সোমবার, ৫ আগস্ট ২০১৩
“ঈদ করমু কি দিয়া বেতন পাই না “
Home Page » সংবাদ শিরোনাম » “ঈদ করমু কি দিয়া বেতন পাই না “বঙ্গ- নিউজ ডটকমঃ শাহজাহান সিরাজ (৬০)। ৩৮ বছর ধরে খুলনার রূপসায় দাদা ম্যাচ কারখানায় নিরাপত্তা প্রহরীর চাকরি করেন। ২০১০ সালের ১৮ আগস্ট কারখানাটি বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ভালোই চলছিল তার। কিন্তু বন্ধ হওয়ার পর থেকে তিন ছেলে মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন তিনি।গত তিন বছর কারখানাটি বন্ধ থাকলেও চাকনি ছাড়েননি। অথচ বেতন পান না তিনি।সেই খাকি পোশাক পরে কারখানার ফটকে অতন্দ্র প্রহরীর দায়িত্ব পালন করে আসছেন।
শাহজাহান সিরাজ বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৮ বছর এই মিলে দারোয়ানি করি। তিন বছর ফ্যাক্টরি বন্ধ। বেতন পাই না, তবুও আশায় আশায় থাহি। যদি ফ্যাক্টরিডা চালু অয়।’
ঈদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেতন পাই না ঈদ করমু- কি দিয়া।’
ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন,‘দেশের প্রধানমন্ত্রী খুলনা প্রভাতী স্কুলে মোগো ফ্যাক্টরি চালু করার কথা দেছেলো। তার কথা হুইনা অনেক আশায় বুক বাইদা ছিলাম। কিন্তু আমাগো হে আশা পূরণ অচ্ছে না।’ এভাবে কথা বলতে বলতে এক পর্যায়ে কেঁদেই ফেললেন শাহজাহান।
তিনি আরও বলেন, ‘এ ফ্যাক্টরিতে ৪২ জন দারোয়ান (সিকিউরিটি গার্ড) মিল চালু অবস্থায় আমার লগে চাকরি হরত। মিল বন্ধের পর বেতন কড়ি না পাইয়া প্রায় হগোলে চইলা গেছে। আমি বাজান আছি। বুড়া বয়সে যামু কোতায়। তাই এহানেই আছি।’
কারখানাটি বন্ধ হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ জন শ্রমিক বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন বলে জানান তিনি।
এ সময় কথা হয় এ কারখানায় বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মচারী এম শহিদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে জানান, ১৯৮৪ সাল থেকে এখানে চাকরি করেন তিনি। তিন বছর বেতন ভাতা না পেয়েও ফ্যাক্টরির মায়া ছেড়ে অন্য কোথায়ও যাননি।
তিনি আরও জানান, তার দুই ছেলে। একজন অনার্স পাস করেছে অন্যজন এসএসসি পরীক্ষা দেবে। অর্থের অভাবে সন্তানদের বই কিনে দিতে পারেন না।
শ্রমিক তৈয়েবুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, ‘ফ্যাক্টরি চালু হবে এমন আশায় কোথাও যাচ্ছি না। চার ছেলে মেয়ে নিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।’
ঈদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ফ্যাক্টরি বন্ধের পর প্রতিটি ঈদ আমাদের জন্য আনন্দের পরিবর্তে কষ্ট বয়ে আনে। কেননা অর্থ ছাড়া ঈদের আনন্দ মূল্যহীন।’ ফ্যাক্টরিতে ৩০ বছর ধরে শ্রমিকের কাজ করেছেন আব্দুল্লাহ।
তিনি বলেন, ‘অর্থের অভাবে অনেক আগে পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। নিজে মসজিদের বারান্দায় থাকি। যে যখন ডাকে তার বাসায় খাই।’
এদিকে, এ কারখানাটি বন্ধের পর তিন বছরে চাকরি হারানো শ্রমিকরা বিভিন্ন সময় এটি চালুর দাবিতে শতাধিক কর্মসূচি পালন করেছেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ২ আগস্ট ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন কার্যালয়ে এক সভায় কারখানাটি ঈদের আগে চালু ও বকেয়া বেতন-ভাতা পরিশোধের দাবি বাস্তবায়ন না হলে কারখানার সামনের সড়কে ঈদের নামাজ আদায় করার ঘোষণা দেওয়া হয়।।
দাদা ম্যাচ ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন দিলখোশ বলেন, ‘দীর্ঘ তিন বছরে আমাদের জীবনের সব উৎসব বিষাদে পরিণত হয়েছে। আর কোনো উৎসবে অংশগ্রহণ নয়, নিজেদের ন্যায়সঙ্গত দাবি বাস্তবায়নে রাজপথেই ঈদের নামাজ আদায় করা হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের আগে ফ্যাক্টরি চালু না হলে শ্রমিক-কর্মচারিরা সকাল ৯টায় গেটের সামনে ঈদের নামাজ আদায় এবং পরবর্তীতে হরতাল অবরোধসহ দুর্বার আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হবে।’
উল্লেখ্য, খুলনা মহানগরীর রূপসা নদীর তীরে ১৯৫৬ সালে ১৮ একর জমির ওপর সুন্দরবনের গেওয়া কাঠ নির্ভর দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে। ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠান ভাইয়া গ্রুপ সরকার বা শ্রমিকদের সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করে ২০১০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি উৎপাদন ও ১৮ আগস্ট দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি বন্ধ করে দিয়ে সব শ্রমিক-কর্মচারী টারমিনেশন করে।
এরপর থেকে শ্রমিক-কর্মচারীরা মিলটি বিসিআইসি’র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চালু ও শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু দীর্ঘদিনে মালিক পক্ষ ফ্যাক্টরি চালু ও শ্রমিকদের বকেয়া পরিশোধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি।
২০১১ সালের ৫ মার্চ খালিশপুরের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফ্যাক্টরিটি বিসিআইসি’র আওতায় চালুর প্রতিশ্রুতি দেন। একই বছর ২৩ মার্চ শিল্প মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে খুলনা জেলা প্রশাসন ফ্যাক্টরির স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বুঝে নেয়।
কিন্তু এখন পর্যন্ত ফ্যাক্টরিটি চালু হয়নি। ইতোমধ্যে অর্থাভাবে বিনা চিকিৎসায় মিলের ৬০ জন কর্মচারীর মৃত্যু হয়েছে বলেও বিভিন্ন সময় সরকারের কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়।
বাংলাদেশ সময়: ৮:৪৮:৪২ ৫২১ বার পঠিত