সোমবার, ৩০ নভেম্বর ২০২০

ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব- ১০”

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব- ১০”
সোমবার, ৩০ নভেম্বর ২০২০



নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ

  নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ :
অনেকদিন পর আমার ধারাবাহিক কলাম ‘নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ’ –নিয়ে আবার আপনাদের কাছে ফিরে এলাম ৷বর্তমানে ভয়ানক মহামারী ‘করোনা ভাইরাস-Covid-19’ এর ভয়ানক থাবায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের সমগ্র মানবজাতি আজ ভয়ে প্রকম্পিত ! বিভিন্ন শাস্ত্র, ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের অর্জিত জ্ঞান পর্যালোচনা করে জানা যায়, প্রতি একশ বছর পর পর সৃষ্টিকর্তা নাকি এইরকম বড় কোনো দুর্যোগ বা সমস্যা পৃথিবীতে প্রেরন করে থাকেন সমগ্র মানবজাতির সামগ্রিক উন্নয়ন, শুদ্ধি ও পরিবর্তনের জন্য ৷ এটি এমন এক ভয়ানক মহামারী যেনো এক নিমিষেই আমাদের থামিয়ে দিতে পারে৷কিন্তু নাহ্, যুগ যুগ ধরে মানবজাতি প্রমান করেছে তারা চাইলে তাদের মেধা, প্রজ্ঞা, বিবেক, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা,দক্ষতা,একাগ্রতা, নিষ্ঠা, প্রচেষ্টা, সৎ-ইছ্ছা দিয়ে যেকোনো দুর্যোগ থেকে নিজেদের ও অপরকে বাঁচাতে পারে ৷ পৃথিবীর সৃষ্টির পর থেকে এইরকম নানাবিধ দুর্যোগ তারা সফলতার সহিত মোকাবেলা করে করে সেই আদিম যুগের মানুষ (যখন মানুষ আগুন,খাদ্য,বস্ত্র,বাসস্হান,চিকিৎসা,শিক্ষার ব্যবহার জানতো না) হতে নিজেদের উন্নীত করেছে সভ্য জগতের সভ্যমানুষ হিসেবে এবং সেই সঙ্গে পৃথিবীকে তৈরী করেছে চরম বাসযোগ্য হিসেবে ৷ তাই আমরাও সুদৃঢ় চিত্তে আশা করি, স্রষ্টা নিশ্চয়ই এ যুদ্ধে আমাদের সকলের মেধা, প্রজ্ঞা, বিবেক, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা,দক্ষতা,একাগ্রতা, নিষ্ঠা ও সা্র্বিক প্রচেষ্টার মূল্যায়ন করে খুব শীঘ্রই আমাদেরকে এই মহা বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিবেন ৷ এখনকার পুরো বাংলাদেশের চিত্রটি এমন যেনো আমরা সেই ১৯৭১ সালের মতো প্রতিটি ক্ষণ পার করছি চরম উৎকণ্ঠায় , চরম উদ্বেগে ! আসলেই চারপাশে যেনো সেরকমই থমথমে একটি পরিবেশ ! এই মুজিব বর্ষে , করোনা-ভাইরাসের কারনে সরকারী নির্দেশ অনুযায়ী ঘরে বন্দী হয়ে থাকার এইদিনগুলোতে আমার সেকথাই মনে পড়ছে বার বার ! যেনো এক অদ্ভূত অথচ সত্য এক নষ্টালজিয়ায় আমরা সকলে ডুবে আছি ! মনে হছ্ছে, এসব কিছুই হছ্ছে আমদের আত্মশু্দ্ধির জন্য ৷ আমরা খুব বেশী পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত এবং খুব বেশী আবেগহীন, স্বার্থপর, হিংস্র ও যান্ত্রিক হয়ে উঠেছিলাম যা কিনা সৃষ্টিকর্তার ভালো লাগেনি কিংবা তিনি তা সহ্য করতে পারেন নি! তবুও আশার কথা এই যে, শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা-বিজ্ঞানীরা করোনার ভ্যাকসিন আবিস্কার করতে সমর্থ হয়েছেন ৷ অন্যান্য কঠিন রোগগুলোকে চিরতরে বিদায় জানানোর জন্য আমরা যেমন নিয়মিত টীকা ও ভ্যাকসিন নিয়ে থাকি, ঠিক তেমনি ‘করোনা-ভাইরাস’ কে চিরবিদায় জানাতে বিশ্বের সমগ্র মানবজাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ‘করোনার-ভ্যাকসিন বা টীকা’ টির জন্য ৷ সুতরাং এ বিষয়ে বিশ্বের সকল করোনা-আক্রান্ত দেশ সমূহে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সচেতনতা ও সু-দৃষ্টি একান্তভাবে কাম্য ৷

বাই দ্যা বাই, সুপ্রিয় পাঠক/ এবারে আমরা মূল বক্তব্যে ফিরে আসি ৷উপমহাদেশ থেকে বিট্রিশদের তাড়ানোর পর এই অঞ্চলের মানুষজন ভেবেছিল, এবার বুঝি তারা সুখে-শা্ন্তিতে বসবাস করতে পারবে এবং এখন থেকে তাদের অর্জন ও নিজস্ব সম্পত্তিতে বাইরের কেউ ভাগ বসাতে আর কখনো আসবে না ৷এবং এসময়ে উপমহাদেশে আবার হি্দু ও মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় ৷অর্থাৎ তখন থেকেই ভারত ও পাকিস্হান আলাদা হয়ে যাবার চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত ৷১৯৪৭ সালে এ দু’টি দেশ মূলতঃ একারনেই বিভক্ত হয়ে যায় এবং আজকের বাংলদেশ (তৎকালীন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্হান, তখন ভারতের কলকাতাকে বলা হতো-পশ্চিম বাংলা ) তখন পাকিস্হানের ( পশ্চিম পাকিস্হান) অভ্যন্তরে অবস্হিত একটি অঙ্গরাজ্য বলে পরিগনিত হয় ৷ তখন পূ্র্ব পাকিস্হান ও পশ্চিম পাকিস্হান নিয়ে মূল “পাকিস্হান” রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয় ৷ এবং কিছুদিন যেতে না যেতেই পূর্ব পাকিস্হান অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের জণগণ উপলদ্ধি করতে পারে যে, দুইশ বছর বিট্রিশরা শাসন করছিল বলে তাদেরকে তাড়ানো হয়েছিল এবং এখন সময় এসেছে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্হানের মাটি থেকে পশ্চিম পাকিস্হানের শাষকগোষ্ঠিদের তাড়ানোর ৷ বিট্রিশরা পূর্ব পাকিস্হানকে শাসন করেছিল দুইশ বছর আর অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্হান পূর্ব পাকিস্হানকে শাসন করেছিল প্রায় চব্বিশ বছর (১৯৪৭ থেকে ১৯৭১) ৷ পশ্চিম পাকিস্হান ও পূর্ব পাকিস্হান একটি দেশ হওয়া সত্ত্বেও শুরু থেকেই পশ্চিমা শাষকগোষ্ঠী বড় বড় অফিস-আদালত , কল-কারখানা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের দেশে তৈরী করা শুরু করে এবং পূর্ব পাকিস্হানের সকল সেক্টরর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে যা কিনা কোনোভাবেই পূর্ব পাকিস্হানের জণগন মেনে নিতে পারছিল না ৷একসময় পশ্চিমা শাষকগোষ্ঠী সরকারীভাবে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রীয় ভাষা বলে ঘোষনা করে ৷ এবং ঠিক তখনি পূর্ব পাকিস্হানের জণগন বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ৷ আর ঠিক তখনি পূর্ব পাকিস্হানের জনগণের মধ্যে তাদের সবরকম অধিকার সংরক্ষনের জন্য একটি রাজনৈতিক সচেতনতাবোধের সৃ্ষ্টি হয় এবং এটাই ছিল সমগ্র পূর্ব পাকিস্হানে বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলন জেগে ওঠার মূল শক্তি ৷এসময়ে পূর্ব পাকিস্হানের প্রধানতম রাজনৈতিক দলগুলো ছিল যথাক্রমে - আওয়ামী মুসলীম লীগ (আজকের বাংলদেশ আওয়ামী লীগ), যুক্তফ্রন্ট ও অন্যান্য কয়েকটি ছোট-খাট দল ৷ এইসব গুলো দল পূর্ব পাকিস্হানের জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বললেও এদের মধ্যে তখন ‘আওয়ামী মুসলীম লীগ’ কেই প্রধানতম ও জনপ্রিয় দল হিসেবে গন্য করা হতো কারন এ দলে তখন ছিলেন মাওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ( যিনি একবার উভয় পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন) ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান প্রমুখ নেতূবৃন্দ এবং এই নেতারা সর্বদাই পূর্ব পাকিস্হানের জনগণের অধিকার নিয়ে কথা বলতেন ৷

১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনের সময় পূর্ব পাকিস্হানের সকল রাজনৈতিক দল ও জণগণ এক হয়ে পশ্চিম পাকিস্হানের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজেদের বাংলা ভাষাকে রক্ষা করেছিল পশ্চিমাদের হাত থেকে ৷ আওয়ামী মুসলীম লীগ ও এর নেতৃবৃন্দের সহায়তায় শুধু বাংলা ভাষাই নয়, একে একে নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, ভোটের অধিকার, সবরকম মৌলিক অধিকার এবং সর্বোপরি নিজেদের স্বাধীনতা অর্জন করতেও সক্ষম হয়েছিল পূ্র্ব-পাকিসহানের জণগণ ৷ ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্হানের সরকার ব্যবস্হায় বেশ কয়েকবার কেন্দ্রীয় (জাতীয়) সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে উভয় পাকিস্হানের রাজনৈতিকদলগুলো অংশগ্রহন করে জয়ী হলেও প্রতি বারই পশ্চিম পাকিস্হান পূর্ব পাকিস্হানের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃ্ন্দকে উল্লেখযোগ্য কোনো পদ দিতেন না ৷ দুই পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিদের নিয়োগ দেয়া হতো পশ্চিম পাকিস্হান থেকে ৷এর মধ্যে আইয়ূব খানের শাসনমল ও পশ্চিম পাকিস্হানের সামরিক শাষনামলকে পূর্ব পাকিস্হানের জনগণ চরম দুঃসময় বলে আখ্যায়িত করতো ৷ পূর্ব পাকিস্হান থেকে আওয়ামী মুসলীম লীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী , শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য আরও নেতৃবৃ্ন্দ এবং যুক্তফ্রন্টের শেরে বাংলা , মাওলানা ভাসানী ( এর মধ্যে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী মুসলীম লীগ থেকে যুক্তফ্রন্টে জয়েন করেন ) অন্যান্য আরও নেতৃবৃ্ন্দ উভয় পাকি্হানের কেণ্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী,এমপিদের মতো উল্লেখযোগ্য পজিশনে থাকলেও পশ্চিম পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকার কখনই তাদের দাবী –দাওয়াগুলো পূরন করতেন না বরং উল্টো পূর্ব পাকিস্হানের জণগণের উপর দমন-নীতি চালিয়ে যেতেন ৷ এই কারনে পূর্ব পাকিস্হানের জণগণ তাদের রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট প্রায়ই তাদের নৈতিক দাবীগুলো বিভিন্ন দফা আকারে পেশ করতেন এবং এই দফাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দফা হছ্ছে-১৯৫৪ এর ২১ দফা ( আওয়ামী মুসলীম লীগসহ পূর্ব পাকিস্হানের সকল রাজনৈতিক দলগুলো এক হয়ে এই দাবীর প্রতি একাত্বতা ঘোষনা করে), ১৯৬৬ এর ৬দফা (পূর্ব পাকিস্হানের অধিকংশ জণগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে আওয়ামী মুসলীম লীগ অরফে আওয়ামী লীগের সভপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক উথ্থাপিত ) ও ১৯৬৯ র ১১দফা (পূর্ব পাকিস্হানের অধিকংশ জণগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মতিতে আওয়ামী মুসলীম লীগ অরফে আওয়ামী লীগের সভপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কর্তৃক উথ্থাপিত ) ইত্যাদি ৷

উল্লেখ্য, পরবর্তীতে এই কলামের বিভিন্ন পর্বে আমরা এই দফাগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবো ৷সে সময়ে পূর্ব পাকিস্হানের জণগণ সকল রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দের মাঝে কেবল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকেই তারা তাদের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল এবং শেখ মুজিবর রহমানও তখন তাঁর সম্পূর্ন জীবনের রাজনৈতিক কর্ম কান্ড, নিজের দেশের প্রতিটি মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা,নিষ্ঠা, সততা ও দেশপ্রমবোধের দ্বারা পূর্ব পাকিস্হানের আপমর জণগণের কছে তুমুল জনপ্রিয় ও ভালোবাসার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন ৷ ১৯৬৮ সালে, ৩ জানুয়ারীতে পাকিস্হানকে বিছ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে পাকিস্হান-সরকার ‘শেখ মুজিব’কে প্র্ধান আসামী করে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করেন ৷ ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী জনগণের চাপের মুখে পশ্চিম পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয় ও বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি প্রদান করে। ২৩ ফেব্রুয়ারী রেসকোর্ষ ময়দানে আনুষ্ঠানিক ভাবে পূর্ব-পাকিস্হানের আপামর জনগণ শেখ মুজিবকে “বঙ্গবন্ধু” উপাধিতে ভূষিত করে এবং পূর্ব-পাকিস্হানের পূর্ন স্বায়ত্তশাসনের দাবীতে গন-আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারী “বঙ্গবন্ধু” পুনরায় আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ৭ ডিসেম্বর পাকিস্হানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে । নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্হানের আওয়ামীলীগের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারী নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ অনু্ঠিত হয় এবং ৫ জানুয়ারী পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বাধিক আসন লাভকারী ভুট্টো কেন্দ্রে আওয়ামীলীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে সম্মতি জানায় ।

জাতীয় পরিষদের সদস্যদের সভায় শেখ মুজিব পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো দুই প্রদেশে দুই দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানান । ১৬ ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে এ দাবীর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন , ‘ দুই প্রদেশে দুই দলের নিকট নয়, যেহেতু নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরুঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেছে, সুতরাং ক্ষমতা আওয়ামীলীগে র কাছেই হস্তান্তর করতে হবে ‘ । ১৯৭১ এর ১ লা মার্চ জাতীয় ( কেন্দ্রীয়) পরিষদের সভা অনিদির্ষ্ট কালের জন্য বনধ ঘোষনা করা হয় ও ৩রা মার্চ সারা দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয় । ৭ মার্চ “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান “রেসকোর্স ময়দানে বাঙ্গালী জাতির উ্দ্দেশ্যে সর্বপ্রথম প্রকাশ্যে স্বাধীনতার ঘোষনা দেন ৷ তিনি দৃঢ় চিত্তে বলেন ‘এবারের সংগ্রাম- মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম’৷

এই যুগা্ন্তকারী-কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে তিনি পূর্ব- বাংলা অর্থাৎ পূর্ব-পাকিস্হানের সকল জনগনকে একত্রিত করে পূর্ব-পাকিস্হানের স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক দেন ও পশ্চ৭ম পাকিস্হানের শোষন – অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়তে সকলকে উদ্বুদ্ধ করেন ৷ এরপর ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্য্ন্ত্ স্বাধীন দেশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। এসময় পূর্ব-পাকিস্হানের সকল জনগন ও সকল সরকারী – বেসরকারী সকল অফিস –আদালত বঙ্গবন্ধুর নিদের্শ মেনে নেয় । ১৯৭১ এর ১৬ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে আলোচনা হয় পূর্ব-পাকিস্হানের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান , পশ্চিম -পাকিস্হানের ভুট্টৌ আর জেনারেল ইয়াহিয়ার মাঝে, আলোচনা ব্যর্থ হলে ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ করে পাকিস্হানে চলে যান । ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে অতর্কিতে পূর্ব-পাকিস্হানের নিরীহ জনগণের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৃশংষ হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে ৷ এই খবর পেয়ে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাত ১২টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনা দেন লিখিত আকারে ৷ তাঁর এই ঘোষনা সর্বত্র টেলিফোন, টেলিগ্রাম ও ওয়ারল্যাসে পাঠানো হয় এবং এই ঘটনার পর পরই ২৫ মার্চ , রাত ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু পশ্চিমাদের হাতে গ্রেফতার হন । ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া এক ভাষনে আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী আখ্যা দেন ।

২৬ ও ২৭ মার্চ যথাক্রমে চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম এ হান্নান এবং পরবর্তীতে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর লেখা” স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র” টি তারা তাদের নিজেদের মতো করে বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই পাঠ করেন অর্থাৎ ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে সকলের মতো তারাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব মেনে নিয়েছিলেন (যদিও পরব্তীতে এই ঘোষনা-পাঠ নিয়েই ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হয়েছিল) ৷ পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল, শেখ মুজিবের নেতৃত্বে কুষ্টিয়ায় অস্হায়ীভাবে ‘মুজিবনগর সরকার’গঠন করা হয় ৷ ১৭ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ জাতীয় চারনেতার সমন্বয়ে ৷

জাতীয় চারনেতারা হছ্ছেন যথাক্রমে ১. তাজউদ্দিন আহমেদ (জন্ম : ২৩ জুলাই, ১৯২৫ - মৃত্যু নভেম্বর ৩, ১৯৭৫ ) , ২. সৈয়দ নজরুল ইসলাম (জন্ম : ১৯২৫ - মৃত্যু নভেম্বর ৩, ১৯৭৫ ) , ৩.ক্যাপ্টেন মনসূর আলী (জন্ম : ১৬ জানুয়ারী ১৯১৯ - মৃত্যু নভেম্বর ৩, ১৯৭৫ ) এবং ৪. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ কামরুজ্জামান (জন্ম : ২৬ জুন, ১৯২৬ - মৃত্যু নভেম্বর ৩, ১৯৭৫ ) ৷ এবং শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। তাঁর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন-তাজউদ্দিন আহমেদ ৷ পূর্ব পাকিস্হানের আপামর জণগণ এক হয়ে পশ্চিম পাকিস্হানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যু্দ্ধে অবতীর্ন হয় ! এসময় ‘মুজিবগর সরকার’ এর উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি ও সদস্যরা ছিলেন যথাক্রমে মাওলানা ভাসানী, মনি সিংহ,মোজাফফর আহমদ,মনোরঞ্জন ধর,তাজউদ্দিন আহমেদ ও আরও বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ ৷

‘মুজিবনগর সরকার’ ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্হান)স্বাধীনতা যুদ্ধ সু্ষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে তৎকলীন সেনাপ্রধান জেনারেল আতাউল গনি ওসমানীকে সর্বাধিনায়ক করে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করেন এবং বাংলাদেশের তিন বাহিনীর বিভিন্ন অফিসারদেরকে একেক সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব অর্পন করেন সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য ৷ ১১টি সেক্টর যথাক্রমে-১. সেক্টর -১ (এলাকা- চট্রগ্রাম ও পার্বত্য চট্রগ্রাম এরিয়া) –অধিনায়ক: মেজর রফিকুল ইসলাম (বীর উত্তম) ও মেজর জিয়াউর রহমান ,২. সেক্টর -২ (এলাকা- কুমিল্লা,ফরিদপুর,চাঁদপুর এরিয়া) –অধিনায়ক : লেঃ কর্নেল খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম), , ৩. সেক্টর -৩ (এলাকা-ঢাকা,জয়দেবপুর, নরসিংদী এরিয়া) –অধিনায়ক: লে: কর্ণেল কে.এম.শফিউল্লাহ (বীর উত্তম), ও মেজর এ.কে.এম.নুরুজ্জামান (বীর উত্তম), ৪. সেক্টর -৪ (এলাকা-সিলেট , মৌলভীবাজার এরিয়া ) – অধিনায়ক : লে: কর্নেল সি.আর. দত্ত (বীর উত্তম),

সেক্টর -৫ (এলাকা-কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ) –অধিনায়ক : লেঃ কর্নেল মীর শওকত আলী (বীর উত্তম), ৬. সেক্টর -৬ (এলাকা-রংপুর, তেতলিয়া, গাইবান্ধা এরিয়া ) –অধিনায়ক: উয়িং কমা্ডার এম.কে.বাশার (বীর উত্তম), ৭. সেক্টর -৭ (এলাকা- বগুড়া, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ এরিয়া ) –অধিনায়ক : লেঃ কর্নেল কজী নুরুজ্জামান (বীর উত্তম), ও মেজর নাজমুল হক (বীর উত্তম), ৮. সেক্টর -৮ (এলাকা-যশোর, খুলনা, মাগুরা ,কুষ্টিয়া এরিয়া ) –অধিনায়ক : মেজর – আবু ওসমান চৌধুরী (বীর উত্তম) ও লেঃ কর্নেল এম.এ মঞ্জুর (বীর উত্তম), ৯. সেক্টর -৯ (এলাকা- দৌলতপুর-সাতক্ষীরা,খুলনার দক্ষিণাঞ্চল, সমগ্র বরিশাল , পটুয়াখালী, বাগেরহাট, পিরোজপুর, সুন্দরবন এরিয়া) –অধিনায়ক: মেজর এম.এ জলিল (বীর উত্তম), ১০. সেক্টর -১০ (এলাকা-কোনো আঞ্চলিক সীমানা নেই। ৫১৫ জন নৌবাহিনীর কমান্ডো অধীনস্হ। শত্রুপক্ষের নৌযান ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে পাঠানো হত) –অধিনায়ক : সুনির্দিষ্ট কোনো অধিনায়ক ছিলনা, শত্রুপক্ষের নৌযান ধ্বংসের জন্য বিভিন্ন সেক্টরে বিভিন্ন সময়ে নৌবাহিনীর কমান্ডারদের পাঠানো হতো,

সেক্টর -১১ (এলাকা-ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল , নগরবাড়ি এবং বাংলাদেশের সমগ্র আকাশপথ ) –অধিনায়ক: লে কর্নেল এম.এ তাহের (বীর উত্তম) ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম হামিদুল্লাহ খান (বীর উত্তম) ৷ চলবে ৷

তথ্যসূত্র : বুকস্ , ইন্টারনেট ৷
লেখক: ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, একাডেমিসিয়ান, কলামিস্ট এবং লেখক৷

---

তথ্যসূত্র: বুকস, ইন্টারনেট

লেখক : ফারহানা আক্তার ,লেখক,কলামিষ্ট

---

বাংলাদেশ সময়: ১৪:০৬:০৭   ৮১৮ বার পঠিত   #  #  #