সোমবার, ৯ নভেম্বর ২০২০
ফারহানা আকতার এর কলাম – “নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-৭”
Home Page » সাহিত্য » ফারহানা আকতার এর কলাম – “নতুন প্রজণ্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব-৭”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির সবচেয়ে গৌরবময় ঘটনা। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়েই আমরা লাভ করেছি ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি স্বাধীন দেশ, নিজস্ব পতাকা। ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ বাংলার ছাত্র-যুবক, কৃষক-শ্রমিকসহ সর্বস্তরের জনগণ বর্বর হানাদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। তারই পরিণতিতে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় চূড়ান্ত বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে খোদিত হয় একটা নাম-‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ’।
আমাকে আবারো অত্যন্ত পরিস্কারভাবে আমার পাঠকদের জানাতে হছ্ছে যে, মূলতঃ “নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ” আমার এই ধরাবাহিক রচনা বা কলামের মূল উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের এবং সুশীল সমাজের একজন সুনাগরিক হিসেবে (যদিও মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে আমার জন্ম) বাংলাদেশে আমার পরবর্তী প্রজন্মের ও বহিরবিশ্বের সাধারণ পাঠকের কাছে এই উপমহাদেশের ইতিহাসসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি পরিস্কারভাবে তুলে ধরা এবং আমার এই কলামটিকে রাজনৈতিকভাবে বি্শ্লেষন করা মোটেই উচিত হবেনা (উল্লেখ্য, এখানে ভারতবর্ষের অর্থাৎ এ উপমহাদেশের ইতিহাস টি আলোচিত হয়েছে মূলতঃ বাঙ্গালী জাতির পূ্র্বপুরষদের ইতিহাসটুকু জেনে নেয়ার জন্য) ৷ আমি মনে করি, “একটি জাতি বা রাষ্ট্র –এর জন্মের ইতিহাস একটিই হবে, দুটি কিংবা তিনটি কিংবা চারটি হবেনা অর্থাৎ একটি জাতি বা রাষ্ট্র –এর ইতিহাস তো সাধারনতঃ একটিই হয়ে থাকে কিন্তু জন্মের আমাদের দেখবার বিষয় হছ্ছে, সেই ইতিহাসকে কে কিভাবে লিখছে , দেখছে এবং কে কিভাবে গ্রহন করছে ৷ তবে বাঙ্গালী জাতি ও বাংলাদেশের ইতিহাসটি যে যেভাবে লিখুক বা বর্ননা করুক না কেন, একজন সচেতন সুনাগরিক ও পাঠক হিসেবে আমাদের উচিত হবে-এই একই বিষয়ের উপর পাঁচ /দশ জন লেখকের বই সংগ্রহ করে মূল ইতিহাসটি জেনে নেয়া ৷ এভাবে পড়লে আপনি অত্যন্ত সচেতনভাবে দেখতে পাবেন যে, একই ইতিহাস একেকজন একেকভাবে লিখেছে অর্থাৎ কেউ ১৯৪৭ এর ঘটনাকে , কেউ ১৯৫২কে, কেউ ১৯৬৯-এর উপর জোড় দিয়ে আবার কেউ বা তখন পূর্ব-পাকিস্হানের রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা লিখতে গিয়ে কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো মুসলীম লীগ ,কখনো কমিউনিস্ট পার্টি কখনোবা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের ভূমিকাকে জোড় দিয়ে লিখছেন৷ আবার কেউ বা শুধুই লিখছে তখনকার সময়ের রাজনৈতিক দলগুলোর ইতিহাস ও উৎপত্তি নিয়ে৷ তবে যে যেভাবেই ‘বাঙ্গালী জাতি’-র ইতিহাস ও ‘বাংলাদেশ’ সৃষ্টির ইতিহাস তথা ‘ বাংলদেশের মুক্তিযু্দ্ধ’ নিয়ে লেখুক না কেন, এ বিষয়ে মূল বক্তব্য কিংবা সামারি কিন্তু হবে একটাই অর্থাৎ এক কথায় যা ঘটেছিল তাই, যা ঘটেনি তা কিন্তু নয় ”৷
ধারাবাহিকভাবে, এবারে আমরা মূল আলোচনায় ফিরে আসি-‘নতুন প্রজন্মের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – পর্ব- ২’-এ আমরা এই উপমহাদেশের ইতিহাসকে নিমোক্ত দুটো খণ্ডে বিভক্ত করে দেখিয়েছিলাম :
ক. খ্রীষ্টপূর্ব ৭০,০০০ থেকে ৬০ খ্রীষ্টাব্দ এবং খ. খ্রীষ্টাব্দ ৬০ থেকে বর্তমান ৷
এরই মধ্যে আমরা “ক. খ্রীষ্টপূর্ব ৭০,০০০ থেকে ৬০ খ্রীষ্টাব্দ”– এই অংশটি জেনে নিয়েছি ৷ আজ আমরা জেনে নেবো- “খ. খ্রীষ্টাব্দ ৬০ থেকে বর্তমান” -এই অংশটুকু৷ এ পর্বে এই অংশটি হতে যে যে সাম্রাজ্যের শাসনামল সম্পর্কে জানবো ,সেগুলো হছ্ছে-ধারাবাহিকভাবে-১২.কুষাণ সাম্রাজ্য(৬০-২৪০ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৩.গুপ্ত সাম্রাজ্য (২৮০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৪.পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৫. দিল্লি সুলতানি (১২০৬-১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ) ,১৬. সুলতানী আমল (১২০৬-১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দ), ১৭. দাক্ষিনাত্যের সুলতান (১৪৯০-১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দ) , ১৮.হোয়সলা সাম্রাজ্য (১০৪০-১৩৪৬ খ্রীষ্টাব্দ) ,১৯.কাকাতিয়া সাম্রাজ্য (১০৮৩-১৩২৩ খ্রীষ্টাব্দ) ,২০.আহমন সাম্রাজ্য ( ১২২৮-১৮২৬ খ্রীষ্টাব্দ) ,২১.বিজয়নগর সাম্রাজ্য (১৩৩৬-১৬৪৬ খ্রীষ্টাব্দ) , ২২.মুঘল সাম্রাজ্য (১৫২৬-১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দ) ,২৩.মারাঠা সাম্রাজ্য (১৬৭৪-১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দ) ,২৪.শিখ রাষ্ট্র ( ১৭১৬-১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দ) ,২৫.শিখ সাম্রাজ্য ( ১৭৯৯-১৮৪৯ খ্রীষ্টাব্দ) , ২৬.ব্রিটিশ ভারত (১৮৫৮–১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দ) ,২৭.ভারত ভাগ (উপমহাদেশের বিভাজন) -১৯৪৭– বর্তমান ৷
১২.কুষাণ সাম্রাজ্য(৬০-২৪০ খ্রীষ্টাব্দ) :
খ্রিষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দীর প্রথমার্ধে শুংনু (চৈনিক: 匈奴, ফিনিন: Xiōngnu শুংনু) নামে এক উপজাতি তাদের প্রতিবেশী ইউয়েচি (চৈনিক: 月支, ফিনিন: Yuèzhī উ্যয়েট্ষ্র্) নামে অপর এক উপজাতিকে হারিয়ে দেয়। দীর্ঘ সংঘর্ষের পর য়ুঝি উপজাতির লোকেরা পশ্চিমদিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। তারা পশ্চিমদিকে সরে ইলি নদীর উপত্যকা পেরিয়ে ইস্সিক কুল হ্রদের (ইংরাজীতে Lake Issyk Kul) দক্ষিণতীর ধরে এগোতে থাকে। তাদের এই স্থান পরিবর্তন শকসহ বেশ কিছু উপজাতিকে তাদের সামনে এগোতে বাধ্য করে। ১৪৫-১২৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যবর্তী কোন সময়ে তারা ব্যাকট্রিয় ও পার্থিয়ায় বসতি স্থাপন করে। এক প্রজন্ম পর তারা সেই জায়গা ত্যাগ করে কাবুল উপত্যকা পেরিয়ে পাঞ্জাব সমভূমিতে প্রবেশ করে। খ্রীষ্টাব্দ শুরুর দিকে য়ুঝি উপজাতির নেতা কিউ-সিউ-কিও (ইংরাজীতে K’iu-tsiu-k’io)) বাকী চার নেতাকে মেরে সমগ্র উপজাতির প্রধান হয়ে বসে। তার নাম থেকেই নাম হয় কিউই-শাং (ইংরাজীতে Kuei-shang), বা কুষাণ।
১৩.গুপ্ত সাম্রাজ্য (২৮০-৫৫০ খ্রীষ্টাব্দ) :
গুপ্ত সাম্রাজ্য (সংস্কৃত: गुप्त राजवंश, Gupta Rājavaṃśa) ছিল একটি প্রাচীন ভারতীয় সাম্রাজ্য। আনুমানিক খ্রিষ্টীয় ৩২০ থেকে ৫৫০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতীয় উপমহাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল জুড়ে এই সাম্রাজ্য প্রসারিত ছিল।মহারাজ শ্রীগুপ্ত ধ্রুপদি সভ্যতা-র আদর্শে এই সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।গুপ্ত শাসকদের ভারতে যে শান্তি ও সমৃদ্ধি স্থাপিত হয়েছিল, তার ফলশ্রুতিতে দেশ বৈজ্ঞানিক ও শিল্পক্ষেত্রে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করতে সক্ষম হয়। গুপ্তযুগকে বলা হয় ভারতের স্বর্ণযুগ। এই যুগ ছিল আবিষ্কার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাস্তুবিদ্যা, শিল্প, ন্যায়শাস্ত্র, সাহিত্য, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ধর্ম ও দর্শনের বিশেষ উৎকর্ষের যুগ; বর্তমান হিন্দু সংস্কৃতি মূলত এই যুগেরই ফসল।গুপ্ত যুুগের আমলে অনেক পণ্ডিত ব্যক্তি যেমন কালিদাস, আর্যভট্ট, বরাহমিহির, বিষ্ণু শর্মা -এর অবির্ভাব হয়েছিলো। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ সম্রাট তার সাম্রাজ্য সীমা দক্ষিণ ভারতেও প্রসার লাভ করে ।
গুপ্ত রাজবংশের শাসকগণ : প্রায় ৩২০ থেকে ৫৫০ অবধি,গুপ্ত বংশের প্রধান শাখা ভারতের গুপ্ত সাম্রাজ্য শ্বাসন করেছিলেন। এই সাম্রাজ্য শ্রীগুপ্ত দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শাসকগণ: শ্রী গুপ্ত, ঘটোৎকচ, প্রথম চন্দ্রগুপ্ত,সমুদ্রগুপ্ত,রামগুপ্ত,দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত,প্রথম কুমারগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত, পুরুগুপ্ত,প্রথম কুমারগুপ্ত দ্বিতীয় ,বুধগুপ্ত,নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য,প্রথম কুমারগুপ্ত তৃতীয়,বিষ্ণুগুপ্ত, বৈনগুপ্ত ও ভানুগুপ্ত ৷
১৪.পাল সাম্রাজ্য (৭৫০-১১৭৪ খ্রীষ্টাব্দ) : পাল সাম্রাজ্য ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের পরবর্তী ধ্রুপদি যুগের একটি সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্যের উৎসস্থল ছিল বাংলা অঞ্চল। পাল সাম্রাজ্যের নামকরণ করা হয় এই সাম্রাজ্যের শাসক রাজবংশের নামানুসারে। পাল সম্রাটদের নামের শেষে ‘পাল’
অনুসর্গটি যুক্ত ছিল। প্রাচীন প্রাকৃত ভাষায় এই শব্দটির অর্থ ছিল ‘রক্ষাকর্তা’। পাল সম্রাটেরা বৌদ্ধধর্মের মহাযান ও তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের অনুগামী ছিলেন। ৭৫০ খ্রিষ্টাব্দে গৌড়ের সম্রাট পদে গোপালের নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে এই সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটে।অধুনা বাংলা ও বিহার ভূখণ্ড ছিল পাল সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র। এই সাম্রাজ্যের প্রধান শহরগুলি ছিল পাটলীপুত্র, বিক্রমপুর, রামাবতী (বরেন্দ্র), মুঙ্গের, তাম্রলিপ্ত ও জগদ্দল।পাল সম্রাটরা ছিলেন প্রাজ্ঞ কূটনীতিবিদ ও যুদ্ধজয়ী। তাদের
সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্য ছিল একটি বৃহৎ যুদ্ধহস্তী বাহিনী। তাদের নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষামূলক ভূমিকা পালন করত। পাল সম্রাটরা ছিলেন ধ্রুপদি ভারতীয় দর্শন, সাহিত্য, চিত্রকলা ও ভাস্কর্যশিল্পের বিশিষ্ট পৃষ্ঠপোষক। তারা একাধিক বৃহদায়তন মন্দির ও মঠ নির্মাণ করিয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল সোমপুর মহাবিহার। তারা নালন্দা ও বিক্রমশিলা মহাবিহারের পৃষ্ঠপোষকতাও করতেন। তাদের রাজত্বকালেই প্রোটো-বাংলা ভাষার বিকাশ ঘটে।
শ্রীবিজয় সাম্রাজ্য, তিব্বতি সাম্রাজ্য ও আরব আব্বাসীয় খিলাফতের সঙ্গে পাল সাম্রাজ্যের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। বাংলা ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পাল যুগেই বাংলায় প্রথম ইসলামের আবির্ভাব ঘটে। পাল প্রত্নস্থলগুলিতে আব্বাসিদ মুদ্রা পাওয়া গিয়েছে। তাছাড়া আরব ইতিহাসবিদদের রচিত নথিপথেও পাল সাম্রাজ্যের সঙ্গে তাদের দেশের বাণিজ্যিক ও বৌদ্ধিক যোগাযোগের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ এই যুগেই ভারতীয় সভ্যতার গাণিতিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞান-সংক্রান্ত কীর্তিগুলির সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল।
খ্রিস্টীয় ৯ম শতাব্দীর প্রথম ভাগে পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি লাভ করেছিল। এই সময় পাল সাম্রাজ্যই ছিল ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তরাঞ্চলের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। সেই যুগে এই সাম্রাজ্য অধুনা পূর্ব-পাকিস্তান, উত্তর ও উত্তরপূর্ব ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভূখণ্ডে প্রসারিত হয়।পাল সাম্রাজ্য সর্বাধিক সমৃদ্ধি ঘটেছিল সম্রাট ধর্মপাল ও দেবপালের রাজত্বকালে। তিব্বতে অতীশের মাধ্যমে পাল সাম্রাজ্য প্রভূত সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তার করেছিল। পাল সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক
প্রভাব পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়াতেও। উত্তর ভারতে পাল শাসন ছিল ক্ষণস্থায়ী। কারণ কনৌজের আধিপত্য অর্জনের জন্য গুর্জর-প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূটদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে পাল সম্রাটরা পরাজিত হন। কিছুকালের জন্য পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল। তারপর সম্রাট প্রথম মহীপাল বাংলা ও বিহার অঞ্চলে দক্ষিণ ভারতীয় চোল অনুপ্রবেশ প্রতিহত করেন। সম্রাট রামপাল ছিলেন সর্বশেষ শক্তিশালী পাল সম্রাট। তিনি কামরূপ ও কলিঙ্গে আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। খ্রিস্টীয় ১১শ শতাব্দীতে পাল সাম্রাজ্যের নানা অঞ্চলে বিদ্রোহ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এর ফলে সাম্রাজ্যের শক্তি অনেকটাই হ্রাস প্রাপ্ত হয়। খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে হিন্দু সেন রাজবংশের পুনরুত্থানের ফলে পাল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে ৷
১৫.দিল্লি সুলতানি (১২০৬-১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দ) : দিল্লী সালতানাত বলতে মধ্যযুগে ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসনকালকে বুঝানো হয়। ১২০৬ থেকে ১৫২৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ভারতে রাজত্বকারী একাধিক মুসলিম রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি দিল্লী সালতানাত নামে অভিহিত। এই সময় বিভিন্ন তুর্কি ও আফগান রাজবংশ দিল্লি শাসন করে। এই রাজ্য ও সাম্রাজ্যগুলি হল: মামলুক সুলতান (১২০৬-৯০), খিলজি রাজবংশ (১২৯০-১৩২০), তুঘলক রাজবংশ (১৩২০-১৪১৩), সৈয়দ রাজবংশ (১৪১৩-৫১) এবং লোদি রাজবংশ (১৪৫১-১৫২৬)। ১৫২৬ সালে দিল্লি সালতানাত উদীয়মান মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিশে যায়।
১৬. সুলতানী আমল (১২০৬-১৫৯৬ খ্রীষ্টাব্দ) :
ভারতের সুলতানী আমলের প্রধান শাসকবৃন্দ হছ্ছেন –
ক. কুতুবউদ্দিন আইবেক (১২০৬-১০ খ্রিস্টাব্দ)– ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দে নিঃসন্তান মুহাম্মদ ঘুরি মৃত্যু হলে গজনির সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে কুতুবউদ্দিন আইবক নিজেকে স্বাধীন সার্বভৌম নরপতি ঘোষণা করেন। ১২০৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘সুলতান’ উপাধি গ্রহণ করেন। তার সিংহাসনারোহণের ফলে দিল্লিতে স্বাধীন সুলতানি শাসনের গোড়াপত্তন হয়।
খ. ইলতুতমিশ (১২১১-১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ)– কুতুবউদ্দিন আইবেকের মৃত্যুর পর ১২১১ খ্রিষ্টাব্দে তার দত্তকপুত্র আরাম শাহ্কে সিংহাসনচ্যুত করে দিল্লির মসনদে বসেন কুতুবউদ্দিনের জামাতা ইলতুতমিশ। প্রথম জীবনে ইলতুতমিস ছিলেন কুতুবউদ্দিনের ক্রীতদাস। পরে তার কর্মদক্ষতা ও বিচক্ষণতায় মুগ্ধ হয়ে কুতুবউদ্দিন তার সঙ্গে নিজ কন্যার বিবাহ দান করে তাকে বাদাউনের শাসনকর্তা নিয়োগ করেন। সিংহাসনে আরোহণের পর ইলতুতমিসকে একাধিক বৈদেশিক আক্রমণ ও আঞ্চলিক বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু ইলতুতমিস কঠোর হাতে সমস্ত বিদ্রোহ দমন করেন ও বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করেন। ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে বাগদাদের খলিফা তাকে ‘সুলতান-ই-আজম’ উপাধি দিলে দিল্লি সালতানাতের গৌরব বৃদ্ধি পায় এবং এই সালতানাত স্বতন্ত্র ও সার্বভৌম অস্তিত্ব মুসলিম জগতে স্বীকৃত হয়।
গ. রাজিয়া সুলতানা (১২০৫ – ১২৪০) – সুলতান ইলতুতমিশের কন্যা ও ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক। তিনি একাধারে একজন ভাল প্রসাশক ও সেনাপতি ছিলেন; তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে একজন দক্ষ সৈন্য হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। সুলতান ইলতুতমিশের সবথেকে যোগ্য পুত্র সুলতানের জীবদ্দশায় মৃত্যু বরণ করলে সুলতান তার কন্যা রাজিয়া সুলতানাকে দিল্লির শাসক হিসেবে মনোনিত করে যান। যখনই ইলতুতমিশের রাজধানী ছাড়তে হত, তিনি তখন তার কন্যা রাজিয়া সুলতানাকে শাসনভার বুঝিয়ে দেন৷ রাজিয়া সুলতানা সাম্রাজ্যে শান্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। শাসনকার্য দৃঢ়ভাবে পালন করার জন্য তিনি নারীত্বের আবরণ পরিত্যাগ করে, পুরুষের পোশাক গ্রহণ করেন। ১২৩৯ সালে লাহোরের তুর্কি গভর্নর বিদ্রোহ করে। রাজিয়া তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে, গভর্নর প্রথমে পালিয়ে যান ও পরে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
ঘ. সালতানাতের পতন : কুতুবউদ্দীন আইবক দিল্লির সালতানাতের গোড়াপত্তন করেছিলেন। অতঃপর তুর্ক-আফগান সুলতানরা দিল্লিতে প্রায় তিনশ বছর রাজত্ব করেন। এ দীর্ঘ রাজত্বকালে অনেক সুলতানের রদবদল ঘটেছে; সাম্রাজ্যে নানা বিদ্রোহ-বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সুলতানী আমলের শেষদিকে সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। সালতানাতের শেষ সুলতান ছিলেন ইবরাহীম লোদী। পানিপথের প্রথম যুদ্ধে সুলতান ইবরাহীম লোদীর পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে দিল্লি সালতানাতের অবসান ঘটে। দিল্লি সালতানাতে যে কয়েকজন যোগ্য, শক্তিমান ও প্রতিভাশালী সুলতান ছিলেন, দুর্ভাগ্যবশত তারা কেউই উপযুক্ত উত্তরাধিকারী রেখে যেতে পারেননি। সুলতান শামসউদ্দীন ইলতুিমশ একজন যোগ্য শাসক ছিলেন। তিনি রাজ্যে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। তার মৃত্যুর পর রুকুনউদ্দীন ফিরুজ, রাজিয়া, মুইযউদ্দীন বাহরাম, আলাউদ্দীন মাসুদ প্রমুখ দুর্বল উত্তরাধিকারীরা পর পর সিংহাসন লাভ করেন, কি্ন্তু তাদের সময়ে রাজ্যের সর্বত্র দুর্যোগ ও গোলযোগ দেখা দেয় এবং সুলতানী আমলের অবসান ঘটে৷ (চলবে) ৷
তথ্যসূত্র: বুকস, ইন্টারনেট
লেখক: ফারহানা আকতার, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক, কলামিস্ট এবং গবেষক ৷
বাংলাদেশ সময়: ১০:৩২:৪৭ ৮৫৫ বার পঠিত