শনিবার, ১১ জুলাই ২০২০

‘টাকা ছড়িয়ে’ পাপুল হলেন সাংসদ

Home Page » এক্সক্লুসিভ » ‘টাকা ছড়িয়ে’ পাপুল হলেন সাংসদ
শনিবার, ১১ জুলাই ২০২০



ফাইল ছবি-কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল        স্বপন চক্রবর্তী,বঙ্গ-নিউজ:  সাধারণ শ্রমিক হিসাবে কুয়েত গিয়ে বিশাল সাম্রাজ্য গড়া পাপুল এখন সেখানকার মারাফি কুয়েতিয়া কোম্পানির অন্যতম মালিক। প্রবাসী উদ্যোক্তাদের প্রতিষ্ঠিত এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকেও তার বড় অঙ্কের শেয়ার রয়েছে। পরে স্ত্রী সেলিনা ইসলামকেও  সংরক্ষিত আসনের এমপি বানিয়েছেন পাপুল, যিনি অর্থ ও মানব পাচারের অভিযোগে এখন কুয়েতের কারাগারে বন্দি।  লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের মানুষ ২০১৬ সালের আতাকে চিনতও না, কিন্তু সেই কাজী শহিদ  ইসলাম পাপুলই দুই বছরের মাথায় ‘টাকা ছড়িয়ে’ স্থানীয় আওগে য়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ভোট করে বাংলাদেশের  আইনপ্রণেতা বনে গেছেন।

জুনের শুরুতে কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সেখানে পাপুল ও তার কোম্পানির ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে কুয়েত কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশেও তার বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ।

২০১৮ সালের নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনে (রায়পুর-লক্ষ্মীপুর সদরের আংশিক) স্বতন্ত্র প্রার্থী কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলকে সমর্থন দেওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের নেতারা এখন কৌশলগত কারণের কথা বলছেন। তবে তার হঠাৎ করে সাংসদ হয়ে যাওয়ার পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকারও ভূমিকা ছিল, স্থানীয় নেতাদের কথায় তা স্পষ্ট।

রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের অনেকেই বলেন, ২০১৬ সালের কোনো এক সময় পাপুল তার গ্রামের বাড়ির সামনে নিজের মায়ের নামে একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান করার উদ্যোগ নেন। তার আগে পাপুলকে কেহই চিনতেন না।

“এরপর থেকে উপজেলা আওয়ামী লীগসহ সকল সহযোগী সংগঠনের দলীয় অনুষ্ঠানগুলোতে প্রচুর অর্থ দিয়েছেন তিনি। প্রত্যেকটি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় করে দিয়েছেন, সেই ভাড়াও তিনি দিয়ে যাচ্ছেন।”

জনৈক জামসেদ জানান, কুয়েত আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হিসেবে পরিচয় দেওয়া পাপুল ২০১৭ সালে দেশে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক সদস্য পদের ফরম পূরণ করেন। এমপি হওয়ার পর ২০১৯ সালে রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর সদস্য পদ পান। নিজের পাশাপাশি স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ও মেয়েকে যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় সদস্য করেন।

এর আগে বা পরে আওয়ামী লীগের আর কোনো পদে পাপুল ছিলেন না। তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম ছিলেন কুমিল্লা উত্তর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি। তবে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য সেই পদ থেকে তাকে সরতে হয়।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ২০১৮ সালের নির্বাচনে লক্ষ্মীপুর-২ আসনটি তাদের মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয়। আর জাতীয় পার্টি মনোনয়ন দেয় তাদের চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা গতবারের এমপি মোহাম্মদ নোমানকে।

এদিকে শহিদ ইসলাম পাপুল দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন স্বতন্ত্র হিসেবে। নির্বাচনের আগে হঠাৎ জাতীয় পার্টির নোমান সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিলে পরিস্থিতি বদলে যায়। পরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা পাপুলকে সমর্থন দেন এবং তিনি এমপি হয়ে যান।

রাজনীতিতে নতুন মুখ পাপুলের আড়াই লাখ ভোটের বিপরীতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির আবুল খায়ের ভূঁইয়া পান ২৮ হাজার ভোটের সামান্য বেশি।
সংসদে দলীয় এমপির অনুপাতে সংরক্ষিত ৫০টি আসন ভাগাভাগির পর পাপুলসহ স্বতন্ত্র চার এমপির ভাগেও একটি আসন জোটে। সেই সংরক্ষিত আসনে পাপুল এমপি বানিয়ে আনেন তার স্ত্রী সেলিনা ইসলামকে।

কী ঘটেছিল নির্বাচনের আগে, যে রাজনীতিতে অচেনা পাপুলকে সমর্থন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আওয়ামী লীগ?

রায়পুর পৌর আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কাজী জামসেদ বলেন, “কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক সেলিম মাহমুদ স্বাক্ষরিত একটি চিঠি নিয়ে জেলা আওয়ামী লীগ নেতারা তখন আমাদের রায়পুরে সভা করেন। ওই বর্ধিত সভা থেকেই কেন্দ্রের নির্দেশনায় আমরা পাপুলকে সমর্থন দিই। তবে এখন পাপুল বিপদে পড়ায় অনেকেই তার বিরুদ্ধে কথা বলছে।”

উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মামুনুর রশিদও বলেছেন, জোটের প্রার্থী নিস্ক্রিয় হয়ে যাওয়ায় কেন্দ্রের নির্দেশনাতেই তারা ভোটের মাঠে পাপুলকে সমর্থন দিয়েছিলেন। আর পাপুল ‘উদ্দেশ্য নিয়েই’ আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মকাণ্ডে টাকা খরচ করেছেন।

“তিনি মূলত অরাজনৈতিক লোক, আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে ভেড়ার জন্য প্রচুর টাকা খরচ করেছেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের অফিস করে দিয়েছেন। এগুলো ছিল উদ্দেশ্যমূলক, তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়ার পর আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে। শেষ পর্যন্ত দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। পরে কীভাবে জয় পেয়েছেন সেটা সবাই জানেন।”

কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল ‘বিএনপি পরিবারের সন্তান’ দাবি করে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন খোকন বলেন, “তিনি কখনোই আওয়ামী লীগ করতেন না এবং করেননি। টাকা ছড়িয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশেছেন, আমাদের মধ্যে অনেকে তার টাকা নিয়ে প্রোগ্রাম করেছেন।

“তাদের পুরো পরিবার বিএনপি করত। এতদিন পর বাড়ি এসে আওয়ামী লীগে ভেড়া শুরু করেন এবং আমদের দলের সকল কর্মকাণ্ডে যুক্ত হন। আমরা উপজেলা আওয়ামী লীগ তাকে কোনো পদে রাখিনি, এমন কি সে আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের নেতাও না।”

তাহলে পাপুল কীভাবে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সদস্য হয়েছিলেন জানতে চাইলে খোকন বলেন, “কীভাবে সে ওখানে নাম লিখিয়েছে সেটা আমার জানা নেই।”

জাতীয় পার্টির রায়পুর আসনের প্রার্থী নোমানের নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ানোর পেছনে ‘অর্থ লেনদেন ও আওয়ামী লীগের চাপ’ ছিল বলে দাবি করেছেন জেলা ও উপজেলা জাতীয় পার্টির নেতারা।

লক্ষ্মীপুর জেলা জাতীয় পার্টির আহ্বায়ক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক এম আর মাসুদ বলেন, “বিষয়টা দৃশ্যমান না হলেও এটাই সত্য যে টাকার বিনিময়ে তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন। পাপুলের সঙ্গে নেগোশিয়েট করেই এটা করেছিলেন। নোমান সাহেব সব খুলে না বললেও পাপুলের সঙ্গে লেনদেনের বিষয়ে আমাকে হিন্টস দিয়েছিলেন। ভালো অ্যামাউন্ট পেয়েই ছেড়েছিলেন, এমন ইংগিত আমি পেয়েছিলাম।”

এক্ষেত্রে তার কোনো ভূমিকা ছিল কি না- এই প্রশ্নে মাসুদ বলেন, “আমার সঙ্গে নোমান সাহেবের কোনো সময়ই ভালো সম্পর্ক ছিল না। আমি কেন যাব তাকে বসানোর জন্য। আর লেনদেনে আমি ছিলাম না। পার্টির বোঝাপড়ার মাধ্যমে হলে আমরা স্যারের (এইচএম এরশাদ) মাধ্যমেই করতে পারতাম, কারণ তখনও স্যার বেঁচে ছিলেন।”

জাতীয় পার্টির প্রার্থীর বসে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি আনোয়ার হোসেন বাহার বলেন, “এখানে নির্বাচনের আগে বহু রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ হয়েছে, নোমান সাহেবও আমাদের মারপ্যাঁচে ফেলে চেলে গেছেন। পাপুলের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের মাধ্যমে লেনদেন হলেও হতে পারে, আমাদের এ বিষয়ে কেউ কিছু জানায়নি।

“আওয়ামী লীগের অনেকেও চাপ প্রয়োগ করেছেন নোমান সাহেব বসে যাওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগের একটি অংশের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে নোমান সাহেব সরে দাঁড়িয়েছিলেন।“

পাপুল কুয়েতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর সমালোচনার মধ্যে গত ২৮ জুন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা নোমানকে বহিষ্কার করা হয় দল থেকে।  জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নেতারাও এ বিষয়ে চুপ।

আর আওয়ামী লীগ কেন পাপুলকে সমর্থন দিয়েছিল, সেই প্রশ্নে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ বলেছেন দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমামের ‘সিদ্ধান্তের’ কথা।

২০১৮ সালের নির্বাচন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক সেলিম বলেন, “যে চিঠিটি ইস্যু হয়েছিল সেটি ছিল নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সিদ্ধান্ত। নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচ টি ইমাম সাহেবের সিদ্ধান্তটাই যথাযথভাবে পদাধিকার বলে আমি চিঠিতে জানিয়েছি।

“রায়পুর থেকে আওয়ামী লীগ ও প্রার্থীর পক্ষের লোকজন সমর্থনের জন্য কো-চেয়ারম্যানের সঙ্গেই যোগাযোগ করেছিল, আমি উনার নির্দেশে চিঠি দিয়েছি। সেই হিসেবেই পাপুলকে দলীয় সমর্থনের ওই চিঠি।”

জাতীয় পার্টির নেতাদের বরাত দিয়ে একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, লক্ষ্মীপুর-২ আসন পাপুলকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নির্বাচনের আগে ঢাকায় এইচ টি ইমামের বাসায় একটি বৈঠকও হয়েছিল।

সেই বৈঠকে আসলে কী হয়েছিল, কেন পরে আওয়ামী লীগ কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে চিঠি দিয়ে পাপুলকে সমর্থন দিতে বলেছিল, সে বিষয়ে কথা বলতে এইচ টি ইমামকে কয়েকবার ফোন করা হলেও তিনি ধরেননি। মোবাইল ফোনে এসএমএস পাঠিয়ে কথা বলতে চাইলেও তিনি সাড়া দেননি।

ফোন ধরেননি আওয়ামী লীগের লক্ষ্মীপুর জেলা কমিটির সভাপতি গোলাম ফারুক পিঙ্কুও। আর সাধারণ সম্পাদক নূরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন বলেছেন, তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে, এখন এ বিষয়ে কথা বলতে পারবেন না।

ওই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, “পাপুল কোনো সময়ই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না। যেহেতু জোট মনোনীত জাতীয় পার্টির প্রার্থী নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছিলেন, সুতরাং আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি পাপুলকে সমর্থন দিয়েছে। পাপুল আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র কিনেছিল, কিন্তু মনোনয়ন পায়নি, তখন সে সতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে ছিল। এর বাইরে আমি কিছু বলতে চাই না।”

আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক সেলিম মাহমুদ বলছেন, পাপুলকে তাদের সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি ছিল কৌশলগত।

“দলীয়ভাবে আসনটি জাতীয় পার্টিকে দেওয়ার পর একমাত্র পাপুল ছাড়া আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে আর কেউ ওই নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন না। কিন্তু নির্বাচনের প্রায় ১৫/১৬ দিন আগে জাতীয় পার্টির প্রার্থী নোমান স্বতন্ত্র প্রার্থী পাপুলকে সমর্থন করে নির্বাচনের মাঠ ছেড়ে দেন। তার নেতাকর্মীদেরও নির্দেশ দেন পাপুলকে সমর্থন করার জন্য।

“এই প্রেক্ষাপটে লক্ষ্মীপুরের বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে অবহিত করেন, ওই আসনে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিএনপি প্রার্থী খুব সহজেই এ আসনে জয়ী হয়ে যাবে।… আর সে সময় নতুন করে প্রার্থী দেওয়ার সুযোগ সেই। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিএনপির প্রার্থীকে হারানোর জন্য স্থানীয় আওয়ামী লীগের পক্ষে পাপুলকে সমর্থন দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।”

স্থানীয় নেতাদের ওই বক্তব্য কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের কাছে ‘অত্যন্ত যৌক্তিক ও গ্রহণযোগ্য’ মনে হয়েছিল বলেই পাপুলের পক্ষে কাজ করতে স্থানীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল বলে সেলিম মাহমুদের ভাষ্য।

বাংলাদেশ সময়: ১২:০৭:১৯   ৫৫০ বার পঠিত   #  #  #  #