বুধবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১
সৈয়দ আলী আহমদ’র উপন্যাস ‘ষোলোআনা চৌধুরী’ : বৈষম্যের সমাজ উপলব্ধি বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল
Home Page » সাহিত্য » সৈয়দ আলী আহমদ’র উপন্যাস ‘ষোলোআনা চৌধুরী’ : বৈষম্যের সমাজ উপলব্ধি বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সলসাহিত্য জীবনের কথা বলে। সাহিত্য সমাজের কথা বলে। সাহিত্য আমাদের মুখোমুখি করে জীবন সত্যের ও সমাজ সত্যের; আমরা উপলব্ধি করি জীবনের তাৎপর্য এবং সামাজিক বাস্তবতা। সাহিত্যের মাধ্যমে আমরা প্রবেশ করি এমন এক নির্মল আনন্দলোকে, যে আনন্দলোকে সৃষ্টি হয় সত্য, সুন্দর এবং কল্যাণের দ্বার।
আদিকাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত সাহিত্যের অগ্রগতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে সমগ্র বিশ্বের সাহিত্য দুটি ভাগে বিভক্ত। একদল মনে করেন সাহিত্যের বা শিল্পের প্রয়োজন কেবল সাহিত্যের জন্যই; যাকে বলা ‘শিল্পের জন্য শিল্প’। আর অন্য দলে যাদের অবস্থান তারা বলেন, না সাহিত্যের জন্যই কেবল সাহিত্য নয়। জীবনের প্রতি, সমাজের প্রতি সাহিত্যের অবশ্যই এক প্রকার দায়বদ্ধতা আছে। এ জন্য তারা বলেন, ‘জীবনের জন্য শিল্প’।
ছড়া-কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক, উপন্যাস এসব কিছুই সাহিত্যের অংশ। সাহিত্যের মাধ্যমে ভালো-মন্দ, দুঃখ ও সুখ, পতন ও উত্থান ইত্যাদি নানা বিপরীতমুখী বিষয় ফুটে উঠে। সাহিত্যের মাধ্যমেই ব্যক্তির জীবনদর্শন ফুটে উঠে। লেখকের ক্ষেত্রে দর্শন ভিন্নমাত্রিক হতে পারে। অনেক লেখক আবার অন্যের দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। নিজস্ব মতামত, চিন্তা-দর্শন, ভাব-ভাষা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং আদর্শকে অন্যের কাছে পৌঁছানোর অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে সাহিত্য। যুগে যুগে এই সাহিত্যের রয়েছে সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা কেবল প্রয়োজনেই নয়, বরং সাাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা শিল্পের জন্য, জীবনের জন্য। সৃষ্টিশীল চেতনায় যাদের হৃদয় উন্মুখ থাকে, তারাই অনুভব করতে পারে এর স্বাদ এবং আনন্দ। জীবনের রূপ-বৈচিত্র্য, ভিন্নদেশি ভাষা কিংবা সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর জীবনাচার, এসকল কিছুর সঠিক উপস্থাপনের জন্য সাহিত্যের চেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র আর হতে পারে না। সাহিত্যে যে কেবল উপরোক্ত বিষয়গুলো চিত্রিত হয় তা নয়, বরং সাহিত্যের মাধ্যমে বিভিন্ন গোষ্ঠীকেন্দ্রিক যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, তা সাহিত্যেই প্রতিফলিত হয়। এছাড়া সময়ের সাম্প্রদায়িকতা, গণতন্ত্রহীনতা, শোষণ-নির্যাতন-অত্যাচার-জুলুম উপন্যাসে ফুটে উঠে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, শ্রেণিচেতনা, সমাজ বৈষম্যের চিত্র, দুর্বৃত্তের মুখাকৃতি, সুবিধাবাদীদের নগ্নমূর্তি এবং শোষিত, ভাগ্য-বিড়ম্বিত, দরিদ্র, নিঃস্ব, অসহায় মানুষের ছবি ভেসে ওঠে উপন্যাসের চরিত্রে এবং বৈশিষ্ট্যে। লড়াকু কিংবা সংগ্রামী এবং মধ্যবিত্ত ভাবুক সাধারণ মানুষের প্রতিচিত্রও অনেক সময় মুখ্য হয়ে ওঠে। অথবা সদ্যজন্ম নেওয়া শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজের কথা, তাদের আবেগ, জীবনের শাশ্বত বহমান বৈশিষ্ট্য, জাগতিক ভাবনা এবং শ্রেণিবাস্তবতার স্বরূপ ঘটে উপন্যাসে। কখনো খণ্ডিত কিংবা বিচ্ছিন্নভাবে, আবার কখনো সামগ্রিক মানবিক দৃষ্টিতে প্রতিভাত হয় অভিজাত শ্রেণির আলোচনা। এছাড়া সামাজিক অবস্থান, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থাও উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের চিন্তাদর্শন এবং দৃষ্টিভঙ্গিতে ভিন্নমাত্রিকতা স্পষ্টত হয়। বাংলাসাহিত্যের উপন্যাসে এ রকম অসংখ্য উদাহরণ এসেছে। সিলেটের বিশিষ্ট লেখক, কবি ও ঔপন্যাসিক সৈয়দ আলী আহমদ রচিত ‘ষোলোআনা চৌধুরী’ তার অন্যতম। এটি ঔপন্যাসিকের চতুর্থ উপন্যাস। সৈয়দ আলী আহমদ স্বনামে পরিচিত এক আলোকিত প্রতিভা। তাঁর চিন্তাভাবনায় যেমনই বৈদগ্ধের ছাপ লক্ষণীয়, তেমনই এর সঙ্গে সমন্বয় ঘটেছে পরিশীলিত জীবনবোধের স্পষ্ট নির্যাস। শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম-দর্শনসহ বিচিত্র বিষয়ে তাঁর রয়েছে নিবিষ্ট অধ্যয়ন। তাঁর চিন্তার প্রখরতায় মিশে আছে কল্যাণকামী সমাজের দূরদর্শী রূপরেখা। আদর্শবাদী চিন্তার স্ফুরণ তাঁর বোধের জগতকে করেছে স্বতন্ত্রতায় ভূষিত। ‘ষোলোআনা চৌধুরী’ উপন্যাসে তাঁর গভীর অনুযোগ ঘটেছে।
‘চৌধুরী’ নামক এই গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। এই উপন্যাসের ৬১নং পৃষ্ঠায় ঔপন্যাসিক চৌধুরীদের কয়েকটি শ্রেণিবিভাগ করেছেন। অবশ্য এটা উপন্যাসের নায়ক ফয়সল চৌধুরীর পিতা মাহবুব চৌধুরীর শ্রেণিবিভাগ। ঔপন্যাসিক এটাকে ভাষা প্রদান করেছেন মাত্র। তিনি চৌধুরীদের ‘অদ্য চৌধুরী, জাকাতি চৌধুরী, হঠাৎ চৌধুরী, গাংপারি চৌধুরী, চরাঞ্চলের চৌধুরী, দু-আনি চৌধুরী, সিকি চৌধুরী, আধুলি চৌধুরী, ভরাউটের চৌধুরী, ছোঁয়াচে চৌধুরী, তালুকদার চৌধুরী, ভাটিয়ালা চৌধুরী, ভাদাইমা চৌধুরী, উঁচু চৌধুরী, নিচু চৌধুরী, নব্য চৌধুরী, ভাদাইটিলা চৌধুরী, চাড়াল চৌধুরী, ভূইফোঁড় চৌধুরী, উজানী ও বিলপারি চৌধুরী’ নামক বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করেন। ঔপন্যাসিকের সার্থকতা এখানে প্রাসঙ্গিক ভাবনায় ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে, যেকোনো একটি গোষ্ঠীর সহায়-সম্পত্তি, কিংবা ক্ষমতা-জনবল বেড়ে গেলেই ‘চৌধুরী’ নামক পদবিটি (!) ব্যবহার করা যেন রীতিমতো ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গেছে। ঔপন্যাসিক এখানে মাহবুব চৌধুরীর মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বে এটাকে বেশ তাচ্ছিল্যের অবস্থানে নিয়ে পৌঁছিয়েছেন। ঔপন্যাসিক বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে ‘চৌধুরী’দের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বকে একীভূত করে তুলেন। এ সকল চৌধুরী চরিত্রের আড়ালে তিনি ‘মানসিক প্রবণতা’-কে জিইয়ে রাখার একটি আকুল আবেদন সৃষ্টি করেছেন। বাংলা উপন্যাসে অভিজাতকেন্দ্রিক ভাবনায় নিষ্পেষণ-নিগ্রহের চরিত্র ফুটে ওঠে, এর বিপরীতে ‘ষোলোআনা চৌধুরী’-কে একটি মানবিক স্বরূপতার আখ্যান বলা যায়। এখানেই ‘ষোলোআনা চৌধুরী’র সার্থকতার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
এ উপন্যাসের মূল চরিত্র আতুয়াজানের অচলায়তন জমিদার মাহবুব চৌধুরী। তাঁর উচ্চশিক্ষিত ছেলে ফয়সল চৌধুরীর বিয়ে এবং চাকুরি ভাবনা নিয়ে এর মূল গল্পটি সামনে এগিয়েছে। অপরদিকে, এই উপন্যাসের অন্যতম চরিত্র মাইজভাগ গ্রামের ‘মফিজ চৌধুরী’র মেয়ে সাদিয়া চৌধুরীর রেশ ধরেই গল্পটি সার্থকতায় রূপ নিয়েছে।
এই উপন্যাসে গভীর জীবনবোধে ফুটে উঠেছে মানবরচিত বিভেদের দেয়ালের ভাঙনের চিত্র। উত্তরাধিকার সূত্রে কিংবা খ্যাতির বিড়ম্বনার শিকার ‘আভিজাত্যের নৈতিক দ্বার’ও উন্মোচিত হয়েছে চরিত্রের প্রয়োজনে। সময় এবং অসময়ে বদলে যাওয়া মানুষের ভেতরকার আত্মগরিমা, অহংবোধ এবং আত্মসম্মানবোধ এই উপন্যাসে গভীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে ফুটে উঠেছে। এর মধ্যেও বিচ্ছুরিত হয়েছে হারিয়ে যাওয়া বিবেক এবং মূল্যবোধের প্রোজ্জ্বল প্রদীপের। উপন্যাসের মাহবুব চৌধুরী আর তার পুত্র ফয়সল চৌধুরী যেন দুটি বিপরীত মেরু। মাহবুব চৌধুরীর রক্তের শিরায় শিরায় মিশ্রিত আভিজাত্যের অহংকার। কিন্তু ফয়সল চৌধুরী’র উদার নৈতিকতা এবং বৈষম্যহীন, উঁচু-নিচু ভাবনামুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি এখানে মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পিতার বিপরীতে তাঁর নীরব অবস্থান এবং কখনো আত্মসম্মানবোধে আত্মসমর্পণ, শেষ পর্যন্ত মনের ভেতরকার আবেগ-অনুভূতিকেই নাড়িয়ে দেয়। অবশ্যই এর পেছনে কাজ করেছে অধ্যক্ষ গোলাম আজাদ নামক এক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের। এখানে তিনি মানবিক ব্যক্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে তিনি ‘সমাজব্যবস্থার ভাঙ্গন এবং গোড়ামি’-কে নস্যাৎ করতে সচেষ্ট হয়েছেন, এখানে ঔপন্যাসিকের মানবিক এবং মানবতাবাদী চরিত্রের বিশেষ প্রকাশ ঘটেছে।
গল্পের ক্রমণিকায় পরতে পরতে যে ব্যঙ্গাত্মক সংঘাতময় চিত্র ফুটে উঠেছে, তা মনুষ্যত্বের জগতকে করেছে আশাহত। তবে শেষপর্যন্ত মাহবুব চৌধুরীর আভিজাত্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি এবং ফয়সল চৌধুরী-সাদিয়া চৌধুরীর বিয়ে সেই আশাহত দিককে আনন্দে রূপ দিয়েছে। অবশ্য এই আনন্দের মধ্যেও ঔপন্যাসিক বেদনার চিত্রকে মলিন করে দেখিয়েছেন। আতুয়াজানের চৌধুরীর রাগ-অভিমান এবং ক্ষোভ শেষপর্যন্ত বৈপরিত শুভকামনায় একটি গভীর অনুভ‚তির সৃষ্টি করে। তবুও আশা-আকাঙ্ক্ষার দোলাচলেই গল্প এগিয়ে যায়।
এই উপন্যাসের মূল বিষয় ‘সাম্যবাদ’। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখার যে প্রবণতা, এটা ব্যক্তি মাত্রেই অনুপস্থিত হওয়ায় ‘অভিজাত (!)’ পদবি ব্যবহার করে মানুষ সম্মানিত হতে চায়। এটা যেকোনো নোংরা সমাজের একটি ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পেছনে আছে আত্মগরিমা এবং অহমিকা প্রকাশের চেতনা! ফয়সল চৌধুরী এবং সাদিয়া চৌধুরীর একাত্ম হওয়ার মাধ্যমে ঔপন্যাসিক এ চেতনাকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছেন। তবে মাহবুব চৌধুরীর আভিজাত্য খসে পড়লো কি না, সেটা বিবেচ্য না থেকে, যুবসমাজকে এমন একটি পথরেখা বাতলে দিয়েছেন, যাতে ওই পথ দিয়েই তারা সাম্যের সমাজ গড়তে পারে। চরিত্রের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ঔপন্যাসিক একটি সাম্যের সমাজচিত্রকে অনিবার্য করে তুলেছেন। তাঁর জীবনদর্শনে সমন্বিত মানবিক চিন্তার সার্থক মিলন ঘটেছে উপন্যাসের চরিত্রের আবেগ-অনুভ‚তি এবং উপলব্ধির একাত্মতায়। এখানেই ঔপন্যাসিকের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের কল্যাণময় পরিণতির কালীন সাক্ষী। এই উপন্যাসটি প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আভিজাত্যের অহংবোধ এবং বনেদি বিভেদের দেয়ালে শেষ পেরেক টুকে দিতে অনুপ্রাণিত করবে। তাঁর এই গ্রন্থ নিয়ে আশা শতভাগ প্রফুল্লতায় ভরপুর। চরিত্রের অনুষঙ্গে ঔপন্যাসিকের ভাষাভঙ্গি, রচনাশৈলী, উপস্থাপন প্রক্রিয়া উজ্জ্বলতা এবং পরিচ্ছন্নতার স্মারক। এতে আছে ধ্যানবোধের সংলগ্নতা, যা গ্রন্থ পাঠে এনে দেবে আনন্দময় জীবনের শৈল্পিক প্রবাহ। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন, সিলেট। শুভেচ্ছা মূল্য রাখা হয়েছে ১৫০ টাকা। চকচকে ছাপা, ঝকঝকে বাঁধাই এবং আকর্ষণীয় প্রচ্ছদে গ্রন্থটি বিষয়ভাবনাকেই নির্দেশ করে। আমি তাঁর গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করি।
লেখক : প্রকাশক, প্রাবন্ধিক ও সংগঠক।
বাংলাদেশ সময়: ২২:১৯:৩০ ১১৭৮ বার পঠিত