সোমবার, ৩১ মে ২০২১

ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৩৬”

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৩৬”
সোমবার, ৩১ মে ২০২১



নতুন প্রজন্মের চোখে মুক্তিযুদ্ধ

২. ১৯৪৭-ভারত ভাগ (উপমহাদেশের বিভাজন ) :
খ.মহাসংগ্রামের (ইংরজেদরে সঙ্গে ভারতীয়দরে) ব্যর্থতার কারণ ও ফলাফল, ভারতীয় জাতীয় সংগ্রেস :

# ইংরজেদরে সঙ্গে ভারতীয়দরে মহাসংগ্রামের ব্যর্থতার কারণ :
১৮৫৭ সালে ইংরজেদরে সঙ্গে ভারতীয়দরে মহাসংগ্রাম সুদীর্ঘ ৪ মাস ব্যাপী পরিচালিত হয়েছিলো। বিদ্রোহের সূচনালগ্নে সিপাহীরা মিরাট, কাশিমপুর, দিল্লী ও আগ্রার গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে নিয়েছিলো। আগ্নয়েগিরির লাভার মতো ছড়িয়ে পড়া গণঅভ্যুত্থান প্রথম দিকে অত্যন্ত সফল ছিলো। ইংরেজ সেনাবাহিনী পদে পদে পরাজিত হয়েছে। তবে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অনমনীয় মনোভাব, আধুনিক সমরাস্ত্র, যুদ্ধকৌশল সর্বোপরি ভারতীয় সমাজের বিভক্তিকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজ সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করে। এজন্য তারা ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত করে। যা হোক, প্রাথমিক বিজয় লাভের পরও ভারতীয়দের পরাজয়ের বেশ কিছু বাস্তবিক কারণ রয়েছে। নিম্নে তা আলোচনা করা হলো:
(ক) *ইংরেজদের আধুনিক যুদ্ধকৌশল : সামরিক বিশেষজ্ঞও ঐতিহাসিকরা মহাসংগ্রামের ব্যর্থতার জন্য ভারতীয়দের সনাতনী যুদ্ধ কৌশলকে দায়ী করেছেন। তাদের মতে ইংরেজদের সুপরিকল্পিত ও সংঘবদ্ধ যুদ্ধকৌশল যুদ্ধের ময়দানে ব্যবধান গড়ে দিয়েছে। ভারতীয় সিপাহীরা জীবন উৎসর্গ করে যুদ্ধ করলেও তাদের যুদ্ধের ময়দানের ‘স্ট্রাটেজিক ম্যাপ’ তৈরির অভিজ্ঞতা ছিলো না। কেননা, ইংরেজ সেনাবাহিনীতে ভারতীয় কোন অফিসার নিয়োগ করা হতো না। যুদ্ধের ম্যাপ মূলতঃ প্রণয়ন করে সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থকর্মকর্তারা সেপাহীদের নেতৃত্বদানকারী নানা সাহেব, ঝাঁসীর রানী বা তাতিয়া টোপীর কোন কামান বা আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র ছিলো না। অন্যদিকে হেনরী লরেন্স, হিভলক, কালন ক্যাম্পবেল প্রমুখ সেনাপতির আধুনিক কৌশলী যুদ্ধ পরিকল্পনা ভারতীয় সিপাহীদের ছদ্রভঙ্গ করে দেয়। তারা দিল−ীতে আটকা পড়ে। ইংরেজ সেনাদের দ্বারা দিল−ীতে অবর্ধু হয়ে ভারতীয় সেনাদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। এ সুযোগে হঠাৎ দিল−ী আμমণ করে ব্রিটিশরা রাজধানী পুণঃরুদ্ধর করে। রাজধানী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় সর্বভারতে সিপাহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
*পরিকল্পনা ও যোগাযোগের অভাব : এই বিপ−ব পূব পরিকল্পিত ছিল না। বিদ্রোহীদের কোন নির্দিষ্ট যুদ্ধকৌশল ও কর্মপন্থা ছিল না। বিভিনন স্থানে নেতৃবৃন্দ বিচ্ছিন্নভাবে এই বিদ্রোহ পরিচালনা করেন। উপযুক্ত যোগাযোগ বা সংহতি তাঁদের মধ্যে ছিল না। ফলে একই সময়ে সকল জায়গায় অভ্যুত্থান যেমন ঘটেনি, তেমনি সর্বত্র একই পদক্ষেপ বা কর্মপন্থা অনুসরণ করা সম্ভব হয়নি।
* আদর্শ ও স্বার্থগত দ্ব›দ্ব : অপরদিকে বিপ−বে অংশগ্রহণকারী নেতাদের মধ্যে আদর্শ ও স্বার্থের দ্ব›দ্ব বিদ্যমান থাকায় সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণে তাঁরা ব্যর্থ হয়। নানা সাহেবের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল পেশোয়া পদের পুণ:প্রতিষ্ঠা। অন্যদিকে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ যাঁকে বিদ্রোহীরা নেতা নির্বাচন করে, তার উদ্দেশ্য ছিল মোগল সম্রাটের হারানো শক্তির পুণঃরুদ্ধার করা। উভয়ের উদ্দেশ্য স্পষ্টতই ছিল পরস্পর বিরোধী। ঝাঁসীর রাণী লক্ষীবাঈও নিজের হারানো রাজ্য ফিরে পাবার চেষ্টায় নিয়োজিত হয়েছিলেন।
* সংঘবদ্ধতার অভাব : এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার অন্যতম কারণ ছিল এতে দেশের সকল শ্রেণীর মানুষ অংশগ্রহন করনে।ি তাছাড়া বিদ্রোহীদের প্রতি অনেকের সমর্থন ছিল না। যদিও কয়েকটি অঞ্চলে বিদ্রোহ প্রকট আকার ধারণ করেছিল, তথাপি তা ছিল সীমাবদ্ধ প্রকৃতির। উত্তর প্রদেশ, অযোধ্যা, রোহিলাখণ্ড এবং বাংলা ও বিহারের পশ্চিমাঞ্চলেই বিদ্রোহ সীমাবদ্ধ থাকে। দক্ষিণ ভারতের বিশাল এলাকায় এর বিস্তৃতি ঘটেনি। ভারতবর্ষের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং দেশীয় রাজণ্যবর্গের বড় অংশ এই বিদ্রোহ থেকে নিজেদের দূরে রাখে।
*ভারতীয় সাম্রাজ্যে বিভক্তি : অন্যদিকে দেশীয় নৃপতিদের অনেকেই সμিয়ভাবে বিদ্রোহ দমনে ইংরেজ সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে। হায়দ্রাবাদের নিজাম, কাশ্মীরের মহারাজা এবং মারাঠা অধিপতি সিন্ধিয়ার ভূমিকা এ প্রসঙ্গে উলে−খযোগ্য। লর্ড ক্যানিং এ সময় বলেছিলেন যে, যদি মারাঠা নেতা সিন্ধিয়া এই বিদ্রোহে যোগ দেয় তাহলে ইংজেরকে ভারত ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটা বললে অতিশয়োক্তি হবে না যে, কাশ্মীরের মহারাজার করুণার উপর তখন পাঞ্জাবে ইংরেজদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল। বিপ−বের সময়ে ভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা অর্থাৎ শিখ ও গুর্খা বাহিনী এবং কিছু সংখ্যক রাজপুত যোদ্ধা সিপাহীদের পক্ষ না নিয়ে বরং ইংরেজদের সাহায্যে এগিয়ে যায়।
*বিদ্রোহীদের মধ্যে একতার অভাব : বিদ্রোহীদের মধ্যে আদর্শগত ও ঐক্যবদ্ধ মানসিকতার অভাব ছিল। কয়েকজন ব্যতীত অধিকাংশ নেতা জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থোদ্ধারে ব্যস্ত ছিলেন। তাছাড়া, বিপ−বের নেতৃবৃন্দ পরস্পরের বিরুদ্ধে ঈর্ষান্বিত ছিলেন এবং একে অন্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন। ফলে বিদ্রোহ চলার পথে অন্তর্নিহিত শক্তি হারিয়ে ফেলে এবং শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
*ইংরেজদের অর্থনৈতিক শক্তি : উনিশ শতকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তি ছিলো ব্রিটেনে। বিশ্বের অসংখ্য রাষ্ট্রে তাদের উপনিবেশ ও সামরিক ঘাটি ছিলো। যুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটেন দ্রুত মালয় ও পারস্য থেকে অস্ত্র ও সৈন্য স্থানান্তর করে। এর ফলে ইংরেজদের শক্তি অনেকগুণ বেড়ে যায়। সিপাহীদের হাতে তেমন অর্থ না থাকায় যুদ্ধের রশদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর পুণরায় যোগাড় করা সম্ভব ছিল না।
*কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অভাব : বিদ্রোহীদের মধ্যে সুযোগ্য নেতৃত্বের অভাব ছিল। নেতাদের অধিকাংশই বিদ্রোহের যথাযথ গুরুত্ব অনুধাবনে ব্যর্থ হন। ঝাঁসির রাণী, নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপী, কুনওয়ার সিং প্রমুখ নেতৃবৃন্দ স্ব স্ব এলাকায় সুযোগ্য নেতৃত্বের পরিচয় দিলেও ব্যাপক বিদ্রোহের সার্বিক নেতৃত্বদানের ক্ষমতা তাঁদের কারও ছিল না। তা ছাড়া কোন কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা কেন্দ্রীয় সংগঠনের মাধ্যমে এ বিদ্রোহ সংঘটিত হয়নি। ফলে বিচ্ছিনড়ব ও বিক্ষিপ্ত চেষ্টাগুলো সহজেই ইংরেজদের পক্ষে দমন করা সম্ভব হয়েছিল। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকায় বিপ−ব সমন্বিত রূপ পায়নি।

* ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠত্ব : ইংরেজদের সামরিক সংগঠন ও রণকৌশল তাদের প্রতিপক্ষের চেয়ে উন্নততর ছিল। তাদের অস্ত্রশস্ত্রও ছিল আধুনিক। বিদ্রোহী নেতৃবৃন্দের তুলনায় ইংরেজ সেনাপতিরা ছিলেন অধিক দক্ষ, সাহসী ও রণকৌশলী যোদ্ধা। লরেন্স, আউটরাম এডওয়ার্ড বা নিকলসনের মতো নির্ভিক ও সমরকুশলী বিদ্রোহীদের মধ্যে কেউই ছিলেন না।
* বিদ্রোহীদের প্রয়োজনীয় শক্তির অভাব : যুদ্ধাস্ত্র এবং শক্তির দিক থেকেও বিদ্রোহীরা দুর্বল ছিল। তাদের প্রধান হাতিয়ার ছিল গাদা বন্দুক। বিপরীতে ইংরেজ বাহিনী ছিল আধুনিক টোটা বন্দুক অস্ত্র সজ্জিত ও উন্নত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত। রেলপথে দ্রুত সৈন্য প্রেরণ, টেলিগ্রাফের সাহায্যে অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় বার্তা পৌঁছানো ইত্যাদি ব্যবস্থা বিদ্রোহ দমনে তাদের প্রভূত সাহায্য করে। তদুপরি ব্রিটিশ নৌ-বাহিনী পারস্য ও মালয় থেকে প্রয়োজনীয় সৈন্য ও গোলাবারুদ এনে স্বপক্ষের শক্তি বৃদ্ধি করে। ফলে দেশীয় সিপাহীরা তাদের সঙ্গে দীর্ঘকাল ব্যাপী সংঘর্ষ চালাতে ব্যর্থ হয়।
* রাজন্যবর্গ ও ব্যবসায়ীদের বিশ্বাসঘাতকতা : কিছু সংখ্যক দেশীয় রাজ্যের নৃপতি, স্থানীয় জমিদার, সেনানায়কের বিশ্বাসঘাতকতা এবং বিদ্রোহীদের সাহায্য না করে ব্রিটিশ শাসকদের সাহায্য করা এ যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ। এছাড়া ইংরেজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী এবং দেশীয় সরকারী কর্মচারীগণও তাদের সাহায্য করেছিল।
# মহাসংগ্রামের (ইংরজেদরে সঙ্গে ভারতীয়দরে) ফলাফল :
১. কম্পানি শাসনের বিলুপ্তি ও ব্রিটিশ রাজ্যের শাসনের সূচনা : ১৮৫৭ সালের ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বা মহাসংগ্রাম চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হলেও তা ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিলো। ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এ সংগ্রাম সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখেছে। বিদ্রোহদমনের পর ১৮৫৮ সালে ব্রিটেনের মহারানী ভিক্টোরিয়া এক ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে ভারতীয় উপমহাদেশে কম্পানি শাসনের অবসান ঘটান। তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড ক্যানিং প্রথম নিযুক্ত হন।
২. মহারাণী ভিক্টোরিয়া ডালহৌসির সাম্রাজ্যবাদ নীতি ও স্বত্ব বিলোপ নীতি বাতিল করেন।
৩. জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে যোগ্যতার ভিত্তিতে সরকারী চাকুরিদানের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়।
৪. ভারতের আর্থ সামাজিক সামগ্রকি উন্নয়ন প্রক্রয়িা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট তদারকী করবেন।
৫. সেনা বিদ্রোহে ঝুকি হ্রাস করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ইংরেজ সৈন্যের অনুপাত বাড়ানো হয়।
৬. সেনাবাহিনীতে জাতিগত ও স¤প্রদায়গত বিভেদ সৃষ্টি করা হয়।
৭. মোগল সম্রাটের আইনগত সমস্ত অধিকার বিলুপ্ত করা হয়।
৮. পরবর্তীতে এই বিদ্রোহ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
৯. এই বিদ্রোহের ফলেই পরবর্তী নব্বই বছরের শাসনকালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টটি শাসনতান্ত্রিক সংস্কার আইন পাশ করে।
১০. ভারতে নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সূচনা হয়।
১১. ১৮৫৮ সালে এক রাজকীয় ঘোষণা ও সনদরে দ্বারা অবধৈভাবে ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতা ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির বদলে ইংল্যান্ডরে মহারানী নিজে গ্রহণ করেন র্অথাৎ একজন ভনিদশেী হয়ওে তনিি অন্য একটি দশেরে অভ্যন্তরীন বষিয়ে হস্তক্ষপে করনে। উক্ত সনদের প্রধান ধারাগুলো নিম্নরূপ -
১. ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির শাসনামলে ভারতীয় রাজন্যবর্গের সাথে সম্পাদিত চুক্তি মহারানীর সরকার অনুসরণ করবে।
২. ভারতীয় জনগণের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা হবে। অর্থাৎ নতুনভাবে কোন ধর্মীয় সংস্কার নীতি চাপিয়ে দেয়া হবে না।
৩. লর্ড ডালহৌসি প্রবর্তিত সাম্রাজ্যবাদনীতি ও স্বত্ব বিলোপ নীতি পরিত্যক্ত হয়।
৪. সামন্তপ্রভুরা ইচ্ছা করলে দত্তক পুত্র গ্রহণ করতে পারবেন।
৫. আইন প্রণয়ন ও কার্যকর করার ক্ষেত্রে ভারতীয়দের মতামত নেয়া হবে।
৬. সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে দেশীয় রাজ্যগুলোকে অনুমতি নিতে হবে।
৭. যে সকল ভারতীয় কম্পানি ও রাজন্যবর্গ ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলো তাদের সাধারণ ক্ষমা করা হয়।
৮. যোগ্যতা ও মেধা অনুযায়ী ভারতীয়দের সরকারী চাকরি দেয়ার নীতি গ্রহণ করা হয়। জাতি ধর্ম বর্ণগত বিভেদ ও বৈষম্য চাকরিদানের ক্ষেত্রে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।
৯. ভারতীয়দের আর্থ-সামাজিক উনড়বয়নের প্রতিশ্র“তি দেয়া হয়। বলা হয় ভারতের জনগণের উনড়বতির অর্থ ব্রিটিশ সরকারের শক্তিবৃদ্ধি। তাদের পরিতৃপ্তি ব্রিটিশ সরকারের নিরাপত্তা। তাদের কৃতজ্ঞতা ব্রিটিশ সরকারের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।
# ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ র প্রতিষ্ঠা ও এর র্কাযক্রম :
ভারতের বড় লাট লিটন ১৮৭৮ সালে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ভারতবাসীদের নিরস্ত্র করতে যথাμমে ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট এবং আর্মস অ্যাক্ট পাশ করে। এর তিব্র বিরোধিতা করে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর ‘ভারত সভা’সহ কয়েকটি সংগঠন। কেননা, প্রেস অ্যাক্টের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকার দেশীয় সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করে। ফলে ইংরেজ ও ভারতীয়দের সম্পর্কের ক্ষেত্রে চরম অবনতি ঘটে। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চেতনার সৃষ্টি হয়। জাতিগত বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ পরিস্থিতিতে আবার লর্ড রিপনের সময়কার ‘ইলবার্ট বিল’ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ইলবার্ট বিলের ফলে ইংরেজ ও ভারতীয়দের মধ্যে এক নিদারুণ বর্ণ বৈষম্যের সূত্রপাত হয়। ইলবার্ট বিলে প্রস্তাব করা হয়েছিলো, ভারতীয় জজরা ইউরোপীয় অপরাধীদের বিচার করতে পারবে। এর আগে ব্রিটিশ বা ইউরোপীয়দের বিচারের ক্ষমতা ভারতীয় বিচারকদের ছিলো না। ইলবার্ট বিলের বিরোধিতায় খোদ ইউরোপীয়রা রাজপথে নামে। এর পাল্টা প্রতিক্রয়িাস্বরূপ ভারতীয়রাও আন্দোলন গড়ে তোলে। এসবের প্রেক্ষাপটে এ্যালান অক্টোভিয়ান হিউস নামে একজন ইংরেজ অবসরপ্রাপ্ত আইসিএস কর্মকর্তা ভারতবাসীদের অসন্তোষ প্রশমিত করার লক্ষ্যে ১৮৮৩ সালের ১ মার্চ একটি খোলা চিঠির মাধ্যমে ভারতীয়দের রাজনৈতিক, সামাজিক, নৈতিক উৎকর্ষতা লাভের প্রয়োজনে ভারতবর্ষে একটি স্থায়ী সংগঠন গড়ে তোলার পরামর্শ প্রদান করেন। একই সঙ্গে হিউম বড়লাট ডাফরিনকে ভারতীয় গণবিদ্রোহ থেকে বাঁচার জন্য একটি ব্রিটিশ অনুগত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠনের পরামর্শ দেন। এ সময় ভারতীয় মধ্যবিত্ত শ্রেণীও একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টির চিন্তা করছিলো। এভাবে হিউমের উদ্যোগে লর্ড ডাফরিনের সমর্থনে ১৮৮৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর বোম্বাই শহরে সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস নামে একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত হয় যে দলটি পরর্বতীতে ১৯৪৭ সালে ভারতর্বষরে স্বাধীনতা যুদ্ধে নতেৃত্ব দয়িছেলি । দু’জন মুসলমানসহ সত্তর জন প্রতিনিধি কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন বাঙ্গালি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র ব্যানার্জী। তিনি কংগ্রেসের চারটি উদ্দেশ্যের কথা ঘোষণা করেন-
১. ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে যারা দেশ সেবায় নিয়োজিত তাদের মধ্যে যোগাযোগ ও বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠা।
২. জাতি-ধর্ম-বর্ণ আঞ্চলিকতার সংকীর্ণতা দূর করে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা।
৩. বিশিষ্ট জ্ঞানী, গুণী ও রাজনৈতিক নেতাদের সাতে পরামর্শ করে ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো।
৪. রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য পরবর্তী বছরের কর্মসূচি নির্ধারণ করা।
জন্মলগ্ন থকেইে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ছিল মূলতঃ একটি স্বার্থকর্মী সংগঠন। নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে ভারতীয় জনগণের অভাব অভিযোগ দূর করা ছিলো এর লক্ষ্য। আর এ জন্য দেশের জনমত সংগটিত করা এবং শাসনব্যবস্থায় জনগণের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর জন্য সচেষ্ট ছিলো কংগ্রেস। প্রথমদিকে অল্প কয়েকজন মুসলমান এতে যোগদান করেন।
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গি দু’টি পর্বে বিভক্ত। প্রথমদিকে মুসলমানরা স্বত:- স্ফ‚র্তভাবে কংগ্রেসে যোগ দেয়। প্রতষ্ঠিালগ্নে মুসলমানরা কংগ্রেসকে একটি অসা¤প্রদায়িক রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে বিবেচনা করে। কিন্তু সামাজিক পাটাতনে হিন্দু-মুসলমান স¤প্রদায়ের বিভক্তির প্রভাব কংগ্রেসের ওপরও পড়ে। কংগ্রেসের কিছু নেতার সা¤প্রদায়িক কর্মকাণ্ড মুসলমানদের হতাশ করে। ইংরেজী শিক্ষাকে কেন্দ্র করে হিন্দু মুসলমান স¤প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য ছিলো। শুরুতেই ইংরেজী শিক্ষা গ্রহণ করায় হিন্দুরা মুসলমানদের থেকে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে অনেক এগিয়ে যায়। এ প্রেক্ষাপটে কংগ্রেসে কার্যতঃ হিন্দু স¤প্রদায়ের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস উর্দু ভাষার পরিবর্তে হিন্দি ভাষার ওপর অধিক গুরুত্ব দিলে এবং হিন্দি ভাষায় জাতীয় সঙ্গীত ও দলীয় সঙ্গীত গাইতে শুরু করলে মুসলমান জনগণ ক্ষুব্ধ হয়। চাকরির ক্ষেত্রে মুসলমানদের দাবি ছিলো আলাদা কোটা প্রবর্তনের। কংগ্রেস এ দাবিকে সমর্থন করেনি হিন্দু স¤প্রদায়ের বিরোধিতায়। কংগ্রেসে প্রতিনিধিত্বে হিন্দুদের সহযোগিতা পায়নি মুসলমানরা। এসব কারণে মুসলমান নেতারা উপলব্ধি করেন, কংগ্রেসের মাধ্যমে তাদের স্বার্থ রক্ষা সম্ভব নয়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের পরে হিন্দু মুসলমান স¤প্রদায়ের বিভক্তি আরো জোড়ালো হয়ে ওঠে। এ প্রেক্ষাপটে মুসলমান নেতারা একটি পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। যার অভিব্যক্তি ঘটে ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠনের মধ্য দিয়ে।
মূলতঃ ব্রিটিশ ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’র প্রতিষ্ঠা একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বিকাশের উষালগ্নে কংগ্রেসের আত্মপ্রকাশ। পরবর্তীতে কংগ্রেসই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। যদিও ধারণা করা হয়েছিলো কংগ্রেস ভারতীয়দের রাজনৈতিক অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করলেও তা বরাবরই ইংরেজদের স্বার্থরক্ষা করবে, তবে বাস্তবে তেমনটা সম্ভব হয়নি। ইতিহাসের গতিধারা বিশে−ষণ করে দেখা যায়, প্রাথমিক অবস্থায় কংগ্রেস ব্রিটিশদের সর্মথন করলওে পরবর্তীতে ভারতীয়দের আশা আকাঙ্খার প্রতীকে পরিণত হয়। প্রতিষ্ঠার ৬২ বছরের মধ্যে দলটি ভারতবর্ষে স্বাধীনতা নিশ্চিত করে।(চলবে)

ফারহানা আকতার

তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷লেখক: ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ৷

লেখকের অন্যান্য বই

বাংলাদেশ সময়: ১৫:০০:১০   ৯৯৯ বার পঠিত