সোমবার, ১৬ নভেম্বর ২০২০

ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-৮”

Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম – “ নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-৮”
সোমবার, ১৬ নভেম্বর ২০২০



 নতুন প্রজন্মের চোখে মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা লাভ করেছি ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন দেশ, নিজস্ব পতাকা । ১৯৬৬ সালে ৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কর্তৃক পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট ‘৬ দফা দাবী’ পেশ করার পরেও তাদের কাছ থেকে পূর্ব-পাকিস্হানের জনগণ ফলদায়ক আচরন পেতে ব্যর্থ হন এবং এ সময়ে পাকিস্হান সরকার শেখ মুজিবের প্রতি উল্টো পদক্ষেপ গ্রহন করেন৷ ১৯৬৮ সালে, ৩ জানুয়ারীতে পাকিস্হানকে বিছ্ছিন্ন করার অভিযোগ এনে পাকিস্হান-সরকার ‘শেখ মুজিব’কে প্রধান আসামী করে রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৭ জানুয়ারী’১৯৭১ এ, তাকে মুক্তি দিয়ে জেল গেট থেকে পুনরায় গ্রেপ্তার করে এবং ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী জনগণের চাপের মুখে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে নেয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারী রেসকোর্ষ ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে এক বিরল সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং এই সংবর্ধনার মাধ্যমে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে পূর্ব-পাকিস্হানের জনগণ “বঙ্গবন্ধু” উপাধি প্রদান। ১৯৭০ সালের ৬ জানুয়ারী পুনরায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ২৮ অক্টোবর’ ১৯৭০ এ,শেখ মুজিব জাতির উদ্দেশ্য বেতার ও টিভিতে ভাষন প্রদান করেন। ৭ ডিসেম্বর’ ১৯৭০ এ,সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব-পাকিস্হানের আওয়ামীলীগ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীন ) নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। অর্থাৎ তারা জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্য ১৬৭টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্হানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারী নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ প্রোগ্রাম অনুষ্ঠিত হয়। ৫ জানুয়ারী ‘ ১৯৭১ এ, পাকিস্তানের সর্বাধিক আসন লাভকারী ভুট্টো অনেক গরিমসির মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে আওয়ামীলীগের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনে সম্মতি প্রদান করেন। জাতীয় পরিষদের সদস্যদের সভায় শেখ মুজিব পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। ২৮ জানুয়ারী’ ১৯৭১ এ, ভুট্টো ঢাকায় আসেন। তিনদিন বৈঠকের পর আলোচনা ভেংগে যায়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় জাতীয় পরিষদের সভা আহ্বান করেন। ১৫ ফেব্রয়ারি’ ১৯৭১ তারিখে, ভুট্টো দুই প্রদেশে দুই দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানান। ১৬ ফেব্রুয়ারী’১৯৭১ বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতিতে এ দাবীর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন , ‘ক্ষমতা আওয়ামীলীগের কাছেই হস্তান্তর করতে হবে’। ১ মার্চ ‘১৯৭১ কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় পরিষদের সভা অনিদির্ষ্ট কালের জন্য বনধ ঘোষনা করা হয়। ৩ মার্চ ‘১৯৭১ দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয়। ৭ মার্চ’১৯৭১, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রেসকোর্স ময়দানে বাঙ্গালী জাতির উ্দ্দেশ্যে ভাষণ দেন এবং উচ্চারণ করেন, ‘ এবারের সংগ্রাম- মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম’৷ তাঁর এই যুগা্ন্তকারী-কালজয়ী ভাষণের মাধ্যমে বাংলার সকল জনগনকে একত্রিত করে পশ্চিম পাকিস্হানের বিরুদ্ধে সকলকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ন হতে উদ্বুদ্ধ করেন এবং লক্ষ লক্ষ জনতার সম্মুখে স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক দেন ।এরপর ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ ‘ ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত স্বাধীন দেশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্হান) রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তখন এদেশে বাইরের কারো হুকুম চলেনি। সবাই বঙ্গবন্ধুর নিদের্শ মেনে নিয়েছে। ১৬ মার্চ ‘ ১৯৭১ ক্ষমতা হস্তান্তর আলোচনা শুরু হয় বঙ্গবন্ধু আর ইয়াহিয়ার মাঝে। ভুট্টৌ এসে আলোচনায় যোগ দেন। ২৪ মার্চ পর্যন্ত আলোচনা হয়। এরপর হঠাৎ করে ১৯৭১, ২৫ মার্চে আলোচনা ব্যর্থ হলে জেনারেল ইয়াহিয়ার ঢাকা ত্যাগ করেন এবং গভীর রাতে পূর্ব-পাকিস্হানের নিরীহ জনগণের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনীরা পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম নৃশংষ হত্যাযজ্ঞ চালায় যা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে একটি জঘ্যতম কালো অধ্যায় । এ দেশের মানুষকে পরাধীনতার জিঞ্জিরে বেঁধে রাখতে ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ এর নামের গণহত্যায় মেতে উঠে। মধ্যরাতে ঢাকা পরিণত হয় লাশের শহরে।ঢাকা শহরের রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, নীলক্ষেতসহ বিভিন্ন স্থানে নির্বিচারে তারা বাঙালি নিধন শুরু করে। ঢাকাসহ দেশের অনেক স্থানে মাত্র এক রাতেই হানাদাররা নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল অর্ধ লক্ষাধিক বাঙালিকে।শুধু নিষ্ঠুর ও বীভত্স হত্যাকাণ্ডই নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে থাকা গণমাধ্যমও সেদিন রেহাই পায়নি জল্লাদ ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা থেকে।এ হামলায় জীবন দিতে হয় বেশ কয়েকজন গণমাধ্যম কর্মীকেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও জান্তার কালো থাবা থেকে রক্ষা পাননি। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিভিন্ন বিভাগের নয়জন শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। তাদের এই সশস্ত্র অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল একটিই। আর তা হলো বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে অঙ্কুরেই ধ্বংস করা। ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে তার শুভাকাঙ্খী আর দলের নেতারা বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়ার অনুরোধ জানান। ২৬মার্চ’ ১৯৭১ অর্থাৎ ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১২টা ১০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা দেন। এই ঘোষনা সর্বত্র টেলিফোন, টেলিগ্রাম ওয়ারল্যাসে পাঠানো হয় দেশের সর্বত্র এবং এই রাতেই , রাত ১.৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু পশ্চিম-পাকিস্হানীদের হাতে তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হন এবং এই সময়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সকল সদস্যগণও তাঁর নিজ বাড়ী –ধানমন্ডির ৩২ নাম্বারেই গৃহবন্দী অবস্হায় দিন-যাপন করতে থাকেন। ২৬ মার্চ ‘১৯৭১ , ইয়াহিয়া এক ভাষনে আওয়ামীলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কে ‘দেশদ্রোহী’ বলে আখ্যা দেন। ২৬ মার্চ যথাক্রমে চট্টগ্রাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম এ হান্নান এবং পরবর্তীতে , ২৭ মার্চ মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর লেখা ‘স্বাধীনতার ঘোষনা পত্র’ টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে জাতির উদ্দেশ্যে তারা তাদের নিজেদের ভাষায় পাঠ করেন। ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ – মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার গঠিত হয় ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ১০ই এপ্রিল তারিখে কুষ্টিয়ার চুয়া ডাঙ্গায় এবং বর্তমান মেহেরপুর জেলার আম্রকাননে (পরবর্তী নাম ‘মুজিব নগর’ করা হয় ) শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ৷ ‘মুজিবনগর সরকার’ এর ‘ঘোষনা পত্র’ গঠন করা হয়। ‘মুজিবনগর সরকার’ এর পক্ষে প্রফেসর ইউসূফ আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতা লিখিত আকারে প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে, ১৯৭১ সালের ১৭ ই এপ্রিল তারিখে , ‘মুজিবনগর সরকার’ আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহন করেন৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে রাষ্ট্র্পতি করে সেই দিন নতুন বাংলাদেশে এক নতুন সরকার গঠিত হয় জাতীয় চারনেতার সমন্বয়ে ( সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ মনসুর এবং কামারুজ্জামান এই চারটি নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে উজ্জল নক্ষত্রসম)। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ( অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে বন্দি থাকার কারনে ) অস্থায়ী উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসনবিষয়ক মন্ত্রী করা হয়। এ সময় সমগ্র বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্হান)কে সর্বমোট ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং জেনারেল আতাগনি ওসমানী কে সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব দিয়ে সেনাবাহিনী অন্যান্য উর্ধতন কর্মকর্তাদের একেকটি সেক্টরের অধিনায়ক করে পশ্চিম পাকিস্হানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া হয়৷ ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশেরজনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারত, ভারত-সরকার ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় এই মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। টানা নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ – পশ্চিম-পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করে। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে খোদিত হয় একটা নাম-আমাদের ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ও লাল-সবুজ পতাকা’। তার আগে ৭ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান কে পাকিস্হান সরকার মৃত্যুদন্ড প্রদান করে কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সেটা তারা আর কার্য্কর করতে পারেনি।১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারী আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বঙ্গবন্ধু কে মুক্তি দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকায় আগমনের পূর্বে প্রথমে লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং লন্ডন থেকে ঢাকায় আসার পথে ভারতে যাত্রা বিরতিতে সেখানে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সহযোগী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাক্ষাৎ সেরে বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারী’১৯৭২ এ ঢাকায় অবতীর্ন হন৷ ঢাকায় পৌছার পর বাংলাদেশের জনগণ তাকে অবিস্মরনীয় সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন এবং এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের গৃহবন্দী থেকে মুক্তি দেয়া হয়৷ ১২ জানুয়ারী -১৯৭২, বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করেন এবং এসময় সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৪৯ সালে দেয়া বাহিস্কারাদেশ প্রত্যাহার করে। বঙ্গবন্ধু ৬ ফেব্রুয়ারী ভারত ,২৮ ফেব্রুয়ারী সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেন। ১২ মার্চ মিত্রবাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগ। ১০ অক্টোবর জুলিও কুরী পুরস্কার লাভ। ১৫ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব প্রদানের ঘোষনা। ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাক্ষর। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর হতে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও ডঃ কামাল হোসেনের তত্ত্বাবধানে তৈরী বাংলাদেশের জন্য সংবিধান কার্যকর হয় আর শুরু হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের কার্যক্রম৷
ধারাবাহিকভাবে, এবারে আমরা এই উপমহাদেশের ইতিহাসের মূল আলোচনায় ফিরে আসি- “নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব- ২”-এ আমরা এই উপমহাদেশের ইতিহাসকে নিমোক্ত দুটো খণ্ডে বিভক্ত করে দেখিয়েছিলাম :
ক. খ্রীষ্টপূর্ব ৭০,০০০ থেকে ৬০ খ্রীষ্টাব্দ এবং খ. খ্রীষ্টাব্দ ৬০ থেকে বর্তমান৷ এরই মধ্যে আমরা ‘ক. খ্রীষ্টপূর্ব ৭০,০০০ থেকে ৬০ খ্রীষ্টাব্দ’- এই অংশটি জেনে নিয়েছি৷

আজ আমরা জেনে নেবো- “খ. খ্রীষ্টাব্দ ৬০ থেকে বর্তমান” -এই অংশটুকু৷ এ পর্বে এই অংশটি হতে যে যে সাম্রাজ্যের শাসনামল সম্পর্কে জানবো, সেগুলো হছ্ছে-ধারাবাহিকভাবে-১৭.দাক্ষিনাত্যের সুলতান (১৪৯০-১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দ), ১৮.হোয়সলা সাম্রাজ্য (১০৪০-১৩৪৬ খ্রীষ্টাব্দ), ১৯.কাকাতিয়া সাম্রাজ্য (১০৮৩-১৩২৩ খ্রীষ্টাব্দ), ২০.আহমন সাম্রাজ্য ( ১২২৮-১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দ), ২১.বিজয়নগর সাম্রাজ্য (১৩৩৬-১৬৪৬ খ্রীষ্টাব্দ), ২২.মুঘলসাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ), ২৩.মারাঠা সাম্রাজ্য (১৬৭৪-১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ), ২৪.শিখ রাষ্ট্র ( ১৭১৬- ১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দ), ২৫.শিখ সাম্রাজ্য ( ১৭৯৯-১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দ), ২৬.ব্রিটিশ ভারত (১৮৫৮–১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ), ২৭.ভারত ভাগ (উপমহাদেশের বিভাজন) -১৯৪৭–বর্তমান৷
১৭.দাক্ষিনাত্যের সুলতান (১৪৯০-১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দ) :
দক্ষিণ ভারতের ইতিহাস দুই সহস্রাধিক বছর ধরে ঘটমান উক্ত অঞ্চলের একাধিক রাজবংশ ও সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের ইতিহাস। দক্ষিণ ভারত ভূখণ্ডে প্রাগৈতিহাসিক জনবসতির একাধিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের কোনো লিখিত উপাদান না পাওয়া গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে অনুমিত হয় খ্রিষ্টের জন্মের কয়েকশো বছর আগেই এই অঞ্চলে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। মৌর্য সম্রাট অশোক সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে নিজ আধিপত্য বিস্তার করার সময় দাক্ষিণাত্যের একাধিক অঞ্চল জয় করেন। এই সময় থেকেই এই অঞ্চলের লিখিত ইতিহাসের সূত্রপাত। ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে সাতবাহন, চালুক্য, পল্লব, রাষ্ট্রকূট, চের, চোল, পাণ্ড্য, কাকতীয় ও হোয়েসল রাজবংশ দক্ষিণ ভারতে নিজ আধিপত্য বিস্তার করে। এই সকল রাজ্যগুলি সর্বদাই নিজেদের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকত। পরে উত্তর ভারত থেকে মুসলমান বাহিনী দক্ষিণ ভারত আক্রমণ করলে তাদের বিরুদ্ধেও এরা সামরিক অভিযান চালায়। মুসলমান আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়াস্বরূপ উত্থান ঘটে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের। এই সাম্রাজ্য সমগ্র দক্ষিণ ভারতে নিজ অধিকার স্থাপন করতে সক্ষম হয় এবং দাক্ষিণাত্যে মুঘল অভিযানের বিরুদ্ধে প্রধান বাধাস্বরূপ হয়ে দাঁড়ায়। ষোড়শ শতাব্দীতে যখন ইউরোপীয় শক্তিগুলি এই অঞ্চলে পদার্পণ করতে শুরু করে তখন এই নতুন প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রামের ক্ষমতা দক্ষিণের রাজন্যবর্গের মধ্যে আর অবশিষ্ট ছিল না। ফলে ধীরে ধীরে সমগ্র দক্ষিণ ভারত ব্রিটিশদের অধীনস্থ হয়ে পড়ে। ব্রিটিশ সরকার দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলকে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সির অন্তর্ভুক্ত করেন। অবশিষ্ট অঞ্চলগুলি একাধীন ব্রিটিশ-নির্ভরশীল দেশীয় রাজ্যে বিভক্ত থাকে। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পর ভাষার ভিত্তিতে দক্ষিণ ভারত অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক, কেরল ও তামিলনাড়ু রাজ্যে বিভক্ত হয়।
১৮.হোয়সলা সাম্রাজ্য (১০৪০-১৩৪৬ খ্রীষ্টাব্দ) :
হৈসল সাম্রাজ্য ছিল দক্ষিণ ভারতের একটি উল্লেখযোগ্য কন্নড় সাম্রাজ্য। খ্রখ্রিস্টীয় ১০ম থেকে ১৪শ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে অধুনা ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের অধিকাংশ অঞ্চল এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। প্রথম দিকে হৈসল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল বেলুরু শহর। পরে তা হৈলেবিডু শহরে স্থানান্তরিত হয়।হৈসল রাজাদের আদি নিবাস ছিল পশ্চিমঘাট পর্বতমালার মালেনাড়ু কর্ণাটক উচ্চভূমি অঞ্চলে। খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে তৎকালীন শাসক পশ্চিম চালুক্য ও কলচুরি রাজ্যের মধ্যে ঘনীভূত যুদ্ধ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে হৈসলরা অধুনা কর্ণাটক রাজ্যের ভূখণ্ড এবং অধুনা তামিলনাড়ু রাজ্যের কাবেরী নদীর উত্তর তীরস্থ উর্বর অঞ্চলগুলি অধিকার করেন। খ্রিস্টীয় ১৩শ শতাব্দীর মধ্যেই তারা অধুনা কর্ণাটকের অধিকাংশ ভূখণ্ড, অধুনা তামিলনাড়ুর সামান্য অংশ এবং দাক্ষিণাত্যের অধুনা অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানা রাজ্যের পশ্চিম দিকের কিছু কিছু অঞ্চল নিজেদের অধীনে আনতে সমর্থ হন। দক্ষিণ ভারতের শিল্পকলা, স্থাপত্য ও ধর্মের বিকাশের ক্ষেত্রে হৈসল যুগ বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আজ এই সাম্রাজ্যকে বিশেষভাবে স্মরণ করা হয় এর মন্দির স্থাপত্যের জন্য।
এই যুগে নির্মিত একশোরও বেশি মন্দির এখনও কর্ণাটকের বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে রয়েছে। যে সব বহুল পরিচিত মন্দির হৈসল সাম্রাজ্যের “বিস্ময়কর স্থাপত্য সৌকর্য প্রদর্শন” করে, সেগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বেলু্রুর চেন্নকেশব মন্দির, হৈলেবিডুর হৈসলেশ্বর মন্দির ও সোমনাথপুরার চেন্নকেশব মন্দির। হৈসল শাসকেরা চারুকলার পৃষ্ঠপোষকতা করতেন এবং কন্নড় ও সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে উৎসাহ দান করতেন। (চলবে) ৷

ফারহানা আকতার

তথ্যসূত্র: বুকস, ইন্টারনেট

লেখক: ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক, কলামিস্ট এবং গবেষক ৷

লেখকের অন্যান্য বই

বাংলাদেশ সময়: ১:০৪:০৪   ৭৫৫ বার পঠিত