সোমবার, ২৬ এপ্রিল ২০২১
ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৩১”
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম –“ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ –পর্ব- ৩১”২৬. ব্রিটিশ ভারত : ১৮৫৮ খ্রী:–১৯৪৭খ্রী (বাকী অংশ) :
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ইতিহাস :
• ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত একটি জয়েন্ট-স্টক কোম্পানি। এর সরকারি নাম “ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি”। ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ‘রাণী প্রথম এলিজাবেথ’ এই কোম্পানিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার রাজকীয় সনদ প্রদান করেন। এ সনদ কোম্পানিটিকে ২১ বছর পর্যন্ত পূর্ব ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্য করার প্রাধিকার অর্পণ করেছিল। তবে পরবর্তীকালে এ কোম্পানি সম্পূর্ন অবৈধভাবে ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৮৫৮ সালে বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করে। অত:পর ব্রিটিশ সরকার অবৈধভাবে সরাসরি ভারতবর্ষ শাসন ও শোষন শুরু করে।
• ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি
১৬০০ সালে ভারত ও পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ডের একদল ইংরেজ বণিক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন করে। ৩১ ডিসেম্বর ‘রাণী এলিজাবেথ’ এর সনদ বলে উক্ত কোম্পানি উত্তমাশা অন্তরীপ থেকে সমগ্র পূর্বাঞ্চলে বাণিজ্যের একচেটিয়া অধিকার লাভ করে। তারা ১৬০৮-এ মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের শাসনকালে সুরাটে প্রথম বাণিজ্য কুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। পরে অন্যান্য স্থানসহ হুগলিতে বাণিজ্য কুঠি স্থাপিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দীর ১৬৫৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন প্রতিনিধি হিসেবে ‘জেমস হার্ট ‘ ঢাকা প্রবেশ করার মধ্য দিয়ে বাংলায় ইংরেজ আগমন শুরু হয়। ১৭১৫ সালে মোগল দরবার থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নিজস্ব মুদ্রা ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়। ঐ মুদ্রা মোগল সাম্রাজ্যেও চালু হয়। ১৭৫৬ সালে নবাব সিরাজউদৌলা কোলকাতা দখল করে নেবার পরে (২০ জুন) লর্ড ক্লাইভ এবং ওয়াটসন তামিলনাড়ু থেকে জাহাজযোগে সৈন্যবাহিনী নিয়ে আসেন ও তারা কোলকাতা পুনরায় দখল করেন (২জানুয়ারি,১৭৫৭)। কোম্পানির কেরানি, পরে ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যবাহিনীতে যোগ দেন। নিজের যোগ্যতায় পরে উঁচু পদ পান। চন্দননগর দখল করার পরে বাংলার প্রখ্যাত নবাব সিরাজউদৌলাকে উৎখাত করার জন্য সিরাজের পরিবারের কয়েকজন ও মীরজাফর, উমিচাঁদ, জগত শেঠ প্রমুখদের সঙ্গে গভীর ষড়যন্ত্র করেন। চুক্তি মতো কাজ হয় ও নদীয়ার পলাশির প্রান্তরে সিরাজউদৌলার সঙ্গে একটি মেকি অর্থাৎ পরিকল্পনামাফিক যুদ্ধ হয়। ‘নবাব সিরাজউদৌলা’ পরাজিত হয়ে পালাবার সময় ধরা পড়ে নিহত হন। চুক্তি মতো ‘নবাব সিরাজউদৌলা’ এর সেনাপতি- ‘মীরজাফর’ বাংলার নবাব হন এবং ‘ক্লাইভ’ নগদ ত্রিশ লক্ষ টাকা ও চব্বিশ পরগনার জায়গিরদারি লাভ করেন। জায়গির থেকে ক্লাইভের বছরে তিন লক্ষ টাকা আয় হত। পরে ১৭৬০-এ ক্লাইভ দেশে ফিরে যান। এ দিকে তার অভাবে ইংরেজরা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আবার ক্লাইভের ডাক পড়ে।
ক্লাইভ এ দেশে আবার ফিরে আসেন ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে এবং ইংরেজ সরকারের গভর্নর নিযুক্ত হন। তিনি তখন দিল্লির ‘বাদশাহ শাহ আলম’ এর কাছ থেকে বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করেন (১৭৬৫, আগস্ট ১)। বিহার-ওড়িশার প্রকৃত শাসন ক্ষমতা লাভ করে, নবাবের নামমাত্র অস্তিত্ব থাকে। ফলে পূর্ব ভারতের এই অঞ্চলে যে শাসন-ব্যবস্থা চালু হয় তা দ্বৈত শাসন নামে পরিচিতি লাভ করে । নবাবের হাতে থাকে প্রশাসনিক দায়িত্ব, আর রাজস্ব আদায় ও ব্যয়ের পূর্ণ কর্তৃত্ব পায় কোম্পানি। এতে বাংলার নবাব প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে আর এই সুযোগে কোম্পানির লোকেরা খাজনা আদায়ের নামে অবাধ লুণ্ঠন ও অত্যাচার শুরু করে দেয়। ১৭৭০-এ (বাংলা ১১৭৬) অনাবৃষ্টি হয়। দেশে দেখা দেয় চরম বিপর্যয় ও দুর্ভিক্ষ। কয়েক লক্ষ মানুষ না খেতে পেয়ে মারা যান। এটাই ইতিহাসখ্যাত ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে পরিচিত। এরপর ১৭৯৩ সালে ‘লর্ড কর্নওয়ালিশ’ প্রবর্তিত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এর মাধ্যমে ‘ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ এর শাসন মূলত এবং মুখ্যত লাভজনক ব্যবসায়িক দৃষ্টি ও রীতিপদ্ধতিতেই পরিচালনা করতে শুরু করেন । কোম্পানির স্বার্থে ও সুবিধার জন্য ১৭৬৫ সালে বাংলার কৃষিপণ্যকে বাণিজ্যিকীকরণ, ১৭৭৩ সালে রেগুলেটিং অ্যাক্ট পাস, ১৮১৩ সালে ভারতে ফ্রি ট্রেড প্রবর্তন এবং ওই বছরই বাংলার মুখ্য শিল্প খাত টেক্সটাইল রপ্তানি বন্ধ, ১৮২০ সালে টেক্সটাইলকে আমদানি পণ্য হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩০-এ কলকাতা ডকিং কোম্পানি প্রতিষ্ঠা, ১৮৩৫ সালে ইংরেজিকে অফিস-আদালতের ভাষা হিসেবে ঘোষণা, ১৮৩৮-এ বেঙ্গল বন্ডেড ওয়্যারহাউস অ্যাসোসিয়েশন গঠন এবং ১৮৪০ সালে বেসরকারি খাতে চা-বাগান স্থাপনের মাধ্যমে এ দেশীয় অর্থনীতির স্বনির্ভর সত্ত্বাকে পুরোপুরি পরনির্ভর করার কার্যক্রম শুরু হয়। বাংলা নামের এই অঞ্চলটি ধীরে ধীরে ইংরেজদের সম্পূর্ণ করায়ত্ব হয় ১৮১৩ সালে। ব্রিটিশ সরকার এক ‘চার্টার অ্যাক্ট’ বলে কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকার বিলুপ্ত করে এবং ভারতবর্ষ শাসনভার কোম্পানির উপর ন্যস্ত করে। ১৮৫৮ সালে কোম্পানি বিলুপ্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সরকার ভারতশাসনের দায়িত্ব সরাসরি গ্রহণ করে।
• বণিক থেকে রাজা
ব্রিটিশদের ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ ভারতবর্ষে অর্থাৎ এ উপমহাদেশে এসেছিল বাণিজ্য করার লক্ষ্য নিয়ে। কিন্তু অবস্থা বুঝে পরববর্তিতে তারা ব্রিটিশ রাজের আনুকূল্যে এ উপমহাদেশে শাসনকর্তা হিসাবে আবির্ভূত হন এবং প্রায় ২০০ বছর (১৭৫৭ -১৯৪৭) এ উপমহাদেশ শাষন ও শোষণ করে অবৈধভাবে এখানকার সকল ধন-সম্পত্তি বলতে গেলে একরকম লুট-তরাজ করে নিয়ে নিজেদের দেশ অর্থাৎ ইংল্যান্ডকে সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্রে পরিনত করেন ৷এ জন্য কবি লিখেছেনঃ ‘বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী, দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে’৷এসময় ভারতীয় উপমহাদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল বর্তমানের তিনটি স্বাধীন রাষ্ট্র তথা ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান ৷(চলবে) ৷
তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷ লেখক: ফারহানা আকতার, ডিরেক্টর এন্ড এ্যাসোসিয়েট প্রফেসর, ইন্টারন্যাশনাল রবীন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট, কলামিস্ট, কথাসাহিত্যিক এবং সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশ ৷
বাংলাদেশ সময়: ১২:৪৩:০৩ ৭৭২ বার পঠিত