সোমবার, ২১ ডিসেম্বর ২০২০
ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-১৩”
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-১৩”
“দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে ,
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার” —জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ।।
আমার এই কলামটি পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পরে আমার কিছু শুভাকাঙ্খী ও বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি থেকে আমার কিছু স্টুডেন্ট ফোন করে জানালো যে, আমার কলামটিতে নাকি ‘ভাষা-আন্দোলন’ এর ইতিহাসটি সঠিকভাবে ফুটে ওঠেনি ৷ তাই আমার আজকের এবং আগামীর কলামটি রচিত হয়েছে কেবল আমাদের অর্থাৎ বাঙ্গালিজাতির গৌরবময় জাতীয় অর্জন ‘ভাষা-আন্দোলন’ এর ইতিহাসকে কেন্দ্র করে ৷প্রকৃতপক্ষে, বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্হান (বর্তমান বাংলাদেশে)এ সংঘটিত একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। জণগণের মৌলিক অধিকার রক্ষাকল্পে বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান অধিরাজ্যের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণদাবীর বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে এ আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করলেও বস্তুত এর বীজ রোপিত হয়েছিল বহু আগে, অন্যদিকে এর প্রতিক্রিয়া এবং ফলাফল ছিল সুদূরপ্রসারী।
১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান অধিরাজ্য ও ভারত অধিরাজ্য নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়। ১৯৪৭ এ, ভারত ও পাকিস্তানের এই বিভাজনের পর থেকেই পূর্ব-পাকিস্তান”(বর্তমান বাংলাদেশ) এর জণগণ অবিরাম দাবি জানিয়ে আসছিল যে, ‘বাংলা’ ই হবে তাদের একমাত্র ‘রাষ্ট্রভাষা’ ৷ কাজেই তারা উর্দুকে পূর্ব ও পশ্চিম (উভয়)পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে প্রতিবাদ জানায় ৷ পূর্ব-পাকিস্তানের জাতি-ধর্ম-বর্ণ –গোত্র-ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি-শ্রমজীবি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও পেশাজীবি দল নির্বিশেষে পূর্ব-পাকিস্তানের আপামর জণগোষ্ঠী ‘উর্দু’ কে পূর্ব ও পশ্চিম (উভয়) পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবলভাবে প্রতিবাদ জানায় ও বিক্ষোভে ফেটে পরে ৷ এরই ধারাবাহিকতায়, ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তান সরকারের বরাবর একটি ‘স্মারক’ পেশ করেন পূর্ব-পাকিস্হানের বুদ্ধিজীবিমহল এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদাদানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল এবং সমাবেশের আয়োজন করে ৷ এসময় ‘বাংলা’ কে রাষ্ট্রভাষা করার সমর্থনে প্রথম “রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” গঠন করা হয়। তমদ্দুন মজলিশের ‘প্রফেসর নূরুল হক ভূঁইয়া’ এই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। পরবর্তীতে সংসদ সদস্য ‘সামসুল হক’ আহ্বায়ক হয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কার্যক্রম আরও জোরদার করেন ।
পাকিস্তানের কোনো অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা ছিল না বলে উল্লেখ করেছেন ভাষাবিদ ‘প্রফেসর ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ’ । তিনি বলেন যে, ‘আমাদের যদি একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি’ ।সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ বলেছেন যে, ‘উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ ‘নিরক্ষর’ এবং সকল সরকারি পদের ক্ষেত্রেই ‘অনুপযুক্ত’ হয়ে পড়বে’।
এত সবের পরেও ১৯৪৮ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে, জাতীয় সংসদের এক ভাষণে জিন্নাহ বলেন, ‘পাকিস্তান যেহেতু একটি মুসলীম রাষ্ট্র, সুতরাং উর্দুই হবে এর রাষ্ট্রভাষা ’ ৷ সত্যিকার অর্থে, সেসময় জিন্নাহ্সহ পাকিস্হানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী –লিয়াকত আআলী খাঁন একথা উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন যে, ‘একমাত্র মাতৃভাষা ছাড়া জোর করে অন্য কোনো ভাষার প্রতি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের জণগণের আনুগত্য কখনই তৈরী করা যায় না’ ৷
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’ গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের দাবি জানান। তার দাবি অগ্রাহ্য হয় ফলে ২৬ ও ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ” পুনর্গঠিত হয়েছিল৷ এবং ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয় এবং বাংলা ভাষা দাবি দিবস ঘোষণা দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ এই কর্মসূচি পালনে বিশিষ্ট ভুমিকা পালন করে।
ভাষা আন্দলনে জড়িত থাকার কারনে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমান , শামসুল হক, অলি আহাদসহ ৬৯ জনকে গ্রেপ্তার করলে ঢাকায় ১৩-১৫ মার্চ ধর্মঘট পালিত হয়। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে পুর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ই মার্চ ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তিগুলো ছিল-
১.ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি প্রদান করা হবে।
২.পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে।
৩. বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
৪.সংবাদপত্রের উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
৫.আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না।
৬.২৯ ফেব্রুয়ারি হতে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হবে।
৭.পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাবার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রবর্তন করা হবে।
৮.রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন (বাংলা-ভাষা আন্দোলন) ” রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই”— এই মর্মে মুখ্যমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিবেন।
পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ ঢাকায় আসেন৷ ২১ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘোষণা দেন ” উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা। “। এরপর ২৪ মার্চ তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘোষণা দিলে ছাত্ররা তার উক্তির চরম প্রতিবাদ জানায় রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পরে ।(চলবে)৷
তথ্যসূত্র: বুকস, ইন্টারনেট
লেখক: ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, একাডেমিসিয়ান,গবেষক, কলামিস্ট এবং লেখক৷
বাংলাদেশ সময়: ১১:২৯:১৮ ৮১২ বার পঠিত # #নতুন প্রজণ্ম #বাংলাদেশ #মুক্তিযুদ্ধ