সোমবার, ৭ ডিসেম্বর ২০২০
ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-১১”
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-১১”
“মানুষের একটা দিক আছে,যেখানে বিষয়-বুদ্ধি নিয়ে সে আপন সিদ্ধি খোঁজে । সেইখানে আপন ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা –নির্বাহে তার জ্ঞান, তার কর্ম ,তার রচনাশক্তি একান্ত ব্যাপৃত। সেখানে সে জীবরূপে বাঁচতে চায় । কিন্তু মানুষের আরেকটা দিক আছে, যা এই ব্যক্তিগত বৈশ্বয়িকতার বাইরে ৷ সেখানে জীবনযাত্রার আদর্শে যাকে বলি ক্ষতি,তাই লাভ ৷ যাকে বলি মৃত্যু,সেই অমরতা ৷ সেখানে বর্তমান কালের জন্য বস্তু সংগ্রহ করার চেয়ে অনিশ্চিত কালের উদ্দেশ্যে আত্মত্যাগ করার মূল্য বেশী৷ সেখানে জ্ঞান উপস্হিত প্রয়োজনের সীমা পেরিয়ে যায় ৷ কর্ম স্বার্থের প্রবর্তনাকে অস্বীকার করে৷ সেখানে আপন স্বতন্ত্র জীবনের চেয়ে যে বড় জীবন, সেই জীবনে মানুষ বাঁচতে চায় ৷
স্বার্থ আমাদের যেসব প্রয়াসের দিকে ঠেলে নিয়ে যায়, তার মূল প্রেরণা দেখি জীব-প্রকৃতিতে, যা আমাদের ত্যাগের দিকে তপস্যার দিকে নিয়ে যায়,তাকেই বলি মনুষ্যত্ব, মানুষের ধর্ম ৷কোন মানুষের ধর্ম? এতে কার পাই পরিচয়? এতো সাধারন মানুষের ধর্ম নয়”৷- বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷
সকলকে ভালোবাসতে পারা কিংবা সকলের জন্য ভালোবাসা অনুভব করা একটি অতি মানবীয় গুন ৷ সবার মাঝে এই গুনটি নেই ৷ যদি তাই থাকতো তাহলে আজ পৃথিবীতে শুধুমাত্র মতের অমিল ও ক্ষমতা দখলের জন্য দেশে দেশে এত যুদ্ধ, মারামারি ও হানাহানি লেগে থাকতো না ৷ পৃথিবীর এই অনিয়ম সহ্য করতে না পেরে সকলকে ভালোবেসে রবীন্দ্রনাথ একদিন বলেছিলেন,
“জগৎ জুড়ে উদার সুরে আনন্দগান বাজে, সে গান কবে গভীর রবে ? বাজিবে হিয়া-মাঝে।।
বাতাস জল আকাশ আলো সবারে কবে বাসিব ভালো ? হৃদয়সভা জুড়িয়া তারা বসিবে নানা সাজে”।।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমার প্রিয় ব্যক্তিত্বের মধ্যে একজন ৷ আমি যাদেরকে বই পড়ে জেনেছি এবং যারা আমার প্রিয় ব্যক্তিত্ব তাদের মধ্যে কেবল দুজন ব্যক্তির মাঝে এই অতি মানবীয় গুনটির ছোঁয়া পাওয়া যায়, তারা হছ্ছেন-১.বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং ২. বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৷ বঙ্গবন্ধু তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী তে বলেছেন, “একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি, একজন বাঙ্গালি হিসেবে যা কিছু বাঙ্গালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত,তাই আামাকে গভীরভাবে ভাবায় ৷ এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা,অক্ষয় ভালোবাসা,যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে” ৷
১৯৭১সালে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে যখন পূর্ব পাকিস্হানের যুদ্ধ চলছিল, সে সময়টাতে পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী কোথাও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ভালোবাসা তো দূরে থাকুক কোথাও এক ফোটা মানবিকতাও প্রদর্শন করেনি ৷ বরং তাদের উপর অমানবিক অত্যাচার চালিয়েছিল ৷ গত পর্বে আমরা জেনেছি,পূর্ব পাকিস্তানের জণগণ তাদের রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রায়ই তাদের নৈতিক দাবীগুলো বিভিন্ন দফা আকারে পেশ করতেন এবং এই দফাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দফা হছ্ছে-১৯৫৪ এর ২১ দফা ( আওয়ামী মুসলীম লীগ ও যুক্তফ্রন্টসহ পূর্ব পাকিস্হানের সকল রাজনৈতিক দলগুলো তখন এক হয়ে এই দাবীর প্রতি একাত্বতা ঘোষনা করেছিল), ১৯৬৬ এর ৬দফা (পূর্ব পাকিস্তানের অধিকংশ জণগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে আওয়ামী মুসলীম লীগ অরফে আওয়ামী লীগের সভপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক উথ্থাপিত ) ও ১৯৬৯ এর ১১দফা (পূর্ব পাকিস্তানের অধিকংশ জণগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে আওয়ামী মুসলীম লীগ অরফে আওয়ামী লীগের সভপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক উথ্থাপিত ) ইত্যাদি ৷ আমরা ইতিমধ্যে এই কলামের ৪র্থ পর্বে ১৯৬৬ এর ৬দফাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছি ৷ আজ আমরা জেনে নেবো- ১৯৫৪ এর ২১ দফা ( আওয়ামী মুসলীম লীগ , যুক্তফ্রন্ট সহ পূর্ব পাকিস্হানের সকল রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে এই দাবীর প্রতি একাত্বতা ঘোষনা করে) সম্পর্কে ৷
পূর্ব ও পশ্চিম -উভয় পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট পূর্ব –পাকিস্হানের ১৯৫৪ এর ২১ দফা ( আওয়ামী মুসলীম লীগ , যুক্তফ্রন্ট সহ পূর্ব পাকিস্হানের সকল রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে এই দাবীর প্রতি একাত্বতা ঘোষনা করে) কর্মসূচী :
প্রস্তাব -১. ‘বাংলা’ –কে পাকিস্হানের অন্যতম প্রধান আরেকটি রাষ্ট্রভাষা করা ৷
প্রস্তাব -২. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব রহিত করে উদ্বৃত্ত ভূমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা,খাজনার হার একটি সহনশীল পর্যায়ে নামিয়ে আনা এবং সার্টিফিকেটযোগে খাজনা আদায় রহিত করা৷
প্রস্তাব -৩. পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করে পাট –চাষীদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান এবং মন্ত্রীসভায় পাট কেলেংকারীর তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্হা করা এবং অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ৷
প্রস্তাব -৪. সমবায় কৃষি ব্যবস্হা চালু এবং কুটির শিল্প ও হস্তশিলের উন্নতি সাধন করা ৷
প্রস্তাব -৫. বৃহৎ এবং ক্ষুদ্র আকারে লবণশিল্প স্হাপন করে পূর্ব-পাকিস্হানকে লবণ উৎপাদনে ও সরবরাহে স্বয়ংসম্পূর্ন করা ৷
প্রস্তাব -৬. শিল্প ও কারিগরি শ্রেনীর উদ্বাস্ত্তুদের কর্মসংস্হান করে তাদের পূর্নবাসনের ব্যবস্হা করা ৷
প্রস্তাব -৭. খাল-খনন ও সেচ ব্যবস্হার মাধ্যমে দেশকে অপ্রত্যাশিত বন্যা ও দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করা ৷
প্রস্তাব -৮. পূর্ব পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুযায়ী তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা৷
প্রস্তাব -৯. অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা-প্রকল্প নিশ্চিত করা এবং শিক্ষকদের ন্যায্য বেতন ভাতা নিশ্চিত করা ৷
প্রস্তাব -১০.মাধ্যমিক শিক্ষা –ব্যবস্হায় সরকারি এবং বেসরকারী উভয় ক্ষেত্রে সকল পদ্ধতিগত বৈশম্য দূর করা এবং মাতৃভাষাকে শিক্ষাদানের প্রধান হিসেবে সংযোন করা ৷
প্রস্তাব -১১. বর্তমানে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এ, বিদ্যমান সকল প্রতিক্রিয়াশীল আইন বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় দুটিকে স্বায়ত্ত্শাসনের আওতায় আনা ৷
প্রস্তাব -১২. প্রশাসনের ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সকল উচ্চ ও নিম্নবৈতনভোগীদের বেতন ও অন্যান্য আনুসাঙ্গিক ব্যয় কমিয়ে আনা ৷
প্রস্তাব -১৩. দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং ঘুষ বন্ধ করা এবং ১৯৪০ সাল হতে বর্তমান পর্যন্ত সকল সরকারি চাকুরীজীবি এবং ব্যবসায়ীদের সম্পদের হিসাব নেওয়া ও সন্তোষজনক হিসেব দিতে ব্যর্থ হলে সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা ৷
প্রস্তাব -১৪. সকল জন-নিরাপত্তা আইন ও অধ্যাদেশ বাতিল করে বিনা বিচারে আটক সকল বন্দীকে মুক্তি দেওয়া এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতির অবাধ অধিকার নিশ্চিত করা ৷
প্রস্তাব -১৫. বিচার বিভাগকে শাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা ৷
প্রস্তাব -১৬.বর্ধমান হাউজকে আপাততঃ ছাত্রাবাস এবং পরে তা বাংলা ভাষার জন্য গবেষণাগারে পরিণত করা ৷
প্রস্তাব -১৭. ‘বাংলা ভাষা’ র সম্মান রক্ষার আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মৃতি রক্ষায় স্মূতিসৌধ নির্মান করা ৷
প্রস্তাব -১৮. ২১শে ফেব্রুয়ারীকে ‘শহীদ দিবস’ বলে ঘোষণা দেওয়া এবং ঐদিন সরকারী ছুটি ঘোষণা করা ৷
প্রস্তাব -১৯. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ব-পাকিস্তানকে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে ৷ শুধু প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র এবং মুদ্রা থাকবে পাকিস্রে অধীনে এবং রাষ্ট্রীয় বাকী সকল বিষয় পূর্ব-পাকিস্হানের আওতাভুক্ত ৷ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর থাকবে পূর্ব –পাকিস্হানে অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্হানকে নিরাপত্তার দিক থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে হবে এবং বর্তমান আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করতে হবে ৷
প্রস্তাব -২০.যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা ( এই সময়ে পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় নির্বাচনে পূর্ব –পাকিস্হানের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য হতে যুক্তফ্রন্ট বেশী আসনে জয়ী হয় এবং অন্যান্য সকল রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করে ) হতে কোনো মতেই আইন পরিষদের সময় বাড়াতে পারবে না এবং সাধারন নির্বাচনের ছয় মাস পূর্বে মন্ত্রিসভা ভেঙে দিতে হবে ৷ একজন সর্বজন গ্রহনযোগ্য নির্বাচন কমিশনের অধীনে বিধি মোতাবেক অবাধ এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা ৷
প্রস্তাব -২১. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রীসভায় কোনো আসন শূন্য হলে তিন মাসের মধ্যে উপনির্বাচনের মাধ্যমে তা পূরণ করতে হবে এবং যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী যদি পর পর তিনবার উপনির্বাচনে পরাজিত হয় , তবে মন্ত্রিসভা স্বেছ্ছায় পদত্যাগ করবে ৷ (চলবে) ৷
তথ্যসূত্র: বুকস, ইন্টারনেট
লেখক: ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, একাডেমিসিয়ান, কলামিস্ট এবং লেখক৷
বাংলাদেশ সময়: ০:২২:০৬ ৮৯৭ বার পঠিত # #নতুন প্রজণ্ম #বাংলাদেশ #মুক্তিযুদ্ধ