সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১

দুই দশকে সাফল্যের অগ্রযাত্রায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সিলেট - আহমদ হোসেন হেলাল

Home Page » সাহিত্য » দুই দশকে সাফল্যের অগ্রযাত্রায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সিলেট - আহমদ হোসেন হেলাল
সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১



আহমদ হোসেন হেলালসাহিত্য সমাজের আয়না। কখনো কখনো এটাকে দর্শন বলা হয়। সাহিত্যের মাধ্যমেই সমাজের পরতে পরতে ঝেঁকে বসা অন্যায়-অত্যাচার যেমন ফুটে উঠে, তেমনই মানুষের আনন্দ-বেদনার চিত্রও সামনে ভেসে আসে। এজন্য বলা হয়ে থাকে, সাহিত্য একজন ব্যক্তি নির্মাণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ব্যক্তি নির্মাণেই একটি আদর্শ জাতির নির্মাণ হয়। সামগ্রিকতার বিচারে সাহিত্যকে ব্যক্তির জীবনদর্শন বললেও অত্যুক্তি হবে না। কারণ, কোনো লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিই তার লেখায় ফুটে উঠে। কখনো লেখক অন্যের দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। তাই সাহিত্য একটি জাতি নির্মাণের জন্য সবচেয়ে অনিবার্য প্রয়োজন। এর প্রাসঙ্গিকতাকে অস্বীকার করা নিজেদের অস্তিত্বকে ভুলে থাকার শামিল। যে জাতি তার নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে সাহিত্যে ফুটিয়ে তুলতে পারে না, সে জাতি কালের গর্ভে হারিয়ে যায়। আবার যে জাতি নিজস্ব স্বকীয়তাকে সাহিত্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে পারে, তাদেরকে ইতিহাস থেকে দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। তারা কখনো ইতিহাস থেকে হারিয়ে যায় না। এজন্য সাহিত্যের রয়েছে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। দূরদর্শী এবং প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব মাত্রই সাহিত্যের মূল্যায়ন করে থাকেন। এই সাহিত্যকে বাঁচিয়ে রাখে প্রকাশনা শিল্প। প্রকাশনাকে শিল্প বললাম এই কারণে যে, সাহিত্যই হচ্ছে শিল্প। শিল্পকে যে বাঁচিয়ে রাখে তাকে তো শিল্প বলাই যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া একে শিল্পের রক্ষকও বলা যায়।

সাহিত্যে সিলেট অঞ্চল একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের অংশ। বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের অবদান একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসের দাবীদার। কারণ বাংলাসাহিত্যে যেমনই সিলেটি লেখককের অবদান স্বীকৃত তেমনই বাংলাসাহিত্যের আদি নির্দশন চর্যাপদেরও অনেক কবি ছিলেন সিলেটি। তাদের কেউ কেউ সিলেটি নাগরী লিপি নিয়ে কাজ করেছেন। আর অন্যরা সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। এছাড়া বৈষ্ণব পদাবলির মূল সত্তা চৈতন্যদেবও ছিলেন সিলেটের মানুষ। এজন্য বলা হয়ে থাকে, ‘সিলেট মধ্যমা নাস্তি’। উপমহাদেশের বিশিষ্ট রম্যলেখক ড. সৈয়দ মুজতবা আলী থেকে শুরু করে আশরাফ হাসান সাহিত্যরত্ন, অন্ধ কবি আর্জুমান্দ আলী, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, কবি দিলওয়ার, কবি আফজাল চৌধুরী, সৈয়দ মোস্তফা কামাল, অধ্যাপক আসদ্দর আলী, সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম প্রমুখ ব্যক্তিত্বরাই সিলেটের সম্পদ। এছাড়াও এ অঞ্চলের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চায় এগিয়ে আছেন প্রফেসর মো. আব্দুল আজিজ, প্রফেসর নন্দলাল শর্মাসহ অনেক কৃতি ব্যক্তিত্ব। তাদের অবদানের কারণেই বাংলাসাহিত্যে সিলেটিদের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাসাহিত্যে যেমন সিলেটি লেখকদের অবদান স্বীকৃত, তেমনই প্রকাশনা সাহিত্যেও সিলেট অনেক দূর এগিয়ে আছে। প্রকাশনা সাহিত্যেও সিলেটি প্রকাশকরা স্বর্ণোজ্জ্বল ভূমিকার দাবীদার। কারণ, এ দেশের অন্যতম প্রাচীন সাহিত্য প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সিলেট, যার প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে। এর প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় অবদান রাখছে। এই প্রতিষ্ঠানের প্রভাবেই সিলেটে গড়ে ওঠেছিল অসংখ্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। তাদেরই অন্যতম হলো সিলেটের সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘পাণ্ডুলিপি প্রকাশন’। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের প্রতিষ্ঠার যে প্রেক্ষাপট, সে সময়েও কলকাতায় এবং ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ছিল অনেক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। তবে এ প্রেক্ষাপটে সিলেটও পেছনে পড়ে থাকে নি। কলকাতা এবং ঢাকার পাশাপাশি সিলেটেও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশনী গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রখ্যাত গবেষক প্রফেসর নন্দলাল শর্মার উক্তি এখানে প্রণিদানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ব্রিটিশ আমলে সিলেটে তিনটি সাহিত্য সংগঠন সক্রিয় ছিল। এগুলো হচ্ছে শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ (১৯৩৫), মুসলিম সাহিত্য সংসদ (১৯৩৬) এবং হবিগঞ্জ সাহিত্য সভা (১৯৪৫)। এর মধ্যে মুসলিম সাহিত্য সংসদ ১৯৩৯ থেকে কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ নামে পরিচিতি লাভ করে। যা সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চায় এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে দুটো প্রতিষ্ঠান বই প্রকাশ করতো। এই প্রকাশনীগুলোই সিলেটের আদি প্রকাশনী হিসেবে স্বীকৃত। তবে শ্রীহট্ট সাহিত্য পরিষদ তাদের প্রকাশনা থেকে ছয়টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিল। আর কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ অসংখ্য গ্রন্থ প্রকাশ করে যার ধারা এখানো অব্যাহত আছে।

এভাবেই সিলেটে সাহিত্যের চর্চায় গড়ে ওঠেছে অসংখ্য প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সিলেটে প্রকাশনা শিল্পের ইতিহাসে ২০০০ খ্রিস্টাব্দে যাত্রা শুরু করে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন। তাই বলা যায়, পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের যাত্রা একবিংশ শতাব্দীর শুরুর প্রাক্কালে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকার অগ্রযাত্রী। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান দুই হাজারেরও বেশি গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। এ প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান এখন বিশটি বছর পেরিয়ে একুশ বছরে পা দিয়েছে।

‘ঐতিহ্য-সন্ধানে দৃঢ়কল্প’ স্লোগানকে ধারণ করে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন ‘প্রবন্ধ, বিজ্ঞান বিষয়ক, গবেষণা, স্মৃতিকথা, জীবনী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক রচনা, ভ্রমণকাহিনি, অনুবাদ, উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, নাটক, রম্য, রহস্য থ্রিলার, ছড়া-কবিতা, গল্প, শিশুতোষ, স্মারক/ম্যাগাজিনসহ বহুমুখী গ্রন্থ প্রকাশ করে আসছে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন বাংলা, ইংরেজি, আরবি, নাগরীসহ বিভিন্ন ভাষায় গ্রন্থ প্রকাশ করেছে।

পাণ্ডুলিপি প্রকাশন-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে সাহিত্য প্রকাশের মাধ্যমে একটি সুন্দর সমাজ গঠন করা। এজন্য পাণ্ডুলিপি প্রকাশন শেকড়কে তুলে আনতে বদ্ধপরিকর। ঐতিহ্য ও নতুনকে আধুনিকতায় রূপ দিতে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন অনুসন্ধানী হিসেবে কাজ করছে। সৃজনশীল কর্মকুশলতায় দৃঢ়কল্প থেকে সত্য ও সুন্দরের প্রকাশে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন তারুণ্যের স্বপ্নচারণের সহযাত্রী হিসেবে ভূমিকা রাখছে। একটি আদর্শ সমাজ গঠনের অভিপ্রায়ে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সবার চিন্তা-চেতনার অভিযাত্রী হতে চায় এবং এ লক্ষ্যেই পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের অগ্রযাত্রা।

একুশ বছরের এই দীর্ঘ যাত্রায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিদের গ্রন্থ প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে। এই গ্রন্থগুলো এক একটি সোনালি ইতিহাসের ধারক এবং বাহক হিসেবে ভূমিকা রাখছে। শিক্ষাবিদ, গবেষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার এবং আলেম উলামাসহ সব মিলিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ব্যক্তির গ্রন্থ প্রকাশে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন অনেক এগিয়ে আছে।

বাংলাভাষা আমাদের মাতৃভাষা। এই ভাষায় মেশানো আছে আমাদের স্বকীয়তা এবং আত্মত্যাগের স্বজাত্যবোধ্যতা। এই ভাষার চর্চা এবং প্রসারই এর প্রতি সুষ্টু সম্মান ও মর্যাদা জানানোর নামান্তর। তাই ভাষার মাসে আয়োজিত বিভিন্ন বইমেলায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন প্রতিবারই অংশগ্রহণ করে আসছে। বাংলাদেশের প্রাচীনতম সাহিত্য প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ আয়োজিত প্রতিটি বইমেলায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন অংশগ্রহণ করেছে। যা সিলেটের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। এছাড়া কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অনুষ্ঠিত বইমেলায়ও অংশগ্রহণ করে থাকে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন।

পাণ্ডুলিপি প্রকাশন বিশ্বাস করে গুণীজনদেরকে সম্মান জানানোর অর্থই হচ্ছে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দেওয়া। তাঁদেরকে এমন একটি রাস্তা দেখিয়ে দেওয়া যাতে তারাও ভবিষ্যতে ঐ গুণী ব্যক্তিত্বের মতো জীবন গড়তে পারে। পাশাপাশি এর মাধ্যমে গুণীজনদের মহৎ কর্মের প্রতিও সম্মান জানানো হয়। বাংলাসাহিত্যের কিংবদন্তি সাহিত্যিক ও গবেষক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, যে দেশে গুণীর কদর নেই, সেখানে গুণীজন জন্ম হয় না। দেশমাতৃকা ও গুণীজনদের প্রতি সম্মান জানানোর লক্ষ্য নিয়েই পাণ্ডুলিপি প্রকাশন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২১ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ও ২৪ মার্চ সিলেট নগরীর দরগাহ গেইটস্থ কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের সাহিত্যসভা হলে দুই দিন ব্যাপী বইমেলা ও গুণীজন সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এর মাধ্যমে যেমন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রতি সম্মান জানানো হয়, তেমনি একটি দায়বদ্ধতা নিয়ে কাজ করার জন্য পাণ্ডুলিপি প্রকাশন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। দুই দিনব্যাপী আয়োজনের দ্বিতীয় দিনে অর্থাৎ ২৪ মার্চ অত্যন্ত আনন্দঘন পরিবেশে গুণীজনদেরকে সম্মাননা প্রদান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে যাদেরকে সম্মাননা প্রদান করা হয় তাঁরা হলেন-বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, লেখক ও গবেষক প্রফেসর নন্দলাল শর্মা, শিক্ষাবিদ, লেখক ও সংগঠক লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ আলী আহমদ, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সুচিকিৎসক প্রফেসর ডা. আজিজুর রহমান, বিশিষ্ট সমাজসেবী ও সুচিকিৎসক প্রফেসর ডা. শামীম আহমদ, কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট বেলাল আহমদ চৌধুরী, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধ গবেষক, লেখক ও সংগঠক আনোয়ার শাহজাহান এবং যুক্তরাজ্য প্রবাসী কবি, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক গুলশান আরা রুবী। অনুষ্ঠানের অতিথিবৃন্দ পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের এই আয়োজনকে ভূয়সী প্রশংসার মোড়কে আবদ্ধ করেন। উক্ত অনুষ্ঠানে সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। যা ছিল পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের জন্য অন্যতম পাওয়া।

দুই দশকের চেয়ে বেশি সময় প্রকাশনা জগতে টিকে থাকায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের সম্মান ও মর্যাদা দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশেও স্থান করে নিয়েছে। মূলত পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের একাগ্রতা এবং নিষ্ঠতা এর পেছনে ব্যাপক প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এ পর্যন্ত অসংখ্যবার ভারত্যের আসাম রাজ্যের শিলচরসহ ভারতের অন্যান্য এলাকায় অনুষ্ঠিত বইমেলায়ও অংশগ্রহণ করেছে। এতেও পাণ্ডুলিপি প্রকাশন পাঠক এবং দর্শকদের মধ্য থেকে অভূতপূর্ব সাড়া এবং ভালোবাসা অর্জন করেছে। এতেও পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের বেড়ে গেছে দায়বদ্ধতা।

এছাড়াও যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত বইমেলা ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত বইমেলায় পাণ্ডুলিপি প্রকাশন অংশগ্রহণ করেছে। এতেও পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের সুনাম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া এর মাধ্যমে পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের সামাজিক এবং বৈশ্বিক দায়বদ্ধতা আরো বেড়ে গেছে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এই দায়বদ্ধতার কারণে ভীত কিংবা শঙ্কিত নয়। বরং ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং শেকড়ের সন্ধানে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন আরো বেশি তাড়না নিয়ে কাজ করবে।

পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের ঝুলিতে সঞ্চিত হয়েছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ সম্মাননা এবং মর্যাদা। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন’-এর মাধ্যমে সাহিত্যচর্চায় যুক্ত থাকায় আসাম বিশ্ববিদ্যালয় শিলচরের আমন্ত্রণে ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে তিনদিন ব্যাপী ‘স্বাধীনতাপূর্ব  শ্রীহট্টের পাণ্ডুলিপি ও পাণ্ডুলিপি বিশারদগণ-গুরুত্ব ও সার্বিকতা’ শীর্ষক সেমিনারে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী লেখক, প্রকাশক ও সংগঠক বায়েজীদ মাহমুদ ফয়সল স্মারক সম্মাননা লাভ করেন। এটাও ছিল পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের জন্য অন্যরকম একটি সম্মান। এছাড়া ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে ‘প্রকাশনা ও সম্পাদনায়’ বিশেষ অবদানের জন্য পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সম্মাননা স্মারক লাভ করে। এটা পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের ভাবমূর্তিকে আরো উজ্জ্বল করে দেয়। এছাড়া ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত-আসামের কাছাড় থেকে আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্র-এর পক্ষ থেকেও সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়। ‘সাউথ আসাম মিডিয়া অ্যাসোসিয়েন’ এ সম্মাননা স্মারক তুলে দেয়।

আসাম বিধান সভার ডেপুডি স্পিকার আমিনুল হক লস্কর, আসামের বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা ‘সাময়িক প্রসঙ্গ’-এর সম্পাদক তৈমুর রাজা চৌধুরী, সহ সম্পাদক মিলন উদ্দিন লস্কর, ইন্দো-বাংলা মৈত্রী শিলচরের সেক্রেটারী শুভদ্বীপ দত্ত মলয় প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়াও পাণ্ডুলিপি প্রকাশন বিভিন্ন সময় দেশ-বিদেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান করেছে। বিশেষ করে, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের একদল বরেণ্য শিক্ষাবিদকে সংবর্ধনা ও সম্মাননা প্রদান করেছে। এই সময় ভারতের আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ড. বিশ্বতোষ চৌধুরী, প্রফেসর ড. বেলা দাশ, ড. দেবাশিস ভট্টাচার্য, ড. প্রিয়কান্ত নাথ, ড. বরুণজ্যোতি চৌধুরী, ড. রামী চক্রবর্তী, ড. রমাকান্ত দাশ, নিলামবাজার কলেজ, করিমগঞ্জ-এর বাংলা বিভাগের প্রফেসর ড. সর্বজিৎ দাশ প্রমুখ গুণীব্যক্তিদেরকে সম্মাননা ও সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গ পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের এই আয়োজনকে বরাক-সুরমার সাহিত্যের মেলবন্ধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার সহযোগী হিসেবে অবদান রাখবে বলে ভূয়সী প্রশংসা করেন।

পাণ্ডুলিপি প্রকাশন যেভাবে লেখকদের গ্রন্থ প্রকাশে ভূমিকা রাখে, তেমনই নতুন লেখক সৃষ্টিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। ‘পাণ্ডুলিপি’ ছোটকাগজের মাধ্যমেই এ কাজ সম্পন্ন হয়। এ ছোটকাগজে যেমন দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের লেখা ছাপা হয়, তেমনই নতুনদের সৃষ্টিশীল লেখাকেও বেশ প্রাধান্য দেওয়া হয়। বিশেষ করে নতুনদের মধ্যে অত্যন্ত প্রতিশ্রুতিশীল এবং সম্ভাবনাময় তাদেরকে এ ক্ষেত্রে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ‘পাণ্ডুলিপি’ ছোটকাগজে লিখেছেন এমন অনেক কবি-সাহিত্যিক বর্তমানে সাহিত্যে একটি ভালো অবস্থান সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। নতুনদের ভেতর থেকে তাদের প্রতিভাকে টেনে আনার জন্য পাণ্ডুলিপি প্রকাশন আরো বিচিত্রধরনের সভার আয়োজন করে থাকে। বিভিন্ন সময় পাক্ষিক সাহিত্যপাঠ ও মুক্ত আড্ডার আয়োজন করা হয়। এতে ধ্রুপদী সাহিত্যপাঠের পাশাপাশি স্বরচিত লেখাপাঠের আয়োজন করা হয়। এছাড়াও দেশের প্রথিতযশা এবং বিখ্যাত লেখক-গবেষক ও সাহিত্যবোদ্ধাদের সাহিত্য-কর্ম নিয়ে আলোচনা করা হয়। যা নতুনদের চিন্তার বিকাশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর বাইরেও বিভিন্ন সময় দেশের বাইরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের আমন্ত্রণ করে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। এতেও সাহিত্য সম্পর্কে নতুন জগতের উন্মোচন হয়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এসকল গবেষক তাদের চিন্তাচেতনাকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেন। বিধায় অনেকেই চিন্তাশীলতায় ঋদ্ধতার আবেশ লাভ করে থাকেন। তাছাড়া পাণ্ডুলিপি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়োজন এক ভিন্নমাত্রিকতার দাবীদার। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এই আয়োজন নিয়মিতই করে থাকে।

পাণ্ডুলিপি প্রকাশন’ বিশ্বাস করে, একটি আদর্শ সমাজ গঠনের পূর্বশর্ত হচ্ছে মানুষকে সার্বজনীন বিশ্বাসবোধ এবং কর্মপন্থা অনুসরণে উদ্বুদ্ধ করা। এ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পাণ্ডুলিপি প্রকাশনও এ থেকে দায়মুক্তির পথে হাঁটে না। বরং পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এ লক্ষ্যেই পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সার্বজনীন বিশ্বাসবোধ এবং কর্মপন্থাকে ছড়িয়ে দিতে অসংখ্য ধর্ম-দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের সবচেয়ে বৃহত্তর প্রজেক্ট হচ্ছে যুক্তরাজ্য প্রবাসী বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শায়খ শফিকুর রহমান আল মাদানী অনূদিত সহজ বাংলায় কুরআনুল কারিমের তরজমা ‘আল কুরআনুল কারিম’। পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের মুদ্রণে এ পর্যন্ত ছয় হাজারেরও বেশি কুরআনের কপি দেশ-বিদেশের বিশিষ্টব্যক্তিত্বের হাতে উপহারস্বরূপ প্রদান করা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে একটি বড় উদ্যোগ। এছাড়াও একে বিশ্বের বাংলাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যেও কর্মপন্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এ উদ্যোগটি একটি আদর্শ সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখবে। ব্যক্তিকে পরিবর্তন করে দেওয়ার যে দিক-নির্দেশিকা তার পুরোটাই আছে এ কুরআনে। তাই পাণ্ডুলিপি প্রকাশন একটি আদর্শ সমাজ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

হাঁটি হাঁটি পা পা করে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন একুশ বছরে পা দিয়েছে। নিঃসন্দেহে এ যাত্রাটা অনেক কষ্টের। বন্ধুর পথে বাড়ানো অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। তারপরও দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে একটি আদর্শ সমাজ গঠনের প্রত্যয় রেখেই আমাদের পথচলা। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন বিশ্বাস করে সেই কথা, যা কোনো এক কবি বলেছেন-‘পৃথিবীতে যখন এসেছিস, দাগ রেখে যা।’ অর্থাৎ, পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের অগ্রযাত্রার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে এ সমাজ এবং রাষ্ট্রের জন্য এমন কিছু সৃষ্টিশীল কাজ রেখে যাওয়া, যা যুগ যুগ ধরে মানুষকে প্রেরণা দেবে। সত্য ও সুন্দরের পথে চলতে উৎসাহ যোগাবে। আজ বোধ হয়, এই মহতি লক্ষ্য বিদ্যমান ছিল বলেই দুইটি দশক পেরিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। প্রকাশনা জগতে বিলাসিতার কোনো স্থান নেই। বরং আছে আত্মত্যাগের মহতি অভিপ্রায় এবং ইচ্ছে। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এটাকে হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছে। তার পেছনের কারণ হচ্ছে সমাজের জন্য কিছু রেখে যাওয়া। যাওয়াটাই যেখানে ত্যাগ, সেখানে কিছু রেখে যেতে হলে ত্যাগই করতে হয়। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সেটাই করছে।

দার্শনিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্লেটো বলেছেন, ‘Every heart sings a song, incomplete, until another heart whispers back. Those who wish to sing always find a song. At the touch of a lover, everyone becomes a poet.’ অর্থাৎ, ভালোবাসার সংস্পর্শে সবাই কবি হয়ে যায়। অন্য হৃদয়ের সাড়া পাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতিটি হৃদয় একটি অসম্পূর্ণ গান গেয়ে চলে। যারা গাইতে চায় তারা সব সময়ই একটি গান খুঁজে পায়। তাই ভালোবাসার সংস্পর্শে সবাই কবি হয়ে যায়। এখানে যদি প্লেটোর কবিত্বের ধারণাকে মূল সাহিত্য বিবেচনা করি, তবে বলতে হয়, ভালোবাসার স্পর্শেই সবাই সাহিত্যিক হয়ে যায়। পাণ্ডুলিপি প্রকাশন সেই ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে চায় সবার মধ্যে। এর লক্ষ্য কেবল মানুষকে কবি কিংবা সাহিত্যিক হিসেবে গড়ে তোলা নয়, বরং তাদের মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করা। এটা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য। যা পাণ্ডুলিপি প্রকাশন লালন করে আসছে তাঁর প্রতিষ্ঠার পর থেকে।

সাহিত্যের ধারায় চিন্তাজগতে যে বৈপরিত্যভাব পরিলক্ষিত হয়, পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এটাকে পরিবর্তন করে দিতে চায়। এ লক্ষ্যেই প্রারম্ভ থেকে এখনো ভূমিকা রাখছে। আদর্শিক ভাবনা থেকে কমিটমেন্টের ক্ষেত্রে পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এক চুলও ছাড় দেয় না। এটাই পাণ্ডুলিপি প্রকাশনের অনন্যতা। সবচেয়ে উত্তম সেবাটা দিয়েই পাণ্ডুলিপি প্রকাশন এগিয়ে যাচ্ছে। আর এটাই রাখবে। সিলেটের সাহিত্য-সংস্কৃতির জগতে পাণ্ডুলিপি তার শেষ অবধি সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে এটাই আমাদের প্রত্যয়।

লেখক : কবি, সাংবাদিক ও ঔপন্যাসিক।

বাংলাদেশ সময়: ১৯:৫৭:৪২   ৯৫৬ বার পঠিত   #  #  #