শুক্রবার, ৭ মে ২০২১

ছয় ঘন্টার টানাপোড়েনের কাহিনী -ড. জেবউননেছা [ফেইসবুক অনুপ্রেরণা কড়চা ]

Home Page » শিক্ষাঙ্গন » ছয় ঘন্টার টানাপোড়েনের কাহিনী -ড. জেবউননেছা [ফেইসবুক অনুপ্রেরণা কড়চা ]
শুক্রবার, ৭ মে ২০২১



ফেইসবুক থেকেই নেয়া ছবি ঘটনার
০৬.০৫.২০২১ইং
সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দা থেকে দেখতে পেলাম সাভারগামী বাস চলছে।আমি আশ্বস্ত হয়ে ব্যক্তিগত গাড়িটি নিলামনা।যদিও আসিরের বাবা বলেছিল,গাড়ি নিতে।কিন্ত আমি নেইনি।আর ন্যাচারালি আমি গণ পরিবহনেই বেশি চড়ি।যে কারণে ঢাকার প্রায় সব রুটের বাসের নাম আমার জানা।
যাই হউক ৯.১৫ মিনিট বাসা থেকে বের হলাম জাবির উদ্দেশ্যে।
একটা বাসে উঠলাম নামিয়ে দিল গাবতলি কারণ সিটিতে বাস চলবে।ঢাকার বাইরে বাস যাবেনা।আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম,আমি জাবি যাবই।যেভাবেই হউক।
এরপর আর একটি বাসে উঠলাম নামিয়ে দিল বেড়িবাধ।এরপর আর একটি বাসে উঠলাম নামিয়ে দিল বিরুলিয়া।এরপর সিএনজি নিয়ে ঠিক ১১.১০ মিনিটে জাবি গেলাম।
টিএসসির কাজ সেরে,ঠিকাদারকে সব কাজ বুঝিয়ে দিয়ে,বিভাগের কিছু কাজ সেরে,’ইচ্ছা’ নামক সংগঠন থেকে পরিচালিত দরিদ্র মানুষের খাদ্য সামগ্রী দিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম ডেইরি ফার্ম থেকে অটো রিকশা নিলাম সাভার পর্যন্ত।পথে অল্পের জন্য আমি আর চালক ট্রাকে পিষ্ট হওয়া থেকে বাচলাম। আলহামদুলিল্লাহ।
সাভারে এসে দেখি কোন বাস নেই।
এরপর সাভার থেকে অটো রিকশা নিলাম গাবতলি পর্যন্ত।
কিন্ত চালক আমিনবাজার নামিয়ে দেয়ায় সেখান থেকে হেটে গাবতলি এসে আর একটি বাস ধরলাম বাসার উদ্দেশ্যে।এবার গাবতলি থেকে আসাদ গেট ভাড়া মাত্র ৫০ টাকা।
সর্বসাকুল্যে আসা যাওয়ায় খরচ মাত্র ৫০০ টাকা।
যাই হউক লক ডাউনের জন্য মাসের পর মাস তো যেতেই হয়না,কিন্ত বেতনতো একাউন্টে জমা পড়ে প্রতিমাসে।( যদিও আমি করোনার সময় বিভাগের চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় গণ পরিবহনে বহুবার জাবি গিয়েছি,এরপর ও গিয়েছি তবে আগের চেয়ে কম।তাই আজকে যাবার সুযোগ টি হাতছাড়া করতে চাইনি।কারণ,টিএসসির অন্তর্ভুক্ত ক্যাফেটারিয়া,অডিটোরিয়াম, টিএসসি মূল ভবনের সংস্কার কাজ শুরু হবে।টিএসসির অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে ঠিকাদারকে কাজ বুঝিয়ে দেয়া আমার দায়িত্বের অংশ)
শিক্ষাজীবনে শিখেছিলাম
‘Life is challenge-take it’
আজ সেই চ্যালেঞ্জ নিয়েই জাবি গিয়েছি।চাইলে গাবতলি থেকে ফিরতে পারতাম,কিন্ত ফিরিনি।
জীবনে এর চেয়ে বড় বড় টানাপোড়েন এসেছে থামিনি।তাহলে আজ কেন থামব?
বাসায় ফেরার পথে আমিনবাজার থেকে গাবতলি হাটতে হাটতে দেখেছি শত শত মানুষ হাটছে তাদের গিয়ে গন্তব্যের পথে ।অনেকের মুখে মাস্ক নেই।তবে সবার হাতেই ব্যাগ।লেখাটি যখন লিখছি,তখন বাসের জানালায় ছো মেরে আমার মুঠোফোনটি ছিনতাই করতে চাইল এক যুবক। কিন্ত আল্লাহর অশেষ রহমতে সে হেরে গিয়েছে,আমি জিতে গিয়েছি আলহামদুলিল্লাহ।
এদিকে ঘড়িতে যখন ২.৪৮ মিনিট, তখন মনে হলো এপার্টমেন্টের লিফট ৩ টায় ১ ঘন্টার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।ম্যানেজারকে ফোন দিয়ে বললাম, একটু অপেক্ষা করা যায়না?( যদিও আমি আলগা সুবিধা নেবার পক্ষে নই,কিন্ত আজ না পেরে সুবিধাটি নিতে চেয়েছি।।)সে বলল ৩.০৫ মিনিট পর্যন্ত সর্বোচ্চ অপেক্ষা করা যাবে।তখনও আমি কলেজ গেট।যাই হউক,গাড়ি থেকে নেমে একরকম ঝুঁকি নিয়েই আসাদগেটের রাস্তা পাড় হলাম।তখন ঘড়িতে ২.৫৬ মিনিট।
ঠিক যখন ২.৫৯ মিনিট আমি লিফটের সামনে এসে দাড়ালাম।যাক বাবা বাঁচা গেল,আলগা সুবিধা নিতে হলোনা।
বাসায় এসে দেখি, আসির মূল দরজা ছিটকিনি না দিয়ে ভিজিয়ে রেখেছে,আমি বললাম কি ব্যাপার,সে বলল,তুমি নেই,বাসায় একা,তাই ভয় পাচ্ছিলাম।এজন্য ভিজিয়ে রেখেছি।আহারে বাচ্চাটা বড়ই হচ্ছেনা।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ঘরের তাপমাত্রা ৩১ডিগ্রি সেলিসিয়াস।তাহলে বাইরে কি অবস্থা।
মনের মধ্যে প্রশ্ন,আচ্ছা যে মানুষগুলোকে দেখে এলাম গন্তব্যের দিকে হেটে যেতে,তারা কি গন্তব্যে পৌছাতে পারল কিনা।নাকি তপ্ত রোদে এখনো হাটছে? অথবা যে আমার মুঠোফোনটি ছিনতাই করতে চাইল,সে যে কার মুঠোফোন ছিনতাই করল কে জানে?
যাই হউক অনেকের মতো আজ আমি হয়েছিলাম অনেকের মত।খুজে ফিরেছি দিনমজুর,রিকশাওয়ালা, সাধারণ মানুষের কষ্ট।আমি না হয় একদিন এমন টানাপোড়েনের মাঝে পড়েছি।কত শত মানুষ প্রতিদিন এমন করেই জীবনযুদ্ধে পথে নামে।
কেউ জয়ী হয়ে ফিরে,কেউ ব্যর্থ হয়ে ফিরে।
যাই হউক কথায় আসি,
এ জীবনটায় প্রতি পদে পদে এমন প্রতিবন্ধকতা এসেছে,আমি মুষড়ে যাইনি।।কতিপয় অসুরেরা পথ আগলে রেখেছিল,আমি থেমে যাইনি।তাদের পথ আগলে রাখার নোংরামিকে শক্তি হিসেবে নিয়ে এগিয়ে গিয়েছি। দিনের পর দিন আসিরকে সাথে নিয়ে নিয়েই অফিস করেছি।ক্লাশ নিয়েছি।চেয়ারম্যানশিপ করেছি।কোনদিন ক্লাশে দেরিতে যাইনি। আর ও কত কি।আসির জন্মের ২৪ দিন আগে মাতৃত্তকালীন ছুটি নিয়েছি।তখন তো পথ ছিল আরও কঠিন।মতিঝিল থেকে গণ বিশ্ববিদ্যালয়।সে গল্প না হয় অন্য আর একদিন লেখা যাবে।১৭ বছরের কর্মজীবনে কেউ বলতে পারবেনা,কোনদিন ফাকি দিয়েছি কিনা।আর এজন্য গলা বড় করে কথা বলতে পারি।
কর্মে ফাঁকি দেয়া আমার অভিধানে নেই।পেশা পেশাই,সেখানে ব্যক্তিগত ঝক্কি ঝামেলা আনলে প্রফেসনাল হওয়া যায়না।তবে আমার এরকম প্রফেসনালিজমের জন্য আমি একজন ধূর্ত প্রশাসক হিসেবে অনেকের চক্ষুশূল ।যদিও আমি এসব পাত্তা দেইনা।কারন বরাবরই আমি সস্তা জনপ্রিয়তার পক্ষে নই।এতে কারো ভাল লাগলে লাগবে,না লাগলে নাই।
ছোটবেলা দুই বছর বয়সে আব্বু ঢাকার ধুপখোলা থেকে চাকাসহ কাঠের ঘোড়া কিনেছিলেন আমার জন্য।সে গাড়ির টকটক শব্দ আমাকে শিক্ষা দিয়েছে আমি নারী নই মানুষ।উল্লেখ্য যে আব্বু কোনদিন আমাকে পুতুল কিনে দেয়নি।সব সময় গাড়ি কিনে দিয়েছে। আব্বুর দিনলিপি তাই সাক্ষি দেয়।
আমি যখন রাস্তায় বের হই তখন নিজেকে ‘মানুষ’ মনে করি।এজন্য আমি কোন কাজে হাত দিলে কাজটা করে ছাড়ি।তা যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক না কেন।
জীবন মানেই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা।এভাবেই যুদ্ধে অবতীর্ন হতে হয়।কোনরকম সুবিধা না নিয়ে।তাহলে যুদ্ধ জয়ের স্বাদটা পুরো নেয়া যায়।
একটা কথা বলা হয়নি, পুরো ছয় ঘন্টা শুধু আল্লাহকে মনে মনে স্মরণ করেছি আর বলেছি,হে আল্লাহ তুমি আমার কাজকে সহজ করে দাও ( আল্লাহুম্মা ইয়াসিরলানা ওমুরানা’)।আল্লাহ আমার ডাক কবুল করেছেন আলহামদুলিল্লাহ।
অহ মাই গড ঘড়িতে ৩.৩০ মিনিট!!! কখন বাজল খেয়ালই করিনি।
আজ বুয়া আসেনি।আমাকে এখন বুয়া হতে হবে।যদিও বুয়া রান্না করেনা আমিই করি।কিন্ত সে হাড়িপাতিল ওয়াশ করে,ঘর ঝাড়ে,মুছে,কাপড় ওয়াশ করে। আজ আমাকে রান্নাসহ সব করতে হবে, যাই রান্নাঘরে।রান্না করতে।
আমি নারী
নারীদের যুদ্ধটা কিন্ত একাই করতে হয়।কেউ পাশে থাকেনা।পারলে পথ আগলে রাখে।সুতরাং, নারী তুমি ভীষণ একা।একাকিত্তকে শক্তি হিসেবে নিয়ে এগিয়ে যাও।
অগ্রজ,অনুজ,সতীর্থ সবার কাছে দোয়া চাই,যেন সুস্থ থাকি।

সুত্রঃ ড. জেবউননেছার ফেইসবুক ওয়াল

অধ্যাপক ড. জেবউননেছা

লেখক

অধ্যাপক ড. জেবউননেছা

প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ,   লোক প্রশাসন বিভাগ এবং অতিরিক্ত পরিচালক, ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশ সময়: ১৪:১১:৪৩   ৮৫১ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #  #