সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১
ফারহানা আকতার এর কলাম – “নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – র্পব : ৫০”
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম – “নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – র্পব : ৫০”৬.সামরিক শাষন ও স্বাধিকার আন্দোলন (১৯৫৮-১৯৬৯) :
ক. ১৯৫৬ সালের পাকিস্তানের সংবিধান :
১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান চালু ছিলো মাত্র আড়াই বছর। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক শাসন জারি করে ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে দেন। পাকিস্তানে তিনি সাংবিধানিক শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটান। এতো অল্প সময় সংবিধানের সফলতা-ব্যর্থতা-নিরুপণের জন্য যথেষ্ট নয় ৷ পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ঐতিহ্যহীনতা, সংবিধানের অন্তর্গত ত্রুটি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্ষমতালোভী সামরিক বাহিনী প্রভৃতি কারণে পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের সংবিধান কার্যকর হতে ব্যর্থ হয়।নিম্ন পাকিস্তান -সংবিধানের ব্যর্থতার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো-
* ১৯৫৫ সালের মারী চুক্তি-প্যারিটি ফর্মুলা :
১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই মারীতে পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণ-পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে পাকিস্তানের সকল প্রদেশের নেতারা সংবিধান সম্পর্কে একটি সমঝোতা-চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই সমঝোতা চুক্তি মারী চুক্তি নামে পরিচিত। নিম্নে মারী চুক্তির প্রধান সিদ্ধান্ত গুলো বর্ণনা করা হলো :
১. পাকিস্তানের দুটি প্রদেশ থাকবে; যথা : পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান ৷
২. পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশকে এক ইউনিটে পরিণত করে একটি প্রদেশ গঠন করা হবে।
৩. উভয় প্রদেশকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান করা হবে।
৪. উভয় প্রদেশের সকল বিষয়ে সংখ্যা সাম্যনীতি কার্যকর করা হবে।
৫. যুক্তনির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হবে।
৬. পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা ও উর্দু।
মারী চুক্তি অনুযায়ী ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের সকল প্রদেশকে এক ইউনিটে পরিণত করে দ্বিতীয় গণপরিষদে একটি বিল পাশ হয়। মারী চুক্তির মাধ্যমে ‘পূর্ব বাংলার’ নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখা হয়। মারী চুক্তিতে পূর্ব বাংলার পক্ষ থেকে সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ স্বাক্ষর দান করা সত্তেও, চুক্তির সংখ্যা সাম্য নীতির বিরুদ্ধে বাঙালিদের মধ্যে প্রতিক্রি য়া দেখা দেয়। যাহোক, দীর্ঘ সময় শেষে এ চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানে একটি সংবিধান রচনার দ্বার উন্মুক্ত হয়।
* ১৯৫৬ সালের সংবিধান :
স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ নয় বছর পর পাকিস্তান সংবিধান প্রণয়নে সক্ষম হয়।
সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের রাষ্ট্রকাঠামো ছিলো যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতির। একক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার ঘোষণা ছিল সংবিধানে। এই সংবিধানের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখা হয় এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। কিছু বিতর্ক থাকলেও পাকিস্তানের উভয় প্রদেশ এ সংবিধান মেনে নিয়েছিলো।
মারী চুক্তির আলোকে ১৯৫৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় গণপরিষদের করাচী অধিবেশনে পশ্চিম পাকিস্তানে র সকল প্রদেশ ও দেশীয় রাজ্যসমূহকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘এক ইউনিট’ কার্যকর করা হয়। ১৯৫৬ সালের ৯ জানুয়ারি পাকিস্তানের আইন সচিব আই আই চুন্দ্রীগড় পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদে ‘পাকিস্তান- সংবিধান বিল’ পেশ করেন। ব্যাপক আলোচনা সাপেক্ষে বিলটি ২৯ ফেব্রুয়ারী গণপরিষদে গৃহীত হয়। ২৩ মার্চ পাকিস্তান- দিবস (ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উত্থাপনের দিন) থেকে তা কার্যকর হয়। এ সংবিধান প্রণয়নে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এই সংবিধানে ৬টি তফসিল, ১৩টি অনুচ্ছেদ এবং ২৩৪টি ধারা ছিলো। নিম্নে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
১। ইসলামী প্রজাতন্ত্র : ১৯৫৬ সালের সংবিধান পাকিস্তানকে একটি ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণা করা হয়। কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন প্রণয়ন নিষিদ্ধ হয় এবং রাষ্ট্রপতি মুসলমান হবেন− এ শর্ত যুক্ত করা হয়। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের লক্ষে ইসলামী গবেষণাগার ও ইসলামী উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করা হয়।
২। দুষ্পপরিবর্তনীয় সংবিধান : এই সংবিধান ছিল দুষ্পরিবর্তনীয়। জাতীয় পরিষদের সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের দ্বারা সংশোধনী বিল উত্থাপন করা গেলেও তা পাস করতে দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের প্রয়োজন হত।
৩। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র : ১৯৫৬ সালের সংবিধান অনুযায়ী সর্বজনীন ভোটাধিকার নীতির ভিত্তিতে জাতি ধর্ম-বর্ণ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটে সরকার গঠিত হবে।
৪। যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার : এই সংবিধান যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা প্রবর্তন করে। সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালত এবং প্রদেশিক স্বায়ত্তশাসনের মতো যুক্তরাষ্ট্রীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান ছিল।
৫। সংসদীয় সরকার : কেন্দ্রে এবং প্রদেশে সংসদীয় প্রকৃতির বা মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রপতি ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। মন্ত্রিপরিষদ তাদের কাজের জন্য আইন পরিষদের নিকট দায়ী ছিলেন।
৬। এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা : পাকিস্তানে গোড়া থেকে যদিও দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা নিয়ে আলোচনা চলছিল, শেষ পর্যন্ত— এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা প্রবর্তিত হয়। ১০ জন মহিলা সদস্য সহ মোট ৩১০ সদস্যের পার্লামেন্ট গঠনের কথা বলা হয়। সংখ্যাসাম্য নীতির ভিত্তিতে এই আসন বণ্টন করা হবে বলে বিধান করা হয়।
৭। রাষ্ট্রভাষা : বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাকেই রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়। এর ফলে বাঙালির দীর্ঘদিনের দাবি বাস্তবায়িত হয়।
৮। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়েছে। সংবিধানে পরিষ্কার ভাষায় প্রাদেশিক সরকারের কার্যাবলী নির্ধারণ করা হয়েছিল। প্রদেশ পরিচালনার জন্য প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ, আইন পরিষদ প্রভৃতির বিষয়ে স্পষ্ট বিধান ছিল। সংবিধানে স্পষ্ট অক্ষরে বলা হয়নি এমন বা অলিখিত বিষয়সমূহ প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারভুক্ত রাখা হয়।
৯। মৌলিক অধিকার রক্ষা : ১৯৫৬ এর সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারসমূহ তালিকভুক্ত করে তা সংরক্ষনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়। এক্ষেত্রে হাইকোর্টকে নাগরিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব দেয়া হয়।
১০। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : সংবিধানে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগের হস্তক্ষেপে বা নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত রাখার কথা বলা হয়। তাছাড়া, বিচার বিভাগকে সংবিধানের রক্কেষর ভূমিকা প্রদান করা হয়।
১১। সংখ্যালঘু সমপ্রদায়ের স্বার্থ রক্ষা : পাকিস্তান একটি ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে ঘোষণা করা হলেও, সংবিধানে সংখ্যালঘু স¤প্রদায়ের বিভিনড়ব ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়।
১২। স্বাধীন নির্বাচন কমিশন : সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সংবিধানে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ব্যবস্থা রাখা হয়।
১৩। সংবিধান সংশোধন : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে সংশোধনের যে ব্যবস্থা রাখা হয় তাকে নমনীয় বলা যায়। সাধারণ সংশোধনীসমূহ সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় এবং বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের সম্মতি নিয়ে সংবিধান সংশোধন করার ব্যবস্থা ছিল। তবে উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রপতির সম্মতি নেবার প্রয়োজন ছিল।
*১৯৫৬ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণ :
১৯৫৬ সালে প্রণীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান চালু ছিলো মাত্র আড়াই বছর। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক শাসন জারি করে ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে দেন। পাকিস্তানে তিনি সাংবিধানিক শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটান। এতো অল্প সময় সংবিধানের সফলতা-ব্যর্থতা-নির“পণের জন্য যথেষ্ট নয়। পাকিস্তানে গণতন্ত্রের ঐতিহ্যহীনতা, সংবিধানের অন্তর্গত ত্রুটি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ক্ষমতালোভী সামরিক বাহিনী প্রভৃতি কারণে পাকিস্তানে ১৯৫৬ সালের সংবিধান কার্যকর হতে ব্যর্থ হয়। নিম্নে পাকিস্তানে সংবিধানের ব্যর্থতার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো-
১৯৫৬ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণসমূহ :
# সাংবিধানিক ত্রুটিসমূহ :
(১) অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধান : সংবিধানে রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রিপরিষদ ও আইন পরিষদের শাসন ক্ষমতার বিধানগুলো অস্পষ্ট ছিলো। এ কারণে ক্ষমতা চর্চার ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টি হয়। বিষয়টি সাংবিধানিক তথা সংসদীয় শাসন ব্যবস্থার উপযোগী ছিলো না।
(২) ত্রুটিপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে ত্রুটিপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতি চালু করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভার বিকল্প নেই। কিন্তু পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানে এক কক্ষ -
বিশিষ্ট আইন সভা চালু করা হয়। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রীয় পদ্ধতিতে প্রাদেশিক সরকারকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। কিন্তু পাকিস্তানের সংবিধানে প্রদেশকে নামমাত্র স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। শাসনতান্ত্রিক সব বিষয়েই কেন্দ্রিয় সরকার প্রাদেশিক সরকারের ওপর খবরদারি করেছে। এর ফলে সংবিধান সত্যিকার অর্থে কার্যকর হতে পারেনি।
(৩) সংখ্যাসাম্য নীতির অভাব : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানীদের আশা-আকাঙ্খার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেনি। এটা ছিল ‘মারী’ চুক্তির বরখেলাপ। ১৯৫৫ সালে সম্পাদিত মারী চুক্তিতে পাকিস্তানের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্য নীতি গৃহীত হবার শর্ত ছিল। কিন্তু উক্ত সংবিধানে রাষ্ট্রীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে সে শর্ত মান্য করার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়নি। যেমন, সামরিক বাহিনী ও কেন্দ্রীয় প্রশাসনে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল খুবই নগণ্য। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালিরা তাই স্বাভাবিকভাবে এ সংবিধানকে মনে-প্রাণে গ্রহণ করেনি।
(৪) স্বায় ত্তশাসনের অভাব : ১৯৫৬ সালের সংবিধান পূর্ব পাকিস্তান তথা প্রদেশসমূহের স্বায়ত্তশাসন প্রদান করতে ব্যর্থ হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানবাসীদের আশা-আকাঙ্খার প্রতীকধর্মী না হওয়ায় এ সংবিধানকে তারা ভালভাবে গ্রহণ করেনি। ফলে সংবিধানের ত্র“টি একে ধীরে ধীরে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে গিয়েছিল।
(৫) নির্বাচনের বাধ্যবাধকতার অভাব : ১৯৫৬ সালে প্রণীত সংবিধানে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের তেমন কোন বাধ্যবাধকতা ছিলো না। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও দীর্ঘ এক যুগেও দেশটিতে কোন জাতীয় নির্বাচন হয়নি। সংবিধান প্রণয়নের দু’বছর পরও নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। সংবিধানে এ ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ছিলো না। এর ফলে পাকিস্তানে বরাবরই গণবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও আমলাতন্ত্র ক্ষমতা ভোগ করেছে। শাসক কর্তৃপক্ষের বৈধতা না থাকায় বারে বারে তারা অগণতান্ত্রিক পন্থায় পরিবর্তিত হয়েছে। এ কারণে পাকিস্তানে সংবিধান কার্যকর হওয়ার মতো পরিবেশ পায়নি।
# সাধারণ কারণসমূহ :
(১) মন্ত্রিপরিষদের ওপর প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপ : পাকিস্তানে মন্ত্রিপরিষদের কার্যক্রম পরিচালনার ওপর প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপে এবং বার বার প্রেসিডেন্ট কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর রদবদল সংসদীয় ব্যবস্থাকে অকার্যকর করে তোলে। যা সংবিধানকে ব্যর্থ করে দেয়।
(২) প্রেসিডেন্ট কর্তৃক রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতা দান : প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা নিজেই তার দল রিপাবলিকান পার্টির শক্তি বৃদ্ধির জন্য অন্যায় ও অযৌক্তিক পন্থায় নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করেন যা দল ব্যবস্থায় দুর্নীতির বীজ বপন করে।
(৩) সুশৃক্সখল রাজনৈতিক দলের অভাব : সংসদীয় ব্যবস্থা কার্যকর করার জন্য সুসংগঠিত রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন। কিন্তু পাকিস্তানে সুসংগঠিত কোনো রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠতে পারেনি। রাজনৈতিক দলের নেতারা ছিলেন ক্ষমতালিপ্সু , স্বর্থপর, হিংসুটে ও কোন্দলপ্রিয়। জনস্বার্থকে নেতারা কোনো প্রকার গুরুত্বই দিতেন না।
(৪) সাংবিধানিক নীতির প্রতি দলীয় শ্রদ্ধার অভাব : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তীব্র স্বার্থান্বেষী - প্রতিদ্বন্দ্বিতা নৈতিক অঙ্গনের পবিত্রতা বিনষ্ট করে। পার্লামেন্টারি রীতিনীতির প্রতি দলগুলো শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে। আইনসভাগুলো প্রকৃতপক্ষে রণক্ষেত্রে রূপ নেয়। ফলে সংবিধান আর এগিয়ে যেতে পারেনি।
(৫) রাজনীতিবিদগণ কর্তৃক প্রশাসনে হস্তক্ষেপ : রাজনীতিবিদগণ কর্তৃক প্রশাসনে অযথা হস্তক্ষেপ করায় প্রশাসকবৃন্দ অসহায়বোধ করেন। এতে প্রশাসনের দক্ষত হ্রাস পায়। ফলে সংবিধানের কার্যকারিতা ব্যর্থ হয়ে পড়ে।
(৬) অর্থনৈতিক সংকট : অর্থনৈতিক সংকটও ১৯৫৬ সালের সংবিধান ব্যর্থ হওয়ার পেছনে দায়ী ছিল। কালোবাজারি, চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য ও বেআইনি ব্যবসার ফলে জনজীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল। দেশে খাদ্যাভাব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শ্রমিক অসন্তোষ প্রভৃতি কারণে জনগণ সামরিক শাসনব্যবস্থাকে মেনে নিতে অসম্মতি জানিয়েছিল।
(৭) গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা : পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেলগণ অগণতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা করেছেন। তারা রাষ্ট্রের নামমাত্র প্রধান হতে চাননি। বিশেষতঃ গোলাম মোহাম্মদ এবং পরবর্তীতে ইস্কান্দার মীর্জা দু’জনই আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন যাতে সরকার স্থায়ীরূপ লাভ করতে না পারে। শাসনতন্ত্র লক্সঘন করে তারা বার বার কেন্দ্রীয় সরকার পরিবর্তন করেছেন। পাকিস্তানে গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা চর্চার কারণে সাংবিধানিক সরকার কার্যকর হতে পারেনি। এ কারণে ১৯৫৬ এর সংবিধান ব্যর্থ হয়।
(৮) রাজনৈতিক অস্থিরতা : স্বাধীনতা লাভের পর থেকে পাকিস্তানে ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা ছিলো। পূর্ব পাকিস্তানে ৯ বছরের মধ্যে ৭ বার মুখ্যমন্ত্রী পরিবর্তন করা হয়। কেন্দ্রেও বারে বারে প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তিত। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র কিংবা সংবিধান স্থায়িত্ব পায়নি।
# শাহাবুদ্দিন কমিশনের রিপোর্ট :
১৯৬০ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কর্তৃক গঠিত শাহাবুদ্দিন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী পাকি¯—ানের ১৯৫৬ সালের সংবিধান ব্যর্থ হয়েছিল প্রধানতঃ চারটি কারণে-
(১) সংবিধানের অন্তর্নিহিত ত্রুটি এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের অভাব।
(২) পাকিস্তানে রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক অহেতুক মন্ত্রিপরিষদ ও রাজনৈতিক দলের ওপর হস্তক্ষেপ ৷
(৩) সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দলের অভাব।
(৪) রাজনৈতিক নেতাদের নেতাসুলভ গুণাবলির অভাব।
খ. ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন :
পাকিস্তানে ১৯৪৭ হতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত— দীর্ঘ নয় বছর কোন সংবিধান ছিলো না। ফলতঃ জন্মলগ্ন থেকেই দেশটির শাসন ব্যবস্থায় অগণতান্ত্রিক সরকার ও আমলাতন্ত্র জেঁকে বসে। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ পাকি¯—ানের দ্বিতীয় গণপরিষদ একটি সংবিধান প্রণয়নে সক্ষম হলেও তা মাত্র আড়াই বছর টিকে ছিলো। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের তদান্তীতন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা সারাদেশে সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধান কেবল স্থগিতই করেননি, তা বাতিল করে দেন। বরখাস্ত করেন ফিরোজ খান নুনের সরকারসহ সকল প্রাদেশিক সরকারকে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইয়ূব খানের সহযোগিতায় ইস্কান্দার মীর্জা সামরিক শাসন জারি করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে নিযুক্ত করেন আইয়ূব খানকে। ইস্কান্দর মীর্জা চেয়েছিলেন সেনাপ্রধানের কাঁধে বন্দুক রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে। কিন্তু ইস্কান্দর মীর্জার সে আশা পূরণ হয়নি। মাত্র ২০ দিন পর ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ূব খান তাকে সরিয়ে নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। অস্ত্রের মুখে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে বিদেশে পাঠিয়ে দেন। শুর“ হয় আইয়ুব খানের দীর্ঘ সামরিক শাসন।
*১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি
প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জা সামরিক আইন জারি করেন গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। রাষ্ট্রপতি সামরিক শাসন জারির কারণ হিসাবে দুর্নীতি, কোন্দল, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা প্রভৃতিকে চিহ্নিত করেন। গণতন্ত্রের মাধ্যমে যে দেশের সংকট দূর হবে না তা মীর্জা তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করে বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মানসিকতা এতই নীচে নেমে গেছে যে, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না, নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমানের গোলযোগপূর্ণ অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে। নির্বাচনে জয়ী হলে তারা পুনরায় দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির পদ্ধতি প্রয়োগ করবেন।’ তিনি আসনড়ব নির্বাচনের মাধ্যমেও সমস্যার কোন সমাধাণ দেখছেন না বলে ঘোষণা করেন। সামরিক শাসনের ঘোষণায় তিনি নিম্নের নির্দেশনা জারি করেন-
ক. ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল থাকবে।
খ. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারসমূহ বরখা¯— করা হলো।
গ. জাতীয় পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক পরিষদসমূহ ভেঙ্গে দেয়া হলো।
ঘ. সকল রাজনৈতিক দলের কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ঘোষিত হলো।
ঙ. বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত— সেনা শাসন বহাল থাকবে।
সেনাপ্রধান আইয়ূব খান পরবর্তীকালে আরো একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সামরিক শাসন জারি করেন। ২৭ অক্টোবর ঘোষিত সে আদেশে সেনাপ্রধান রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন। তারপর থেকে ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত আইয়ূব খানের নামেই চলে সেনা শাসন।
* ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির কারণ :
পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হবার প্রেক্ষাপটেই সামরিক শাসন জারি করা হয়। এ কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রের ব্যর্থতা আর সামরিক শাসন জারি একই সূত্রে গাঁথা। যেসব কারণে পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে ঠিক সে সব কারণেই দেশটিতে সামরিক শাসন জারি করা হয়। নিম্নে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি ও সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হবার কারণসমূহ আলোচনা করা হলো -
(১) জিন্নাহর গভর্নর জেনারেলের পদ গ্রহণ : মুসলিম লীগ প্রধান মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ ছিলেন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা। দ্বি-জাতি তত্তে¡র জনক জিনড়বাহ ঈর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন। তবে পাকি¯—ান সৃষ্টির পর অনেকটা অগণতান্ত্রিকভাবে তিনি গভর্নর জেনারেলের পদ গ্রহণ করেন। জিন্নাহর এ সিদ্ধান্ত— পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক হয়নি। কেননা, সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। রাষ্ট্রপতি থাকেন নামমাত্র প্রধান। ভারতে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করে জওহর লাল নেহের“ দেশটিতে সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু জিনড়বাহ এবং পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছে বিপরীত। এ কারণে শুরুতেই পাকিস্তানে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়ে।
(২) সংবিধানের অনুপস্থিতি : ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভ করলেও দীর্ঘ নয় বছর পাকিস্তানে কোন সংবিধান ছিলো না। সংবিধানের অনুপস্থিতির কারণে দেশটিতে গণবিচ্ছিনড়ব অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতা চর্চার সুযোগ পায়। এ প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা চরম আকার ধারণ করে। ’৫৬ সালে সংবিধান প্রণীত হলেও তা নিয়ে বিতর্ক ছিলো। এ প্রেক্ষাপটে সামরিক শাসন জারি করে সংসদীয় গণতন্ত্রের অবসান ঘটান ইস্কান্দার-আইয়ূব চক্র৷
(৩) ইস্কান্দার মীর্জার ক্ষমতা লিপ্সা : পাকিস্তানের রাজনীতির অন্যতম কুশীলব ইস্কান্দার মীর্জা ছিলেন একজন অবাঙালি। তিনি ১৯৫৫-১৯৫৮ এ সময়ে প্রথমে পাকি¯—ানের গভর্নর জেনারেল এবং পরে রাষ্ট্রপতি ছিলেন। এরপূর্বে তিনি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সচিব (১৯৪৭-১৯৫৪), পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর (১৯৫৪), পাকিস্তানের রাষ্ট্রমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত— কূট প্রকৃতির ও ক্ষমতালিপ্সু। ১৯৫৬ সালে তাঁরই প্রত্য ক্ষ মদদে রিপাবলিকান পার্টি নামে একটি দল গঠিত হয়। তিনি যখন দেখলেন যে, ১৯৫৬ সালের সংবিধানের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তাঁর নতুন করে রাষ্ট্রপতি হওয়ার সম্ভাবনা একেবারে ক্ষীণ, তখনই তিনি সংবিধান বাতিল ও ফিরোজ খান নূনের সরকারকে বরখাস্ত করেন এবং সামরিক আইন জারির মাধ্যমে নিজ হাতে ক্ষমতা তুলে নেন। তবে ইস্কান্দার মীর্জার শেষ রক্ষা হয়নি। সেনাপ্রধান আইযূব খান রাষ্ট্র
মতা দখল করে তাকে পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত করেন।
(৪) সরকারের অস্থিতিশীলতা : পাকিস্তানে ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রে ৭টি মন্ত্রীসভা গঠিত হয়। কিন্তু এই সময়ে সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ছিলেন ১ জন (জেনারেল আইয়ুব খান)। প্রাদেশিক সরকারও অনুরূপ অস্থিতিশীল ছিল। এমনও ঘটেছে যে, একটি সরকার মাত্র ২৪ ঘণ্টা স্থায়ী হয়েছে। ১৯৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে আবু হোসেন সরকার মাত্র ১ দিন ক্ষমতায় ছিলো। বিভিন্ন চক্রান্তের কারণে সোহ্রাওয়ার্দীর মত দক্ষ, প্রাজ্ঞ ও প্রবীণ রাজনীতিক কেন্দ্রে মাত্র ১৩ মাস (১৯৫৬-১৯৫৭) ক্ষমতাসীন থাকতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ প্রেক্ষিতে পাকিস্তানে চরম রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও বিশৃক্সখলা দেখা দেয় যা সামরিক শাসনের ক্ষেত্রে প্রস্তুত করে।
(৫) সুসংগঠিত দলের অভাব : ১৯৪৭ সাল থেকে পাকি¯—ানে কোন সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠেনি। মুসলিম লীগ পরিণত হয়েছিল কয়েকজন কুচμী ও ষড়যন্ত্রকারী নেতার পকেট সংগঠনে। আওয়ামী লীগকে দমন-পীড়ন করে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল। সুসংগঠিত রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা গড়ে না উঠায় আমলা-সেনাবাহিনী রাজনীতিতে প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াতে সক্ষম হয়। ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করলে তাই সাংগঠনিকভাবে কোন প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেনি। উপরন্তু অনেক রাজনৈতিক দল সামরিক শাসনকে স্বাগত জানায়।
(৬) যুক্তফ্রন্টের অন্তর্দ্বন্দ্ব : পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট ছিলো মুসলিম লীগ বিরোধী একাধিক রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাজনৈতিক মোর্চা। নির্বাচনে জয়লাভের পর ফ্রন্টের ভেতর সরকার গঠন নিয়ে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে এজন্য বেশি দায়ী করা হয়। শেষ পর্যন্ত অন্তর্দ্বন্দ্ব ও যুক্তফ্রন্ট সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রের কারণে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। এ প্রেক্ষিতে যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের এ রাজনৈতিক অস্থিরতা সমগ্র রাজনৈতিক পরিবেশকে বিশৃক্সখল করে তোলে। এ পরিস্থিতি সামরিক শাসন জারির জন্য সহায়ক হয়েছিলো।
(৭) ডেপুটি স্পিকার হত্যাকান্ড : ঢাকায় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বাক-বিতন্ডতার এক পর্যায়ে ১৯৫৮ সালে আμাš— হয়েছিলেন। পরবর্তীতে হাসপাতালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনা পাকিস্তানের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের নীচু পর্যায়ে নামিয়ে আনে। এ ঘটনার পনের দিন পরেই ইস্কান্দর মীর্জা সামরিক শাসন জারি করেন। ডেপুটি স্পিকারের হত্যাকান্ড পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছে।
(৮) আইয়ূব খানের ক্ষমতালিপ্সা : ১৯৫৮ সালে ইস্কান্দার মীর্জা সেনা শাসন জারি করলেও নেপথ্যে ছিলেন আইয়ূব খান। তিনি ছিলেন ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি। তিনি সেনা প্রধান থাকা অবস্থায় মন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর সামনে পুরো রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের সুযোগ করে দেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দর মীর্জা। সেনাবাহিনী ছিল আইয়ূবের অনুগত। সুতরাং ইস্কান্দর মীর্জা কর্তৃক জারি করা সামরিক আইন অল্প ক’দিনের ভেতরই আইয়ূব খানের অধীন চলে যায়। মীর্জাকে সরিয়ে আইয়ূব ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ূবের ক্ষ মতা দখল বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। ১৯৫৪ সালে লন্ডনের এক হোটেল কক্ষে আইয়ূব খান সামরিক শাসন জারির পরিকল্পনা করেছিলেন বলে আত্মজীবনীতে দাবি করেছিলেন।
(৯) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ের সম্ভাবনা : ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নুন ঘোষণা করেন যে, সংবিধান অনুসারে ১৯৫৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনের ঘোষণার পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের আশায় ব্যাপক প্রচারাভিযানে নামে। মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নির্বাচনের অংশ গ্রহণের জন্য জনগণকে আকৃষ্ট করতে থাকে। এ সময়ে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। আওয়ামী লীগের এই জনপ্রিয়তাকে লক্ষ্য করে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে চলে যাবে এ আশঙ্কায় ভীত হয়ে নির্বাচনকে প্রতিহত করার জন্য সামরিক শাসন জারির প্রয়োজনীয়তা অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়ায় এবং সামরিক শাসন জারি করা হয়।
(১০) জাতীয় নির্বাচনের অভাব : সংসদীয় সরকারের সাফল্যের একটি অন্যতম শর্ত হলো জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে বৈধতা অর্জন। কিন্তু পাকিস্তানে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত— সংসদীয় গণতন্ত্র চালু থাকলেও সরকারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। কেননা, সরকার জাতীয় নির্বাচন দ্বারা নির্বাচিত হয়নি। এ প্রেক্ষাপটে কেন্দ্রীয় সরকারকে বারে বারে অগণতান্ত্রিক পন্থায় বরখাস্ত করা হয়েছে। ফলতঃ সংসদীয় সরকার কার্যকর হওয়ার সুযোগ পায়নি। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত না হওয়ায় কেন্দ্রীয় সরকারকে বাতিল করে ক্ষমতা গ্রহণে তাই সামরিক বাহিনীকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
(১১) আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য : সংবিধান ও জাতীয় নির্বাচনের অনুপস্থিতির প্রেক্ষা পটে পাকিস্তানে শাসন ক্ষমতা
চর্চা করেছে আমলাতন্ত্র। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার উত্তরাধিকারী পাকি¯—ানের আমলাতন্ত্র শুর“ থেকেই ছিলো অত্যš— সংগঠিত ও শক্তিশালী। গোলাম মোহাম্মদ, ইস্কান্দার মীর্জা, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, জেনারেল আইয়ূব খান বেসামরিক না হয় সামরিক আমলাতন্ত্র থেকে রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বে উঠে আসেন। রাজনীতির প্রতি এরা বরাবরই ছিলেন বীতশ্রদ্ধ। এসব আমলা রাজনীতিবিদদের পরস্পরের বিরুদ্ধে কোন্দলে ইন্ধন যুগিয়েছেন। অতিবিকশিত ক্ষমতাধর আমলাতন্ত্রের কারণে পাকি¯—ানে সংসদীয় গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়। এ সুযোগে সামরিক বাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে।
গ.আইয়ূব খানের শাসনামল :
১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে জেনারেল আইয়ূব খান পাকি¯—ানের শাসন কাঠামো ও রাজনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের ঘোষণা দেন। তার উদ্যোগ একদিকে ছিলো অভিনব অন্যদিকে ছিলো
স্বেচ্ছাচারপূর্ণ। আইয়ূব খান তার দীর্ঘ এক দশকের শাসন আমলে রাজনীতিবিদদের তেমন কোন গুর“ত্ব দেননি। রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন কতিপয় সামরিক-বেসামরিক আমলা দ্বারা। এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের দু’অংশে বৈষম্য কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মৌলিক গণতন্ত্রের নামে তিনি অদ্ভুত এক ব্যবস্থা চালু করে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা হরণ করেন। আইয়ূব খানের শাসনামলে কিছুটা অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। তবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের বিবেচনায় আইয়ূব শাসনামল মহাশূন্যতার সৃষ্টি করে। নম্নিে আইয়ূব খানের শাসনামলের বভিন্নি দিক আলোচনা করা হলো-
১.মৌলিক গণতন্ত্র :
মৌলিক গণতন্ত্র একধরনের সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার অধীনে জাতীয় নেতৃত্ব নির্বাচনে সার্বজনীন ভোটাধিকারকে অগ্রাহ্য করা হয়। সত্যিকার অর্থে, মৌলিক গণতন্ত্র হচ্ছে এমন এক সীমিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যাতে কেবলমাত্র কিছু লোকের অধিকারে সরকার নির্বাচনের অধিকার ছিলো।
আইয়ূব খানের ক্ষমতা গ্রহণের এক বছর পূর্তির দিন ১৯৫৯ সালের ২৭ অক্টোবর তিনি ‘মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশ’ জারি করেন। এই অধ্যাদেশ বলে তিনি যে স্থানীয় সরকারের পরিকল্পনা করেন তার নামকরণ করা হয় ‘ইধংরপ উবসড়পৎধপু’ বা ‘মৌলিক গণতন্ত্র’। মৌলিক গণতন্ত্র অধ্যাদেশে চার-স্তরে স্হানীয় স্বায়ত্তশাসন গড়ে তোলার কথা বলা হয়। প্রথম স্তরে ছিল গ্রামে ‘ইউনিয়ন কাউন্সিল, পৌর এলাকায় ‘ইউনিয়ন কমিটি’, এবং ছোট শহরে ‘টাউন কমিটি।’ দ্বিতীয় স্তরে ছিল থানায় থানা কাউন্সিল, পৌর এলাকায় ‘মিউনিসিপ্যাল কমিটি’, সামরিক এলাকায় ‘ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড’। তৃতীয় স্তরে ছিল ‘জেলা কাউন্সিল’ এবং চতুর্থ স্তরে ছিল ‘বিভাগীয় কাউন্সিল’। পূর্ব পাকিস্তানের ৪০ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার সর্বমোট ৮০ হাজার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’ (ইধংরপ উবসড়পৎধঃং) সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন বলে বিধান করা হয়। এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটেই ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, আইন সভার সদস্য ও রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতেন।
মৌলিক গণতন্ত্রে প্রবর্তিত ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী বা বি ডি (বেসিক ডেমোক্রেট) ছিলেন দেশের মূল নির্বাচনমন্ডলী। জনগণকে এ ব্যবস্থায় মূল নির্বাচকমন্ডলী বলা যায় না। কেননা, জনগণ রাষ্ট্রপতি বা জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচন করতে পারতেন না। জনগণ কেবল মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচন করতো।
মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে গঠিত ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্যগণ জাতীয় ও প্রাদেশিক রাজনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। ইউনিয়ন কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে মৌলিক গণতন্ত্রীরা নির্বাচিত হতেন না। তারা প্রথমত নির্বাচকমন্ডলীর সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হতেন। তাদের দায়িত্ব ছিলো দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের নির্বাচন করা। এ দায়িত্ব পালন করার পর তারা কাউন্সিলের সদস্যে পরিণত
হতেন। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আইয়ূব খান মৌলিক গণতন্ত্র নামক একটি ভন্নি ধরনের সরকার পদ্ধতি চালু করনে এবং তাঁর বিরোধী নেতা-র্কমীদরে সুকৌশলে অর্কাযকর করে রাখতনে। আইয়ূব খান সংসদীয় পদ্ধতিকে অপছন্দ করতেন। তার দৃঢ়বিশ্বাস ছিলো পাকিস্তানের মত একটি অনুন্নত দেশে পাশ্চাত্য ধাঁচের সংসদীয় পদ্ধতি অচল। সুতরাং এদেশের উপযোগী একটা নতুন মডেল তৈরির উদ্দেশে মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তিত হয়। রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করেন, মৌলিক গণতন্ত্র চালুর মাধ্যমে আইয়ূব খান সারা দেশে ক্ষমতার নিজস্ব বলয় গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
জেনারেল আইয়ূব ঘোষণা করেছিলেন, ‘জনগণের ইচ্ছাকে সরকারের কাছাকাছি এবং সরকারী কর্মকর্তাদেরকে জনগণের কাছাকাছি এনে গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণ করতে মৌলিক গণতন্ত্র চালু করা হয়েছে।’ আইয়ূব খানের এ ঘোষণা সত্য ছিলো না। মৌলিক গণতন্ত্র না ছিল মৌলিক, না ছিল গণতন্ত্র অর্থাৎ এর মধ্যে গণতান্ত্রিক কোন ধারাই বিকশিত হয়নি। সমালোচকরা বলে থাকেন, মৌলিক গণতন্ত্র ছিল একটি মৌলিক প্রতারণা।
২.আইয়ূব শাসনামলের নির্বাচন :
আইয়ূব খানের নির্বাচনী ব্যবস্থা ছিলো মূলতঃ ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী দ্বারা নির্বাচিত হওয়ার ব্যবস্থা। মৌলিক গণতন্ত্রীরা আইয়ূব শাসনামলকে বৈধতা দানের জন্য দু’বার ভোট দিয়েছেন। আইয়ূব খান ১৯৬২ সালের সংবিধানের আওতায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনও সম্পন্ন করেছেন। তবে তাতে আওয়ামী লীগ, ন্যাপসহ দেশের স্বীকৃত রাজনৈতিক দলগুলো অংশ গ্রহণ করেনি।
১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারী আইয়ূব খানের ওপর আস্থা আছে কিনা সে বিষয়ে হা/না নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে আইয়ুব খানের বির“দ্ধে কোন প্রতিদ্ব›দ্বী ছিলো না। ছিলো কেবল দু’টি বাক্স ‘হ্যা’ এবং ‘না’ ভোটের বাক্স। মৌলিক গণতন্ত্রী দ্বারা সম্পনড়ব এই নির্বাচনে আইয়ুব খান প্রায় ৯৫ ভাগ ‘হ্যা’ ভোট পান। তবে বিরোধী দলগুলো একে প্রহসনের নির্বাচন বলে প্রত্যাখান করে।
১৯৬৫ সালে দ্বিতীয়বারে মতো প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান নির্বাচনের আয়োজন করেন। ’৬৫ সালের নির্বাচন ৬০ সালের মতো বিনা চ্যালেঞ্জে সম্পন্ন হয়নি। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এর পরিবার আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
৩. আইয়ূব শাসনামলে রাজনৈতিক হয়রানি :
আইয়ূব খান একনায়কতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন। তার শাসনামলের প্রথম চার বছর রাজনৈতিক কর্মকান্ড নিষিদ্ধ ছিলো। পরবর্তীতে রাজনীতিবিদরা সীমিত পরিসরে রাজনৈতিক কর্মকান্ড শুরু করলেও পদে পদে হয়রানির শিকার হয়েছেন। পোডো (চঙউঙ, চঁনষরপ ঙভভরপব উরংয়ঁধষরভরপধঃরড়হ ঙৎফবৎ) এবং এবডোর (ঊইউঙ, ঊীবপঁঃরাব ইড়ফরবং উরংয়ঁধষরভরপধঃরড়হ ঙৎফবৎ) মাধ্যমে দেশের বিরোধী রাজনীতিবিদদের জব্দ এবং হয়রানি করার জন্য দু’টি নির্বতনমূলক আইন আইয়ুব সরকার জারি করেছিলেন। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের বিচারের জন্য বিশেষ আদালত গঠন করা হয়। সেখানে অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনজীবীর সহায়তা পেতেন না। শাস্তি হিসাবে রাজনৈতিক নেতা বা নির্বাচিত ব্যক্তিদের বিভিন্ন মেয়াদের জন্য রাজনীতিতে, সরকারি পদের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হতো। শুধু এবডো আইনের মাধ্যমেই ৮৭৭ জন রাজনীতিবিদ অযোগ্য ঘোষিত হন। তাঁদের মধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খান আবদুল গাফফার খান, মিয়া দৌলতানা প্রমুখ অন্যতম। এ দুটি আইনের প্রধান শিকার হয়েছেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা।অনেক স্বনামধন্য রাজনীতিবিদদের নিষিদ্ধ করা ছাড়াও আইয়ূব খান বিভিন্ন সময়ে তার বিরোধিতা করার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী, মিয়া দৌলতানা, আতাউর রহমান খান, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ গণতান্ত্রিক নেতাদের বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটক রেখেছেন।
৪.আইয়ূব খাঁনরে শাসনামলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য :
পাকিস্তানে সামরিক একনায়ক আইয়ূব খানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অনেক রূপকল্প প্রচলিত আছে। এটি সত্য পাকিস্তানে আইয়ূব খানের শাসনামলে কিছুটা অর্থনৈতিক উনড়বয়ন সাধিত হয়েছে। তার সুদীর্ঘ ১০ বছরের শাসনামলে পাকিস্তানের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ছিলো ৭ থেকে ৮ ভাগ। এসময় দেশে বেশ কিছু ভৌত কাঠামো গড়ে ওঠে। তবে আইয়ূবের উনড়বয়নকে অতিরিঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল পি. হান্টিংটন আইয়ূব শাসনামলকে ‘উনড়বয়নের দশক’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আইয়ূব শাসনামলকে সমর্থন করতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, তৃতীয় বিশ্বে সামরিক শাসন উন্নয়নের একটি লক্ষণ। তবে হাটিংটন স্বীকার করেছেন , রাজনৈতিক উনড়বয়ন (চড়ষরঃরপধষ উবাবষড়ঢ়সবহঃ) ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানিকীকরণের (চড়ষরঃরপধষ ওহংঃরঃধঃরড়হধষরুধঃরড়হ) বিবেচনার সামরিক শাসনামল এক মহাশূন্যতা। সত্যকার অর্থে, আইয়ুবের শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভৌত কাঠামো স্থাপনের মূলে ছিলো বিদেশী বিশেষতঃ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সাহায্য ও অভ্যন্তরীণ শোষণ।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি বিমাতাসুলভ আচরণ শুর“ করে। নম্নিে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আইয়ূব খাঁনরে শাসনামলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরা হলো :
(ক) রাজনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানে পূর্ব বাংলা বরাবরই ভয়াবহ রাজনৈতিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের পূর্ব বাংলার সংখ্যাধিক্য থাকা সত্বেও গভর্ণর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রী উভয় পদেই নিয়োগ করা হয় পশ্চিম পাকিস্তান হতে। সংখ্যাগরিষ্ঠের দাবীকে উপেক্ষা করে পাকিস্তানের
রাজধানীও প্রতিষ্ঠা করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানের করাচীতে। পরে আইয়ূব খান রাজধানী ইসলামাবাদে স্থানান্তর করেন। পশ্চিম পাকিস্তা নীরাই ছিল প্রকৃত অর্থে শাসন ক্ষমতার কর্ণধার। পূর্ব বাংলার জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, এ. কে. ফজলুল হকসহ এ অঞ্চলের জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে নি®িঙঊয় করে রাখা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা অধিক হওয়া সত্তে¡ও এ অঞ্চল হতে জনসংখ্যা অনুপাতে কেন্দ্রীয় আইনসভা ও সরকারে প্রতিনিধিত্বের অধিকার দেয়া হয়নি। ১৯৪৭-৫৮ সাল পর্যন্ত —পাকিস্তানের ৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মাত্র ১ জন ছিলেন পূর্ব বাংলার এবং তিনি ছিলেন উর্দুভাষী। এই সময়ে পূর্ব বাংলার ৪ জন গভর্নরের মাত্র ১ জন ছিলেন বাঙ্গালি। গভর্নরগণ ছিলেন কেন্দ্রীয় সরকারের মনোনীতি ব্যক্তি। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে প্রাদেশিক গভর্ণরগণ প্রাদেশিক সরকারের কাজে অযাচিতভাবে হস্তক্ষেপ করতেন। ১৯৪৭ থেকে ৫৮ সাল পর্যন্ত— ৭ জন প্রধানমন্ত্রী ২ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের । এদের মধ্যে একজন ছিলেন উর্দুভাষী।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ব্যাপকভাবে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে যুক্তফ্রন্ট। কিন্তু বিশৃক্সখলা ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হক মন্ত্রীসভাকে পদচ্যুত করে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় শাসন চালু করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানকে কিছুটা স্বায়ত্তশাসন দেয়া হলেও ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে তা বাতিল করা হয়। শুরু হয় দীর্ঘ ১০ বছরের অগণতান্ত্রিক অপশাসন। এসময় এবডো নামের একটি কালাকানুন দ্বারা পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য জননেতাকে আটক রাখা হয়। আইয়ুব শাসনামলে বাঙ্গালির জননেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে বিনা বিচারে প্রায় ৬ বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে।
পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতায় বাঙ্গালি জনগোষ্ঠী কখনো ন্যায্য অধিকার পায়নি। এক গবেষণায় দেখা গেছে পাকিস্তানে লিয়াকত আলী খানের সময় (১৯৪৭-৫১) মাত্র ৩১.২ ভাগ, খাজা নাজিমুদ্দিনের সময় (১৯৫১-৫৩) ৪০ ভাগ, আইয়ুব খানের সময় ৩২ ভাগ, ইয়াহিয়া খানের সময় (১৯৬৯-৭১) ৪৫ ভাগ মন্ত্রী ছিলেন বাঙ্গালি। তবে বিভিনড়ব মন্ত্রীসভায় বাঙ্গালি স্থান পেলেও কখনও গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্র, ¯^রাষ্ট্র, অর্থ কিংবা প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পায়নি।
(খ) সাংস্কৃতিক বৈষম্য : পাকিস্তান সৃষ্টির পরই পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে তৎপর হয়ে ওঠে। পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ মানুষ ছিল বাঙ্গালি অন্যদিকে উর্দু ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিলো মাত্র ৭ ভাগ। তথাপি বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানী শাসক ঘোষ্ঠী। বাংলার জনগণ শেষ পর্যন্ত— বুকের রক্ত দিয়ে ১৯৫২ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে।
বাংলা ভাষাকে ‘হিন্দুর ভাষা’ হিসাবে আখ্যা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাংলা অক্ষর ‘আরবী হরফে’ লেখারও ষড়যন্ত্র করেছিলো। পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৪ বছরের অভ্যন্তরীন ঔপনিবেশিক শাসনের পুরো সময়টা জুড়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত ও বাংলা নববর্ষ উদযাপনের ওপরে আঘাত এসেছে। ১৯৬৭ সালে সামরিক একনায়ক আইয়ুব খান রেডিওতে রবীন্দ্র সঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করেন। একই বছর তিনি বাংলা নববর্ষ উদযাপনেও বিধি নিষেধ আরোপ করেন।
(গ) অর্থনৈতিক বৈষম্য : পাকিস্তানের দু’অংশে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিলো অত্যন্ত— প্রকট। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিনিয়োগের মাত্র ২৬ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারণ করা হয়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় তা ছিলো যথাক্রমে - ৩১ ও ২৬ ভাগ। বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তি ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাকে ভয়াবহভাবে বঞ্চিত করা হয়। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, স্টেট ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকসমূহের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে থাকায় অর্থ পাচার হত অবাধে। উদ্বৃত্ত আর্থিক সঞ্চয় পশ্চিম পাকিস্তানে জমা থাকত। যার ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়ে উঠতে পারেনি৷ বৈদেশিক ঋণের শতকরা ৯০ থেকে ৮৫ ভাগ ব্যয় করত পশ্চিম পাকি¯—ান আর বাকি ১০ থেকে ১৫ ভাগ খরচ করত পূর্ব পাকিস্তানে । পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় দ্বিগুণ। অথচ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের দু’অংশে মাথাপিছু আয় প্রায় সমান ছিলো।
ঘ.১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্য ও ব্যর্থতার কারণ :
১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ূব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জাকে বিতাড়িত করে রাষ্ট্র- ক্ষমতা দখল করেন। রাজনীতি ও রাজনীতিবদদের প্রতি আইয়ূব খানের শ্রদ্ধা ছিলো না। এজন্য তিনি পাকি¯—ানে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক কর্মকাÊ নিষিদ্ধ করেন। পোডো (চঙউঙ) এবং এবডো (ঊইউঙ) নামক দু’টি আদেশ জারি করে শত শত রাজনীতিবিদকে নিষিদ্ধ করেন। একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অপবাদ ঘুচানোর জন্য তিনি ১৯৬০ সালে তদানীন্তন বিচারপতি মো: শাহাবুদ্দিনকে সভাপতি করে একটি ‘সংবিধান কমিশন’ গঠন করেন। তথাপি সংবিধান কমিশনের রিপোর্ট অগ্রাহ্য করে আইয়ূব খান পাকিস্তানকে একটি উদ্ভট সংবিধান উপহার দেন। তিনি ১৯৫৬ সালের সংবিধানে প্রণীত সংসদীয় গণতন্ত্রসহ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও নাগরিক অধিকার বাতিল করেন। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে এক অদ্ভুত ব্যবস্থা চালু করে সরকার নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করেন।১৯৬২ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খান প্রণীত সংবিধান স্বৈরাচারমূলক একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্ম দেয়। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এ সংবিধানের লক্ষ্য ছিলো না। এ সংবিধানের একমাত্র লক্ষ্য ছিলো আইয়ূব খানের ক্ষমতাকে সুসংহত করা। আইয়ূব প্রবর্তিত সংবিধান সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্রপতির
স্বৈরশাসনের নীল নকশা ছিলো। নিম্নে এ সংবিধানের প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করা হলো :
* ১৯৬২ সালের সংবিধানের বৈশিষ্ট্যসমূহ :
১। ইসলামী প্রজাতন্ত্র : আইয়ূব খানের সংবিধান ১৯৫৬ সালের সংবিধানের মতো পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করে। সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, পাকিস্তান আইন পরিষদ কোরআন ও সুনড়বাহ পরিপন্থী কোন আইন পাশ করতে পারবে না। সংবিধানে ইসলামী আইন প্রণয়নের জন্য পরামর্শ দানের লক্ষ্যে আলেম সমাজ নিয়ে একটি পরামর্শ সভা বা কাউন্সিল গঠনের ঘোষণা দেয়া হয়।
২। লিখিত সংবিধান : ১৯৬২ সালের সংবিধান ছিলো লিখিত এবং অত্যন্ত বৃহৎ। ১২টি অংশে বিভক্ত এই সংবিধান ২৫০টি ধারা ও ৩টি তালিকা ছিলো।
৩। মৌলিক গণতন্ত্র : ১৯৬২ সালের সংবিধানে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ নামে এক অভিনব ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। ভোটারগণ সরাসরি ভোট দিয়ে মৌলিক গণতন্ত্রীদের নির্বাচন করতেন। আর মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা গঠিত নির্বাচকমন্ডলী প্রেসিডেন্ট, জাতীয় পরিষদের সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত করবে বলে বিধান রাখা হয়।
৪। যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা : এ সংবিধান পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। পূর্ব -পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান এ দু’প্রদেশের সমন্বয়ে পাকিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।
৫। এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা : ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ন্যায় ১৯৬২ সালের সংবিধানেও কেন্দ্র ও প্রদেশে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রবর্তন করা হয়। এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অনুকূল ছিলোনা।
৬। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার : এ সংবিধানে পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। প্রেসিডেন্ট ছিলেন রাষ্ট্রের প্রকৃত শাসক। মন্ত্রিপরিষদ প্রেসিডেন্টের নিকট দায়ী ছিলেন।
৭। মৌলিক অধিকার : ১৯৬২ সালের সংবিধানে প্রথমত, কোনো মৌলিক অধিকারের কথা উলে−খ করা হয়নি। পরবর্তীকালে দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক অধিকারের একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়।
৮। মূলনীতি : ১৯৬২ সালের সংবিধানে ২১টি নীতি নির্ধারকমূলক নীতিমালা সংযুক্ত ছিল। এগুলো আদর্শমাত্র কিন্তু আইনগত কোনো ক্ষমতা ছিল না। সরকারের নীতি নির্ধারণে এগুলো আদর্শ হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
৯। আইনপরিষদের কেন্দ্র ঢাকা : এ সংবিধানে বলা ছিল, রাজধানী ঢাকার এলাকা হবে কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের কেন্দ্র এবং ইসলামাবাদ হবে সরকারের প্রধানকেন্দ্র।
১০। দুষ্পরিবর্তনীয় : ১৯৬২ সালের সংবিধান দুষ্পরিবর্তনীয় প্রকৃতির ছিল। এর পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও সংশোধনের জন্য বিশেষ পদ্ধতির ব্যবস্থা ছিল। জাতীয় পরিষদের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যদের সম্মতিসহ রাষ্ট্রপতির সম্মতিক্রমে সংবিধান সংশোধন করা যেত।
১১। বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ : ১৯৬২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ হতে পৃথক করার ব্যবস্থা করা হয়।
১২। বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ : ১৯৬২ সালের সংবিধানে পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সমতা আনয়নের ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু ফলাফল এর বিপরীত হয়েছিল।
১৩। বিষয় তালিকা : এ শাসনতন্ত্রে একটিমাত্র বিষয় তালিকা ছিল। সংবিধানের তৃতীয় তালিকায় জাতীয় পরিষদের আওতাভুক্ত বিষয়ের বিবরণ দেওয়া হয়। তালিকাবহির্ভূত অবশিষ্ট বিষয়সমূহ প্রাদেশিক আইনপরিষদের ওপর ন্যস্ত ছিল।
১৪।প্রস্তাবনা : এ সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা সংযোজন করা হয়। এতে বলা হয়, সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর ওপর অর্পিত হবে। তবে জনগণ এ ক্ষমতা পবিত্র আমানত হিসেবে ব্যবহার করবে।
১৫। গণভোটের বিধান : এ সংবিধানে গণভোটের পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়। রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পরিষদ সদস্যদের মধ্যে কোনো বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিলে বিষয়টি গণভোটের মাধ্যমে সমাধা করার বিধান রাখা হয়।
১৬। সমতার নীতি গ্রহণ : এ সংবিধানে কেন্দ্রীয় সরকারের সকল ক্ষেত্রে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সমতার নীতি বজায় রাখার ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
১৭। রাষ্ট্রভাষা : এ সংবিধানে বাংলা ও উর্দু উভয়কেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।
১৮। কমিশন গঠন : কেন্দ্রীয় সরকার ও প্রাদেশিক সরকারগুলো মধ্যে রাজ্য বণ্টনের সুপারিশ করার জন্য জাতীয় অর্থকমিশন ও দেশের সর্বোচ্চ অর্থনৈতিক পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা এ সংবিধানে সন্নেিবশিত হয়।
১৯। কেন্দ্রীভূত শাসন : ১৯৬২ সালের সংবিধানের আওতায় রাষ্ট্রপতি, জাতীয় ও প্রাদেশিক আইন সভার সদস্যবৃন্দ ৮০,০০০ মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা নির্বাচিত হতেন, জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রীগণ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত ও তাঁর মর্জির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। কেন্দ্রীয় আইনসভা ছিল তাঁর আজ্ঞাবহ। প্রদেশের গভর্নরগণও রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হতেন। একমাত্র তাঁর কাছে জবাবদিহি করতেন। এভাবে আইয়ুব প্রবর্তিত ব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন ক্ষমতার মধ্যমনি। তাঁকে কেন্দ্র করে সব কিছু আবর্তিত-নিবর্তিত হয়েছে। ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্টের অনেকটা মধ্যযুগের রাজার মতো ক্মষতা ছিলো ।
২০। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অনুপস্থিতি : ১৯৫৬ সালের সংবিধানে লাহোর প্রস্তাবের আলোকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়া হয়। কিন্তু আইয়ূব প্রবর্তিত সংবিধানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন উপেক্ষিত ছিলো। প্রেসিডেন্ট নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রিয় আইনসভা যে কোন বিষয়ে আইন প্রণয়ন ক্ষমতা রাখত।
* ১৯৬২ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণ :
আইয়ূব প্রবর্তিত সংবিধান পাকিস্তানের জনগণের আশা-আকাঙ্খা পূরণ করতে পারেনি। এই সংবিধান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা বাতিল করে শক্তিশালী কেন্দ্রিয় শাসন চালু করে। ফলতঃ পূর্ব-বাংলার মানুষ এ সংবিধান গ্রহণ করেনি। উপরন্তু কেন্দ্রিয় শাসন শক্তিশালী হওয়ায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালির মুক্তিসনদ ‘ছয়দফা’ উত্থাপন করেন। ছয়দফাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। আইয়ুব খানের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের উভয় অংশে ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলন শুরু হয়। গণ-আন্দোলনের চাপে আইয়ূব খান পদত্যাগে বাধ্য হন। বাতিল হয়ে যায় তার প্রবর্তিত উদ্ভট সংবিধান। নিম্নে ১৯৬২ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণগুলো আলোচনা করা হলো :
১। মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণের আক্রোশ : আইয়ূব খানের সংবিধানে ৮০ হাজার ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’র পদ সৃষ্টি করা হয়। এই মৌলিক গণতন্ত্রীদের হাতে ছিলো ইউনিয়ন কাউন্সিল, পৌরসভা প্রভৃতি পরিচালনার ভার। এরা জনগণের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ-সম্পদ, রিলিফ, অনুদান লুট-পাট করে খেত। সরকার তথা আইয়ূব খানকে অন্ধভাবে ভোট দানের শর্তে প্রশাসন মৌলিক গণতন্ত্রীদের অন্যায় কাজ মেনে নিত। ফলে অতি দ্র“ত জনগণ এদের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে। এ কারণে মৌলিক গণতন্ত্র কোন জনভিত্তি পায়নি।
২। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন উপেক্ষা : ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী আইন পরিষদে পূর্ব-পাকিস্তানের যথাযোগ্য প্রতিনিধিত্ব ছিলো না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিও এ সংবিধান উপেক্ষা করে। ফলে বাঙ্গালিরা এ সংবিধান ও প্রেসিডেন্ট আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলে। গণঅভ্যুত্থানে আইয়ূব খানের পতনের সঙ্গে সঙ্গে তার সংবিধানেরও মৃত্যু ঘটে।
৩। রাষ্ট্রপতির স্বেচ্ছাচার : ১৯৬২ সালের সংবিধান সংসদীয় গণতন্ত্রের বদলে রাষ্ট্রপতি শাসিত শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে। পাকিস্তানের খন্ডিত ভৌগলিক অবস্থান ও গণমানুষের রাজনৈতিক চিন্তা -ধারার সঙ্গে এ ব্যবস্থার বিরোধ ছিলো। উপরন্তু সংবিধান রাষ্ট্রপতি তথা আইয়ূব খানের হাতে বিপুল ক্ষমতা অর্পণ করে। রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচারী শাসকে পরিণত হয়। যার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে সংবিধান ব্যর্থ হয়।
৪। অর্থনৈতিক বৈষম্য সৃষ্টি : ১৯৬২ সালের সংবিধান দ্বারা প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থা পাকিস্তানের দু’অংশের মধ্যে ব্যাপক অর্থনৈতিক বৈষম্যের সৃষ্টি করে। সরকারের আর্থিক নীতিগুলো পশ্চিম পাকিস্তান ঘেঁষা হওয়ায় পূর্ব-বাংলা ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়। ফলে অর্থনৈতিক অসমতার বির“দ্ধে ন্যায়সঙ্গত দাবির প্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলার জনগণ এক দুর্বার রাজনৈতিক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর ফলে সাংবিধানিক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
৫। অগণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সৃষ্টি : ১৯৬২ সালের সংবিধান চূড়ান্ত বিশেষণে এক অগণতান্ত্রিক ও
স্বৈরাচারী শাসনের নীলনকশা। জনগণের মৌলিক অধিকারের নীতিসমূহ এতে যথাযোগ্য সম্মান পায়নি। বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকেও এ সংবিধান উপেক্ষা করেছিল।
ঙ. ১৯৫৬ ও ১৯৬২ এর সংবিধানে পূর্ব বাংলার অবস্থান :
পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে বাঙ্গালি মুসলমানের অগ্রণী ভূমিকা ছিলো। লাহোর প্রস্তাবের উত্থাপনকারী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ছিলেন একজন বাঙ্গালি। আবার লাহোর প্রস্তাব সংশোধন করে ‘এক পাকিস্তান’ সৃষ্টির উত্থাপক সোহরাওয়ার্দীও ছিলেন বাঙ্গালি । মূলতঃ ’৪৬ এর প্রাদেশিক নির্বাচনে বাংলা প্রদেশে মুসলিম লীগের ব্যাপক বিজয়ে পাকিস্তান দাবি প্রথম গণভিত্তি পায়। পাকিস্তানে বাঙ্গালিরাই ছিলো সংখ্যাগুরু। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই পূর্ব বাংলা ও বাঙ্গালিরা অবহেলার শিকার হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙ্গালি মুসলমান তার আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের যে স্বপ্ন দেখেছিলো, ১৯৪৭ পরবর্তী রাজনৈতিক বা¯—বতায় তা ভেঙ্গে যায়। পূর্ব বাংলা অব্যাহতভাবে পাঞ্জাবী তথা পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক চক্রের শোষণের শিকার হয়েছে। ১৯৫৬ ও ’৬২ এর সংবিধানে পাঞ্জাবী শাসকগোষ্ঠীর এ মনোভাবই ফুটে উঠেছে। উভয় সংবিধানে বাঙ্গালির আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে। তবে এ কথা ঠিক দু’টি সংবিধানের মধ্যে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে বাঙ্গালির কিছুটা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো। সীমিত হলেও ১৯৫৬ সালের সংবিধান প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলেছিলো। কিন্তু ১৯৬২ সালের আইয়ূব খানের সংবিধান কেন্দ্রীয় শাসনের নামে পূর্ব বাংলার (পূর্ব পাকিস্তান ) সম- রাজনৈতিক অধিকার হরণ করে। নম্নিে এই দুই সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থানের তুলনামূলক আলোচনা করা হলো :
• ১৯৫৬ ও ১৯৬২ এর সংবিধানের তুলনামূলক আলোচনা :
(১) পূর্ব বাংলার অসম প্রতিনিধিত্ব :
পাকিস্তানের পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী ছিলো ৫৬ ভাগ। সঙ্গত: কারণেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে গণপরিষদ, সরকারী চাকরি, নীতি-নির্ধারণী পর্ষদ, প্রশাসন সকল ক্ষেত্রে বাঙ্গালির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কথা ছিলো। কিন্তু পাকিস্তানে ঘটেছে উল্টোটা।
পাকিস্তানের উভয় সংবিধানে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিত্ব ছিল নগণ্য। ১৯৪৭ সাল থেকেই পাকিস্তানের অবাঙালি শাসকগণ পূর্ব বাংলাকে গ্রহণ করেছিল একটি উপনিবেশ হিসেবে। পূর্ব বাংলার বাঙালি জনগণের মর্যাদা, দাবি-দাওয়া, আশা-আকাঙ্খাকে তাই তারা কোনদিন গ্রাহ্য করেনি। ১৯৫৬ সালের সংবিধানে যে সংখ্যা সাম্যনীতি অনুসৃত হয় তাতে জনসংখ্যানুপাতে পূর্ব বাংলা বঞ্চিত হয়। তবুও যেটুকু অংশীদারিত্ব ছিল তার অবসান ঘটে ১৯৬২ সালের সংবিধান প্রণীত হবার পর। কেননা, রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত হয় সকল নির্বাহী কর্তৃত্ব। এছাড়াও নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। এরা প্রায় সকলেই ছিলেন অবাঙালি। ফলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব তথা প্রশাসনের সর্বক্ষেত্রে অসম প্রতিনিধিত্বের সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রিয় প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীতে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব ৫ ভাগে নেমে আসে।
(২) প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন উপেক্ষা:
পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই বাঙ্গালিরা লাহোর প্রস্তাবের আলোকে ব্যাপক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করে। বাঙ্গালির সে দাবি ৯ বছর উপেক্ষিত হয়েছে। সংবিধানের অনুপস্থিতির সুযোগে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় তথা আমলাতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা কায়েম হয়। ১৯৫৬ সালে সংবিধান প্রণীত হয় মূলতঃ মারী চুক্তির ভিত্তিতে। মারী চুক্তিতে পাকিস্তানের দুই প্রদেশকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দেয়ার কথা ছিলো। কিন্তু পাকিস্তানের ১৯৫৬ সালের প্রথম সংবিধানে পূর্ব বাংলাকে সীমিত স্বায়ত্তশাসন দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় সরকার ও রাষ্ট্রপতি পূর্ব পাকিস্তানের সরকারের ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছে। এ সংবিধান অনুযায়ী অর্থনৈতিক সব ¶মতা ছিলো কেন্দ্রের হাতে। উপরন্তু প্রাদেশিক সরকারকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা ছিলো কেন্দ্রীয় সরকারের। তথাপি এ সংবিধান ১৯৬২ সালে প্রবর্তিত আইয়ূব খানের সংবিধানের তুলনায় ভাল ছিলো। আইয়ূবের সংবিধান রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা চালু করে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি বাতিল করে দেয়।
(৩) অর্থনৈতিক বৈষম্য :
১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকিস্তানের উভয় অংশে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের তেমন কোন দিক নির্দেশনা ছিলো না। ১৯৬২ সালের সংবিধানের অধীনে অর্থনৈতিক বৈষম্য আরও বেড়ে যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পশ্চিম পাকিস্তানে বড় বড় মিল, কলকারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। জাতীয় উৎপাদনের
ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের অবদান হয়ে দাঁড়ায় প্রায় দ্বিগুণ। পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের বাজারে পরিণত হয়।
(৪) রাজনৈতিক বৈষম্য :
১৯৫৬ সালের সংবিধানে পাকি¯—ানের রাজনীতিতে অনেকটা অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু ষড়যন্ত্রের কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় নেতারা তাদের অংশীদারিত্বকে ধরে রাখতে পারেনি। ১৯৬২ সালের সংবিধান অনুযায়ী রাজনৈতিক অংশীদারিত্ব পূর্ব পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রে প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে আসে। ১৯৬২ এর সংবিধান অনুযায়ী পাকি¯—ানের শাসন ব্যবস্থা কতিপয় জেনারেল ও উচ্চপদস্থ আমলার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এরা সকলে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের। কেননা, সেনাবাহীতে কোন উচ্চপদস্থ বাঙ্গালি অফিসার ছিলো না।
(৫) প্রশাসনিক বৈষম্য :
পাকিস্তানের উভয় সংবিধানে দেশটির প্রশাসনিক বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে কোন দিক-নির্দেশনা ছিল না। প্রশাসনে বাঙালিদের উপস্থিতি ও ভূমিকা ছিল খুবই নগণ্য। ১৯৪৭-৬৬ সাল পর্যন্ত— প্রশাসনে বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা ছিল প্রথম শ্রেণীতে ২৩%, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ২৬%, তৃতয়ি শ্রণীতে ২৭% এবং চতুর্থ শ্রেণীতে ৩০% মাত্র। প্রশাসনে সর্বময় ¶মতার অধিকারী সচিব পদমর্যাদার বাঙ্গালি কর্মকর্তা ছিলো খুবই নগণ্য। উপরন্তু, তারা গুর“ত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেতেন না। ১৯৫৬ ও ’৬২ এর সংবিধান আমলাতন্ত্রে বাঙ্গালির অংশ গ্রহণ বৃদ্ধির জন্য কোন বিশেষ নীতিমালা প্রণয়ন করেনি।
(৬) বাংলা ভাষার অবস্থান :
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে বাধ্য করে। পাকিস্তানের দু’সংবিধানই বাংলা ভাষাকে দেশটির অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর ঔপনিবেশিক মানসিকতাই পাকিস্তানের ১৯৫৬ ও ১৯৬২ সালের সংবিধানে ফুটে উঠেছে।প্রকৃতপক্ষে, পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক-প্রশাসনিক অংশ গ্রহণ বৃদ্ধি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন্নের লক্ষ্যে এ দুই সংবিধান প্রণীত হয়নি। (চলবে) ৷
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনটে ৷
লেখক : ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফসের, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টটিউট, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টিমেম্বার আইইউবি এন্ড বাউবি , গবেষক ও লেখক এবং সদস্য, সম্পাদকমন্ডলী, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডশেন র্জানাল ৷
বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫৮:৫৩ ১২৭৮ বার পঠিত #কলাম #চুক্তি #মুক্তিযুদ্ধ #সামরিক বাহিনী #সামরিক শাসন