সোমবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১

ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –র্পব- ৪৯”

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –র্পব- ৪৯”
সোমবার, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১



নতুন প্রজন্মের চোখে মুক্তিযুদ্ধ

৪.ভাষা আন্দোলন : এই কলামের শুরুর দিকেরকয়েকটি পর্বে ‘ভাষা আন্দোলন’সর্ম্পকে আমরা বিস্তারিত জেনে নিয়েছি ৷
৫. ১৯৫৪ সালরে নির্বাচন ও পর্রবতী ঘটনাপ্রবাহ :
ক. ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন : ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন পূর্ব-বাংলার জন্য তো বটেই সমগ্র পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ঘটনা। মুসলিম লীগের পরাজয়ের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় নতুন রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। বাঙ্গালি জাতিয়তাবাদকে কেন্দ্র করে এদেশের জনগোষ্ঠী ঐকবদ্ধ হয়। সূচনা করে স্বাধিকার ও স্বায়ত্ত্বশাসনের আন্দোলন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে একক নেতৃত্ব দিয়েছে মুসলিম লীগ। পূর্ব বাংলার মুসলিম জনতা পাকিস্তানের এই দলটির পতাকাতলে সমবেত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম লীগ মূলতঃ পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবী শাসক গোষ্ঠীর শাসন-শোষণের হাতিয়ারে পরিণত হয়। মুসলিম লীগ বাংলা ভাষার প্রশ্নে ছাড়াও পদে পদে বিভিন্নভাবে বাঙ্গালির স্বার্থবিরোধী অবস্থান নেয়। এর ফলে দলটির সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষের দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। মুসলিম লীগ নেতৃত্বও বিষয়টি আঁচ করতে পারে। ১৯৪৯ সালের টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে দলটির ভরাডুবি মুসিলম লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাসের বিষয়টি নিশ্চিত করে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের সকল প্রাদেশিক আইন পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো। ১৯৫১ সালে পাঞ্জাব ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে সিন্ধু প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পূর্ব-বাংলার প্রাদেশিক নির্বাচন শাসকগোষ্ঠী নানা অজুহাতে বিলম্বিত করে। ১৯৪৬ সালে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য দ্বারা প্রাদেশিক আইনসভা চলছিলো। পূর্ব বাংলায় ’৫০ এর দশকের শুরুতে প্রাদেশিক নির্বাচনের দাবি জোরালো হয়ে ওঠে। জনতার দাবির প্রেক্ষিতে সরকার ১৯৫৩ সালে ভারত শাসন আইনের নির্বাচনী - ধারায় কিছুটা সংশোধন এনে ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনের দিন ধার্য করে।

খ. যুক্তফ্রন্ট গঠন : ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগ বিরোধী পূর্ব বাংলার কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী জোট গঠন করে। এই জোট ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে পরিচিত। প্রধান বিরোধীদল আওয়ামী মুসলিম লীগ ছিলো জোট গঠনের মূল উদ্যোক্তা। ১৯৫৩ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ‘যুক্তফ্রন্ট’ গঠনের সিদ্ধান্ত— গৃহীত হয়। যুক্তফ্রন্টে মূলতঃ চারটি রাজনৈতিক দল ছিলো। এগুলো হলো −
১. মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী মুসলিম লীগ।
২. ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-শ্রমিক পার্টি।
৩. মাওলানা আতাহার আলীর নেতৃত্বাধীন নিজাম-ই-ইসলামী এবং
৪. হাজী দানেশের নেতৃত্বাধীন বামপন্থী গণতান্ত্রিক দল।
নির্বাচন যুক্তফ্রন্ট প্রতীক হিসাবে বেছে নেয় ‘নৌকা’ প্রতীক। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনকে সামনে রেখে ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। মুসলিম লীগ ও পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্যের বিরোধিতা ছিলো জোটের ভিত্তি।
গ. যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা : বাঙ্গালি জাতিয়তাবাদী চেতনাকে গুরুত্ব দিয়ে যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-বাংলার আর্থ-সামাজিক উন্রয়নের লক্ষ্যে ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। ভোটারদের আকৃষ্ট করার বিষয়টি ছিলো ঘোষিত ২১ দফার মূল লক্ষ্য। তবে তাতে ভবিষ্যৎ পূর্ব বাংলার রূপ-কাঠামো নির্ধারনের বিষয়টিও স্থান পায়। নিমেড়ব ২১ দফা কর্মসূচি আলোচনা করা হলো−
(১) বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে মর্যাদা দান।
(২) বিনা খেসারতে জমিদারী প্রথার উচ্ছেদ সাধন করে ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বণ্টন।
(৩) ‘পাট’ ব্যবসায়কে জাতীয়করণ করে চাষীদেরকে পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদানের ব্যবস্থা করা।
(৪) সমবায় কৃষি-ব্যবস্থার প্রবর্তন সহ কুটির শিল্পের বিকাশ সাধন।
(৫) পূর্ব বাংলাকে লবণের ক্ষেত্রে স্বনির্ভর করে তোলার জন্য লবণ শিল্পের বিকাশ সাধন ।
(৬) সেচ ব্যবস্থার উন্নতি সাধনসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা।
(৭) বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের জন্য জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ।
(৮) পূর্ব বাংলায় শিল্পায়ন । শিল্প শ্রমিকদেরকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সর্বপ্রকার অধিকার ভোগের নিশ্চয়তা প্রদান।
(৯) অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার প্রবর্তন করা। শিক্কষদের ন্যায্য বেতন, ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান।
(১০) সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভেদ বিলোপ করে সমগ্র মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্গঠন করা। মাতৃভাষা বাংলা হবে শিক্ষার মাধ্যম।
(১১) বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত সকল প্রকার কালা-কানুন বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাষিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা।
(১২) প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচনের মাধ্যমে নিম্ন বেতনভুক্ত সরকারি কর্মচারীদের বেতনের মধ্যে সামঞ্জস্য আনয়ন।
(১৩) সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি ও জনপ্রীতি উচ্ছেদ।
(১৪) সকল রাজবন্দীকে বিনাশর্তে মুক্তি দান। বাক-স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ।

(১৫) শাসন বিভাগকে অবশ্যই বিচার বিভাগ হতে পৃথক করে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
(১৬) ‘বর্ধমান হাউস’কে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগারে পরিণত করা।
(১৭) ভাষা শহীদদের স্মৃতিকে স্মরণ করার জন্য ‘শহীদ মিনার’ নির্মাণ ।
(১৮) ২১ ফেব্র“য়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে ঘোষণা করে তা সরকারি ছুটি দিবস হিসেবে পালন।
(১৯) লাহোর প্রস্তাবের আলোকে পূর্ব-বাংলাকে পূর্ণ - স্বায়ত্ত্বশাষন প্রদান। নৌবাহিনীর সদর দপ্তর (সাবেক) পূর্ব পাকিস্তানে স্হানান্তর ৷
(২০) যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোন ভাবেই আইনসভার আয়ুষ্কাল বর্ধিত করবে না। সাধারণ নির্বাচনের ৬ মাস পূর্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে এবং অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে।
(২১) আইনসভায় কোন আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ এবং যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীরা পর পর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হলে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা স্বেছ্ছায় পদত্যাগ করবে।

ঘ.১৯৫৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল : ১৯৫৪ সালের ৮ মার্চ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৩০৯টি আসনের মধ্যে মুসলমানদের জন্য সংরক্ষিত ছিল ২৩৭টি আসন। যুক্তফ্রন্ট ২২৩টি আসন জয়লাভ করে। এর মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগ পায় ১৪৩টি আসন, প্রদত্ত ভোটের ৬৪ ভাগ লাভ করে মুসলিম লীগ বিরোধী যুক্তফ্রণ্ট। অন্যদিকে সরকারী দল মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন, তবে তা ছিল প্রদত্ত ভোটের ২৭ ভাগ। বাকি ৫টি মুসলিম আসনের ৪টি পায় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এবং একটি পায় খেলাফত-ই-রব্বানী পার্টি। এছাড়া নারীদের জন্য সংরক্ষিত ৯টি আসনের সবকটিই যুক্তফ্রন্ট লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে পূর্ব বাংলায় প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা গঠন করে।

এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থে কেন্দ্রীয় মুসলীম লীগ বিরোধী বিভিন্ন সম-মনা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করতে শিখিয়েছিল৷ ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ৷যুক্তফ্রন্টের প্রধান অঙ্গদল পূর্ব-পাকিস্তানের আওয়ামী মুসলিম লীগ শুরুতে মন্ত্রিসভায় যোগদান না করলেও পরবর্তীতে তারা যোগদান করেন ৷এ সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কিছুটা অসুস্হ হয়ে পড়েন ৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মন্ত্রিসভার একজন মন্ত্রী হিসেবে মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হকের নেতূত্বে শপথ গ্রহন করেন৷মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক প্রতিরক্ষা,মুদ্রা ও পররাষ্ট্রনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকার পক্ষে মত প্রকাশ করেন যা কিনা যুক্তফ্রন্টের অনেক নেতা-কর্মী মেনে নিতে পারে নি ৷ তারা চেয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ব বাংলার জন্য পৃথক প্রতিরক্ষা, পৃথক মুদ্রা ও পৃথক পররাষ্ট্রনীতি ৷
১৯৫৪ সালের মে মাসে কলকাতা সফর কালে শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক বলেন, “দুই বাংলার (পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা অর্থাৎ বর্তমানের কলকাতা )জনগণের মধ্যে মৌলিক সত্যের উপলদ্ধি তৈরী হওয়া খুবই জরুরী এবং এই পদ্ধতিতে সহযোগিতার মাধ্যমে এ অঞ্চলের জীবনযাত্রা উন্নত হবে একে অপরের ৷ রাজনীতিবিদরা রাজনীতির মাধ্যমে তাদের আবাসভূমি ভাগ করেছে কিন্তু সাধারন মানুষ তাই করে যাতে তারা শান্তিপূর্নভাবে বাস করতে পারে ৷বাংলা ভাষা দুই বাংলার লোকের মধ্যে ঐক্যের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে এটা ঐতিহাসিকভাবে সত্য “৷ তিনি কোনো দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক বিভাজনে বিশ্বাসী ছিলেন না ৷ তাঁর এ বক্তব্য ও বিশ্বাস পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম বাংলার জনগণকে তাদের নিজ নিজ ধর্ম ও ভৌগলিক সীমারেখার প্রতি আনুগত্যকে ছাপিয়ে মানসিকভাবে তাদেরকে এক অভিন্ন জাতিতে পরিণত করে, যে জাতির নাম ‘বাঙ্গালি জাতি’৷ কলকাতায় দেয়া তাঁর এ বক্তব্যের কারনে শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হককে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের রোষানলে পরতে হয়ছিল ৷ এসময় তাঁর সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ভুল বোঝাবোঝির সৃষ্টি হয় ৷ যুক্তফ্রন্টের সদস্যরা মূলতঃ তখন পূর্ব -পাকিস্তানের পরিপূর্ন স্বাধীনতা না চেয়ে বরং অভ্যন্তরীন স্বায়ত্ত্বশাষন চেয়েছিল৷কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার পরিপূর্নভাবে পূর্ব-পাকিস্তানকে তাদের নিয়ন্ত্রনে রাখতে চেয়েছিল ৷
তাই “প্রাদেশিক সরকার পূর্ব-পাকিস্তানে প্রভিশন অনুযায়ী প্রশাসন চালাতে পারছে না ” - এই মিথ্যা অভিযোগ এনে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের ৬ সপ্তাহের মাথায় এই মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় এবং এর স্বপক্ষে যুক্তি দাঁড় করানো হয় যে,”যুক্ত ফ্রন্টের মন্ত্রীরা দেশের অখণ্ডতার প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত” ৷এর ফলে কেন্দ্রীয় সরকার পূনরায় পূর্ব-পাকিস্তানকে দমন-পীড়নের ক্ষমতা পেয়ে যায় ৷এ সময় উভয় পাকিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার উভয় পাকিস্তানের কমিউনিস্ট নেতাদের বেধরম গ্রেফতার করে জেল-হাজতে পাঠায় ৷পাণ্জাবীদের সম্পর্কে বাঙ্গালিদের বিরূপ ধারনা ক্রমশঃ বেড়ে ঘৃনায় পরিণত হছ্ছিল৷এ সময় দেশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় গভর্নর ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ’ এ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে.ফজলুল হককে তাঁর টকাটুলিস্হ বাসভবনে নজরবন্দি এবং যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার আরেক তরুন মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান (আওয়ামী লীগ নেতা)কে গ্রেফতার করা হয় ৷মাওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন দেশের বাইরে অবস্হান করার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তখন চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়ে৷এই মন্ত্রিসভা বাতিল করে মেজর জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা কে পূর্ব - পাকিস্তানের নতুন গভর্নর নিযুক্ত করা হয় এবং কেন্দ্রীয় পাকিস্তান আর্মির কমান্ডার -ইন-চীফ (সেনাপ্রধান) আইয়ূব খানকে কেন্দ্রীয় পাকিস্তানের ক্ষমতা হাতে নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় এবং শুরু হয় এক স্বৈরশাষনের কাহিনী৷

ঙ.১৯৫৪ সালের নর্বিাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় ও মুসলিম লীগের পরাজয়ের কারণ : পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে মুসলিম লীগ। ১৯৪৬ সালে বাংলা প্রদেশে দলটির ব্যাপক বিজয় পাকিস্তান দাবিকে গণভিত্তি দান করে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক বছরের মধ্যে মুসলিম লীগ পূর্ব-বাংলায় প্রতিক্রিয়া শীল বিরোধী দলে পরিণত হয়। সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আওয়ামী মুসলিম লীগের উত্থান ঘটে। বিভিন্ন কারণে ১৯৫৪ এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় হয়। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো−
১। জোট গঠন : নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে পূর্ব-বাংলায় মধ্যপন্থি, বামপন্থি, ইসলাম পন্থীদের সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠন করা হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বাধীন এই জোট যুক্তফ্রন্ট নামে পরিচিত। অন্যদিকে মুসলিম লীগ নির্বাচনে এককভাবে অংশ গ্রহণ করে। বাংলায় মুসলিম লীগ বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ অবস্থান দলটির পরাজয় নিশ্চিত করে।
২। রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিরোধ : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম সংঘাত ঘটে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন কে কেন্দ্র করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী পূর্ব-পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মুখের ভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যণ্ত্র করতে থাকে। রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন সংঘবদ্ধ হতে হতে সর্বশেষে গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। এসময় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম লীগ বিরোধী মানসিকতায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে রায় প্রদান করে।
৩। মুসলিম লীগের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনে অনীহা : ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি তৎকালীন পূর্ব বাংলার মুসলিম জনগোষ্ঠীকে পাকিস্তান আন্দোলনে ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুসলিম লীগ সরকার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। উপরন্তু এ ধরনের চিন্তাধারাকে বিচ্ছিন্নতাবাদ বলে আখ্যায়িত করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এ ধরনের বঞ্চনা ও প্রতারণা মেনে নিতে পারেনি। তাই ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। বাঙ্গালি স্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে পুর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাষনে মুসলিম লীগ প্রধান বাধা। তাই তাকে হঠাতে হবে।

৪। যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচি : যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহারের মধ্যে পূর্ববাংলার সাধারণ কৃষক-শ্রমিক সকলের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেছিল। যুক্তফ্রন্টের ইশতেহার জনগণকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিশ্রুতি, প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, দ্রব্যমূল্য হ্রাস কর্মসূচি জনমনে আশার আলো সৃষ্টি করে। অথচ মুসলিম লীগ স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষা বিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে তোলে। মুসলিম লীগ কেবল এই প্রচার চালায় ‘ ইসলাম বিপনড়ব’। বাংলার জনগণ এই প্রচারে কর্ণপাত করেনি। মুসলিম লীগের মুখপাত্র ‘দৈনিক আজাদ’ যথার্থই এ দলের পরাজয়ের জন্য বাংলাভাষা প্রশ্নকে সঠিকভাবে মোকাবেলা না করা, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রতি অবহেলা, পূর্ববাংলার অর্থনৈতিক দুর্গতি, সাধারণ জনগণ থেকে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের বিচ্ছিনড়বতাকে দায়ী করে। নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগ নেতাদের নানা দুর্নীতি, দোষ-ত্রুটি জনগণের সামনে উপস্থাপন করে। কিন্তু মুসলিম লীগ তা মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়।
৫। সংখ্যাসাম্য নীতি উপেক্ষা: ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের— মূলনীতি কমিটির যে তিনটি রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল তাতে কেন্দ্রীয় আইনসভার প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে সংখ্যাসাম্য নীতি গ্রহণ করা হয়নি। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটে।
৬। মুসলিম লীগের অন্ত:কলহ : লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ১৯৪৬ সালে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সে নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। কিন্তু নির্বাচনের কিছুদিন পরেই মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ভাঙন ধরে। ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ এক সম্মেলনে লাহোর প্রস্তাবকে সংশোধন করলে প্রখ্যাত মুসলিম লীগ নেতা আবুল হাশিম ঐ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। অন্যদিকে মুসলিম লীগ থেকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পদত্যাগ করে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগ গঠন করেন। মাওলানা ভাসানী ও এ কে ফজলুল হকসহ প্রমুখ নেতার মুসলিম লীগ ত্যাগ দলটিকে দুর্বল করে ফেলে।
৭। মুসলিম লীগের নির্যাতন : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ যখন অনুভব করে যে পরাজয় তাদের অনিবার্য তখন তারা বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের নির্যাতন শুরু করে। এটাও মুসলিম লীগের পরাজয়ের অন্যতম কারণ।
৮। সরকারি কর্মকর্তাদের দৌরাত্ম্য : পূর্ব বাংলায় উর্দু ভাষী ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, অহমিকা, পূর্ব বাংলার প্রতি অবজ্ঞা ও বঞ্চনা সাধারণ জনগণকে আন্দোলিত করে। ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। তারা যুক্তফ্রন্টকে জয়যুক্ত করে।
৯। যুক্তফ্রন্টের আবেদন : ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার জনপ্রিয় নেতাদের সমন্বয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় এবং এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ২১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। জনগণও দফাগুলোকে তাদের ভাগ্যোনড়বয়নের এবং গণতন্ত্র উদ্ধারের মুক্তিসনদ হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে যুক্তফ্রন্টের আবেদনে সাড়া দিয়ে পূর্ব বাংলার জনগোষ্ঠী মুসলিম লীগকে প্রত্যাখান করে।
১০। মুসলিম লীগের নেতৃত্বের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য : সমাজকাঠামোগত দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতারা ছিলেন উচ্চবিত্ত জমিদার, জোতদার, ধনী ও অভিজাতশ্রেণীর। অহমিকাবোধ ছিল এদের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তাঁরা পূর্ব বাংলার জনগণের স্বার্থের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। এ অসম আচরণের ফলে মুসলিম লীগ দুর্বল সংগঠনে পরিণত হয়।
১১। আর্থ-সামাজিক কারণ : পাকিস্তান সৃষ্টির আগে পূর্ব বাংলার জনগণের মধ্যে এ ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, পাকিস্তানের জন্ম হলে পূর্ব-বাংলার কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ একটি সুখী ও সুন্দর জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু পূর্ব বাংলার জনগণের এ আশা ছিল দুরাশা মাত্র। তাছাড়া এ সময় মুসলিম লীগ সরকারের আশ্রয়পুষ্ট মজুদদার, কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের দৌরাত্ম্যে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। এ ধরনের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা হ্রাস পায়।
১২। যুক্তফ্রন্টের জনপ্রিয় নেতৃত্ব : যুক্তফ্রন্টের জয়ের তিন প্রধান নেতা ছিলেন এ.কে. ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী। নেতৃবৃন্দ ছাড়াও বয়সে তরুণ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য ছাত্রনেতারা ছিল দলের বড় শক্তি। তরুণ ছাত্ররা এ দলের জয়ের জন্য ভূমিকা রাখেন। অপরপক্ষে, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ এ অঞ্চলে কখনো জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেনি। এদের বড় অংশ ছিলেন ধর্মান্ধ, গণবিচ্ছিন্ন ও শহরে এলিট।

১৯৫৪ সালের নির্বাচন বিভিন্ন কারণে বাংলার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ। এ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে বাংলার রাজনীতিতে পূর্বপাকিস্তান হতে মুসলিম লীগের চির বিদায় সম্পন্ন হয়। নতুন রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উত্থান ঘটে আওয়ামী মুসলিম লীগের। যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের মধ্যদিয়ে পূর্ব বাংলায় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির বিকাশ ঘটে। বিভিন্ন কারণে ১৯৫৪ এর নির্বাচনে মুসলিম লীগ পরাজিত হয়েছে। বাঙালি বিরোধী অবস্থান ও পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্শাসনের প্রশ্নে দলটির অনীহা মুসলিম লীগের পরাজয় ডেকে আনে। (চলবে)৷

ফারহানা আকতার

তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনটে ৷
লেখক : ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসয়িটে প্রফসের, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টটিউিট, ভিজিটিং ফ্যাকাল্টিমেম্বার আইইউবি এন্ড বাউবি, গবষেক ও লেখক এবং সদস্য, সম্পাদকমন্ডলী, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্নাল ৷ ৷

ফারহানা আকতারে নতুন বই

বাংলাদেশ সময়: ১৫:২৪:০২   ৮১২ বার পঠিত   #  #  #  #