মঙ্গলবার, ১৭ নভেম্বর ২০২০
কথাশিল্পী শাহেদ আলী, চেনা হাওরের অচেনা মানিক
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » কথাশিল্পী শাহেদ আলী, চেনা হাওরের অচেনা মানিক
জিব্রাইলের ডানা গল্পের মাধ্যমে যে নামটি আমার প্রথম কানে বাজে,যার নামটি শুনতে অপেক্ষা করতে হয়েছে কুঁড়িটি বছর,তিনি আর কেহ নয় সুনামগঞ্জের হাওরের গর্ব, কথা সাহিত্যিক অধ্যাপক শাহেদ আলী।বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে জিব্রাইলের ডানা গল্প পড়তে গিয়ে নামটির সাথে প্রথম পরিচয় ,অথচ সেদিন চমকে যাই শুনে এই যে, সেই মানুষটির জন্ম আমার পার্শ্ববর্তী ইউনিয়নে! এই ব্যর্থতা কি আমার ছিল নাকি সমাজের? হ্যা বন্ধুরা আজ আমরা সেই মানুষটিকেই একটু জানার চেষ্টা করছি।চলুন লেখাটিতে একটু চোখ বুলিয়ে আসি।
বিশ্ব মুক্তকোষ উইকিপিডিয়া হতে জানা যায় অধ্যাপক শাহেদ আলী একাধারে বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী, ভাষাসৈনিক,ইসলামী চিন্তাবিদ, সাংবাদিক, অনুবাদক এবং একজন গবেষক ছিলেন।শিক্ষকতা,লেখা-লেখির পাশা- পাশি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনেও।
১৯২৫ সালে ২৬ মে সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় শ্রীপুর ইউনিয়ন(বর্তমান দক্ষিণ শ্রীপুর) ইউনিয়নের মাহমুদপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তাঁর জন্ম। পিতার নাম মৌলবী ইসমাইল আলী, মাতা আয়েশা খাতুন।
সরকারি জুবিলী উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৪৩ সালে প্রবেশিকা(এসএসএসি), সিলেট এমসি কলেজ থেকে ১৯৪৫ সালে এফ এ(এইচএসসি),একই কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে ব্যাচেলর’স(বিএ) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মাস্টার্স(১৯৫০) ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৫১ সালে বগুড়া আজিজুল হক কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।পরে ঢাকার মিরপুর বাঙলা কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ ও চট্টগ্রাম সিটি কলেজে অধ্যাপনা করেছেন।
অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নকালে(১৯৪০) সওগাত পত্রিকায় তাঁর প্রথম লেখা গল্প “অশ্রু” প্রকাশিত হয়।সেই থেকেই সাহিত্য জগতে তাঁর পদচারণা শুরু।
তিনি একাধারে উপন্যাস, ছোটগল্প, মননশীল রচনা, শিশুসাহিত্য, অনুবাদ, ভ্রমণ কাহিনী লিখে পাঠকদের আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসমূহের মাঝে ছোটগল্প গল্পগুলো হলো জিবরাইলের ডানা(১৯৫৩), একই সমতলে(১৯৬৩), শা’নযর(১৯৮৫), অতীত রাতের কাহিনী(১৯৮৬),অমর কাহিনী(১৯৮৭), নতুন জমিনদার(১৯৯২),শাহেদ আলীর শ্রেষ্ঠগল্প(১৯৯৬) ইত্যাদি।উপন্যাস সমূহ - হৃদয় নদী(১৯৬৫),কাঁদা মাটির, (অপ্রকাশিত),সাতকাহন(অপ্রকাশিত)
শিশু সাহিত্য সমূহের মাঝে রুহীর প্রথম পাঠ(১৯৮০),ছোটদের ইমাম আবু হানিফা (২য় সংস্করণ ১৯৮০), সোনার গাঁয়ের সোনার মানুষ(১৯৭১), (২য় সংস্করণ-১৯৯২ সালে)।
গবেষণা প্রবন্ধ সমূহ “বাংলা সাহিত্যে চট্রগ্রামের অবদান ১৯৬৫(২য় সংস্করণ),তরুণ মুসলিম ভূমিকা, একমাত্র পথ, তরুণের সমস্যা, তওহীদ, মুক্তির পথ, বুদ্ধির ফসল আত্মার আশিস, ধর্ম ও সাম্প্রদায়িকতা, জীবন নিরবচ্ছিন্ন,জীবনদৃষ্টি।”
ইতিহাস ভিত্তিক লেখা ফিলিস্তিনে রুশ ভূমিকা,সাম্রাজ্যবাদ ও রাশিয়া, বিপর্যয়ের হেতু।
অনুবাদ গ্রন্থসমূহ মক্কার পথ (মূলঃ মুহাম্মদ আসাদ) ১৯৯৩ (৩য় সংস্করণ), ইসলামে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনার মূলনীতি (মূলঃ মুহাম্মদ আসাদ) (১৯৬৬),আধুনিক বিজ্ঞান ও আধুনিক মানুষ (মূলঃ কে বি এইচ কোনান্ট), ইতিবৃত্ত (মূলঃ হরোডোটাস) ১৯৯৪,হিস্টরি অব পলিটিক্যাল থিওরী (মূলঃ জি এইচ সেবাইন,আংশিক), উন্ডামেন্টালস অব ইকোনমিকস (মূলঃ জি এইচ সেবাইন,আংশিক), আত তাওহীদ (মূলঃ ইসমাইল আর রাযী ফারুকী) অমুদ্রিত,ডেইলী লাইফ অব এনসাইন্ট রোম (মূলঃ জেরোমি কাসোপিনো),হেরোডোটাস, এ যুগের বিজ্ঞান ও মানুষ (১৯৬০)।
গ্রন্থিত লেখা : মাসিক সওগাতে ১
এছাড়াও “বিচার ” নামে একটি নাটিকাও তিনি লিখেছিলেন।
শাহেদ আলীর সুবিখ্যাত গল্প ‘জিবরাইলের ডানা’ তাঁকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায় এবং ছোটগল্পকার হিসেবে তিনি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করেন। মর্যাদাসম্পন্ন এ গল্পটি ১৯৫০ সালে আইএ ও বিএ ক্লাসে পাঠ্য ছিল। ১৯৮৫ সালে এটি এসএসসি ক্লাসের পাঠ্য তালিকাভুক্ত হয়। ‘জিবরাইলের ডানা’ প্রকাশের পরই দেশে–বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে। Afro-Asian Book Club msKwjZ Under the Green Canopy গ্রন্থে ‘জিবরাইলের ডানা’র ইংরাজি অনুবাদ এবং মস্কো থেকে প্রকাশিত ‘জানোতোয়ে ওবোলো’ (সোনালী মেঘ) নামক সংকলনে রুশ ভাষায় অনূদিত হয়ে ছাপা হয়। একসময় ভারতের বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটক, জ্যোতির্ময় রায়, নৃপেন গঙ্গোপাধ্যায়সহ অনেকে চলচ্চিত্র নির্মাতা এর চলচ্চিত্র রূপ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন, অবশ্য যে কোন কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি।
লেখালেখির পাশাপাশি সম্পাদনায় ও তাঁর অবদান কম নয়।মূলত ৪০ এর দশক থেকেই তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন।তাই সাহিত্য ও সাংবাদিকতায় রয়েছে তাঁর অনেক সম্পাদনা।আমাদের সাহিত্যে ও ভাবনায় কায়েদে আজম, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ-জাতীয় সম্বর্ধনা স্মারক,ইসলামী সংস্কৃতির রূপরেখা, মাসিক প্রভাতী ১৯৪৪-১৯৪৬, সাপ্তাহিক সৈনিক ১৯৪৮-১৯৫০, দৈনিক বুনিয়াদ,১৯৫৫,ইসলামিক একাডেমী পত্রিকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা ১৯৬২-১৯৮০,মাসিক সবুজ পাতা ১৯৬৩-১৯৮২ প্রভৃতি পত্রিকা সমূহ সম্পাদনা করেন।এছাড়াও সহ সম্পাদনায়, আংশিক সম্পাদনায় যেগুলোতে কাজ করেছেন -সহসম্পাদক, দৈনিক মিল্লাত ১৯৫৬, প্রথম সম্পাদক- বাংলা বিশ্বকোষ, ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনস ১৯৫৯-৬০, ৩. সদস্য-সম্পাদনা বোর্ড,বাংলা একাডেমী পত্রিকা ১৯৬৩-৬৪, সদস্য-সম্পাদনা বোর্ড,ইসলামি বিশ্বকোষ (ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলা প্রকাশিত),অনুবাদক ও সম্পাদক, আল কোরআনুল কারীম (ইসলামিক একাডেমী প্রকাশিত) ১৩৭৪-৭৮,সদস্য-সম্পাদনা কমিটি,আল্লামা ইকবাল সংসদ পত্রিকা প্রভৃতি পত্রিকা ও সাহিত্য সংকলন সম্পাদনা করেন।
অধ্যাপক শাহেদ আলী তাঁর নিজের লেখার মূল্যায় নিজেই করেছেন দুবাই ভিত্তিক দুটি পত্রিকাতে।পাঠকদের বুঝার সুবিধার্থে হুবহু তুলে ধরা হলো।
“My message is social. It is an attempt to awaken the social conscience of my people. Yes. there is a great deal of symbolism but it is rooted in my experience and environment.’’ (Quoted from the Gulf Weekly’’, Dubai, 19-25, March, 1992.) ”
My Writings are about my experience, about my environment. There is a great deal about my rural life but my themes are also urban. Often, I respond to my own feelings about the anomalies in urban life, about the erosion in social values in moral standards. The sum total of my massage is to illustrate and convey the sufferings, the pain and the tragedies which people are forced to bear and struggle against. I don’t believe that a writer can or should try to create anything outside the context of his own experience. To be authentic, you must be a product of your own environment. I contradict the theory that true poets and writers are bonded to humanity at large, not to a particular place or time. A Writer is born in a particular country, at a particular time and in a particular place.’’
এছাড়াও ১৯৮০ সালে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত সাহিত্য উৎসবে বাংলাদেশ সরকারের একমাত্র মনোনীত সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি।
তৎকালীন বিশিষ্ট জনদের লেখার সারমর্ম থেকে কথাশিল্পী শাহেদ আলী সম্পর্কে যতটুকু Summary হিসেবে পাওয়া যায় তা হলো “শাহেদ আলী ইতিহাস–সচেতন, ঐতিহ্যপুষ্ট, বা
রাজনৈতিক জীবনে তিনি ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে খেলাফতে রব্বানী পার্টির নমিনেশনে সুনামগঞ্জ থেকে পূর্ব পাকিস্থান আইনসভার সদস্য(এমএলএ) নির্বাচিত হন। তাছাড়া ১৯৪৮-৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সার্বিক কার্যক্রমে জড়িত থাকা অধ্যাপক শাহেদ আলী তমুদ্দন মজলিসের সাধারণ সম্পাদক ও পরে সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন।
শাহেদ আলী তাঁর সাহিত্য-কর্ম, ভাষা আন্দোলন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য যেসব পুরস্কার ও স্বীকৃতি লাভ করেন- বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৪), তমঘায়ে ইমতিয়াজ (১৯৭০), রাষ্ট্রপতির ভাষা-আন্দোলন পদক (১৯৮১), নাসির উদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৮৫), সিলেট লায়ন ক্লাব পদক (১৯৮৫), ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (১৯৮৬), রাগিব-রাবেয়া সাহিত্য-১৯৮৮, একুশে পদক (১৯৮৯), সিলেট যুব ফোরাম পদক (১৯৯০), বাংলা সাহিত্য পরিষদ পদক-১৯৯১,বাংলাদেশ ন্যাশনাল স্টুডেন্ট এ্যাওয়ার্ড, ইংল্যান্ড (১৯৯১), বাংলাদেশ ইসলামিক ইংলিশ স্কুল, দুবাই সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯২, চট্রগ্রাম সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রদত্ত ‘কবি ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯৭) ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পদক-২০০০, সেলুসাস সাহিত্য পুরস্কার- ২০০০, জাসাস স্বর্ণ পদক, ২০০২ (মরণোত্তর), কিশোরকণ্ঠ পুরস্কার ২০০৩ প্রভৃতি।
দাম্পত্য জীবনে অধ্যাপিকা চেমন আরাকে তাঁর জীবন সঙ্গীনি হিসেবে বেঁচে নেন।বিবি চেমন আরা ও একজন সুলেখিকা,অধ্যাপক।মৃত্যুকালে তিনি তিন ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে যান।
আজ এইবেলায় দুঃখ ভরেই বলতে হয়,যার নামে পরিচিতি পেতো সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল,এমন একটা সময় ছিল শাহেদ আলী মানেই সুনামগঞ্জ বলে জানতো সবে সেই মহান ব্যাক্তিটি ২০০১ সালের ৬ নভেম্বর মৃত্যু বরণের ১৯ টি বছর পেরিয়ে গেলেও তাঁর নামে না আছে কোন পাঠাগার,না আছে কোন সড়কের নাম,না আছে কোন সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র।এমন কি তাঁর জন্ম মৃত্যু দিবসে জেলা প্রশাসন বা স্থানীয় প্রশাসন কেহই তাঁর স্মরণ উৎসব বা আলোচনা সভা কিছুই আয়োজন করতে দেখা যায়না।তাই আক্ষেপ করেই বলতে হয় কথাশিল্পী শাহেদ আলী, চেনা হাওরের এক অচেনা মানিক।বলার অপেক্ষা রাখেনা হাওরের তরুণদের কাছে শাহেদ আলী এক অচেনা,অবহেলিত নাম! তাই আজকের এই দিনে হাওর ভিত্তিক সাহিত্য সংগঠন “হাওর সাহিত্য উন্নয়ন সংস্থা(হাসুস) বাংলাদেশ” র পক্ষ থেকে এই মহান কৃতী মানুষটির কীর্তি সংরক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।ভুলে যাবেননা “গুণী জনদের কদর হয়না দেশে গুণীজন জন্মায়না”।শাহেদ আলীকে সংরক্ষণ প্রয়োজন শাহেদ আলীর জন্য নয়,অনাগত শাহেদ আলীদের জন্যই আজকের শাহেদ আলীকে তুলে ধরতে হবে,সসম্মানে সংরক্ষণ করতে হবে।আশা করি সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে সচেষ্ট হবেন।
লেখকঃ
হাওরকবি জীবন কৃষ্ণ সরকার
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি,
হাওর সাহিত্য উন্নয়ন সংস্থা(হাসুস) বাংলাদেশ
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪১:২৮ ৮৩৯ বার পঠিত