মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০

পাখির নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ-মোজাফফর বাবু

Home Page » সাহিত্য » পাখির নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদ-মোজাফফর বাবু
মঙ্গলবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০



মোজাফ্ফার বাবু

শ্বেত শ্বেত মেঘের মিছিল, গগণে বেশ কারুকার্য করেছে ,কখনো কালো আবছায়ার মাঝে সাদা , কোথাও আবার সাদার মাঝে নীল। হঠাৎ আবহাওয়া তার মেজাজি রুপ ধারণ করল । এটা যেন তার ঋতুর প্রকৃতিগত বৈশিষ্ট্য ।

তাপমাত্রা বেড়ে ৩৫ ডিগ্রী হয়ে গেল । শরতের সাদা মেঘের ভেলা নিকষ কালো আঁধারে হঠাৎ করে অন্ধকার অমানিশায় একাকার হয়ে গেল ।
তার সাথে যোগ হলো ঝড়ো হাওয়া ও এক পশলা বৃষ্টি , বৃষ্টি স্নাত কাশফুল ফিরে পেল নতুন বর্নিল সজীবতা তারা যেন সকালে দিগন্ত মাঠে পেয়েছে নতুন জীবন ।
রমেল সাহেব ভেবেছিল এই বৃষ্টিতে গরমের মেজাজ থেকে প্রকৃতি যেন শীতল পরিবেশ খুঁজে পাবে ।
বরং উল্টোই হল।ভ্যাপসা গরম যেন হাত পা ছড়িয়ে বসল। মানবকুলে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা ।
একে তো রমেল সাহেবের ডায়বেটিস , প্রেসার। তার উপরে এসির যন্ত্রনা তো আছেই । আজকে কমপ্রেশার খারাপ , কালকে গ্যাস ভরতে হবে। বার বার সরাইখানায় নিতে হয় । রমেল সাহেব তাই রাগ করে আর এসি ঠিক করেন না এই নিয়ে পরিবারের লোকজন বেশ নাখোশ ।
রাতের তার ঘুমই আসে না । অনেক সময় দেখা যায় ঘুম আসে মাঝ রাতে । তাই তার সহধর্মিনী ও আদরিনী কন্যারা তাকে খুব সকালে ডাকে না ।
আর ডাক্তার সাহেব জানিয়েছেন , একটি মানুষ সুস্থ থাকার জন্য সুষম খাদ্য যেমন প্রয়োজনীয় ঠিক তেমনি ৭-৮ ঘন্টার ঘুম খুবই জরুরী।
অনেকের বেড রুমে গেলে আপনাআপনি ঘুম চলে আসে । রমেল সাহেবের আসে না । এপাশ ওপাশ করে, অনেক সময় পায়ে ঠান্ডা পানি ঢালে তবুও তার ঘুম আসতে ফজরের আযান ও মোরগে ডাক দেয়।
ঘুম যেন এক সোনার হরিণ, সে যেন থাকে সাত সমুদ্র তের নদী ওপারে , ঘোড়ায় তোলাজল ।
জীব বৈচিত্র্য ও প্রানীর প্রতি সে খুবই আগ্রহী।
সে পাখপাখালির ডাক যেমন ঘুঘুর ঘুঘু ঘুঘু ডাক, পায়রার বাকবাকুম ডাক সে খুব মনযোগ সহকারে শুনে। দূর থেকে দূরে গিরিবাজ পায়রার নীলিমায় ডিগবাজি মারে, সে মনযোগ সহকারে দেখে ।
কিন্তু তার চিৎকার চেচামেচী একদম পছন্দ না ,এ সব বিষয় নিয়ে দাম্পত্য জীবনে মতানৈক্য দেখা যায় । দক্ষিণ পাশের বেডরুমের বেলকুনিতে সন্ধ্যা ৭ টা থেকে সকাল ৭ টা পর্যন্ত যাওয়া নিষেধ ।
এটা যেন পুরো কারফিউ এলাকা , বাচ্চারা যেতে চাইলেও যেতে দেয় না । কারন তা উন্মুক্ত পাখিদের অভয়াঅরন্য ।
শিশির ভেজা ভোরে পাখপাখালিরা কিচিরমিচির করে , মনের ভাব ব্যক্ত করে শিস দিয়ে ক্ষেতখামার ও তপোবনের দিকে ছুটে চলে যায়। আবার গোধুলী লগ্নে সন্ধ্যার সময় ফিরে আসে ।
আর সেদিন রমেল সাহেব এর বেশ রাতেই ঘুম এসেছে । এদিকে সুগার টা বার বার আপ ডাউন করছে । তাই ঘুম টাও নির্দিষ্ট সময়ে আসে না ।
কিন্তু হঠাৎ বেলকুনিতে পাখিদের কি যেন হল । বছরের পর বছর উন্মুক্ত বারান্দায় নিরবিচ্ছিন্ন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে পাখিরা থাকে ,রুটিন মাফিক ভাবে তারা চলাচল করে।
কেন আজ পাখিদের মতিভ্রম হল । থাই জানালার কাঁচে ঠোকর দিল আর জোড়ে জোড়ে হাকডাক শুরু করল।
আবার দশ মিনিট পর একই ভঙ্গিতে হাকডাক শুরু করল।
রমেল ডাক শুনে হচকিয়ে উঠে পড়ল , বেশ কিছুক্ষনের হাকডাকে রমেল সাহেবের মনে হল,
তারা যেন স্ব স্ব ভাষায় নিয়মতান্ত্রিক ভাবে প্রতিবাদ করছে ঠোকর দিয়ে , তার সাথে চিৎকারও করছে ।
রমেল সাহেব ঘুম থেকে উঠে গেলেন এবং পাখিগুলো রমেল সাহেব কে দেখে , ক্ষেতখামার , তপবন ও শস্য ভান্ডারের দিকে ছুটে গেল ।
নিশ্চয়ই কোন অভিনপ্রিত ঘটনা ঘটেছে ,কোনদিন তো প্রতিবাদ স্বরূপ এমন আচরণ করেনি।
রমেল সাহেব চড়ুই এই প্রতিবাদ করার কারন পর্যবেক্ষন করা শুরু করলেন। এবং সমস্যাটি খুজে বের করার জন্য করিডোর , বারান্দা ও সমস্ত ঘরে ঘুরে ঘুরে দেখলেন ।বেশ কিছুক্ষন পর পায়চারি করে, চড়ুইদের প্রতিবাদ যে ন্যায়সঙ্গত ছিল তার হদিস পেলেন ।
তিনি দেখলেন বহু কষ্ট করে বিভিন্ন ক্ষেতখামার থেকে শন এনে যে শৈল্পিক নীড় বানিয়েছিল নির্মানাধীন তূতীয় তলার ওয়াশরুমে, সে ঘরের কিছু অংশ বাথরুমের সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে ।
ঐ ওয়াশরুমের থাই কাঁচ ছিল না।তাই পাখিরা নীড় বানিয়েছিল । থাই ওস্তাগার এসে ভেন্টিলেটরে চড়ুই পাখি সুনিপুন যে নীড় বানিয়েছিল তা ভেঙ্গে নতুন থাই কাঁচ লাগিয়েছিল।
রমেল সাহেব দেখে বিস্মিত হল তার সহধর্মিনী ও আদরিনীদের প্রতি যে কেন তাকে বিষয়টা বলা হয়নি, চড়ুই পাখির বাসা ভেঙ্গেছে ?
তারা ও ঠিক কাজ করেছে , এটা তাদের নিয়মতান্ত্রিক চলমান প্রতিবাদ । আর এদিকে পরিবারের প্রতি নাখোশ হলেন ।
কত পাখি শিকারীরা পাখি শিকার করে বিক্রি করে, আবার কত দুরন্ত বালক পাখির বাসা ভেঙ্গে পাখিকে ধরে নিয়ে আসে, আবার পাখির অগোচরে নীড় থেকে বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যায় আবার গুলতি দিয়ে নির্বিচারে পাখি হত্যা করে ।
এই হত্যার মধ্যে পৈশাচিক উল্লাস করে । আবার দেখা যায় সখাকে ধরে নিয়ে যায় সখী বনে আহাজারি করে।আমাদের যেমন বাচ্চাদের প্রতি মায়া আছে, তাদের ও কমতি নাই । হয়ত প্রতিবাদের ভাষা ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।
যে কাক ও বানর তাদের গোত্রে কেউ যদি আহত নিহত হয়, তার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও শোক জ্ঞাপন করে ।
কিছুদিন আগে আরিচ রোডে রাস্তা পারাপারের সময় দুর্ঘটনায় এক বানর ক্ষতবিক্ষত হয়।
সে যখন মৃত্যুর সাথে যখন পাঞ্জা লড়ছিল,তখিন তার পরম আদরের ধন বাচ্চাটাকে ওই বিমর্ষ অবস্থাতেও দুধ খাওয়াচ্ছিল যা পরে ফেসবুকে আলোড়ন তুলেছিল ।
বর্তমান জীব বিচিত্রের উপর মানবকুলের অসহনীয় আচরন অথবা দূর ব্যবহার এর জন্য প্রকৃতির উপর বিরুপ প্রতিক্রিয়া ঘটেছে ।
এজন্য এখন আর তপোবন,উপবনে ডোরা কাটা কাঠবিড়াল, কাঠঠোকরার সেই ঠক ঠক মধুর শুব্দ, শেয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক আর শোনা যায় না ।
অবিশ্বস্য ভাবে লুপ্ত জীববৈচিত্র । প্রায় দশ লক্ষ উদ্ভিত ও প্রাণী প্রজাতি এই ঝুঁকিতে আছে ।জাতিসংঘ কনভেনশন অন বায়োলজীক্যল ডাইভাইসিটি (সিবিটি) গত মঙ্গলবার ১৫।৯।২০২০ ইং তারিখে এই তথ্য প্রকাশ করেন ।
ইয়াহু নিউজের খবরে বলা হয় । বৈচিত্র্যময় এ সব কীট , পাখি , স্তন্যপায়ী প্রাণী,অতি ক্ষুদ্রাকৃত জীব ও তৃনগুলো বাস্তুতন্ত্রের জন্যই প্রয়োজন নয় পচন থেকে পরাগায়ন
ওষুধ তৈরী কৃষির জন্য প্রয়োজন । মোদ্দা কথা মানুষের নিরাপত্তাসমৃদ্ধ জীবন যাপন রক্ষা করার জন্য জীব বিচিত্রের প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া জরুরী ।
ইট পাথর সিমেন্ট এর শহরে যান্ত্রিক বস্তু হয়ে আমরা প্রকৃতির অস্তিত্ব কে অস্বীকার করতে চলেছি । তাই রমেল সাহেব প্রানী কুল যে আমাদের অংশীদার এই ভেবে এদিক ঐদিক থেকে শন এনে,
দখিনা বারান্দায় যেখান পাখিদের অভয় অরন্য সন্ধ্যার সাজো বেলা থেকে সকাল অবদি কেউ যেতে পারেনা , সেখানে নতুন একটা বাসা বানিয়েছেন।
সেটা সুনিপুন না হলেও তিনি সেখানে পাখিদের অস্তিত্ব কে প্রাধান্য দিয়েছেন। নীড় তৈরি করে সে যেন , কিছুটা তার ঋণ শোধ করতে পেরেছে এটা তার বাসনা বা অভিলাষ ।
পাখিরা ওই বাসাটাকে স্বাচ্ছন্দে গ্রহন করে ওই বাসাটাকেই সুনিপুন কারুকার্যে ফুটিয়ে তুলেছে ।
সাঝের বেলায় নীড়ে ফিরে কিচিরমিচির এর মাধ্যমে তারা নিজেদের মধ্যে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে,আর রমেল সাহেব কে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
আর নিশ্ছিদ্র নিরাপদ করিডোর যেখানে সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত যাওয়া নিষেধ , সেখানে দূর থেকে পাখিদের আনন্দ উল্লাস দেখে বেদনা বিধুর মুহুর্তে তার চোখের কোনায় আনন্দের অশ্রু জমে উঠল।
রমেল সাহেব মাঝে মাঝে ভাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আম্পান,সিডর থেকে পাখপাখালি জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য তপোবন, উপবন, বাড়ির ছাদে বা খোলামাঠে যদি উন্মুক্ত আশ্রয় কেন্দ্র তৈরী করা যায় , তাহলে প্রানীকুল প্রাকৃতিক দুর্যোগে অকালে প্রাণ হারাবে না।
এরা আমাদের প্রকৃতির অংশীদার। চৈত্রের তাপদাহে বাড়ির ছাদে বা বেলকুনির পাত্রে পানি রাখলে এরাও তেষ্টা নিবারনের সুযোগ পাবে।
#সত্য_ঘটনা_অবলম্বনে

বাংলাদেশ সময়: ১৭:৪৯:৩৪   ৮৮৮ বার পঠিত   #  #  #