মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল ২০২১

লকডাউন একেবারেই ঢিলেঢালা

Home Page » জাতীয় » লকডাউন একেবারেই ঢিলেঢালা
মঙ্গলবার, ৬ এপ্রিল ২০২১



 ফাইল ছবি

বঙ্গনিউজঃ  করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে দেশজুড়ে শুরু হওয়া সপ্তাহব্যাপী লকডাউনের প্রথম দিনের চিত্র ছিল একেবারেই ঢিলেঢালা। প্রধান সড়কের পাশের কিছু দোকানপাট ও ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ছাড়া কার্যত প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই ছিল খোলা। তবে উপস্থিতি ছিল তুলনামূলক কম। কাঁচাবাজার ও অলিগলির চেহারা ছিল স্বাভাবিক। কেবল বিমান, ট্রেন, দূরপাল্লার বাস এবং বড় নগরীগুলোতে গণপরিবহন বন্ধ ছিল। কিন্তু অন্যান্য যানবাহন স্বাভাবিকভাবেই চলেছে। অফিস-আদালত ছিল খোলা। তবে উপস্থিতি ছিল কিছুটা কম। গ্রামে লকডাউনের কোনো ছাপই চোখে পড়েনি। জীবনযাত্রা ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। কয়েকটি এলাকায় স্বল্প দূরত্বের গণপরিবহনও চলেছে। কিছু স্থানে ব্যবসায়ীরা মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। যথারীতি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের চিত্র ছিল হতাশাজনক।

গতকাল সোমবার ভোর ৬টা থেকে সরকার ঘোষিত ‘লকডাউন’ শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজপথে মানুষের উপস্থিতি বাড়তে থাকে। রিকশা-সিএনজিচালিত অটোরিকশা-মোটরবাইকে কর্মস্থলের উদ্দেশে রওনা হন। অনেকে প্রতিষ্ঠানের বাসে যাতায়াত করেছেন। কাউকে কাউকে হেঁটেও রওনা হতে দেখা গেছে বিভিন্ন স্থানে। রাজপথে গণপরিবহন না থাকায় নগরে যানজট-কোলাহল ছিল না। অবশ্য কয়েকটি ক্রসিংয়ে কিছু যানজটের চিত্র চোখে পড়েছে। রাইড শেয়ার অ্যাপ বন্ধ থাকলেও চুক্তিতে বিভিন্ন দূরত্বে যাত্রী পরিবহন করতে দেখা গেছে চালকদের। গণপরিবহন না থাকায় রিকশা-অটোরিকশা চালকরা যাত্রীদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া নিয়েছেন।

সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা থাকলেও উপস্থিতি ছিল কম। ব্যাংকগুলো যথারীতি সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত খোলা ছিল। কিছু শাখায় লেনদেনকারীর ভিড় ছিল বেশি। সেগুলোতে নির্ধারিত সময়ের পরও লেনদেন চলেছে। শপিং মল ও বড় বিপণিবিতানগুলো ছিল বন্ধ।

রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীরা লকডাউনে দোকান সীমিত সময়ের জন্য হলেও খোলা রাখার দাবিতে রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন। আরও কয়েকটি শহরে ব্যবসায়ীরা দোকান খোলা রাখার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন। তাদের বক্তব্য, সরকারি অফিস-আদালত, বইমেলা খোলা থাকলে দোকানপাটও সীমিত পরিসরে খোলা থাকবে না কেন। অন্যদের পেটে খিদে আছে। দোকানদারদের কি পেটে খিদে নেই?

এদিকে লকডাউনকে কেন্দ্র করে গতকালও অনেককে রাজধানী ছাড়তে দেখা গেছে। টার্মিনালগুলো থেকে দূরপাল্লার বাস না ছাড়লেও একই রুটের কয়েকজন যাত্রী জড়ো হয়ে মাইক্রোবাস ভাড়া করে রওনা দিয়েছেন। এসব ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের কোনো ‘বালাই’ ছিল না। মহাসড়কের কয়েকটি পয়েন্টে যানজটেরও সৃষ্টি হয়। কয়েকজন মিলে ভাড়া ভাগাভাগি করে অটোরিকশায় সওয়ার হতে দেখা গেছে। সিএনজি অটোরিকশা চালকরা জানান, এতে যাত্রীরও লাভ। তাদেরও লাভ। যাত্রীরা অভিযোগ করেন, লকডাউনের কারণে অটোরিকশা ও রিকশাচালকরা ভাড়া তিনগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। না গিয়ে তো উপায় নেই। গন্তব্যে তো যেতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনের যেসব নিয়ম ঘোষণা করা হয়েছে তা যথাযথ হয়নি। এতে সংক্রমণ আরও বাড়তে পারে। তাদের ভাষ্য, দোকানপাট-বাজার চালু থাকলে মানুষ যাবে। কলকারখানা, অফিস-আদালত খোলা থাকলে মানুষকে সেখানে কাজে যেতে হবে। আবার বিদেশ থেকে মানুষ আসতে পারবে; সঙ্গে লকডাউনে ছুটির আমেজে কয়েক লাখ মানুষ শহর ছেড়েছেন, তারা যাতায়াত করবেন। ফলে লকডাউনের মাধ্যমে মানুষকে ঘরে রাখার উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। কারণ জনসমাগম এবং মানুষের মধ্যে সংস্পর্শের যথেষ্ট সুযোগ রাখা হয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এমন লকডাউন কার্যত কোনো কাজে আসবে না। প্রথম দিন দেখা গেল জনসমাগম হলো, দোকানপাট খোলা ছিল, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য-সামগ্রীর বাজারে মানুষের ভিড়। মানুষ স্বাস্থ্যবিধিও যথাযথভাবে মানেনি। অধিকাংশ মানুষের মুখে মাস্ক ছিল না। এমনকি সড়কেও যানজট হয়েছে। তাহলে লকডাউন কীভাবে হলো? এভাবে চললে সংক্রমণ কমবে না। মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে। মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধিও। তাহলেই কেবল এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অন্যথায় বিপদ আরও বাড়বে।

ঢাকার বাইরের চিত্র: দেশের মফস্বল এলাকাগুলোতে গণপরিবহন ও বড় দোকানপাট বন্ধ থাকা ছাড়া জীবনযাত্রা ছিল স্বাভাবিক। সর্বত্রই খাবার দোকান ছিল খোলা। রেস্টুরেন্টে বসে খাবার গ্রহণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কোথাও তা অনুসরণের চিত্র চোখে পড়েনি।

চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও ব্যক্তিগত যানবাহন ও মোটরসাইকেল চলাচল ছিল চোখে পড়ার মতো। সাধারণ ও অফিসগামী মানুষ রিকশায় চড়ে, কেউ হেঁটেই যাতায়াত করেছেন। নগরীর তিনটি প্রবেশ পথে কঠোর নজরদারি চালিয়েছে পুলিশ। নগরীর বহু এলাকায় বহু দোকানপাট অর্ধেক খোলা রাখতে দেখা গেছে। অলিগলির মুখে ও ভেতরে প্রচুর মানুষ মুখে মাস্ক ছাড়াই আড্ডা দিয়েছেন। লকডাউনের বিরোধিতা করে নগরীতে বিক্ষোভ ও সমাবেশ করেছেন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান জানান, লকডাউন কার্যকর করতে নগরীতে ১০ জন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে রয়েছেন। নগরের তিনটি প্রবেশ পথে বিআরটিএ ম্যাজিস্ট্রেটরা দায়িত্ব পালন করছেন।

সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে লকডাউনের প্রথম দিনকে অনেকটা হরতাল পালনের মতোই বলে মন্তব্য করেছেন আখালিয়া কালীবাড়ির বাসিন্দা শামসুর রহমান জাবেদ। তার মতে, বিএনপি বা অন্য কেউ হরতাল আহ্বান করলে নগরীর দৃশ্য এরকম হয়। সিলেটে লকডাউনে বিভিন্ন মার্কেট ও দোকানপাট বন্ধ থাকলেও নগরীতে রিকশা ও সিএনজি অটোরিকশা চলাচল করেছে। তবে বিভিন্ন পাড়ামহল্লার অধিকাংশ দোকানপাট খোলা ছিল। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় নগরীতে লোকজনের আনাগোনা ছিল কম। সিলেটের ব্যাংক ও সরকারি অফিস আদালতে উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। অধিকাংশ বিচারিক আদালতও বন্ধ ছিল। দুপুরে নগরীর কোর্ট পয়েন্ট এলাকায় লকডাউনের প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা মিছিল করেছেন। লকডাউন বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে মাঠে নামে সিলেট সিটি করপোরেশন (সিসিক)। মাস্ক ব্যবহার না করায় কয়েকজন পথচারী ও সিএনজি অটোরিকশা চালককেও জরিমানা করা হয়।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, দক্ষিণাঞ্চলের পোশাক বিক্রির প্রধান মোকাম বরিশাল নগরীর চকবাজার এলাকায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলা ছিল। অনেক দোকানি বাহ্যিকভাবে দোকান বন্ধ রেখে ক্রেতাদের ভেতরে ঢুকিয়েছেন। বড় বড় বিপণিবিতানগুলোর প্রধান ফটক ও যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ ছাড়া অন্য সবকিছুই ছিল প্রায় স্বাভাবিক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতাও চোখে পড়ার মতো ছিল না। মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শাহাবুদ্দিন খানের নেতৃত্বে বিপুল সংখ্যক মোটরসাইকেল ও গাড়ি নিয়ে পুলিশের একটি সচেতনতামূলক মহড়া নগরীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এছাড়া মাস্ক না পরায় বেশ কয়েকজনকে জরিমানা করেন জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।

রাজশাহী ব্যুরো জানায়, দোকানপাট খোলা রাখার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ীরা। বাজারগুলোতে প্রচুর মানুষের চলাচল দেখা গেছে। তারা মাস্ক পরলেও শারীরিক দূরত্বের বালাই ছিল না। অনেকে থুতনিতে মাস্ক পরেছেন। সকাল থেকে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে করোনা সচেতনতা বিষয়ক মাইকিং করা হয়। নগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিক বলেন, জনগণকে ঘরের বাইরে প্রয়োজন ছাড়া বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে।

রংপুর অফিস জানায়, অনেকটা স্বাভাবিক ছিল নগরীর চিত্র। সর্বত্রই মানুষের আনাগোনা ছিল স্বাভাবিক। দূরপাল্লার বাসগুলো না চললেও পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুরসহ বিভিন্ন জেলাগামী বাসগুলোকে মহাসড়কে চলতে দেখা গেছে। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে সরকার কঠোর নির্দেশনা দিলেও খেটে খাওয়া মানুষের মাঝে মাস্ক ব্যবহারে উদাসীনতা দেখা গেছে। সকালে নগরীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে মাইকিং করে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে র‌্যাব-১৩। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে জেলা প্রশাসন। মাস্ক না পরা প্রসঙ্গে নগরীর পায়রা চত্বরের চায়ের দোকানি আজিজার রহমান বলেন, মাস্ক পরে ডাকাতি, ছিনতাই বেশি হচ্ছে। সরকার লকডাউন দিয়েছে। কিন্তু খাবারের ব্যবস্থা করেনি।

খুলনা ব্যুরো জানায়, বাস, ট্রেন ও লঞ্চ চলাচল বন্ধ থাকলেও ইজিবাইক, হলার, অটোরিকশা চলাচল করছে। খোলা ছিল অনেক দোকান। তবে নগরীতে লোক চলাচল ছিল অন্যদিনের তুলনায় কম।

পাবনা অফিস জানায়, স্বাভাবিক চলাচল করছে সকল পরিবহন। দোকানপাটসহ শহরের বড় বড় শপিং মল বন্ধ থাকলেও ছোট দোকান এবং অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা ছিল। শহরজুড়ে যানজট ছিল আগের মতোই। বাজারগুলোতে সাধারণ মানুষের উপচেপড়া ভিড় ছিল।

পাবনা জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, আমরা প্রথম দিনের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। সবাইকে অনুরোধ করছি, সতর্ক করছি। আগামীকাল থেকে আইন প্রয়োগ করা হবে।

‘লকডাউন’ বাড়বে কিনা সিদ্ধান্ত বৃহস্পতিবার :গতকাল মন্ত্রিসভার ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, গত রোববার ১১ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়, ৫ এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ১১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত এসব নির্দেশনা মেনে লকডাউন কার্যকর থাকবে। ইতোমধ্যে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রয়োজনীয় কাজ চালানোর জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততজনই জনবল রাখবে। তবে লকডাউনের মেয়াদ বাড়ানো হবে কিনা এজন্য আগামী বৃহস্পতিবার পুনরায় বৈঠকে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হবে।

সূত্রঃ সমকাল

বাংলাদেশ সময়: ১১:৪১:৫৪   ৯৭৫ বার পঠিত   #  #  #  #