সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২০
ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-১২”
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-১২”
১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে ‘১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত’ ছিল পাকিস্তান সরকারের জন্য একটি অস্হিতিশীল সময় এবং আইয়ূব খানের শাসনামলে এই স্হিতিশীলতা ফিরে এলেও ইতিহাসে তাঁর শাষনামলকে উভয় পাকিস্তানের জন্য চরম দুঃসময় বলে আখ্যায়িত করা হয় ।
পশ্শ্চিম পাকিস্হান (বর্তমান পাকিস্তান) এর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সর্বদাই তাদের অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এমনকি শিক্ষাক্ষেত্রে তাদের নীতিগুলো এমনভাবে তৈরী করত যেন পূর্ব-পাকিস্হান (বর্তমান বাংলাদেশ) চিরকালই শিক্ষা-দীক্ষায় তাদের চেয়ে পিছিয়ে থাকে এবং পূর্ব-পাকিস্তানের সকল ক্ষেত্রে তাদের কতৃর্ত্ব বজায় থাকে৷ তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের সরকার আইয়ূব খান ১৯৫৯ সালে একটি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করে ‘বিচারপতি হামুদুর রহমান’ কে সভাপতি করে । এই কমিশন তাদের প্রতিবেদনে ‘শিক্ষা’ সম্পর্কিত বেশকিছু নীতিমালা ও প্রস্তাব সরকারের নিকট পেশ করে যা ছিল পূর্ব –পাকিস্হানের বাংলা ভাষাভাষী জনগণের প্রতি বৈষম্যপূর্ণ ৷’হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবিত প্রতিবেদনের কিছু অংশ এখানে উল্লেখ করা হলো :
১. সকল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজগুলোতে সরকারের নিয়ণ্ত্রন সবচেয়ে বেশি থাকবে ৷
২. স্নাতক ডিগ্রীর জন্য সময় দুই থেকে তিন বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি ৷
৩. বিনাবেতনে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ বাতিল৷
৪. বাংলা এবং উর্দু উভয় ক্ষেত্রে রোমান পান্ডুলিপির সংযোজন ৷
৫. স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি থেকে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সাহিত্য (বিশেষ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র, শরৎচণ্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্র প্রমুখ বাংলা ভাষার কবি-সাহিত্যিকদের রচনাসমগ্র) বাদ দেয়ার নির্দেশ জারি করে ৷
পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ এইরকম একটি বৈষম্যপূর্ণ উচ্চশিক্ষা নীতির প্রস্তাবনার কথা জানতে পেরে বিক্ষোভে ফেটে পরে ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে ৷এটি বাংলা ভাষার পুরোপুরি বিলীন করে দেওয়ার একটি জঘন্য ষড়যন্ত্র৷ ছাত্ররা বুঝতে পারে যে, এটি ১৯৫২ এর ভাষা-আন্দোলনের মতো আরেকটি সংকট সৃষ্টি করা হছ্ছে সেই সময়কার ( ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দলন )পরাজয়ের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ৷ এই প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণে এটাই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ‘পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে স্বায়ত্ত্বশাসন ব্যাবস্থা তুলে দিয়ে সকল জায়গায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সেগুলোকে তাদের তাবেদার করা এবং সেসব জায়গায় তাদের খেয়াল-খুশী মতো নিয়ম-কানুন বলবৎ করা ’ ৷উল্লেখ্য, ঔপনিবেশিক আমলে এই উপমহাদেশ (ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে একসঙ্গে উপমহাদেশ বলা হয়) শাসন ও শোষন –ব্যবস্হা চিরস্হায়ী-পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকারও এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহন করেছিল ৷ এসময় (১৯৫৯ )থেকেই অর্থাৎ আইয়ূব খানের শাসনামল থেকেই পূর্ব-পাকিস্হানের ছাত্রসমাজ তথা আপামর জনসাধারন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের এহেন দমন –নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে আরম্ভ করে ৷ প্রথমে এই আন্দোলন এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে হলেও পরবর্তীতে তা রাজনৈতিক দিকে মোড় নেয় ৷ ইতিমধ্যে ১৯৫৪ সালের ২৩ থেকে ২৬ এপ্রিল ঢাকায় পূর্ব-পাকিস্হানের বাঙ্গালি সাহিত্যিকদের সমন্বয়ে ৪র্থ সাহিত্যিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যার উদ্বোধন ও সভাপতিত্ব করেন ‘ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ ৷ এর পরপরই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সারাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘সাহিত্য-সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ রক্ষার নিমিত্তে ৷ এসময় পাকিস্তানর কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত’কেও নিষিদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন এবং তখন সঙ্গে সঙ্গে এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান পূর্ব-পাকিস্হানের বুদ্ধিজীবী-সমাজ , তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হছ্ছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, ডঃ মুহামমদ শহীদুল্লাহ্,কাজী মোতাহার হোসেন,প্রফেসর বিনয় রায়, প্রফেসর ডঃ আহমদ শরীফ, প্রফেসর গনেশ বসু, কমরেড মোজাফফর আহমেদ,লীলা রায়, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, বেগম সুফিয়া কামাল, প্রফেসর অতুল সেন,ডঃ মুহাম্মদ এনামুল হক, সাহিত্যিক আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদ ,কবি জসীম উদ্দীন, প্রমুখ ৷
এরই মধ্যে ১৯৬৩ সালে ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড –এ সপ্তাহব্যাপী ‘বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত সপ্তাহ’ পালন করা হয় ৷ এভাবেই তখন ছাত্র-জনতা একসঙ্গে ‘বাংলা ভাষা,সাহিত্য ও শিক্ষা- এর রক্ষার জন্য কাজ করে আসছিল !এই আন্দোলন একসময় পূর্ব –বাংলায় একটি শক্তিশালী জনশক্তিতে পরিণত হয় ৷১৯৬৬ সালের মাঝামাঝি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’ পূর্ব-পাকিস্তানের ‘স্বায়ত্তশাসন’ আন্দোলনের মুখপাত্র হিসেবে আন্দোলনের পুরাভাগে চলে আসেন এবং এ কারনে তিনমাসের মধ্যে তাকে বেশ কয়েকবার জেলে যেতে হয়েছিল ৷১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি একটি সাংবাদিক-সম্মেলনের মাধ্যমে পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট ‘ছয়দফার দাবীগুলো’ তুলে ধরেন এবং ঘোষনা দেন ।
অপরদিকে, পূর্ব –বাংলার ছাত্রসমাজ একটি সামগ্রিক ও যুগোপযুগী শিক্ষানীতি –এর প্রস্তাবনা তৈরীর কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করলেও প্রস্তবনাটি বিভিন্ন কারনে থেমে যায় এবং অবশেষে, এটি আওয়ামীলীগের সভাপতি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান’ এর নেতৃত্ব ১৯৬৯ এর ১১ দফায় পরিনত হয় ৷
“নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ” -এর গত পর্বগুলো থেকে আমরা জেনেছি, পাকিস্তানের জণগণ তাদের রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রায়ই তাদের নৈতিক দাবীগুলো বিভিন্ন দফা আকারে পেশ করতেন এবং এই দফাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দফা হছ্ছে-
ক. ১৯৫৪ এর ২১ দফা ( আওয়ামী মুসলীম লীগ ও যুক্তফ্রন্টসহ পূর্ব পাকিস্তানের সকল রাজনৈতিক দলগুলো তখন এক হয়ে এই দাবীর প্রতি একাত্বতা ঘোষনা করেছিল),
খ.১৯৬৬ এর ৬দফা (পূর্ব পাকিস্তানের অধিকংশ জণগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে আওয়ামী মুসলীম লীগ অরফে আওয়ামী লীগের সভপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক উথ্থাপিত ) ও
গ. ১৯৬৯ এর ১১দফা (পূর্ব পাকিস্হানের অধিকংশ জণগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে আওয়ামী মুসলীম লীগ অরফে আওয়ামী লীগের সভপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক উথ্থাপিত ) ইত্যাদি ৷
আমরা ইতিমধ্যে এই কলামের ৪র্থ পর্বে ১৯৬৬ এর ৬দফাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি এবং গত পর্বে আমরা বিস্তারিত জেনেছি, “১৯৫৪ এর ২১ দফা” সম্পর্কে ৷ আজ আমরা জেনে নেবো- “১৯৬৯ এর ১১দফা (পূর্ব পাকিস্হানের অধিকংশ জণগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে আওয়ামী মুসলীম লীগ অরফে আওয়ামী লীগের সভপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক উথ্থাপিত )” সম্পর্কে ৷পূর্ব-পাকিস্হানের সর্বদলীয় ছাত্র-সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৯৬৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট ১১ দফা দাবী করা হয় । এখানে সে দাবীগুলো তুলে ধরা হলো :
১. ক.প্রাদেশিক কলেজগুলোকে তাদের আদি অবস্হায় পুননির্মাণ করতে হবে ।
খ. স্কুল-কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে৷
গ. প্রাদেশিক কলেজগুলোতে নৈশ শাখা চালু করতে হবে ৷
ঘ. শিক্ষা ব্যয় ৫০ ভাগ কমিয়ে আনতে হবে ৷
ঙ. শিক্ষা প্রদানের ভাষা এবং অফিস-আদালতের ভাষা হতে হবে বাংলা৷
চ. ছাত্রাবাসের খরচের ৫০ ভাগ ভর্তুকি দিতে হবে৷
ছ. শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে ৷
জ. ৮ম শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষা বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক করতে হবে ৷
ঝ. ম্যাডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্হাপন করতে হবে এবং ম্যাডিকেল অধ্যাদেশ পরিষদ বাতিল করতে হবে৷
ঞ. পলিটেকনিক ছাত্রদের কোর্স সংক্ষিপ্ত করার সুযোগ থাকতে হবে ৷বাস এবং রেলের ভাড়া কমিয়ে দিতে হবে ৷চাকুরীর নিশ্চয়তা দিতে হবে ৷বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পূর্ন স্বায়ত্তশাষন দিতে হবে৷
২. সার্বজনীন ভোটাধিকারের মাধ্যমে সংসদীয় গনতন্ত্র চালু করতে হবে ৷
৩. ক. কেন্দ্রীয় সরকার এবং সার্বভৌম আইনসভা হতে হবে ৷
খ. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্রনীতি এবং মুদ্রা-বিষয়ক কাজেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং বাদ বাকী অন্যান্য কাজগুলো দেখবে প্রাদেশিক সরকার ৷
৪. বেলুচিস্তানে উপকেন্দ্র, উত্তর –পশ্চিমের সকল প্রদেশসহ পাঞ্জাব এবং সিন্ধুর প্রতে্যকটি ইউনিটে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে ৷
৫. ব্যাংক, বীমা কোম্পানি এবং সর্ববৃহৎ শিল্প-কারখানাগগুলো জাতীয়করণ করতে হবে ৷
৬. কৃষকদের কর – রাজস্বো কমিয়ে আনতে হবে ৷
৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরী ও বোনাস নিশ্চিত করতে হবে ৷
৮. পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য নির্দিষ্ট খাদ্য-নিয়ন্ত্রন আইন থাকতে হবে ৷
৯. সকল প্রকার জরুরী আইন, নিরাপত্তা আইন এবং নিষেধাজ্ঞার সবরকম আদেশ তুলে নিতে হবে৷
১০.সিয়াটো,সেন্টো এবং পাকিস্হান-মার্কিন সামরিক চুক্তি অকার্যকর করতে হবে৷
১১. ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ সহ বিনাবিচারে আটক সকল বন্দিদের মুক্তি দিতে হবে ৷ (সূত্র : The Palkistan Observer, Dhaka,জানুয়ারি ২৯,১৯৬৯) ৷ (চলবে ) ৷
তথ্যসূত্র: বুকস, ইন্টারনেট
লেখক: ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, একাডেমিসিয়ান, কলামিস্ট , গবেষক এবং লেখক৷
বাংলাদেশ সময়: ১১:২৭:১৪ ৭৯৭ বার পঠিত #নতুন প্রজণ্ম #বাংলাদেশ #মুক্তিযুদ্ধ