সোমবার, ৭ জুন ২০২১
ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৩৭”
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৩৭”২. ১৯৪৭-ভারত ভাগ (উপমহাদশেরে বভিাজন ) :
গ.বঙ্গভঙ্গ ১৯০৫, বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন :
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ ভারতের রাজনৈতিক শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা। বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ভারতের যে রাজনৈতিক আলোড়নের সৃষ্টি হয় তা পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বঙ্গভঙ্গ কেবল বাংলার বিভক্তিই ছিলো না; এটা ছিলো ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির এক বিরাট ষড়যন্ত্র। বাংলা থেকে রাজনীতির কেন্দ্র অন্যত্র সরিয়ে দেয়া এ চক্রান্তের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি বঙ্গভঙ্গ ও বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তা করতে সমর্থ হয়। তবে, এটি ঠিক বঙ্গভঙ্গের ফলশ্র“তিতে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের বিভক্তি চরমভাবে ফুটে ওঠে। বলা হয়ে থাকে প্রশাসনিক কারণে বঙ্গভঙ্গ করেছিলো ব্রিটিশ রাজ। তবে বঙ্গভঙ্গের পিছনে রাজনৈতিক, সামাজিক অর্থনৈতিক কারণও বিদ্যমান ছিলো।
. বঙ্গভঙ্গের পটভূমি :
লর্ড কার্জন প্রশাসনিক ব্যাপক বিস্তৃতির কারণ দেখিয়ে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কথা ঘোষণা করেন। তবে লর্ড কার্জনের আগেও বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করার ব্যপারে আলোচনা হয়েছে। স্যার ক্যাম্পফিল্ড ফুলার এবং স্যার এন্ড্র ফ্রেজার এদের মধ্য অন্যতম ছিলেন। ইংরেজদের পরিকল্পনার সাথে সাথে পূর্ব বাংলা থেকেও বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব ওঠে। ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের কাছে বঙ্গভঙ্গের দাবি জানান। এর জন্য তিনিও আন্দোলনও শুরু করেন। বাংলা প্রদেশের বিভক্তির প্রশেড়ব তিনি বেশ কয়েকটি যুক্তি উপস্থাপন করেন। এগুলো হলো-
১. কলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু সম্প্রদায় অত্যন্ত প্রভাবশালী ছিল বিধায় সরকারি চাকরি, ব্যবসা বাণিজ্যে তাদের প্রভাব ছিলো। বাংলা বিভক্ত হলে পূর্ব বাংলায় এসব ক্ষেত্রে মুসলমানদের সুযোগ তৈরি হবে।
২. অধিকাংশ হিন্দু জমিদারই পূর্ববঙ্গ থেকে অর্থ উপার্জন করে কলকাতায় বাসবাস করতেন সেখানেই সমস্ত অর্থ ব্যয় করতেন। ফলতঃ পূর্ব বাংলার উনড়বতি হয়নি।
৩. কলকাতা বাংলা প্রদেশের রাজধানী ছিল বলে ব্যবসায়িক ও বাণিজ্যিক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সেখানেই বিশেষভাবে গড়ে উঠে। পক্ষান্তরে বিস্তীর্ণ পূর্ববঙ্গ রাজধানীর সব সুযোগ-সুবিধা থেকে ছিল বঞ্চিত। দৃষ্টান্তস্বরূপ, পাট পূর্ববঙ্গে উৎপনড়ব হত কিন্তু পাটকলগুলো প্রধানতঃ গড়ে উঠেছিল কলকাতায়।
৪. কলকাতা রাজধানী বিধায় তা ছিল রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। রাজনীতি, মূলত: হিন্দুদের হাতেই নিয়োজিত ছিল। বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলমানরা রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে।
৫. জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রেই হিন্দুদের কর্তৃত্ব বিদ্যমান ছিল। বিশেষ করে হিন্দু মধ্যবিত্ত ও বিত্তশালী শ্রেণীই সকল সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত। এসব ক্ষেত্রে মুসলমানরা ছিল নিতান্তই পশ্চাৎপদ।
.বঙ্গভঙ্গের ফলাফল :
পূর্ব বাংলার জন্য বঙ্গভঙ্গ ছিল আর্শীবাদ স্বরূপ, অন্ততঃ অর্থনৈতিক ও অবকাঠামো নির্মাণের বিবেচনায়। সঙ্গতকারণেই বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্ট নতুন প্রদেশ মুসলমানদের জন্য অনুপ্রেরণা ছিলো। বাংলার প্রাচীন রাজধানী ঢাকা তার লুপ্ত গৌরব ফিরে পায়। এ সময় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ড ঢাকাকে কেন্দ্র পরিচালিত হতে থাকে। ফলে ঢাকার অবকাঠামো নির্মাণে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে। দৃষ্টিনন্দন কার্জন হল ছাড়াও অসংখ্য অফিস, আদালত ভবন গড়ে ওঠে।
প্রথম লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার সচেতন ছিলেন যে, মুসলমানরা শিক্ষাক্ষেত্রে অনগ্রসর সরকারী চাকুরীতে হিন্দুদের তুলনায় তাদের সংখ্যা নিতান্তই অপ্রতুল। মুসলমান ছাত্রদের জন্য সরকারের মঞ্জুরীকৃত বৃত্তির
পরিমাণ বাড়ানো হয়। এতে অল্পকালের মধ্যেই স্কুল কলেজের ছাত্রসংখ্যা বেড়ে যায় এবং বিনা বেতনে পড়াশোনার সুযোগ সৃষ্টির জন্যও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করা হয়। মুসলমানদের মধ্যে দ্রুত শিক্ষা বিস্তারের জন্য অতিরিক্ত পদক্ষেপ হিসেবে বেশি সংখ্যক মুসলমান শিক্ষক ও স্কুল পরিদর্শক নিযুক্ত করা হয়।
নতুন প্রদেশের উনড়বয়নের জন্য গভর্নর বিশেষ যতড়ববান হন। স্যার ক্যামফিল্ড ফুলার চট্টগ্রাম বন্দর উনড়বয়ন ও অভ্যন্তরীণ নৌ-পথ এবং সড়ক পথের উন্নতি সাধনের জন্য এক বছরের মধ্যে বিরাট পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রদেশের সামুদ্রিক বাণিজ্যের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নতি সাধন করেন। অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্যের উনড়বতি সাধন করা হয়। অভ্যন্তরীণ ব্যবসা বাণিজ্যের উনড়বতি সাধন, স্থানীয় বনিক ও বাণিজ্যিকব পণ্যের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য নৌ-পুলিশের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়। গ্রামের সঙ্গে শহর এবং বাণিজ্য কেন্দ্রের সংযোগের জন্য পুরাতন রাস্তা সমূহের সংস্কারক এবং নতুন নতুন রাস্তা নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এছাড়া ঢাকায় নতুন নতুন প্রশাসনিক ভবন, হাইকোর্ট, সেক্রেটারিয়েট ও আইন পরিষদ ভবন নির্মিত হয়।
তবে বঙ্গভঙ্গের ফলে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। হিন্দুরা বঙ্গবঙ্গের তীব্র বিরোধিতা করে। তারা একে মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদ হিসাবে বর্ণনা করে। অন্যদিকে অর্থনৈতিক উনড়বয়নের হাতছানির কারণে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা বঙ্গবঙ্গের পক্ষে অবস্থান নেয়।
. বঙ্গভঙ্গের মূল্যায়ন : আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক যে কোন বিবেচনায় বঙ্গভঙ্গ এক অনন্য সাধারণ ঘটনা। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ব বাংলা তাৎক্ষণিক কিছু সুবিধা পেলেও অখন্ড বাংলা চেতনার জন্য তা ছিল আত্মঘাতিমূলক। বঙ্গভঙ্গের প্রভাব পরবর্তী চার দশকের রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। সত্যিকার অর্থে বঙ্গভঙ্গের ফলে ব্রিটিশদেরই জয় হয়েছে। নিম্নে বঙ্গভঙ্গের মূল্যায়ন করা হলো-
১. ব্রিটিশদের বিভেদ নীতির জয় : বঙ্গবঙ্গের ফলে ব্রিটিশ শাসকদের অনুসৃত ভাগ কর ও শাসন কর নীতি (Divide & Rule) জয়যুক্ত হয়। ব্রিটিশ শাসকগণ কৌশলে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। ব্রিটিশ শাসকগণ কৌশলে হিন্দু ও মুসলমান জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। ভারতের বৃহত্তর দুটি সম্প্রদায় এর ফলে চিন্তা চেতনার দিক থেকে বিভক্ত হয়ে পড়ে।
২. সর্বভারতীয় জাতীয়তদাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ: বঙ্গভঙ্গের দ্বারা ব্রিটিশ শাসকগণ কৌশরে কলিকাতাকেন্দ্রিক সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন নস্যাৎ করার সুযোগ লাভ করে। কেননা,কলিকাতা শহরের লেখক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদগণ পূর্ববাংলার উপর নির্ভরশীল ছিল। বঙ্গবঙ্গের ফলে তারা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. উগ্র হিন্দু জাতীয়তবাদের উত্থান : ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ফলে ভারতীয় রাজনীতিতে বিশেষ করে বাংলা, পাঞ্জাব ও মহারাষ্ট্রে নাশকতামূলক কার্যকলাপ বৃদ্ধি পায়। সমগ্র ভারতে উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী চিন্তা চেতনা বিস্তৃত হয়।
৪. ভারত বিভক্তি : বঙ্গভঙ্গ হিন্দু মুসলিম জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনার বিষবৃক্ষ রোপন করে। এই সাম্প্রদায়িক চেতনাই পরবর্তীতে ভারত বিভাগকে অত্যাসনড়ব করে তোলে।
৫. মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রসার : বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলিম জাতীয়তাবাদের বীজ রোপিত হয়। মুসলমান জনগণ নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগঠিত হতে থাকে। তারা ১৯০ সালে ‘নিখিল ভারত মুসলিম লীগ’ নামক একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে।
৬. পূর্ববঙ্গের উন্নয়ন : বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গে বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন ভবন, অফিস আদালত গড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডেও গতি আসে।
. বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন :
উদারপন্থী মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে কংগ্রেস বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করে। সরকারের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য কংগ্রেস বিদেশী পণ্য বর্জনের ডাক দেয়। বিদেশী পণ্য আমদানী ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে। কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলন জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
. ইংরেজ সরকারের নতি স্বীকার :
প্রথম দিকে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবঙ্গের ব্যাপারে দৃঢ় ও অনমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেন। ভারত সচিব মর্লে বঙ্গ বিভাগকে একটি মিমাংশিত বিষয় বলে ঘোষণা করেন এবং কংগ্রেস কর্তৃক তা বাতিলের দাবী নাকচ করে দেন। এমনকি দমন নীতির মাধ্যমে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন প্রশমণের চেষ্টা করে। ভাইসরয় মিন্টোও বঙ্গ বিভক্তি বাতিল না করার ব্যাপারে মুসলমানদের আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা, স্বদেশী আন্দোলনের উগ্রতা এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ড ব্রিটিশ সরকারকে ক্রমশঃ ভাবিয়ে তোলে। ঔপনিবেশিক স্বার্থ এবং সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলার কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা নতি স্বীকার এবং বঙ্গভঙ্গ বিরোধীদের সাথে আপোষের পথ বেছে নেয়।
১৯১০ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ ভারতের নতুন ভাইসরয় হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা লক্ষ করে বঙ্গভঙ্গ রদের বিষয়ে গোপন তৎপরতা শুরু করেন। বৃটেনের সম্রাট পঞ্চম জর্জ এবং ভারত সচিব লর্ড ক্রূ প্রমূখ বঙ্গভঙ্গ রদের পক্ষে মত দেন। ১৯১১ সালে সম্রাট পঞ্চম জর্জ ও রাণী মেরী ভারত সফরে আসেন। তাদের সফর উপলক্ষ্যে ১২ ডিসেম্বর দিল−ীতে এক ঐতিহাসিক দরবারের আয়োজন করা হয়। সেখানে সম্রাট পঞ্চম জর্জ আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা দেন। ফলে কার্জনের বাংলা বিভক্তির ব্যবস্থা বাতিল হয়। ঢাকা চট্টগ্রাম, রাজশাহী, প্রেসিডেন্সী ও বর্ধমানের পাঁচটি বাংলা ভাষাভাষী বিভাগ নিয়ে বাংলা প্রদেশ পূনর্গঠন করা হয়। ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী কলকাতা হতে দিল−ীতে স্থানান্তর করা হয়।
. মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া :
বঙ্গভঙ্গ সাধিত হবার পর ব্রিটিশ সরকার অত্যন্ত জোরেসোরে প্রচার করেন যে, “বঙ্গভঙ্গ একটা অবধারিত ঘটনা এবং এ অবস্থাটাকে অপরিবর্তিত রাখা হবে।” সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ এ ধরনের প্রচারের ওপর সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস স্থাপন করেন এবং প্রগতিশীল ভবিষ্যৎ রচনায় গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করেন। কিন্তু ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণায় মুসলমানদের ওপর নেমে আসে বিষাদের ছায়া। মুসলমান সম্প্রদায় এ ঘোষণায় বিস্মিত হন। স্যার সলিমুল্লাহ বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণাকে সামনে রেখে বলেন যে, “মুসলমানদের সাথে আলাপ আলোচনা না করে বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণায় মুসলমানগণ বিস্মিত হয়েছে এবং ব্রিটিশ সরকারের ওপর মুসলমানদের আস্থা চিরতরে বিনষ্ট হয়েছে।” বঙ্গভঙ্গ রদের ঘোষণায় মুসলিম নেতৃবৃন্দ সাংঘাতিকভাবে ক্ষুব্ধ হন। স্যার সলিমুল্লাহর অসন্তোষকে কেন্দ্র করে তাকে খুশি করার জন্য ইংরেজ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নির্দেশ দেন।
ঘ.১৯০৯ সালের মর্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ও লক্ষ্মৌ চুক্তি:
ক্স মার্লি-মিন্টো সংস্কার :
ভারতবর্ষের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসে ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইন বা মার্লি-মিন্টো সংস্কার আইন এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আইন দ্বারা ভারতবর্ষে প্রথম মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তণ করা হয়। আইন পরিষদগুলোর ক্ষমতা ও পরিধি বৃদ্ধি করা হয়। নিমেড়ব ১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. মুসলমানদের দাবি অনুযায়ী এই আইন দ্বারা মনোনয়ন প্রথার ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়।
২. এই আইন দ্বারা ভারতীয় আইন সভার পরিধি বাড়ানো হয়। সদস্য সংখ্যা ৮ জনে উনড়বীত হয়।
৩. এই আইনদ্বারা প্রাদেশিক আইন সভার সদস্য সংখ্যাও বাড়ানো হয়। বড় প্রদেশেগুলোর সদস্য সংখ্যা ৫০ জনে এবং ছোট প্রদেশগুলোর সদস্য সংখ্যা ৩০ জনে উনড়বীত করা হয়।
৪. এই আইন দ্বারা আইন সভার ক্ষমতা বৃদ্ধি করা হয়। আইন সভার সদস্যগণ সম্পূরক প্রশড়ব করতে এবং যে কোন প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারবেন।
৫. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন সভাগুলোতে নির্বাচনের মাধ্যমে ভারতীয় বেসরকারী সদস্যগণ নির্বাচনের বিধান করা হয়। তবে অধিকাংশ সদস্যই নির্বাচিত হতেন পরোক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে।
৬. গভর্ণর ও গভর্ণর জেনারেলের ‘শাসন পরিষদে’ একজন ভারতীয় সদস্যের অন্তর্ভূক্তি নিশ্চিত করা হয়।
৭. এর মাধ্যমে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ ভারতে প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থার ধারণা র্স্বীকৃত হয়। নির্বাচনের পাশাপাশি মনোনয়ন প্রথাও চালু রাখা হয়েছিলো।
৮. আইন পরিষদে আলাপ আলোচনা পরিধি বৃদ্ধি করা হয়।
৯. আইনসভাগুলোর মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়।
১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইন ১৮৬১ এবং ১৮৯২ সালের ভারতীয় কাউন্সিল আইনের তুলনায় ছিল এক বিরাট অগ্রগতি। তথাপি এ আইন ভারতবাসীর আশা আকাঙ্খা পূরণ করতে পারেনি ভারতীয়রা শাসন ব্যবস্থায় পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন চালাতে থাকে।
ক্স ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তি :
১৯০৯ সালের ভারত শাসন আইন ভারতীয়দের সব দাবী দাওয়া পূরণে ব্যর্থ হয়। এ আইনে যদিও মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচনের অধিকার দেয়া হয় তথাপি তা মুসলমান সম্প্রদায়কে খুশী করতে পারেনি। এ সময় স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক দু’টি ঘটনা মুসলমানদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। বঙ্গভঙ্গ রদের ঘটনা মুসলমানদের বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এর উপর যোগ হয় বলকান যুদ্ধ। এ যুদ্ধে তুর্কী খেলাফতের প্রতি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধাচারণ ভারতীয মুসলমানদের মর্মাহত করে। তারা রাজপথে নেমে আসে। ব্রিটিশদের ওপর মুসলমানদের রাগ ক্ষোভ ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। এ সময়ে মুসলিম রাজনীতির ক্ষেত্রে দু’জন প্রখ্যাত জননেতার আর্বিভাব হয়। তারা হলেন মাওলানা মোহাম্মদ আলী এবং মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। তারা উভয়ই ব্রিটিশ সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। এ পরিস্থিতিতে ১৯১৩ সালে লক্ষ্মৌ মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ দলের কাঠামোতে পরিবর্তন আনেন। নতুন গঠনতন্ত্রে বলা হয়, জাতীয় ঐক্য জোরদার করা, সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি হলো মুসলমানদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। এর ফলে ভারতে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৯১৫ সালে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ বোম্বে প্রায় একই সময়ে বার্ষিক সমাবেশ আহ্বান করে। ওই সম্মেলনে উভয় দল ব্রিটিশ সরকারের বিভিনড়ব নীতি ও শাসন প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে। একই সঙ্গে উভয়দলই ভারতে হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায়ের ঐক্যের ওপর জোর দেয়। ১৯১৬ মালের ডিসেম্বর মাসে লক্ষ্মৌ শহরে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারতের শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের প্রশেড়ব একটা সমঝোতায় আসে। ইতিহাস এটি লক্ষ্মৌ চুক্তি নামে পরিচিত। এ চুক্তির মাধ্যমে লীগ কংগ্রেস কিছু মৌলিক বিষয়ে মিলিত দাবি পেশ করে। লক্ষ্মৌ চুক্তির বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো :
১. লক্ষ্মৌচুক্তিতে কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্যসংখ্যা ১৫০ জন করার সুপারিশ করা হয়। এদের মধ্যে পাঁচ ভাগের চার ভাগ হবেন নির্বাচিত সদস্য এবং বাকী একভাগ মনোনীত সদস্য। যতদূর সম্ভব ব্যাপক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন। নির্বাচিত সদস্যের এক তৃতীয়াংশ হবে মুসলিম সদস্য এবং নিজ সম্প্রদায়ের দ্বারাই তারা নির্বাচিত হবেন।
২. কেন্দ্রের হাতে থাকবে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, শুল্ক, রেলওয়ে, ডাক ও তার বিভাগ। ভারত সচিবের কাউন্সিল বিলুপ্ত করতে হবে এবং ব্রিটিশ সরকারই তাঁকে বেতন দেবে। তাঁর সাহায্যকারী থাকবেন দুজন এবং এদের মধ্যে একজন হবেন ভারতীয়।
৩. প্রাদেশিক আইনসভার ক্ষেত্রে দাবি করা হয় যে, বৃহৎ প্রদেশে সদস্য সংখ্যা ১২৫ জনের কম হবে না। ছোট প্রদেশগুলোতে এ সংখ্যা হবে ৫০ থেকে ৭৫ এর মধ্যে। প্রদেশের ক্ষেত্রেও চার পঞ্চমাংশ সদস্য হবেন নির্বাচিত এবং অবশিষ্ট এক পঞ্চাংশ হবেন সদস্য নির্বাচিত এবং অবশিষ্ট এক পঞ্চাংশ মনোনীত। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে।
৪. প্রদেশগুলোতে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যার ক্ষেত্রে মুসলিম সদস্য থাকবে পাঞ্জাবে ৩৩%, যুক্তপ্রদেশে ৩০%, মধ্যপ্রদেশে ১৫%, বাংলায় ৪০%, বিহারে ২৫%, মাদ্রাজে ১৫% ও বোম্বেতে ৩৩%। এখানেও পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর মাধ্যমেই মুসলিম প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হবে। তবে শর্ত ছিল যে, এসব সংরক্ষিত আসন ছাড়া মুসলমানরা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক অন্য কোন আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না।
৫. কেন্দ্রীয় বা প্রদেশিক আইন পরিষদে কোন সম্প্রদায়ের স্বার্থ সংশি−ষ্ট কোন বিল কখনো গৃহীত হবে না যদি উক্ত সম্প্রদায়ের তিন চতুর্থাংশ সদস্য সে বিলের বিরোধিতা করে।
৬. ভারতের স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ একত্রে আন্দোলন করবে।
৭. চুক্তিতে দাবি করা হয় যে, ডোমিনিয়ন সরকারসমূহের সঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের উপনিবেশ মন্ত্রীর যে সম্পর্ক, ভারত সরকারের সাথে ভারত সচিবের সম্পর্কও হতে হবে অনুরূপ।
৮. গভর্নর জেনারেলের শাসন পরিষদের অর্ধেক সদস্য ভারতীয় হবেন। তারা ভারতীয় আইন পরিষদের সদস্য দ্বারা নির্বাচিত হবেন।
৯. সদস্যদের প্রশড়ব ও বিল উত্থাপন, প্রস্তাব পাশ ও মূলতবী প্রস্তাব উত্থাপন করার অধিকার থাকবে।
১০. প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষেত্রে প্রদেশগুলো যথাসম্ভব কেন্দ্রিয় সরকারের নিয়ন্ত্রণ থেকে স্বাধীন থাকবে।
১১. আইন পরিষদের সদস্যদের দ্বারা আইন পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হবেন।
ক্স লক্ষ্মৌ চুক্তির গুরুত্ব :
ভারত উপমহাদেশের সাংবিধানিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে ১৯১৬ সালের লক্ষ্মৌ চুক্তি এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এ চুক্তি ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ভারতের জন্য একটি সংবিধানের মূল রূপরেখা প্রণয়নে এ চুক্তি ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ প্রয়াস। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি রচনা করে এ চুক্তি। এর ফলেই হিন্দু মুসলমান সম্মিলিতভাবে ব্রিটিশ সরকারের সম্মুখে যুক্তভাবে নিজেদের দাবী দাওয়া পেশ করার সুযোগ লাভ করে। লক্ষ্মৌ চুক্তির গুরুত্বগুলো আলোচনা করা হলো :
১. লক্ষ্মৌ চুক্তির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে হিন্দু মুসলিম রাজনৈতিক সহযোগিতার ভিত্তি রচিত হয়।
২. এ চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় কংগ্রেসে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচনের দাবি মেনে নেয়।
৩. এ চুক্তির ওপর ভিত্তি করেই পরবর্তীতে খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল।
৪. এ চুক্তির ফলে ভারতবর্ষে স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয়ে ওঠে।
৫. এ চুক্তির ফলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সম্মিলিতভাবে ব্রিটিশ সরকারের কাছে স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানায়।
৬. মুসলমানদের স্বার্থ বিরোধী বিল পাশ না হওয়ার সম্ভবনা সৃষ্টি হয়।
ঙ.১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন :
মার্লি-মিন্টো সংস্কার আইন ভারতীয়দের আশা আকাঙ্খা পূরণ করতে ব্যর্থ হয়। লক্ষ্মৌ চুক্তির মাধ্যমে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের লক্ষ্যে এক যৌথ প্রস্তাব সরকারের নিকট পেশ করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ভারতবাসীর সহযোগিতার পুরস্কারস্বরূপ ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত সচিব মন্টেগু ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কমন্সসভায় ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থেকে ভারতবাসী যাতে প্রশাসনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অংশ গ্রহণ গ্রহণের সুযোগ পেয়ে μমশঃ স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত হয়ে উঠতে পারে, সরকার সে নীতিরই পক্ষপাতি। তবে তিনি ভারতকে ডিমিনিয়নের মর্যাদা দেয়ার দাবি বাতিল করে দেন। এরপর মন্টেগু ও ভারতের বড়লাট চেমসফোর্ড একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করেন। এর ভিত্তিতেই ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কার বা ভারত শাসন আইন পাস করা হয়।
১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের প্রধান দিক ছিল, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের কার্যাদি যথাসম্ভব সুস্পষ্টভাবে নির্দিষ্ট করা। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে দেশরক্ষা, আইন শৃঙ্খলা, পররাষ্ট্র, অর্থ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, রেল ও ডাক প্রভৃতি সর্বভারতীয় বিষয়গুলো ন্যস্ত করা হয়। প্রদেশের হাতে বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জেল, সেচ, স্থানীয় সরকার প্রভৃতির দায়িত্ব রাখা হয়।
ভারত শাসন আইনের বৈশিষ্ট্যসমূহ :
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইন এক সুবৃহৎ দলিল। এ আইনের বেশ কিছু দিক ভারতীয়দের সন্তুষ্ট করে। আবার এর সমালোচনাও রয়েছে। নিমেড়ব ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো আলোচনা করা হলো -
১. দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় আইনসভাকে একটি দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভায় (Bicameral legislature) পরিণত করা হয়। উচ্চ কক্ষের নামকরণ করা হয় রাষ্ট্রীয় পরিষদ (Council of State) এবং নিমড়বকক্ষের নামকরণ করা হয় ব্যবস্থাপক সভা (Legislative Assembly। রাষ্ট্রীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৬০ জনে নির্ধারিত করা হয় এবং তন্মধ্যে ৩৪ জন নির্বাচিত সদস্য ও বাকী ২৬ জন বড়লাট (Covernor Gerenal) কর্তৃক মনোনীত হবে। ব্যবস্থাপক সভার সদস্য সংখ্যা সর্বমোট ১৪৫ জনে নির্ধারিত করা হয় এবং তন্মধ্যে ১০৫ জন নির্বাচিত ও বাকী ৪০ জন মনোনীত হবে। এ মনোনীত সদস্যদের মধ্যে ২ জন সরকারী কর্মচারী এবং অবশিষ্ট সদস্যগণ বেসরকারী।
২. গভর্ণর জেনারেলের ভোট ক্ষমতা : ক্ষমতার দিক থেকে ব্যবস্থাপক পরিষদ রাষ্ট্রীয় পরিষদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাবান ছিল। ব্যবস্থাপক পরিষদকে বাজেটের উপর আলোচনা করার এবং ভেটাধিকারমূলক ব্যয় বিষয়ে অনুমোদনের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। রাষ্ট্রীয় পরিষদ ব্যয় বরাদ্দ আলোচনা করতে পারত কিন্তু এর ভোট প্রদানের কোন ক্ষমতা ছিল না। যে কোন বিলকে আইনে পরিণত হতে হলে একে অবশ্যই উভয় পরিষদ পাস হতে হত। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে কেন্দ্রীয় আইনসভার কোন সত্যিকার ক্ষমতা ছিল না বললেই চলে। কারণ গভর্নর জেনারেল আইনসভা কর্তৃক পাসকৃত যে কোন বিলে ভেটো (াবঃড়) প্রয়োগ করতে পারতেন। এমনকি তাঁর পূর্বানুমতি (চৎবারড়ঁং ঝধহপঃরড়হ) ব্যতীত আইনসভায় কোন বিল বা সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করা যেত না।
৩. এককক্ষ বিশিষ্ট প্রাদেশিক আইন সভার সম্প্রসারণ : এ আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলোতে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার (টহরপধসবৎধষ খবমরংষধঃঁৎব) ব্যবস্থা করা হয়। শুধু তাই নয় প্রাদেশিক আইনসভাগুলোর সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়। যেমন : বঙ্গ প্রদেশের আইনসভায় সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১৩৯ জনে, মাদ্রাজ প্রদেশে ১২৭ জনে এবং বোম্বাই প্রদেশে ১১১ জনে উনড়বীত হয়। তাছাড়া এ আইনে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, প্রাদেশিক আইন পরিষদে নির্বাচিত সদস্যের সংখ্যা শতকরা ৭০ জনের কম এবং সরকারী সদস্যের সংখ্যা ২০ জনের অধিক হবে না।
৪. যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা : ১৯১৯ সালের ভারত শাসনের আইনের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভারতে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। প্রথমবারের মত সরকারী বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক-এ দুভাগে ভাগ করা হয়। কেন্দ্রীয় বিষয়গুলোকে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে এবং প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে প্রাদেশিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। এভাবে দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ক্ষেত্রে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনই ছিল সর্বপ্রথম পদক্ষেপ।
৫. পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অপর একটি উলেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার (ঝবঢ়ধৎধঃব ঊষবপঃড়ৎধঃব) প্রবর্তন। এ আইনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। ভারতের বিভিনড়ব সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা গৃহীত হয়। মুসলমান সম্প্রদায় ছাড়া পাঞ্জাবের শিখ, ভারতীয় খ্রিস্টান, এ্যাংলো ইন্ডিয়ান এবং ইউরোপীয়গণও পৃথক নির্বাচনের সুযোগ ও অধিকার লাভ করে।
৬. দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা : ভারতবর্ষের প্রদেশগুলোতে দ্বৈত শাসন ব্যস্থার (উুধৎপযু) প্রবর্তন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এ ব্যবস্থাধীনে প্রাদেশিক বিষয়গুলোকে দু’টি পৃথক অংশে বিভক্ত করা হয় । সংরক্ষিত বিষয়সমূহ (জবংবৎাবফ ঝঁনলবপঃং) এবং হস্তান্তরত বিষয়সমূহ (ঞৎধহংভবৎৎবফ ঝঁনলবপঃং)। আইন-শৃঙ্খলা, অর্থ, পূর্ত, রাজস্ব প্রভৃতি বিষয়গুলো সংরক্ষিত বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পক্ষান্তরে শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, কৃষি, স্বায়ত্তশাসন প্রভৃতি ছিল হস্তান্তরিত বিষয়াদির অন্তর্ভুক্ত। সংরক্ষিত বিষয়গুলো প্রাদেশিক গভর্নর এবং তাঁর শাসন পরিষদ (ঊীবপঁঃরাব ঈড়ঁহপরষ) কর্তৃক শাসিত হত। এক্ষেত্রে প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদের কোন হাত ছিল না। পক্ষান্তরে, হস্তান্তরিত বিষয়গুলো প্রাদেশিক গভর্নর তাঁর মন্ত্রিসভার পরামর্শμমে শাসন ও পরিচালনা করতেন। প্রাদেশিক মন্ত্রিপরিষদ প্রাদেশিক আইনসভার কাছে সম্পূর্ণরূপে দায়ী ছিলেন না।
৭. ভারত সচিবের ক্ষমতা হ্রাস : ১৯১৯ সালের আইনের মাধ্যমে ভারত সচিবের (ঝবপৎবঃধৎু ড়ভ ঝঃধঃব ভড়ৎ ওহফরধ) ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। যে পরিমাণ ক্ষমতা প্রাদেশিক মন্ত্রীদের হাতে হস্তান্তরিত হয় ঠিক সে পরিমাণে ভারত সচিবের ক্ষমতা খর্ব করা হয়। ভারত সচিবের ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদান এবং তাঁর রাজনৈতিক কার্য পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার ব্রিটেনের রাজস্ব বিভাগের উপর অর্পিত হয়।
৮. নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রবর্তন : নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রবর্তন ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অপর একটা উলেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করে উল্লেখ করা হয় যে, প্রাদেশিক আইন পরিষদে অন্ততঃ শতকরা ৭০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন এবং শতকরা ২০ জনের বেশি সরকারী সদস্য থাকতে পারবেন না। প্রত্যেক প্রাদেশিক আইন পরিষদে তিন প্রকার সদস্য থাকতেন; যেমন: নির্বাচিত সদস্য (ঊষবপঃবফ গবসনবৎং), সরকারী সদস্য (এড়াবৎহসবহঃ গবসনবৎং) এবং মনোনীত সদস্য (ঘড়সরহধঃবফ গবসনবৎং)। অবশ্য ভোটাধিকার ছিল খুবই সীমিত।
৯. সরকারী আয়ের শ্রেণীবিভাগ : এ আইন দ্বারা সরকারের আয়ের শ্রেণীবিভাগ করা হয়। এর মাধ্যমে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ের উৎসও (ঝড়ঁৎপবং ড়ভ ওহপড়সব) নির্ধারিত হয়।
ভূমি রাজস্ব ও মাদক দ্রব্যের উপর আবগারী শুল্ক (ঊীপরংব উঁঃু) প্রদেশের জন্য এবং আয়কর ও বাণিজ্যিক কর কেন্দ্রের জন্য নির্ধারিত করা হয়।
১০. হাই কমিশনার পদের সৃষ্টি : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ইংল্যাণ্ড “ভারতীয় হাই কমিশনার পদের” (ঙভভরপব ড়ভ ঐরময ঈড়সসরংংরড়হবৎ ড়ভ ওহফরধ) সৃষ্টি হয়। তিনি ইংল্যাণ্ড ভারতীয় ছাত্র ও শ্রমিকদের স্বার্থ সংশিষ্ট বিষয়াদি ও বাণিজ্য সংμান্ত বিষয়াদির তত্ত্বাবধন করতেন। তিনি পাঁচ বছরের জন্য ভারত সরকার কর্তৃক নিয়োগ লাভ করতেন।
১১. স্টেচুট্যারি কমিশন গঠন : এ আইন দশ বছর পরে একটি সংবিধিবদ্ধ কমিশন ‘স্টেটুট্যারি কমিশন’ (ঝঃধঃঁঃড়ৎু ঈড়সসরংংরড়হ) গঠনের প্রস্তাব করে। উক্ত সময়ের মধ্যে যেসব শাসন সংμান্ত ও সংস্কারমূলক কাজ সম্পনড়ব করা হবে সে সম্পর্কে প্রতিবেদন (জবঢ়ড়ৎঃ) পেশ করাই ছিল এ কমিশনের মূল উদ্দেশ্য।
১২. দায়িত্বশীল সংসদীয় সরকার গঠন : ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতের প্রদেশগুলোতে সর্বপ্রথম দায়িত্বশীল পার্লামেন্টারী স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তন করা হয়। যদিও এ দায়িত্বশীল শাসনের ক্ষেত্র ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ । তবুও তা রাজনৈতিক শিক্ষা ও সরকারী সিদ্ধান্তসমূহকে প্রভাবিত করার জন্য জনগণকে যথেষ্ট সুযোগ প্রদন করেছিল।
* দ্বৈত শাসনব্যবস্থা :
১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে প্রাদেশিক সংμান্ত বিষয়ে দু’ধরনের শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, যা দ্বৈত শাসনব্যবস্থা নামে পরিচিত। এ আইনানুসারে প্রাদেশিক সরকারের শাসন সংμান্ত বিষয়সমূহকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয় -
১. সংরক্ষিত বিষয়সমূহ (জবংবৎাবফ) এবং ২. হস্তান্তরিত বিষয়সমূহ (ঞৎধহংবৎৎবফ)।
১. সংরক্ষিত বিষয়সমূহ (জবংবৎাবফ) : সংরক্ষিত বিষয়সমূহ ছিল পুলিশ, জেল, বিচার, অর্থ ইত্যাদি। এগুলো গভর্নর এবং তাঁর “শাসন পরিষদের (২-৪ জন) সদস্য” দ্বারা শাসিত হত। হস্তান্তরিত বিষয়সমূহ ছিল কৃষি, সমবায়, শিল্প, শিক্ষা ইত্যাদি। এগুলো গভর্নর এবং তাঁর মন্ত্রিপরিষদ দ্বারা শাসিত হত।
মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা গভর্নর এবং আইনসভার নিকট দায়ী থাকতেন। কিন্তু শাসন পরিষদের সদস্যরা তাঁদের কার্যের জন্য আইন পরিষদের নিকট দায়ী থাকতেন না। ফলে একই প্রাদেশিক বিষয়সমূহ ওপর শাসন সংμান্ত দায়-দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায় দু’রকম। মন্ত্রীদের ক্ষেত্রে এক রকম এবং শাসন পরিষদের সদস্যদের ক্ষেত্রে আর এক রকম।
এভাবে প্রাদেশিক সরকার দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একই প্রদেশের বিষয়সমূহ শাসন করার ক্ষেত্রে সরকারের দু’ধরনের প্রকৃতি লক্ষ করা যায় বলে একে ‘ দ্বৈত শাসনব্যবস্থা’ বলা হয়ে থাকে।
২. হস্তান্তরিত বিষয়সমূহ (ঞৎধহংবৎৎবফ) :
* পুলিশ, জেল, বিচার, অর্থ ইত্যাদি।
* কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, সমবায় ইত্যাদি
* শাসন পরিষদ (২-৪ জন সদস্য ব্রিটিশরাজ কর্তৃক ৫ বছরের জন্য মনোনীত)
* মন্ত্রিপরিষদ ও
* গভর্নরের নিকট দায়ী, কিন্তু প্রাদেশিক গভর্নর প্রাদেশিক সরকারের নিকট দায়ী নন। আইনসভার নিকট দায়ী।
দ্বৈত শাসন ব্যবস্থার অকার্যকারিতা :
দ্বৈত শাসনব্যবস্থা ভারতবর্ষে বাস্তবিক কোন সুফল আনতে পারেনি। এর ফলে প্রদেশগুলোর শাসনক্ষেত্রে নানাবিধ অসুবিধা ও সমস্যার সৃষ্টি হয়। সঙ্গতকারণেই দ্বৈত শাসনব্যবস্থা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
চ. খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন :
ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন প্রথম গণ ভিত্তিক আন্দোলন। এ আন্দোলন দু’টি ভিনড়ব প্রেক্ষাপটে শুরু হলেও পরবর্তীতে তা একত্রিত হয়ে যায়। ফলতঃ এ আন্দোলনের শক্তি ও জনসমর্থন ছিলো ব্যাপক। খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপকতা ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতের শাসনব্যবস্থাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। যদিও এ আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয় তথাপি তা ভারতীয় জনগণের মধ্যে আত্মসচেতনতা ও রাজনৈতিক অধিকারবোধ সৃষ্টিতে বিশেষতঃ রাজনীতির সঙ্গে গণ মানুষের সম্পৃক্তকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ক্স খিলাফত আন্দোলন :
খিলাফত ইসলামের একটি ধর্মীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। মদীনায় এ প্রতিষ্ঠানের জন্ম। খিলাফত রাজনৈতিক বিবর্তনের ধারায় দামেস্ক, বাগদাদ, কায়রো ও কর্ডোভা হয়ে তুরস্কের অটোমান সুলতানদের অধিকার যায়। এটি বিশ্ব মুসলমানের নিকট ঐক্যের ও মর্যাদার প্রতীক। এ মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের অধিকারী হওয়ায় বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের মত তুরস্কের সুলতান খলিফার প্রতি ভারতীয় মুসলমানদের আনুগত্য ও সম্মানবোধ অনেক দিন থেকেই ছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) শুরু হলে তুরস্ক নিজের স্বার্থে মিত্র শক্তির (ব্রিটেন, ফ্রান্স ও রাশিয়া ইত্যাদি) বিরুদ্ধে অক্ষ শক্তির (জার্মানী, ইটালী ইত্যাদি) পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ায় ভারতীয় মুসলমানরা রাজনৈতিকভাবে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। তাদের মনে দ্বৈত আনুগত্যের প্রশড়ব দেখা দেয়। এমতাবস্থায় চতুর ব্রিটিশদের প্ররোচনায় ভারতীয় মুসলমানগণ এ শর্তে যুদ্ধে যোগদান করেন যে, যুদ্ধ শেষে ব্রিটিশরা তুরস্কের খিলাফতের মর্যাদা রক্ষা করবে, এর কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু যুদ্ধে অক্ষ শক্তি তথা তুরস্ক পরাজিত হলে এবং ব্রিটিশদের মারমুখি অবস্থানের কারণে মুসলমানগণ খলিফার মর্যাদা রক্ষা ও তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার ব্যাপারে শংকিত হয়ে পড়েন। এমতাস্থায় খলিফার মর্যাদা ও খিলাফত রক্ষার দাবীতে ভারতীয় মুসলমানগণ যে আন্দোলন গড়ে তোলে, ইতিহসে এ আন্দোলন ‘খিলাফত আন্দোলন’ নামে পরিতি। আলী ভ্রাতৃদ্বয় (মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলী), মওলানা আবুল কালাম আযাদ, ড. এম.এ. আনসারী, হযরত মোহানী , শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রমুখের নেতৃত্বে এ আন্দোলন পরিচালিত হয়।
ক্স অসহযোগ আন্দোলন :
প্রাদেশিক স্বায়ত্বশাসন প্রদানের আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে ভারতীয়রা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারকে সাহায্য প্রদান করেন। কিন্তু ১৯১৯ সালে প্রণীত মন্টেগু-চেমসফোর্ড আইন ভারতের স্বায়ত্তশাসনকে প্রত্যাখান করে। ফলে এ আইন ভারতবাসীকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। বরং এই বছরই ব্রিটিশ সরকার কুখ্যাত ‘রাউলাট অ্যাক্ট’ পাস করে। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল এই আইনের প্রতিবাদে অনুষ্ঠিত পাঞ্জাবের জালিওয়ানওয়ালা বাগের শান্তিপূর্ণ সভায় ব্রিটিশ সরকার গুলি চালায়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপ অসহযোগ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। কংগ্রেস নেতা মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী (মহাত্মা গান্ধী) এ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন।
ক্স অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের কর্মসূচি :
অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি মূলতঃ গৃহীত হয় ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেসের কলকাতা সম্মেলনে এবং একই সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের নাগপুর সম্মেলনে।
হাজার প্রতিনিধি নতুন সংগ্রামের উদ্দীপনা নিয়ে উপস্থিত হয়। সম্মেলনে পূর্ববর্তী কলকাতা কংগ্রেসে গৃহীত নতুন সংগ্রামের পরিকল্পনা প্রস্তাবকারে উপস্থিত করা হলে ২২ হাজার প্রতিনিধি (উবষবমধঃবং) একবাক্যে তা সমর্থন করে। মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণাকে ভারতীয়রা চূড়ান্ত সংগ্রামের ইঙ্গিত বলে মনে করেন। এ আন্দোলন কর্মসূচির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকে-
১. বিদেশী পণ্য বর্জন এবং স্বদেশী পণ্য ব্যবহার;
২. খেতাব ও পদবী বর্জন, অবৈতনিক পদসমূহ ত্যাগ এবং স্থানীয় পরিষদে সরকার মনোনীত ভারতীয় আসনসমূহ থেকে পদত্যাগ;
৩. সরকারী কার্যμমে অংশ গ্রহণে অসম্মতি জ্ঞাপন;
৪. আইনজীবীদের আদালত বর্জন;
৫. রাষ্ট্রচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বর্জন;
৬. নতুন কাউন্সিলের নির্বাচন বর্জন এবং এসব নির্বাচনে ভোটদানে ভোটারদের অস্বীকৃতিজ্ঞাপন;
৭. বিভিনড়ব পেশাজীবী জনগণকে মেসোপটেমিয়ায় চাকুরীতে যোগদান না করতে উদ্বুদ্ধ করা;
৮. পঞ্চায়েত গড়ে তোলা এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে সুসংহত ও সুদৃঢ় করা;
৯. চরকার সূতা কাটায় উৎসাহ দান;
মুসলমান নেতারাও এসব বর্জন কর্মসূচি সমর্থন করেন। দিল্লীতে মুসলমান নেতাদের সম্মেলন সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয় যে, আইনসভা, আদালত, স্কুল কলেজ, সরকারী খেতাব, চাকুরী বর্জন করা একজন মুসলমানের জন্য হালাল। বরং এর অন্যথায় তার জন্য হারাম। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন, যে সব মুসলমান অসহযোগ কর্ম পদ্ধতি গ্রহণ করবেন না, অন্য মুসলমানরা তাদেরকে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে বর্জন করবেন। (চলবে)৷
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷লেখক: ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ৷
বাংলাদেশ সময়: ১১:৪১:০৩ ৮৪১ বার পঠিত #Content loading problem. Please reload/refresh this pag