বুধবার, ৭ জুলাই ২০২১

কুসুম: পর্ব-৫: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » কুসুম: পর্ব-৫: স্বপন চক্রবর্তী
বুধবার, ৭ জুলাই ২০২১



স্বপন চক্রবর্তী

( একটি ছোট গল্প লেখার সামান্য প্রচেষ্টা)

ভাইটাকে অত্যন্ত স্নেহ করতো কুসুম। জীবনে আপন বলতে এখন সুরুজ। আপন বলতে এখন এই ভাই। তার জন্যই জীবন বাজি রেখে সে কাজ করে।

সে বছরে পূজা আসন্ন। প্রকৃতির সর্বত্রই তার আগমণী বার্তা বইছে। গাছে গাছে শেফালি ফুল ফোটতে দেখা যাচ্ছে। যদিও শহরে কালে-ভদ্রে দুএকটি মাত্র শেফালি গাছ চোখে পড়ে, কিন্তু গ্রামে গাছে গাছে শেফালী ফুল ফুটতে দেখা যাচ্ছে অনেক। ভোরে দুর্বা ঘাসের ডগায় দু’এক বিন্দু করে শিশির জমতে দেখা যায়। আকাশে সাদা মেঘের ভেলা একপ্রান্ত হতে অন্য প্রান্তে উড়ে উড়ে বুঝিবা পূজার বার্তাই প্রচার করছে। ভোরের দিকে সামান্য শীত শীত অনুভুত হয়। আমার স্ত্রী দীর্ঘ একটি তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বললো, এবারের পূজায় একবারেই যা না হলে নয়, তারই একটি লিস্ট তৈরি করলাম। পরে আরও কিছু মনে পড়লে তাও লিখে নিতে হবে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, প্রায় প্রতি বছরই কোন একটি সার্বজনীন দুর্গা পূজায় অংশ গ্রহন করে থাকি।

পূজায় সাধ্যমত কিছু খরচ করতে হয়। দুর্গাপূজা আমাদের মতো মধ্যবিত্ত লোকদের একার পক্ষে করা প্রায় অসম্ভব ব্যপার। তাই অন্য কোন পূজায় অংশ গ্রহন করি মাত্র। তাতে ছেলে-মেয়েরাও আনন্দ উপভোগ করে থাকে। সারা বছরের আনন্দ উৎসবের এটি একমাত্র উপলক্ষ্য। তার জন্য বিশাল অপেক্ষা। চাকুরীতে উৎসব বোনাস পেয়ে থাকি। সেটা পূজা উপলক্ষ্যে নয়,দুই ঈদে দুটি। সেই বোনাস আমাদেরকে একত্রেই পূজায় অথবা ঈদে প্রদান করা হয়। বোনাসের টাকা আবার সঞ্চয় করে রাখতে হয় পূজা পর্যন্ত, যে কাজটা খুব সহজ বলে আমি মনে করিনা। সঞ্চয় রাখাকে টাকা কামানোর চেয়েও বেশ কঠিন কাজ বলে আমার কাছে মনে হয়।

বাজারে যাবার পথে পকেট থেকে বের করে গিন্নীর দেওয়া ফর্দ খানাতে চোখ বুলাচ্ছিলাম। পূজার জন্য আতপ চাল,কলা, ধূপ,দ্বীপ, ঘৃত,মধু, ফলমুল,পূজার জন্য শাড়ী,পুরোহিতের জন্য ধূতি গামছা এমনকি পূজার খরচের একাংশ, ইত্যাদি। এর সাথে যুক্ত হবে ছেলেমেয়ের নতুন জামা-কাপড়, নিজেদের জন্য কাপড় ,পরবর্তীতে মনে পড়লে যুক্ত হবে বাদ যাওয়া জিনিস ইত্যাদি । তা ছাড়াও থাকবে মিষ্টান্ন ,মিষ্টি দধি-কততো কি। প্রতি বছরের অভ্যাস অনুযায়ী সেটা করতে অভ্যস্থ হয়েছি। এই সব কারণেই বোনাসের টাকাটা যত কষ্টই হোক জমা রাখতে হয়।
জমানো টাকার প্রায় সমস্তটাই সাথে করে নিয়ে চলেছি। বাজার করতে হবে। সাথে করে তালিকাটি নিয়েছি কিনা গিন্নী এসে পুনর্বার জিজ্ঞেস করে গেল। সহযাত্রী হয়েছে কন্যা শৈলী। তার জামা কিনতে হবে তারই পছন্দ মতো,তাই সাথী হয়েছে। আজকে আর অফিস নয়,স্কুলেও পাঠাবো না শৈলীকে। শুধুই পূজার বাজার নিয়ে সময় কাটাবো।

সেদিনও চলছিল হরতাল। বিরোধী দলের ডাকা হরতাল। ঢাকা শহরের আর এক দুর্ভোগের নাম হরতাল। কথায় কথায় হরতাল। যার সাথে নগরবাসী অতি অভ্যস্থ। গণতন্ত্র রক্ষা,দুর্নীতি মুক্ত দেশ গড়া ও জনহিতকর কাজের পূর্ব শর্ত হিসাবে এই হরতাল নাকি অত্যাবশ্যক। দোকানপাট বন্ধ। গাড়ি চলছে না। চুপি চুপি কেহ দোকান সামান্য খোলে রেখেছে, আবার হরতাল আহ্বানকারী লোকজন এসে বন্ধ করে দিচ্ছে। আবার খুলছে । এই ভাবে চলে হরতাল। কিন্তু আমার মার্কেটিংয়ে যাওয়া জরুরী । তাই আমাকে বের হতে হয়েছিল। রাস্তায় খন্ড খন্ড মিছিল চলছে। - ”চলবে না,চলবে না, জবাব চাই জবাব চাই “ ইত্যাদি শ্লোগান, যা প্রায় সব সময়েই ব্যবহৃত হয়।

মিছিলের ফাঁকে ফাঁকে রিক্সা নিয়ে চলছি। সেদিন যদিও গতিপথ পরিবর্তন করা যেতো, তবুও শৈলীকে আনন্দ দিতে বরাবরের রাস্তা ধরেই যাচ্ছি। কুসুমের অবস্থানের দিক দিয়েই যাচ্ছি। শৈলীর সেদিনও প্রশ্নবাণে আমাকে জর্জরিত করা বন্ধ ছিল না। তার মনে খুব আনন্দ। যেন-
” আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে”। হঠাৎ অনতি দুরে দেখা গেল বড় বেষ্ঠনি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একদল পুলিশ। বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের পায়ের কাছে মাটিতে কি যেন একটা পড়ে আছে। এমন সময় আমার মেয়ের আর্তচীৎকার!! বাবা, এই দেখ ,এইযে কুসুম!! কাল বিলম্ব না করে চলন্ত রিক্সা থেকে এক লাফ দিয়ে নেমে গেল সে। চলে গেল পুলিশের পায়ে কাছে পড়ে থাকা বস্তুটির দিকে। পুলিশ তাকে কাছে ভিড়তে দিতে রাজি ছিল না,তবুও আটকাতে পারে নি। নিকটে এসে নিশ্চিত হলাম, এটা কুসুমই বটে। তার রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়ে গেলো। রক্ত তখনও গড়িয়ে যাচ্ছে। দেখলাম হতভাগাদের রক্তও লাল। তাই রাজপথ লাল হয়েছে। মনে হলো অল্প কিছুক্ষণ পূর্বেই ঘটনাটি ঘটে গেছে। একটু আগেও এখানে মিছিল চলছিল। একটু দুর থেকে শ্লোগানের আওয়াজ, ককটেল বিষ্ফোরণ এবং গুলির শব্দ শোনেছি। হায়! শেষ হয়ে গেলো কুসুমের, সুরুজকে মানুষ করার স্বপ্ন। বোমার আঘাতে নাকি গুলাগুলিতে জীবন প্রদীপ নিভে গেলো কুসুমের ? প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই কেন ঝড়ে গেল কুসুম ? এভাবেই কত কুসম যে অকালে ঝড়ে যায় কে তার খোঁজ রাখে। এই কুসুমরা কোনদিন কোন পূজায় লাগে না , না হয় মালা গাঁথার উপকরণ। গন্ধহীন, বর্ণহীন ওরা। কানে বাজতে থাকলো একটি গানের দুটি কলি-”এই পৃথিবীর পরে, কত ফুল ফোটে আর ঝড়ে,সে কথা কি কোন দিন, কখনো কারো মনে পড়ে”।

পুলিশ খুব তৎপর। বলছে লাশের পোস্টমর্টেম হবে,কারণ উদঘাটন করতে হবে। বোমার আঘাতে নাকি গুলিতে শিশুটির মৃত্যূ হলো ,সব উদঘাটন করা হবে। থানায় মোকদ্দমা হবে ইত্যাদি। সাংবাদিকদেরকেও তৎপর হতে দেখা গেলো। হয়তো খবর হবে,অনেক ছবি সংবাদ মাধ্যমে আসবে। জীবনে কোন দিন যার একটি ছবি উঠেনি, আজ তার ছবি আসবে পত্রিকায়। শিরোনাম হবে কুসুম।
দূরে রাজনৈতিক দল মিছিল করছে। শ্লোগান দিচ্ছে, “ আমাদের কর্মী মরলো কেন ? –জবাব চাই ,জবাব চাই। রাজনতিক দলগুলোর অনেকেই লাশ নিয়ে মিছিল করতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পুলিশ বাধা দেয়, আর তাতে ব্যাপক সংঘর্ষও হয়।

হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, বেশ একটু দুরে সুরুজ। খুব ছটফট করছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। মুখে কোন কথা নেই। একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে। শুধু কবুতরের মতো কাঁপছে। শেষ আশ্রয় টুকুও হারিয়ে ফেলেছে সে। হয়তো ভাবছে, কোনও অপরাধে তাকেও হয়তো জড়িত করা হতে পারে।
শৈলী বলতে লাগলো- বাবা আমার পূজার জামা লাগবে না। সুরুজকে টাকাগুলো দিয়ে দাও। কিন্তু সুরুজ তো টাকা রাখা বা খরচ করারও কোন সামর্থ রাখে না। শৈলীর এই কথা শোনে আমার কান্না এসেছিল বটে, বহু কষ্টে তা সংবরণ করেছি। কেউ দেখে ফেললে বলে বসবে, ”শহরে কি নতুন আইছে নাহি” ? সত্যিই তো এই শহরে চোখের সামনে কত মৃত্যু দেখলাম। সেলিম,দেলোয়ার,তাজুল, রাওফুন বসুনিয়া, নুর হোসেন, ডাঃ মিলন আরও কত নাম। দেখলাম বীভৎস একুশে আগস্টের গ্রেনেড হামলা, কত মৃত্যু! দেখেছি শাহবাগের মোরে একটি চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা দিয়ে আগুন। একেবারে ১০/১২ জন যাত্রী পুরে কয়লা হবার দৃশ্য। দেখেছি থামানো একটি ট্রাকে ঘুমন্ত ড্রাইভার ও তার হেলপারকে পুড়ে ভষ্ম করে দেবার ঘটনা। দেখলাম পল্টন ময়দানে বাম দলের জনসভায় বোমা বিষ্ফোরণ,দেখেছি রমনা বটমূলে পহেলা বৈশাখের জমায়েতে বোমা মেরে ৮/১০ জন লোককে একটি মাত্র মাংসপিণ্ড করে নিথর করে ফেলতে। নিজের চোখেইতো সব দেখেছি। শরৎবাবু বেঁচে থাকলে হয়তো এবারও বলতেন, “ হে ভগবান! এই চোখ-দুটি যেমন তুমিই দিয়াছিলে, আজ তুমিই তাদের সার্থক করিলে” ।

কে জানে,সবই হয়তো বৃহত্তর সার্থেই করা হয়ে থাকবে। এই শহরে কে কার খবর রাখে। কিছু মরে রাজনৈতিক কারনে ,কিছু বা মরে দুর্ঘটনায়। শত্রুর অস্ত্রের আঘাতেও মরে অনেকে। কাজেই শোক করে ‍কি হবে?

আমারও ইচ্ছা জেগেছিল , সাথে থাকা কয়টা টাকা ওদেরকে দিয়ে দেই। মায়ের পূজার জন্য রাখা সঞ্চয় মানুষের পূজায় লাগিয়ে দেই। কিন্তু কাকে দিব? কুসুমকে কোন দিনই কোন টাকা দিতে পারিনি। তার আত্মসম্মান বোধ ছিল প্রখর। আজও পারিনি। আজ সে সকল লেন-দেনের উর্ধে। তার কাছে পরাজিত হলাম। রিক্সাটি ফিরিয়ে নিয়ে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। ভাবতে থাকলাম, সুরুজ হয়তো বেঁচে থাকবে, হয়তো মধ্যগগনে একদিন আলোও ছড়াবে। হয়তো কুসুমের ইচ্ছা অনুযায়ী প্রকৃত মানুষ হবে। হয়তো কিছুই হবে না। তবে তার অপরাধ জগতের একজন সম্রাট হয়ে আবির্ভুত হবার সম্ভাবনাই বেশী। কি হয়েছিল,আমরা তা জানিনা।
( সম্মানিত কিছু পাঠক গল্পটি আরও দীঘায়িত করার জন্য অনুরোধ জানিয়ে ছিলেন , আমার অপারগতার জন্য তাঁদের নিকট আমি ক্ষমা প্রার্থী। ধন্যবাদ।)

বাংলাদেশ সময়: ১০:১৩:৪৫   ৫৪৬ বার পঠিত   #  #  #