সোমবার, ৫ জুলাই ২০২১

কুসুম: পর্ব-৩: স্বপন চক্রবর্তী

Home Page » সাহিত্য » কুসুম: পর্ব-৩: স্বপন চক্রবর্তী
সোমবার, ৫ জুলাই ২০২১



স্বপন চক্রবর্তী
( একটি ছোট গল্প লেখার সামান্য প্রচেষ্টা)
এমনি ভাবে কুসুমের দুভাই-বোনের সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি যে এই শহরে তাদের আর কেহ নেই। মা থেকেও এখন নেই। এই শহরে কেন, অন্য কোথাও কেহ আছে কিনা –জানা নেই। বাংলাদেশের কোন এক নিভৃত গ্রামে ছিল তাদের বসবাস। আজন্ম দারিদ্র তাদের পিছু ছাড়েনি।
তবে এক সময় স্নেহ-মায়ায় পরিপূর্ণ ছিল তাদের সংসার। কুসুমের বাবা ছিল রাজ মিস্ত্রির যোগালী। গ্রাম থেকে রোজ নিকটবর্তী কোন এক শহরে এসে রাজ মিস্ত্রির যোগালীর কাজ করতো তাদের পিতা। আবার দিন শেষে ফিরে আসতো শান্তির নীড়ে। সবে স্কুলে যেতে শুরু করেছে কুসুম । তার ভাই সুরুজ আরও ছোট। সুরুজের স্কুলে যাবার খুব সখ হলেও তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয়নি তখনো। সিদ্ধান্ত ছিল, সামনের বছর সুরুজ স্কুলে যাবে। মানসিক প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত। কিন্তু একদিন। হ্যাঁ সেই একদিনের কথাই বলবো এখন।
একদিন অন্তহীন কঠিন পথের যাত্রী হতে হয় তাদেরকে। দুর্ভাগ্য পিছু নেয় পরিবারটির। যোগালীর কাজ করার সময় অসাবধানতার কারণে অনেক উপর থেকে পা পিছলে নিচে পড়ে যায় চাঁন মিয়া। সাধ্যমতো চিকিৎসা তারা করিয়েছে। এই ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে শেষ সম্বল মাথা গুঁজার ঠাই টুকু শেষ হয়ে যায়। ফলে প্রাণে বেঁচে যায় বটে, কিন্তু পরবর্তীতে স্বেচ্ছায় প্রাণ বিসর্জনের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠে চাঁন মিয়া । সুন্দরী যুবতী স্ত্রীর মুখ বিষন্ন। হাসি ম্লান হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়ে সহ পরিবারটি দিনের পর দিন অনাহারে –অর্ধাহারে কাটায়। কেহ কোন কাজ দেয় না চাঁন মিয়াকে। কাজ দিলেই বা কি ? একবারে পঙ্গু জীবন তার। চোখের সামনে অনাহারে থাকে পরিবার। অক্ষমতার গ্লানি থেকে মুক্তির পথ খোঁজতে থাকে সে । পঙ্গুত্ব তার সুখের সংসারের সকল সুখ কেড়ে নিয়েছে। তাই সে মুক্তি নিতে চেয়েছে। আত্মগ্লানির দুর্বিসহ যন্ত্রণা তার জীবনে অভিশাপ হয়ে এলো। এর থেকে পরিত্রাণ, একমাত্র স্বেচ্চা সলিল সমাধি বলে সমীচীন মনে করে চাঁন মিয়া।

এক রাতে গলায় কলসী বেঁধে নদীর জলে ডুবে প্রাণ জুড়ালো চাঁন মিয়া। কুসুমের মা কাজের সন্ধ্যানে গ্রামময় ঘুরে বেড়ায়। সাহায্যের জন্য লোকের কোন অভাব হয়না। কিন্তু অন্য প্রস্তাব পায়। দিন শেষে আদরের সন্তানদের জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সে। কোন ভাবেই দিন আর চলতে ছিল না । দুবেলা খাবার নিশ্চিত তো অন্তত করতে হবে। কিন্তু কুসুমের মা আম্বিয়া খাতুনের সামনে কোন পথ আর খোলা ছিল না।
লোক মুখে সে শোনে, ঢাকা শহরে টাকা নাকি বাতাসে উড়ে বেড়ায়। কোন অভাব হয়না কাজ কর্মের। একদিন সন্তান দুটোকে নিয়ে পাড়ি জমায় স্বপ্নের শহর ঢাকায়। রাস্তা-ঘাট জানা নেই চেনা নেই এই শহরে। তার উপর বড় বিপদ হলো তার রূপ-যৌবন। যেখানেই যায় লোকে শুধু পরখ করে তার গতর। কেহ আবার কোন কাজ নেই বলে বিদায় করে দেয়। কেহ প্রস্তাব দেয় অন্য রকমের। কাজকর্নেম নেই, খাবার জুটেনা, এই অক্ষমতার আত্মগ্লানি আম্বিয়াকেও খুব ব্যাথাতোর করে।

সাত কথায় নাকি সতীর মনও গলে। ছোট বেলায় দেখেছি গ্রামের টিউবওয়েল। তার নিচের কংক্রিটও ক্ষয় হয়ে যায় একটি মাটির কলসের ঘর্ষণে। তাছাড়া নিজের রূপ-যৌবনের একটু নিরাপত্তা এবং সন্তানদের দুটো খাইয়ে পড়িয়ে মানুষ করা, এই সব চিন্তায় কোন একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় সে। সন্তানের মুখে দুটো খাবার তুলে দিবার চিন্তায় মন পরিবর্তন করে। ইচ্ছায় হোক বা বাধ্য হয়েই হোক, একদিন এক কসাইকে বিয়ে করে ফেলে আম্বিয়া। এখানেই শেষ নয়। বিবাহের পরের বাস্তবতা আরো কঠিন, আরো অসহনীয়। প্রথমে শর্ত থাকলেও পরে কসাই লোকটি আর শর্ত রক্ষা করেনি। আদরের সন্তান দুটিকে সাথে রাখার অবলম্বন টুকুও হারায় সে। বাস্তব জগতে প্রবেশ করে তার ভুল ভাঙ্গতে থাকে এক এক করে। কিন্তু তখন আর কোন উপায় খোঁজে পায়নি। কথায় বলে, “ অতি বড় ঘরণী না পায় ঘর, আর অতি বড় রূপসীর না জোটে বর।
একদিন কুসুম ও তার আদরের অবুঝ ভাইয়ের ঠিকানা হয় ফুটপাতে। কিশোরী কুসুম ফুল বিক্রি করে দিনান্তে যা পায়, তাই দিয়ে রাতে দুইজনে আহার করে। চটের একটি বস্তা গায়ে জড়িয়ে দুই ভাইবোন জড়াজড়ি করে নিদ্রার কোলে ঢলে পড়ে। ( চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১২:৫৪:৫৩   ৫৬৩ বার পঠিত   #  #  #  #