ে ঘোষণা করেন ‘বাঙ্গালির তাজা রক্ত মাড়িয়ে আমি কোন সম্মেলনে বসতে পারি না ‘। তিনি অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে রেসকোর্স ময়দানে পূর্ব ঘোষিত ৭ মার্চের জনসভা সফল করতে ছাত্র-জনতাকে নির্দেশ দেন।
৩/১৯৭১ এর ৭ মার্চ, ভাষণ ও অসহযোগ আন্দোলন :
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বাঙ্গালির ইতিহাসের এক মহেন্দ্রক্ষণ। সকাল থেকেই ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ছাত্র-জনতা-অবাল-বৃদ্ধ-বণিতা-দলে দলে সমবেত হতে থাকে। বিকাল নাগাদ প্রায় ১০ লাখ জনতা ময়দানে সমবেত হয়। সমগ্র পাকিস্তানের জন্য এটি ছিলো এক অন্তিম মুহূর্ত । ৭ মার্চের ভাষণের বিষয়বস্তু নির্ধারণে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রিয় ওয়ার্কিং কমিটি টানা দু’দিন বৈঠক করলেও কোন ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। পরে সিদ্ধান্ত হয় যে, উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুই মৌল দিক নির্দেশনা প্রদান করে ভাষণ দেবেন। তিনিই সর্বপ্রথম পূর্ব-পাকিস্তান (বাংলাদেশ)এর স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন এবং এই মঞ্চের সামনেই অন্যান্য প্রধান নেতা-কর্মীদের সঙ্গে উপবিষ্ট ছিলেন কবি বেগম সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমামসহ বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার নারীনেত্রীবৃন্দ ৷স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয় ১৯৭১ সালের ২রা মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে অনুষ্ঠিত এক ঐতিহাসিক ছাত্রসভায় এবং স্মরণকালের ঐ বৃহত্তম ছাত্রসভাতেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকার এবং শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করা হয় ৷
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের এইদিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক ভাষণে মূলতঃ যে ৪টি দাবি উত্থাপন করেন, তা হলো যথাক্রমে :
(ক) সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
(খ) সৈন্যদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
(গ) গণহত্যার তদন্ত ও বিচার করতে হবে।
(ঘ) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে গেরিলা যুদ্ধের দিক নির্দেশনাও প্রদান করেন। তিনি ঘোষণা করেন, ‘ প্রত্যক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল, তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে ’। বঙ্গবন্ধু পরিষ্কার ভাষায় জানিয়ে দেন, তিনি যদি হুকুম (নির্দেশ) দিতে নাও পারেন, বাঙ্গালি যেন যুদ্ধ চালিযে যায়। বাঙ্গালির মনোবল জাগ্রত করতে দার্শনিক নেতার মতো তিনি আরও ঘোষণা করেন , ‘ আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’৷ তিনি পাকিস্তানী সেনাদের ‘ভাতে মারার- পানিতে মারার’ গেরিলা কৌশল ঘোষণা করেন। ভাষণের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু কৌশলগত কারণে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা ব্যক্ত করে বলেন, ” রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এই দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ । এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ।
১৯৭১ এর মার্চে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালির এ দুর্যোগকালে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ছিলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান না করলেও ছাত্র-জনতা-ইপিআর-বাঙ্গালী-সেনা সদস্যদের কাছে তা ছিল ”গ্রীন সিগন্যাল” । অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতে, অসহযোগ আন্দোলনের বিস্তৃত কর্মসূচি ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু কার্যত ” বাংলাদেশ ” রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলেন। কেননা, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই ৭ মার্চ থেকে পরবর্তী ১৯ দিন পূর্ব -পাকিস্তানের প্রশাসন, আদালত, সকল ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হয়েছে। এখানে, বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, ইউনেস্কোর (UNESCO) উপদেষ্টা কমিটি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে দেয়া বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক এ ভাষণটিকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামান্য ঐতিহ্য হিসেবে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর স্বীকৃতি দিয়েছে৷ ফ্রান্সের প্যারিসে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক “ইরিনা বোকোভা” এক ঘোষণায় একথা জানান৷
মূলতঃ কলামটিতে এই উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের তথা বাংলাদেশের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে হয়তবা ১৯৭১ সালের মুক্তিযু্দ্ধের ঘটনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা পুরুপুরিভাবে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি ৷ সেজন্য পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিছ্ছি ৷ আশা করি আপনারা ব্যাপারটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ৷ এখানে আরও উল্লেখ্য যে , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণটি হুবুহু এই কলামের একটি পর্বে তুলে ধরা হয়েছে ৷ (সূত্র: পর্ব -৮, পর্ব -২৪ ) ৷বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর এই ঐতিহাসিক ভাষণের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ন দিক হলো এই যে,এই ভাষণে পূর্ব-পাকিস্তান (বাংলাদেশ)এর পশ্চিম-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়ী হওয়ার জন্য বিভিন্ন দিক নির্দেশনা রয়েছে যা পরবর্তীকালে পূর্ব বাংলার সকল জনগণের মূল প্রেরনার একমাত্র উৎস হয়ে দাড়ায়৷
৪/ অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপ্তি :
১৯৭১ সালের ১ মার্চ থেকেই কার্যতঃ অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া প্রদান করে পূর্ব বাংলায় সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস, সচিবালয়, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট, পুলিশ প্রশাসন, ব্যাংক-বীমা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রেলওয়ে পাকিস্তান সরকারের নির্দেশ অমান্য করে। পূর্ব পাকিস্তানে প্রশাসনিক কর্মকান্ড ভেঙ্গে পড়ে। খাজনা-ট্যাক্স আদায় বন্ধ হয়ে যায়। ইয়াহিয়া সরকার কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করে সরকারী-কর্মকর্তা কর্মচারীদের কাজে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেয়। এর পাল্টা জবাব হিসাবে ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু ৩৫ দফা ভিত্তিক এক নির্দেশনামা জারি করেন। এতে বলা হয় :
ক. সকল সরকারি বিভাগসমূহ, সচিবালয়, হাইকোর্ট, আধা- স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাসমূহ পূর্বের মতোই বন্ধ থাকবে।
খ. বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
গ. জেলা প্রশাসক ও মহকুমা প্রশাসকগণ অফিস না খুলে আওয়ামী লীগ ও সংগ্রাম পরিষদের সহযোগিতায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন।
ঘ. পুলিশ বিভাগও অনুরূপভাবে কাজ পরিচালনা করবেন।
ঙ. রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্র চালু থাকবে। তবে গণআন্দোলনের খবর প্রচার না করলে কর্মীরা কাজে সহযোগিতা করবে না।
চ. কর-খাজনা দেয়া বন্ধ থাকবে।
ছ. তবে কোন কর আদায়যোগ্য বা আদায়কৃত থাকলে তা বাংলাদেশ সরকারের একাউন্টে জমা হবে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বত:স্ফূর্তভাবে অসহযোগ আন্দোলন চলতে থাকে।
এর ব্যাপকতা উপলব্ধি করতে নিমোক্ত ঘটনাগুলো বিবেচনায় নেয়া যেতে পারে :
১) অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ সকল বিচারপতি পূর্ব-পাকিস্তানের নতুন গভর্নর টেক্কা খানকে শপথ পড়ানো থেকে বিরত থাকেন।
২) রেডিও-টেলিভিশনের বাঙ্গালি কর্মকর্তা-কর্মচারিরা কর্ম-বিরতি পালন করেন।
৩) কেন্দ্রীয় জেলখানার জেলারসহ সকল নিরাপত্তা কর্মী কর্মস্থল ত্যাগ করেন।
৪) বাঙ্গালি ব্যবসায়ীরা পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছে খাদ্যসহ সকল প্রকার পণ্য বিক্রয় বন্ধ করে দেয়।
৫) চট্টগ্রাম বন্দর শ্রমিকরা গুলির মুখেও জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায় ও ধর্মঘট পালন করে।
৬) হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন হোটেল) বাঙ্গালি কর্মকর্তা-কর্মচারী-বাবুর্জি-সুইপার কর্মবিরতি পালন করে।
৫/ মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টো বৈঠক :
অসহযোগ আন্দোলনের কারণে সেনাবাহিনী ব্যতীত পূর্ব পাকিস্তানের সকল ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। অবস্থা উপলব্ধি করে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন।
আলোচনা চললেও বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার করেননি। ১৯ মার্চ ভূট্টোর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসেন এবং আলোচনায় যোগ দেন। দফায় দফায় আলোচনা চললেও তা কোন ঐকমত্যে পৌছাতে ব্যর্থ হয়। ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেন। তারপরই শুরু হয় ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড অপারেশন সার্চলাইট ৷
৬/ ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর আক্রমণ : অপারেশন সার্চ লাইট :
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৬ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা শুরু করলেও অত্যন্ত গোপনে সামরিক আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। বস্তুতঃ শেখ মুজিবের সঙ্গে ইয়াহিয়া-ভুট্টোর আলোচনা ছিলো সামরিক শক্তি বৃদ্ধির সময়ক্ষেপন। কেননা, এসময় প্রতিদিন ৬টি থেকে ১৭টি পর্যন্ত— পি.আই.এ ফ্লাইট বোয়িং ৭০৭ বিমান সৈন্য ও গোলা-বারুদ নিয়ে ঢাকায় আসতো। অসংখ্য জাহাজ সৈন্য ও ভারী অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে ভীড়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিক ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ গ্রন্থে উলে্লখ করেছেন, ‘ ১৭ মার্চ জেনারেল টিক্কা খান, লে. জে. খাদিম হোসেন ও রাও ফরমান আলী ‘অপারেশন সার্চলাইট বা বাঙ্গালির ওপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড পরিচালনার নীল নকশা’ প্রণয়ন করেন। ২০ মার্চ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল হামিদ, জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল পীরজাদা, জেনারেল ওমর প্রমুখকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সামরিক প্রস্তুতি তথা অপারেশন সার্চলাইট চূড়ান্ত অনুমোদন করেন।২৫ মার্চ রাত সাড়ে এগারোটার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র-শাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এ সময় প্রথম হামলার শিকার হন ফার্মগেট এলাকায় মিছিলরত বাঙ্গালি ছাত্র-জনতা । একই সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পলিখানায় পাক সেনাবাহিনী আক্রমণ শুরু করে। বাঙ্গালি পুলিশ ও ইপিআর সদস্যরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ শুরু করলেও ভারী অস্ত্রের কাছে পরাজয় বরণ করে অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় চালানো হয় সবচে নৃসংশ হত্যাকাণ্ড। জগন্নাথ হল ও তৎকালীন ইকবাল হলে পাক সৈনদ্যরা রকেট হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে রুমে রুমে তল্লাশি চালিয়ে ছাত্রদের গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। শত শত ছাত্রের লাশ সেদিন এই দুই হলের সিঁড়িতে, বারান্দায় স্তূপ হয়ে ছিলো। শুধু ছাত্র নয়, শিক্ষকদেরও পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী হত্যা করে। রোকেয়া হলে ছাত্রীদের নির্মম পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করে পাকিস্তান সেনারা।
২৫ মার্চ একইভাবে গণহত্যা চলে পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার, শাখারি পট্টি, কচুক্ষেত, মিরপুর, রায়ের বাজার, গণকটুলি, ধানমন্ডিসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। অপারেশন সার্চ লাইটের হত্যাযজ্ঞ কেবল ঢাকায় সীমাবদ্ধ ছিলো না। কুমিল্লা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, বগুড়া, সৈয়দপুর, সিলেটসহ পুর্ব বাংলার বিভিন্ন শহরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৃসংশ গণহত্যা সংঘটিত করে। রাত দেড়টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশেষ সার্ভিস গ্রুপের এক প্লাটুন কমান্ডো সৈন্য ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবের বাড়িতে আক্রমণ করে বাঙ্গালির অবিসংবাদিত জননেতাকে গ্রেপ্তার করে। তবে তার আগেই বঙ্গবন্ধু ইপিআর (বর্তমান বিডিআর) এর ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। (চলবে) ৷
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
লেখক : ফারহানা আকতার, পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, লেখক, গবেষক ও সদস্য, সম্পাদকমন্ডলী,বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্নাল ৷
বাংলাদেশ সময়: ১৬:৫৪:২২ ১০৯৬ বার পঠিত # #আন্দোলন #কলাম #গবেষণা #প্রজন্ম #মুক্তিযুদ্ধ #স্বাধীনতা