সোমবার, ২৩ আগস্ট ২০২১

ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৪৭”

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৪৭”
সোমবার, ২৩ আগস্ট ২০২১



নতুন প্রজন্মের চোখে মুক্তিযুদ্ধ
৩.বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে (১৯৪৭-১৯৭১) রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট : এ অংশে গত পর্বে আমরা জেনেছি, ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির সময় পূর্ব বাংলায় অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান,পশ্চিম পাকিস্তান ও ভারতবর্ষে অর্থাৎ এ অঞ্চলে প্রধানতঃ তিনটি রাজনৈতিক দল বা ধারা বা মতবাদ বিদ্যমান ছিল ৷
১.ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম লীগ ( ১৯৪৭ ও এর পরবর্তী সময়ে এই দলটির জণ্ম ও আধিপত্ব ছিল সমগ্র পকিস্তানে অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ ও পূর্ব পাকিস্তানের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এর কেন্দ্রবিন্দুতে ) , ২.অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও গণতান্ত্রিক ধারার দল জাতীয় কংগ্রেস (১৯৪৭ এ ভারতবর্ষের বিভাজনের সময়ে ও পূর্ববর্তী সময়ে ভারতে এই রাজনৈতিক দলটির জণ্ম ও আধিপত্ব ছিল এবং মহাত্মা গান্ধী, নেতাজী সুভাষ বসু ও জওহরলাল নেহেরু ছিলেন এর কেন্দ্রবিন্দুতে) , ৩. বিপ্লবী সাম্যবাদী ধারার কমিউনিস্ট পার্টি ৷
১.ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম লীগ ( বাকী অংশটুকু) : হিন্দু মুসলিম এই দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্ম হয় ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাস্ট। এই জন্ম ছিল মূলত মুসলিম লীগের রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল। কিন্তু এর পরেই দেশটির রাজনীতিতে অভাবনীয় কিছু ঘটনা ঘটে যার একটি পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি মুসলিম লীগের হাতছাড়া হয়ে যাওয়া।
পাকিস্তানের জন্মের বীজ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সম্মেলনে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবকে। এই প্রস্তাবে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম অংশে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলো নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়।
বঙ্গীয় মুসলিম লীগের নেতা এবং বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এই প্রস্তাবটি পেশ করেন। পরে এই লাহোর প্রস্তাব ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ হিসেবে বিবেচিত হয়।
এর মাত্র ছয় বছর পর ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে বিভাজন আরো স্পষ্ট হয়। মুসলিম এলাকায় মুসলিম লীগের প্রার্থী এবং হিন্দু এলাকায় কংগ্রেসের প্রার্থীরা জয়ী হয়।
মূলত : মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতেই মুসলমানরা দলে দলে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে সেসময় মুসলিম লীগকে ভোট দিয়েছিল।
লর্ড মউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের জুন মাসে ঘোষণা করেন যে ব্রিটিশ সরকার এই “ভারতবর্ষ বিভাগের/বিভাজনের নীতি ” মেনে নিয়েছে এবং ১৪ই অগাস্ট ব্রিটিশরা শাসনভার ছেড়ে দিলে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম হয় এ উপমহাদেশ ভেঙ্গে সৃষ্টি হয় “ভারত ও পাকিস্তানের “।
পাকিস্তানের ছিল দুটো অংশ- পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তান। পরের এক দশক ধরে পূর্ব পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল পূর্ব বাংলা। কিন্তু জন্মের পর থেকে একই দেশের এই দুটো অংশের মধ্যে বৈষম্য ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে।
রাজনৈতিক গবেষক ও লেখক মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর “আওয়ামী লীগ : উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০”— নামক গ্রন্থে লিখেছেন, “বাঙালি মুসলমান পরিচিত প্রতিবেশী হিন্দুর সঙ্গে এক রাষ্ট্রে বসবাস করবে না, এই লক্ষ্য নিয়ে অপরিচিত দূরবর্তী অঞ্চলের মুসলমানদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকিস্তান বানাল। তবে মোহভঙ্গ হতে দেরি হলো না”৷
মুসলিম লীগের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ঠিকই কিন্তু খুব শীঘ্রই পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি মুসলিম লীগের হাতছাড়া হয়ে গেল। সূচনা হলো নতুন এক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের।
শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে এরকম স্বপ্নভঙ্গের বহু ঘটনার উল্লেখ আছে। তাঁর একটি এরকম: “সেসময় মুসলিম লীগের নেতার নামে ‘জিন্নাহ ফান্ড’ নামে সরকার একটি ফান্ড খুলেছিল। তাতে যে যা পরে দান করার কথা থাকলেও কোথাও কোথাও জোরপূর্বক টাকা তোলা শুরু হয়”।
ওদিকে পাকিস্তানের জন্মের আগে থেকেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার রাজনীতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। এর কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
পাকিস্তানে মুসলিম লীগের কার্যকলাপে হতাশ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম তরুণরা ততদিনে সংগঠিত হওয়া শুরু করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয় ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি। আহবায়ক কমিটির মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানও ছিলেন।
পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বলেন, “উর্দু হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়”।
গবেষকরা বলছেন, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে পূর্ব পাকিস্তানের আপামর জনগোষ্ঠী “কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ” এর প্রতি আরো বেশি বিরূপ হয়ে পড়ে এবং তখন থেকেই রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়ে যায় ৷
এই আন্দোলনের প্রথম ধাপটি ছিল সরকারি দল “পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ” এর বিরোধী দল হিসেবে নতুন একটি রাজনৈতিক দলের অর্থাৎ “আওয়ামী মুসলিম লীগ”আবির্ভাব ঘটে মূলত: ” পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ” - ই এই নতুন নামে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করে যে দলটি মূলত: “পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ” এরই একটি বৃহৎ অংশ ৷দীর্ঘদিন ধরে “পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ”এর এই অংশটি ছিল গনতন্ত্রে বিশ্বাসী৷এই অংশে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় নেতৃবৃন্দ , যথাক্রমে,সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম,মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ ৷এই নেতারা “ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক রাজনৈতিক ধারার প্রতিনিধিত্বকারী পাকিস্তান কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ ” এর নানা অনিয়ম -অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে থাকেন এবং নতুন দলের গঠনতন্ত্র নির্মানে ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার আদায়ের লক্ষে মনোনিবেশ করেন ৷কারণ তারা দেখলো যে সরকার পরিচালনায় আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য তৈরি হয়েছে এবং সেখানে বাঙালির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই ৷ ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’।

‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ নামটি দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী যার অর্থ ‘জনগণের মুসলিম লীগ’। মুসলিম লীগের অগ্রগণ্য অনেক নেতা নতুন দলে যোগ দেন। জেলে আটক থাকলেও শেখ মুজিব হলেন যুগ্ম সম্পাদক।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “জেলে আটক অবস্থায় দলের একটি উঁচু পদে তার নির্বাচিত হওয়ার মাধ্যমে এটা অনুমান করা যায়, তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠক হিসেবে মনে করা হতো।”
আওয়ামী মুসলিম লীগ পরিচালনার ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন শেখ মুজিব। সোহরাওয়ার্দী তাকে খুব স্নেহ করতেন- পশ্চিম পাকিস্তানে গেলে তার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন, জামা কাপড় কিনে দিতেন। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলায় এলে শেখ মুজিব সব সময় তার সহযোগী হতেন।
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। পাঁচ দশক পরে এই দলটির রাজনৈতিক নেতৃত্বে পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে জন্ম হয় বাংলাদেশের।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী মনে করেন, “আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন ধরনের রাজনীতির সূচনা ঘটে, উন্মেষ হয় ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির”।
‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠনের সময় ও পরে শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ সময় কারাগারে আটক ছিলেন। যখন জেল থেকে বের হয়ে এলেন তখন মওলানা ভাসানীসহ তার রাজনৈতিক সহকর্মীরা জেলে বন্দী। এসময় তিনি সোহরাওয়ার্দীকে সাথে নিয়ে পূর্ব বাংলার জেলায় জেলায় ঘুরে সংগঠন গড়ে তুলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন: “এই সময় প্রায় প্রত্যেকটা মহকুমায় ও জেলায় আওয়ামী লীগ সংগঠন গড়ে উঠেছে। শহীদ সাহেবের সভার পরে সমস্ত দেশে এক গণজাগরণ পড়ে গেল। জনসাধারণ মুসলিম লীগ ছেড়ে আওয়ামী লীগ দলে যোগদান করতে শুরু করেছিল।”
রাজনৈতিক ভাষ্যকার মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন, “শেখ মুজিবের বয়স তখন ৩২ বছর। দেশের আনাচেকানাচে ঘুরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে মেশা, কর্মী সংগ্রহ ও যাচাই-বাছাই করা এবং প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকারবিরোধী সংগঠনকে মাঠ-পর্যায়ে বিস্তৃত করার গুরুদায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হয়েছিল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠলেন দলের প্রাণপুরুষ।”
পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে ‘ ইত্তেফাক’-পত্রিকাটির প্রকাশনা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। কারণ এক পর্যায়ে পত্রিকাটি আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রধান প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়। আর কোন পত্রিকায় মুসলিম লীগের খবর প্রকাশিত না হলেও ঠাই পেত ইত্তেফাকের পাতায়।
নবাবপুর রোড থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা শুরু হয়, অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হতো, এবং এক পর্যায়ে এটি বন্ধ হয়ে যায়।
পরে ১৯৫১ সালে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সম্পাদনায় আবার সাপ্তাহিক হিসেবে ছাপা হতে শুরু করে। এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ছাপা হতো।
দৈনিক হিসেবে ইত্তেফাকের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৩ সালে। তখন প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মওলানা ভাসানীর নাম ছাপা বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটি চালানোর খরচ দিতেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
মহিউদ্দিন আহমেদ বলছেন, “তিনি ইত্তেফাক চালাতেন। পশ্চিম পাকিস্তানে ওকালতি করে যত টাকা পেতেন এর একটা বড় অংক ইত্তেফাকের পেছনে খরচ করতেন।”
পত্রিকাটি পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়েছিল যার চেয়ারম্যান ছিলেন সোহরাওয়ার্দী। শেখ মুজিবুর রহমানও ওই বোর্ডের সদস্য ছিলেন। পত্রিকাটি চলানোর ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের কাছ থেকেও অর্থ সংগ্রহ করে দিতেন।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি বৈষম্য এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতাদের ওপর পাকিস্তান সরকারের নির্যাতনের সংবাদ পত্রিকাটিতে নিয়মিত প্রকাশিত হতো যা আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করতে সাহায্য করে।উনিশ’শ বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন এবং আরো পরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়েও ইত্তেফাকের ভূমিকা ছিল।
পাকিস্তানের সূচনালগ্ন থেকে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলেও তা উত্তাল হয়ে ওঠে ১৯৫২ সালে যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন ঢাকায় এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় ঘোষণা করেন যে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি করে গঠিত হয় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যাতে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগেরই প্রাধান্য ছিল।
আন্দোলন দমন করতে ২০শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। পরদিন ২১ ও ২২শে ফেব্রুয়ারি আইন অমান্য করে মিছিল বের করলে পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে বেশ কয়েকজন নিহত হয়।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ছিল দ্বি-জাতি তত্বের ভিত্তির ওপর তৈরি। তার প্রধান উপাদান ছিল ধর্ম। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন রাজনীতির ক্ষেত্রে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করলো। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তার প্রধান উপাদান হল ধর্মনিরপেক্ষতা। ফলে বাঙালি মধ্যবিত্ত পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ থেকে বেরিয়ে আসা শুরু করলো। এটা ছিল মস্ত বড় পরিবর্তন।”
ভাষা আন্দোলনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং এ কে ফজলুল হক এদের তেমন কোন ভূমিকা ছিল না। তখন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব তরুণ কর্মীদের সামনে চলে আসেন।
পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হয়ে যায় ১৯৫২ সালে। তার পর থেকেই নিশ্চিত হয়ে যায় যে অচিরেই পূর্ব বাংলায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এই নির্বাচনকে সামনে রেখেই ১৯৫৩ সালে গড়ে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানে নতুন আরও একটি রাজনৈতিক দল , যার নাম “যুক্তফ্রন্ট”, এটি একটি রাজনৈতিক জোট । যুক্তফ্রন্টের সভাপতি হন তৎকালীন “পাকিস্তান কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ” এর সভাপতি হোসেন শহীদ সোহওরাওয়ার্দী। এই জোটের অন্তর্ভুক্ত ছিল ” পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ” (সভাপতি -মওলানা ভাসানী) এবং “পূর্ব পাকিস্তান কৃষক শ্রমিক পার্টি” (সভাপতি -এ কে ফজলুল হক) ।
পাকিস্তানের জন্মের পর কিছুদিন রাজনীতিতে ছিলেন না ফজলুল হক। তিনি পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অ্যাডভোকেট জেনারেল (এটর্নি জেনারেল) হিসেবে চাকরি করতেন। নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন এবং কিছু দিনের জন্য আওয়ামী মুসলিম লীগেও যোগ দান করেছিলেন। কিন্তু দলাদলির কারণে থাকতে পারেন নি। এসময় তিনি তার পুরনো দল কৃষক-প্রজা পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত করে গঠন করেন কৃষক-শ্রমিক পার্টি।
সোহরাওয়ার্দী করাচীতে বসবাস করলেও নির্বাচনকে সামনে রেখে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে এসে যুক্তফ্রন্টের সভা সমাবেশে বক্তব্য রাখতে শুরু করেন। বাঙালিদের মধ্যে তার জনপ্রিয়তা ছিল। পাকিস্তান গণপরিষদে বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন তিনি। পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা তাকে “ভারতের দালাল” বলে প্রচারণা চালিয়েছিল।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “প্রধানত এটা ছিল নির্বাচনী জোট। মুসলিম লীগকে ঠেকানোই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু তার ভেতরে মানুষের হতাশা, ক্ষোভ, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এসব কিছু যুক্ত হলো। এর মধ্যে ছিল পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতাও।”
নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক প্রচারণা শুরু হয়। এই নির্বাচনী ইশতেহার ছিল ২১ দফার যাতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের পরিষ্কার রূপরেখা তুলে ধরা হয়েছিল। এতে আরো ছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা।
এসময় শেখ মুজিব এক জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিতে পরিণত হন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে তিনি লিখেছেন: “আমার মনে আছে খুবই গরিব এক বৃদ্ধ মহিলা কয়েক ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে, শুনেছে এই পথে আমি যাব, আমাকে দেখে আমার হাত ধরে বললো, ‘বাবা আমার এই কুঁড়েঘরে তোমায় একটু বসতে হবে।’ আমি তার হাত ধরেই তার বাড়িতে যাই। অনেক লোক আমার সাথে, আমাকে মাটিতে একটা পাটি বিছিয়ে বসতে দিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান ও চার আনা পয়সা এনে আমরা সামনে ধরে বললো, “খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছুই নাই।’ আমার চোখে পানি এল।”
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে। নৌকা প্রতীক নিয়ে নিরঙ্কুশ জয় পায় যুক্তফ্রন্ট। ২৩৭টি মুসলিম আসনের এই জোটের প্রার্থীরা ২২৮টি আসনে জয়ী হয়। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ পায় মাত্র ৯টি আসন।
শেখ মুজিব লিখেছেন, “দুনিয়ার ইতিহাসে একটা ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পরাজয়ের খবর কোনোদিন শোনা যায় নাই। বাঙালিরা রাজনীতির জ্ঞান রাখে এবং রাজনৈতিক চেতনাশীল। এবারও তারা তার প্রমাণ দিল।”

মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, “যুক্তফ্রন্টের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল গ্রামের মানুষের কাছে ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের মতো একটি সংগঠিত রাজনৈতিক দল। এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী একটি অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে প্রচারে নামার ফলে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে গণজোয়ার তৈরি হয়।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পেছনে আরো একটি কারণ ছিল দুর্ভিক্ষ ও বন্যা। কিন্তু এবিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কোন তৎপরতা মানুষের চোখে পড়েনি যা পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্যে ব্যাপারে মানুষের চোখ খুলে দিয়েছিল।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, “১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ একচেটিয়া জয়লাভ করেছিল। সব মুসলিম ভোট তখন পাকিস্তানের পক্ষে পড়েছে। ওই নির্বাচনে মানুষ যেমন স্রোতের মতো গিয়ে ভোট দিয়েছে তেমনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনেও মানুষ স্রোতের মতো ভোট দিল। কিন্তু এবারের স্রোত গেল উল্টো দিকে( অর্থাৎ যুক্তফ্রন্টে)। কারণ পাকিস্তান তাদের কিছুই দেয়নি। উর্দু রাষ্ট্রভাষা হয়ে যাবে এই ভয়ও তাদের মধ্যে কাজ করছিল।”

নির্বাচনের পর যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে। পূর্ব পাকিস্তানে মুখ্যমন্ত্রী হন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। এই সরকারের মন্ত্রী হিসেবে শেখ মুজিব শপথ গ্রহন করেন কারন যদিও তিনি ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলীগ’ হতে ভোটে বিজয়ী হয়েছিলেন তথাপি তিনি এ মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিলেন (কারন তখন ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ও ‘পূর্ব পাকিস্তান যুক্তফ্রন্ট’ একত্রিত হয়ে পূর্ব পাকিস্তান হতে ভোটে দাড়িয়েছিল ও সর্বোপরি সরকার গঠন করা হয়েছিল) । কিন্তু সেই সরকার ৩রা এপ্রিল থেকে ৩০শে মে এই অল্প কিছু দিন স্থায়ী হয়েছিল।
রাজনৈতিক ইতিহাসবিদ ও বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক করাচীতে গিয়েছিলেন। ফেরার পথে সমস্ত ফ্লাইট ভারত হয়ে আসতো। ফেরার পথে তিনি কলকাতায় কয়েকদিন ছিলেন। সেখানে তিনি একটি জনসভায় ভাষণ দেন। বলেন পূর্ববঙ্গ আর পশ্চিমবঙ্গে আমাদের একই সংস্কৃতি একই ইতিহাস একই ঐতিহ্য। আমাদের আলাদা করে রাখা যাবে না। তখন তার বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতায় লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ আনা হয় এবং পূর্ব বঙ্গের মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান হতে কেন্দ্রীয় শাসন জারি করা হয়” ৷
এর পর ফজলুল হক গৃহবন্দী হন। শেখ মুজিবকে আটক করে আবার পাঠানো হয় জেলে। ভেঙে যায় ‘পূর্ব পাকিস্তান যুক্তফ্রন্ট’ । যুক্তফ্রন্টের বিজয়ের পর পূর্ব বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন এ কে ফজলুল হক। মওলানা ভাসানী এসময় এক শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে ইউরোপে ছিলেন। তার দেশে ফেরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কয়েক মাস বিদেশে অবস্থানের পর কলকাতায় কিছু দিন থেকে তিনি ফিরে যান ঢাকায়।
১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ ঋর কাউন্সিলে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে রাখা হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’। মওলানা ভাসানী দলকে অসাম্প্রদায়িক করে তোলার জন্য এই প্রস্তাব দেন এবং কাউন্সিলররা তা সমর্থন করেন। মওলানা ভাসানী সভাপতি ও শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দলটি সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রিক হওয়ায় আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় শেখ মুজিবের হাতে।১৯৫৬ সালে পাকিস্তানে নতুন সংবিধান চালু হলে পূর্ব বাংলার আনুষ্ঠানিক নাম হয় পূর্ব পাকিস্তান। সেবছর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পদত্যাগ করলে ‘আওয়ামী লীগ’ সরকার গঠন করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ‘হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী’ এর পরে ক্ষমতা আবার চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতাদের হাতে ৷ তখন দুই পাকিস্তানে শুরু হয় “আইয়ূব খানের স্বৈরশাসন ও শোষন” ৷তার শাসনামলের শুরু থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একটি আলাদা রাষ্ট্রের স্বপ্ব দেখতে শুরু করে এবং বিভিন্ন সময়ে আলাদা রাষ্ট্রের দাবীতে আন্দোলন সংগ্রামে জড়িয়ে পরে ৷ ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের এই আপামর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষনা করে ‘আওয়ামী লীগ’ এর নেতা কর্মীদের সহায়তায় ‘ছয় দফা দাবী’ পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পেশ করেন ৷ এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সকল নেতৃত্ব চলে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগের হাতে ৷ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এ দলটির সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ জনগণের ব্যাপক আস্হার পরিচয় বহন করে৷ মূলত: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হাত ধরে অর্থাৎ তাঁর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে আজকের ‘বাংলাদেশ’ এর জন্ম হয়েছিল এবং যেহেতু তিনি বাঙ্গালি জাতির জনক তাই তাঁর রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মকান্ড এ অংশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ৷
শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি তাঁর রাজনৈতিক কর্মকান্ড - গোপালগঞ্জে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সফরের সময়ই তাঁর সাথে কিশোর শেখ মুজিবুর পরিচয় হয়। তাদের মধ্যে কিছুদিন পত্রবিনিময়ও ঘটে। সে সময়ই গোপালগঞ্জে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে শেখ মুজিবের এক সহপাঠীকে স্থানীয় একটি হিন্দু পরিবারে আটকিয়ে রাখার ঘটনা নিয়ে মারামারি হলে তাঁকে জীবনের প্রথম জেলে যেতে হয়েছিল। আওয়ামী মুসলীম লীগ নেতা নূহ আলম লেনিন বলেছেন, “হিন্দু-মুসলিম ভেদাভেদের জেরে কিছু নেতিবাচক ঘটনার মুখোমুখি হলেও সেই কিশোর বয়সেও শেখ মুজিবের ওপর সাম্প্রদায়িক চিন্তা প্রভাব ফেলতে পারেনি।
“তাঁর যে মানস গঠন, সেটা কোনো সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে হয়নি। সেই কিশোর বয়সেই মাদারীপুরের পূর্ণ দাসের স্বদেশী আন্দোলনের গ্রুপের সাথেও তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছিল। আর তিনি ব্রিটিশ শাসন এবং জমিদারী প্রথার প্রতিও তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন”৷ “ইংরেজদের এদেশে থাকার অধিকার নেই। স্বাধীনতা আনতে হবে। আমিও সুভাষ বাবুর ভক্ত হতে শুরু করলাম। এই সভায় যোগদান করতে মাঝে মাঝে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর যাওয়া আসা করতাম। স্বদেশী আন্দোলনের লোকের সাথে মেলা মেশা করতাম” - লিখেছেন শেখ মুজিব।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সময়’-এই ‘শিরোনামে এক প্রবন্ধে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান লিখেছেন, মুসলিম লীগের রাজনীতিতেও উদার অংশের নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশিমের সাথে থেকে শেখ মুজিব রাজনৈতিক শিক্ষা নিয়েছেন। সেকারণে শুরু থেকেই অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির চিন্তা নিয়ে তার রাজনৈতিক মানস তৈরি হয়েছিল। শেখ মুজিব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবন নিয়ে গবেষণা করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত উপাচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশিদ। তিনি বলেছেন, “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর অল্প সময়ের মধ্যেই শেখ মুজিব অসাম্প্রদায়িক চিন্তা নিয়ে গণতন্ত্রের আন্দোলন শুরু করেন”।ফলে পরবর্তীতে “আওয়ামী মুসলীম লীগ” হতে “মুসলীম” কথাটি বাদ দেয়া হয় ৷
“বঙ্গবন্ধু কখনোই সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। মুসলিম লীগে থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন তিনি করেছেন, কিন্তু তাঁর রাষ্ট্র ভাবনায় ছিল ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সাথে আরও কিছু এলাকা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র।”
তিনি আরও বলেছেন, “১৯৪৭ সালে যখন সেই আন্দোলন ব্যর্থ হলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো - সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই নতুন করে তিনি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এবং দেখুন মাত্র সাড়ে চার মাসের মধ্যেই ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করলেন। আর ২২ মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করলেন মুসলিম আওয়ামী লীগের।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্নজীবনী’তেও পাকিস্তানের প্রতি মোহভঙ্গ হওয়ার বিষয়ে কয়েকবার উদাহরণ দিয়েছেন। “অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবোধ” থেকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক দর্শন হিসাবে নির্দিষ্ট করে আওয়ামী মুসলিম লীগের মাধ্যমে এগিয়েছেন বলে গবেষকরা বলেছেন। সেই আন্দোলনের একপর্যায়ে দলটির নাম থেকে “মুসলিম” শব্দ বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ করা হয়েছিল।পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ১৯৪৬ সালে ডাইরেক্ট অ্যাকশন একটি কর্মসূচি হয়েছিল। সেই কর্মসূচিতে ভয়ঙ্কর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা তিনি দেখেছেন। যা তিনি তার অসমাপ্ত আত্নজীবনীতেও লিখেছেন। ফলে তিনি সাম্প্রদায়িক মঞ্চে দাঁড়িয়েও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা করছেন।এরপর অল্প সময়ের মধ্যে ১৯৬৬ সালের ছয়দফা প্রস্তাব শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চিন্তা বাস্তবায়নের বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে কাজ করে। ছয়দফা প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে গণঅভ্যূত্থান এবং এরপরে ৭০এর নির্বাচন - এসব রাজনৈতিক ঘটনার মধ্যে দিয়ে শেখ মুজিব ধাপে ধাপে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ মুজিবকে তাঁর জীবনের চৌদ্দ বছরই কারাগারে কাটাতে হয়েছে। এরপরও রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে দৃঢ় অবস্থানে থেকে তিনি গোটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন। সেজন্যই সেই সময়ের অন্য সব নেতাকে ছাপিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা হয়েছিলেন তিনি এবং তাঁরই নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের। (চলবে)৷

ফারহানা আকতার

তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷লেখক: ফারহানা আকতার, পরিচালক ও সহযোগী অধ্যাপক, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, লেখক এবং গবেষক ৷

লেখকের অন্যান্য বই

বাংলাদেশ সময়: ১৫:৪৬:১৫   ১০৮৭ বার পঠিত   #  #  #  #  #