শুক্রবার, ৫ মার্চ ২০২১

মতি মিয়ার প্রেস ফ্রিডম : পর্ব ১০৭।

Home Page » সাহিত্য » মতি মিয়ার প্রেস ফ্রিডম : পর্ব ১০৭।
শুক্রবার, ৫ মার্চ ২০২১



শুন্য পুরাণ

“Folklore is the boiled down juice of human living” - Zora Hurston, নৃবিজ্ঞানী

জগতে যত অনাচার তা কি শুধুই এশিয়াতেই ঘটে? তা না হলে কেন সৃষ্টি কর্তা এত এত ধর্মস্রষ্ঠা প্রেরণ করেন এশিয়াতে? পৃথিবীর তাবৎ (উল্লেখযোগ্য) ধর্মগুলো এশিয়াতেই জন্ম হয়েছে ! খোদ বঙ্গদেশেতো একডজন, যদিও “নাথধর্ম” ছাড়া সবই অন-উল্লখযোগ্য ! সমাজে, জনজীবনে অনাচার দেখা দিলেই উপর থেকে নেমে আসে সৃষ্টিকর্তার প্রতিনিধী। হিন্দু ধর্ম এ বিষয়ে একটু ব্যতিক্রম। ঋগবেদের আমলে কিছু মুনি ঋষি সমাজে Code of Conduct নির্মানের মাধ্যমে সনাতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিল। যা আজকের “হিন্দু” নামে পরিচিত। তারই সংষ্কার সম্প্রসারণার্থে রাম পরশুরাম কৃষ্ণমাধব রূপে বিষ্ণুকে পাওয়া যায় অবতার হিসেবে, হিন্দ ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক পরে। রক্ত মাংস মাটির মানুষ ঐ ঋষিগণ। বায়ু জল ভূমিজ এই ঋষিজনেরা তাই ধর্মিয় Code of Conductএ প্রকৃতি সচেতনতা রেখেছেন গভীর আগ্রহে। এই Environment Friendliness অন্য ধর্মগলোতে ততটা নেই।
Cultural Geographyর অবশ্য পাঠ্য হওয়া উচিৎ সব পুরাণ আর মঙ্গল কাব্যগুলো।

বঙ্গে মৎস্যেন্দ্রনাথ (নোয়াখালীর দক্ষিনের এক দ্বীপ সন্দ্বীপে জন্ম) ও রামাই পন্ডিত (দু একজন ইতিহাসবিদ মনে করেন কুমিল্লার লালমাই এলাকায় জন্ম) যা ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন তা শুদ্ধ লোকায়ত। “লোক” মানে এখানে “সব” লোকজন নয়, সাধারণ, অতিসাধারণ ব্রাত্য, শুদ্র, ডোম, চাঁড়াল মার্কা লোকদের লোকায়ত। অবধূতের “মরুতীর্থ হিংলাজ”, বা “কলিতীর্থ কালীঘাট” যারা পড়েছেন তাঁরা জানেন লুইপা শিষ্য গোরক্ষনাথ কী ভাবে মৎস্যেন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত “নাথধর্ম”কে কামরূপ থেকে বেলুচিস্থানের হিংলাজে নিয়ে গেছেন, যে জন্য “নাথপন্থা” কিছুটা উঁচু-মার্গীয় ছূঁয়া পেয়ে ‘লোকায়ত’তায় উপরীচর হয়েছে । নাথরা “নাথ” হওয়ার আগে “শুদ্র” ছিল, আত্মা ও আত্মরক্ষার জন্য তারা বৌদ্ধ হয়; আবারও আত্মরক্ষার প্রয়োজন দেখা দিলে এরা “নাথ” হয়। আবারও নিজেদের রক্ষায় কেউ হয় গোরক্ষনাথ পন্থি, কেউ হয় পীর তাবরিজী পন্থি “যবন” মুছলমান। আপনারাতো পড়েছেনই আত্মতুষ্টিতে লুব্ধ সেই ইতিহাসবিদের উপাখ্যান আলাপ, “ইসলামের শান্তির মাশালা শুনিয়া বৌদ্ধরা, নাথ পন্থিরা দলে দলে মুছলমান হইয়া গেল!”?

রামাই পন্ডিত ডোম-চাঁড়ালের পন্ডিতই থেকে গেলো। প্রথম পর্ব ”ভদ্রলোকের সাহিত্য বিচার আর ইতরের ইতিহাস কলপনা”য় বলেছিলাম, “শুদ্ধাচারী শাস্ত্রে আছে প্রমিত ভাষায় “শুদ্ধ-সাহিত্য” “শুদ্ধ-ইতিহাস” লিখন পদ্ধতির নির্দেশিকা, যা ব্রাত্যপন্ডিত রামাই শেখেইনি, এবং তাই “শূন্যপুরাণ” পুরাণই নয়। এ এক ঐতরেয় পূঁথি-সাহিত্য! ব্রাত্যাচার। অথচ পূঁথিসাহিত্য, লোকগীতি তাবৎ Folk Lore অভিজ্ঞান সদায়ই বৃক্ষমুলের আত্মকাহিনী রচে। Charles King নৃবিজ্ঞানী Zora Hurstonএর লেখা পড়ে মন্তব্য করেছেন এই বলে যে, “She wrote from the perspective of some one eager to hold up the entire tapestry of local culture, with its STORIES and DIALECTS, its INSULTS and WISECRACKS, as a work of communal genius that could be understood as well as appreciated.” ।

ফাইল ছবি

বাংলার লোক-কথা সাহিত্য (FOLKLORE) দূর্বল অত্যাচারীতের কথা “দূর্বল ভাষা”য় বলে। এবং শূন্য পুরাণের রামাই পন্ডিত ‘সাহিত্যে-ব্রাহ্মন’ ছিলেন না। তাই ভক্তিমাধব চট্যোপাধ্যায়সহ অনেক ধর্ম-মঙ্গল কাব্যবিশারদ শূন্য পুরাণকে “কাব্যরসবিবর্জিত” বলেন। শূন্য পুরাণের ভাষায় ম্লেচ্ছ ম্লেচ্ছ গন্ধ পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা হল রামাই দ্বিজ নয়, শুদ্ধ সাহিত্য রচনা কীভাবে হবে ! পিতা তার, বিশ্বনাথ, খাস ব্রাহ্মন কিন্তু এই খাস ব্রাহ্মন এক “ডোম্বিনী”র প্রেমাপ্লূত (!) হয়ে বিয়ে করে ফেল্লে রামাইএর জন্ম। (ডোম কন্যার খবর এরপর কেউ জানেনা। ঐতরিয় আরণ্যকের লেখক বিষ্ণু দাসের কথা মনে আছে তো, জন্ম ও কর্মচক্রে কেমন অদ্ভূত মিল! আর চর্যাপদ-কবি কাহ্নুপাদের কবিতায় যৈবতী ডোম-কন্যা-বিলাপটা? “

পৃথিবীর আর কোন ভাষায় বোধ হয় এমন বিচারিক ব্যবস্থা নেই, যা বাংলায় আছে ! কৌলিন্য বিচার ! এই উপমহাদেশের সব ভাষার জাত পাত বংশ কৌলিন্যের তেজ এতই প্রকট যে আমরা ভুলেই গেছি ‘মল্লিকা দি’র নাম’। অচ্ছূৎ, ঐতরিয়, অন্তজ, ম্লেচ্ছ, অসুর, আর কখনো বয়াংশী-ভাষ এই বং-ভাষ হঠাৎই কীভাবে যে একদম মা ধরনীর পৃথিবীর/তে শ্রেষ্ঠ” ভাষাস্তরে লাফিয়ে উঠে পড়লো, চন্দ্রকেতুগড়ের মাটির তলার শীলা-লিপি, নেপালী রাজার আর তিব্বতী লামাদের বইঘর খুঁড়ে খুঁড়ে “আবিষ্কার” করা এই “বং” কখন যে খোদ-কৌলিন্যের ইউরোপিয়ান ভাষার ‘ক্ষেত্রজ’ সন্তানরূপে সমাজে পাত পেলো, জাতে উঠলো, ট্যারই পেলাম না। বং নাকি “Indo-European Family”র (জারজ) সন্তান ! ভারতীয় কোন “স্বয়ং-সম্পূর্ণ” Language Tree বা Family থাকতে নেই। বৌদ্ধ সাহিত্য চর্যাপদ যখন বাংলার মূলাধার, যখন কর্তার কায়াসাধনে কর্মী ডোম্বিনীর শীৎকার বঙ্গ-ভূমিজ শব্দে হয়, সেই শব্দাবলী কী ভাবে ইউরোপিয় Tree বা Familyর ফসল হয়? সাধে কী “কবি সভা”র এক ব্রাত্য কবি এক শুদ্ধ সাহিত্যিকের উদ্দেশ্যে ‘বেটা আবার শুদ্ধ-ভাষায় সাহিত্যমারায় ”, লিখেছিলো !!

গতমাসে একজন Face Bookএ লিখেছে - “. . . কিন্তু মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনা কতটুকু সম্ভব?”

তাইতো ! আদৌ কি সম্ভব?

“ছুইট্যা আইলো রণের ঘোড়া লউয়ের নিশান লইয়া, কি কর কি কর সখিনা বিবি পালঙ্কে বসিয়া” শিল্প সাহিত্য নয় ! “পুথি”তো সাহিত্য নয়, ঐতেরীয় ধর্মবিলাপ মাত্র! একই ধূনে রামাই পন্ডিতের পুথিগুলোও “সাহিত্যরসবিবর্জিত” (ভক্তিমাধব চট্রোপাধ্যায়, পৃ: ১৪)।

ফাইল ছবি

Note: এখনএকটা কথা আমাদের স্পষ্ট করে জেনে রাখা দরকার যে, রামাই পন্ডিত কখনো “শূন্য পুরাণ” নামে কোন “বই” লেখেনইনি। তিনি যা’ই লিখেছেন সবই “পুথি” আকারে। যেমন “সৃষ্টি পত্তন”, “ধর্ম পুরাণ”, বা “অনাদ্যের পুথি”। তার অত্যাধুনীক সমালোচক/আলোচকরা (যারা ধর্ম ঠাকুরকে রামাই পন্ডিতের চে বেশি জানেন {!} ) পন্ডিতের মৃত্যুর ৮শ বছর পর পন্ডিতের পুথিগুলো সংগ্রহ করে Print copyর নাম দিয়েছেন “শূন্য পুরাণ” ! নগেন্দ্রনাথ বসু থেকে শুরু এই নাম করনের।ভক্তিমাধব চট্যোপাধ্যায়ও (১৯৭৭) এই নামই গ্রহন করেছেন।

তথ্য সূত্র:
(১) ভক্তিমাধব চট্যোপাধ্যায় (১৯৭৭) সম্পাদিত, “শূন্য পুরাণ”, : ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেঢ, কলিকাতা।
(২) Charles King (2019), “Gods of the Upper Air”: Double Day, New York.
(৩) রায়হান রাইন (২০০৯) সম্পাদিত, “বাংলার ধর্ম ও দর্শন”, সংবেদ, ঢাকা।
(৪) Richard Eaton (1993), “The Rise of Islam and the Bengal Frontier - 1204-1760″, University of California Press, Berkeley.

লেখক প্রফেসর মতি রহমান

বাংলাদেশ সময়: ১২:২২:৫৪   ৯১৬ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #  #