শনিবার, ৪ জুলাই ২০২০

ভাবী-মা- সাঈফ আলম

Home Page » সাহিত্য » ভাবী-মা- সাঈফ আলম
শনিবার, ৪ জুলাই ২০২০



ফাইল ছবি

ভাবী-মা
-সাঈফ আলম
(৩০ জুন ২০১৯, চট্টগ্রাম)

জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি সময়। শীত প্রায় চলে গেছে। এমনই এক সকালে ঘুম ভেঙে গেলে জামান চোখ মুছে তাকিয়ে দেখলো তার স্ত্রী আফরোজ আগেই ঘুম থেকে উঠে খাটের উপর এক পাশে বসে আছে। জ্বানালা দিয়ে বাইরের দিকে একেবারে আনমনা হয়ে চেয়ে আছে। একদম চুপ চাপ। মুখে কোন কথা নেই।কোন নড়াচড়াও নেই।মুখপানে তাকিয়ে জামানের মনে হলো দুনিয়ার সমস্ত দুঃখ ও বিষণ্ণতা একজায়গায় জড়ো হয়ে আফরোজের চোখে-মুখে ছেয়ে বসেছে। হয়তো মাত্র ঘুম ভেঙেছে, তালে ফেরার চেষ্টা করছে। হয়ত ক্ষণকাল পরেই তার চেনা কন্ঠ আর চেঁচামেচি সংসারের বায়ুমণ্ডলে নিয়ম করে ধ্বনিত হতে আরম্ভ করবে। জামানের একবার এমন ভাবনা হলো। কিন্তু, আফরোজ নৈমিত্তিক বাড়ির সবার আগে জেগে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গেই সংসারের প্রতিদিনকার কাজ শুরু করে। সেই যে শুরু রাত দশটা পর্যন্ত বিরতিহীন চলে। তাই জামানের একটু শঙ্কাও হলো। শরীরে কোন প্রকার অশান্তি হলো কিনা। দুঃস্বপ্ন দেখেও ভয়ে ঘুম ভেঙে আর ঘুম আসেনি, এমন ও তো হতে পারে । বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ এরকম গোটা কয়েক কার্য-কারণ আন্দাজ করে শেষে আফরোজ কে সে জিজ্ঞাসা করলো-
“এই, কী ব্যাপার? কখন উঠে বসে আছ এভাবে? শরীর খারাপ করেনি তো?”
এই বলে কিছুটা ব্যস্ত হয়ে, নিজের গায়ের উপর থেকে কাঁথা সরিয়ে, জামান একটু গড়ামেরে কাছে গিয়ে আফরোজের কপালে হাত রেখে পরীক্ষা- নিরীক্ষা শেষে বুঝলো জ্বর-টর কিছু করে নাই। সুতারাং আশঙ্কা হচ্ছিল, যা কিছুই ঘটে থাক না কেন- তা ঘটেছে ও’র মনে, শরীরে নয়। গতরাতে জামানের অফিসে একটু বেশি খাটুনি হয়েছিল তাই রাতে ক্লান্তির চোটে আফরোজের দিকে ভালো করে তাকানোও হয়নি এবং বাতচিত ও তেমন হয়নি। কিন্তু রাতারাতি দৈবাৎ আফরোজের মনে কি এমন ঝড় বয়ে থাকতে পারে যা তাকে একটা লম্বা বৃক্ষকে কয়েক ভাঙা দিয়ে নিস্তেজ, প্রাণহীন এক সংকুচিত গুড়ির মত বসায়ে দিয়েছে। জামান এবার কন্ঠে উৎকন্ঠার সুর মিশিয়ে বললো-
“সোনা, কী হয়েছে তোমার?”
আফরোজ কোন উত্তর করলো না। কিন্তু তার দুচোখে শীঘ্রই যে জল ভর করতে যাচ্ছে, সে আশু আয়োজন জামানের কাছে আড়াল করতে পারলো না আপরোজের চোখ-মুখ। তার চোখ ছল ছল করতে লাগলো। যেন ভারী এক বর্ষনের জন্য জামানের মুখ থেকে আদর-আহ্লাদ জড়িত ঐ সোনা ডাকটি আরও দু এক-বার শোনার অপেক্ষা করছে মাত্র। চেনা পরিচিত মেঘের ঘনঘটা দেখে জামান কিছুটা থেমে গেল। আর কথা পাড়লো না। তার আফরোজের আজ কী হয়েছে, কীসের জন্য জগতের সমস্ত দুঃখের ছায়া তার মুখের উপর ভর করেছে- কিছুই তার তাৎক্ষনিক কোনভাবেই মাথায় আসলো না। শুধু মনে মনে নিশ্চিত হলো পাগলি তার চোখে আজ নির্ঘাত জল আনবে। কারণ বিয়ের আগে ও পরের জীবনে সুখের কিংবা দুঃখের যে কোন উপলক্ষে আফরোজের কান্না দেখে নিজের কান্না চেপে রাখতে পেরেছে এমন সফলতার ইতিহাস জামানের নেই। জামান খুব আবেগী মানুষ। আবেগী মানুষ দয়ালু হয় বেশি, নিষ্ঠুর হয় খুব কম। পরের দুঃখ দেখলেই এদের অশ্রু বাঁধ ভেঙে পড়ে অনায়াসে। আফরোজের যে কী বেদনা, তা আজ তাকে নিজ কানে শুনতে হবে এবং শুনে তাকে নির্ঘাত কাঁদতে হবে। এরুপ অনিবার্য এক করুণ দৃশ্যের ভাবনা যখন জামানের মনের মধ্যে বয়ে চলেছে, সে সময় আফরোজের দিকে তাকাতেই দেখলো ইতোমধ্যেই তার দুচোখ বেয়ে অনন্ত ঝর্ণা ধারার মত অঝরে জল গড়িয়ে পড়ছে। নিঃশব্দে শুরু হয়েছে এই অশ্রুপাত। কান্নার সাথে শীঘ্রই ফোঁপানী ও দীর্ঘশ্বাস যোগ হয়ে ঘরের মধ্যে অল্প বিস্তর প্রচার পেতে আরম্ভ করলো। এটা এখনই থামাতে না পারলে, আরো শক্তিশালী হয়ে ঘরের দেওয়াল ভেদ করে ক্ষণকালের মধ্যেই পাড়া পড়শিদের কানে উঠবার উপক্রম হবে । তাই ধরে আসা কন্ঠ, আর আড়ষ্ট ঠোঁটে অনেক চেষ্টা করে আফারোজকে সে দুহাতে জড়ায়ে ধরে প্রশ্ন করলো-
“কী হয়েছে? আফরোজ, বলনা। কী হয়েছে?”
আফরোজ হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল-
“ও গো, আল্লাহ আমাকে সন্তানাদি না দিয়ে ঠিক কাজটা করেছে। আল্লাহ সত্যিই ন্যায়বিচারক।”
কথাটা শুনে জামান কোন কুল কিনারা পেল না। এ কথার আগা-মাথা কিছুই তার মাথায় ঢুকলো না। অথচ তার মনে পড়তে লাগলো একটা সন্তানের জন্য এই আফরোজ কত কি যে করেছে সারা জীবন তার অন্ত নেই। শুধু মা ডাকটা শুনে নারী জীবন সার্থক করার জন্য সে নিজে কোথায় যায়নি আর তাকে দেশ-বিদেশ কোথায় পাঠায় নি তার কোন লেখা জোকা নেই। অবশেষ চেষ্টা-তদবির করেও যখন সন্তান ধারণ করতে পারলো না, তখন সন্তানের মা হওয়ার সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল । তা আজ ১৯ বছর আগে। আফরোজ খুব অভিমানী ধরণের মানুষ। বিচক্ষণ ও সুবিচেক ও বটে। তার জন্য স্বামী অসুখী থাকবে সারা জীবন সেটাও সে চাইনি। বহুবার সে বলেছে তুমি আর একটা বিয়ে কর। বলতে ভীষণ কষ্ট হলেও বলেছে। কিন্তু জামান এ কথায় কোনদিন ও রাজি হয়নি। বরং এ কথা শুনলেই ভীষণ ক্ষেপে যেত। এসব কথা আর পাড়েনা, সে তো ২০ বছর হলো। ভাগ্য মেনে নিয়ে চলে আসছে তাদের নিঃসন্তান দাম্পত্য। অনেকটা ভুলেই গেছে। বিষয়টা নিয়ে আফরোজ বেশি অবুঝ হয়ে উঠলে মাঝে মধ্যে জামান তাকে সান্ত্বনা দিত এই বলে যে, পরকালে নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের নিরাশ করবেন না। আফরোজেরও এখন এ ব্যাপারে কোন হা-হুতাশ নেই । শুধু নিজেদের কোন ছেলে মেয়ে আল্লাহ কোন দিন দিল না –এই তাদের আক্ষেপ, এই মনের দুঃখ। কিন্তু আজ এত বছর পর কেন কোন বিচারে আফরোজের মনে হলো আল্লাহ তাকে নিঃসন্তান করে ন্যায় বিচার করেছে, সেটা মিনিট দুই-তিন ভাবনা করে, সে জানতে চাইলো-
“তা, হঠাৎ কোন বিচারে তোমার কাছে মনে হলো যে, আল্লাহ তোমার ছেলেপুলে না দিয়ে ভাল কাজটা করেছে। উচিৎ কাজটা করেছে?”
কাঁদতে কাঁদতে আরো জোর গলায় আফরোজ বললো-
“হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। আল্লাহ আমাকে সন্তানাদি না দিয়ে ঠিক করেছে। আমি মা হবার যোগ্য না।”
এই বলে সে আরো জোরে সরে কান্না জুড়ে দিল। জামানের কিছুটা রাগ উঠতে লাগলো। রাগটা স্ত্রীর উপরে না। আফরোজের কান্না সে দেখতে পারে না। সইতেও পারে না। আফরোজকে প্রেম করে বিয়ে করেছিল সেই কুড়িবছর আগে। চিরকাল বউকে হাসি আনন্দে রাখার চেষ্টা করেছে। হাসি-তামাশা, ঠাট্টা ইয়ারকি করে সব সময় তার মনের দুঃখ দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আফরোজের আজ যে কান্না, সে কান্নায় দুঃখের সুর নেই।আজকের কান্নায় বাজছে অপরাধবোধের সুর। এই অচেনা সুরেই জামানের রাগ উঠলো। জামান চিরকাল চেষ্টা করে তাকে সব ভুলিয়ে রাখতে। কিন্তু আজ কোন কারণ আলাদা উৎপাত বয়ে এনে প্রিয়তম আফরোজকে অশান্ত করে তুলছে? এই ভাবনার সাথে সাথে রাগ উঠতে লাগলো। রেগেমেগে জিজ্ঞাসা করলো-
“কে বলেছে তুমি মা হওয়ার যোগ্য না? কে তোমাকে এই খোটা দিয়েছে শুনি?”
সন্তান না হওয়ার কারণে, বংশের বাতি জ্বালাতে না পারার কারণে, পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয়-স্বজনেরা সবাই অনেক কটু কথা আফরোজকে শুনিয়েছে আর বহুকাল ধরে তারা আফরোজের কোমল হৃদয়ে কেবল রক্তক্ষরণ করে গেছে। বাজা, অভিশপ্ত, অলক্ষ্মী আরো অনেক কথায় মানুষেরা তার কান ঝালাপালা করেছে। মা হতে না পারলে আমাদের রমনী কুলকে এগুলো প্রথাগতভাইে শুনতে হয়। শুনে অনেককে গলায় দড়ি নিয়ে মরতেও হয়। সতীনের ঘর ও অনেক কে করতে হয় আর নিগ্রহের চূড়ান্ত যাতাকলে পিষ্ট হয়ে অনেক সময় স্বামীর ভিটেও ছাড়তে হয়। এমন কি সন্তান না হওয়ার জন্য স্বামী দ্বায়ী হলেও এগুলো ব্যতিক্রমহীন ভাবে ঘটে।
হতে পারে কেউ বোধ হয় নতুন করে এসব ফালতু কথাবার্তা আবার অফরোজকে শুনিয়েছে। এই অজানা অনুমেয় কারণ ভেবে নিয়ে, জামান রাগে ফুলতে লাগলো। একটু গরম হয়ে বললো-
“কী হলো বলো? কে তোমাকে আবার কোন ফালতু কথা বলেছে, বলতো? মানুষের গুষ্টি…”
কিন্তু ঘটনা ও রকম কিছু না। পুরনো কটু কথা আফরোজের আর গায়ে বেঁধে না। ওসব সয়ে গেছে। স্বামীর ভালবাসা আর আশকারায় সে সমাজের মানুষের হাজার কথাও হজম করতে শিখেছে। কিন্তু আজ যে তার হৃদয় ভেঙে চৌচির হয়েছে তার কারণ আলাদা। আরো গভীর। বহুগুণে বেদনার। সন্তান না পাওয়ার চাইতেও বেশি আফেসোসের। আফরোজ করুণ কন্ঠে কাঁদতে কাঁদতে উত্তর দিলো-
“না গো , না। কেউ আমাকে কিচ্ছু বলেনি,কেউ আমাকে কিছু করেনি, আমি করেছি। আমি অন্যায় করেছি। আমি অপরাধ করেছি।”
কথাগুলো বলতে বলতে বিছানায় লুটিয়ে পড়ে বালিশে মুখ চেপে এত বেশি কাদঁতে লাগলো যে, জামান আর একটা কথাও বলতে পারলো না। আর কিছু জিজ্ঞাসাও করতে পারলো না। নিজের চোখেও জল ধরে রাখতে না পেরে শুধু এ হাতে একবার ও হাতে একবার চোখ মুছতে লাগলো। এভাবে প্রায় ১০/১২ মিনিট কেটে গেল। জামান বিছানায় বসে আর আফরোজ শুয়ে শুয়ে একভাবে কেঁদে চলেছে।
এক পর্যায়ে জামান রাগ একটু সামলে নিয়ে আফরোজের গায়ের কাছে সরে গিয়ে মাথায় বার কয়েক হাত বুলাতে বুলাতে ছোট কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করতে লাগলো-
“আচ্ছা ঠিক আছে। মানলাম যে, তুমি মস্ত এক অন্যায় করেছো, বড় এক অপরাধ করেছো। তা তোমার সেই বিরাট অপরাধ টা কি এবার বল দেখি। শুনি একটু।”
প্রথম বার আফরোজ কোন উত্তর করলো না। বেশ কয়েকবার আদর করে অাহ্লাদ করে জিজ্ঞাসার পরে উপুড় অবস্থা থেকে চিৎ হয়ে শুলো। চোখ দুটো একদম লাল টকটকে হয়ে গেছে। একদম গোবরাণী দিয়ে চোখ উঠলে যেমন লাল হয় সেরকম লাল। জামান হাত দিয়ে আফরোজের চোখ মুছে দিল। এরপর কিছুটা শান্ত হয়ে ধরা গলায় আফরোজ বলতে লাগলো-
“ জানো? গতকাল দুপুর সময় ফয়সাল হঠাৎ করে বাড়ি এসেছিল।”
“হুম, তার পার?”
“তখন দুপুর দুইটা বাজে হয়ত। তুমি তো জান যে, মাসের অর্ধেকে ও কখনো শহর থেকে গ্রামের বাড়ি আসে না। খুব ব্যতি-ব্যস্ত দেখাচ্ছিল। এসে বলল, ভাবী-মা ভালো আছ? আমি বলরলাম ‘না’, ভালো নেই। সে শুনতে চাইলো, কেন? ভালো নেই কেন? আমি বললাম, ’তা তোর শুনে দরকার কি?’ সে বললো, ’ঠিক আছে, দরকার নেই’। ফয়সাল আসার মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বে আমাদের কাজের মহিলা রাহেলার কর্মকাণ্ডে এতটা রাগ উঠেছিল যে, ও’র সাথে খুব চেঁচামেচি করে মেজাজটা গরম হয়েছিল। আমি সামলাতে না পেরে ফয়সালের সাথেও রাগ করে কথা বলে ফেলেছি। আমি ওকে কোন দিনও গরম গলায় কথা বলিনা। আজই এরকম হয়ে গেছে।”
- তারপর?
- বলল, আমার পনের’শ টাকা লাগবে। আমি বললাম, টাকাটাকা নেই। আমি কোন টাকা পয়সা দিতে পারবো না। ও বলল, তুমিই তো সবসময় আমার টাকা দাও। আমি বললাম , ‘দিতাম আর দেবনা’। ও বলল, ‘তাহলে কে দেবে?’ আমি বললাম ‘তা আমি কি জানি’?
- তারপর?
- তারপর একটা কথাও না বলে সোজা বাড়ি থেকে গ্যাট গ্যাট করে বের হয়ে গেল। আমি সঙ্গে সঙ্গে পেছন পেছন গেলাম। ডাকতে লাগলাম, ফয়সাল? শোন। এই শোন। যাস নে। আমি বলছি যাবি না কিন্তু। আগে আমার কথা শোন। টাকা নিবি না? বললি যে টাকা লাগবে, তো টাকা না নিয়ে চলে যাচ্ছিস যে? একবারও আর পেছনে তাকালো না। বললাম, ‘ভাত খেয়ে যা, ফয়সাল’। ও আমার একটা কথাও শুনল না। সোজা রাস্তা ধরে বাজারের দিকে চলে গেল।
ফয়সাল হলো জামানের ছোট ভাই। তার একমাত্র আদরের ভাই। ঝিনাইদহ সরকারি কলেজে ৩য় বর্ষে পড়ে। বয়স একুশ-বাইশ হবে। আফরোজ যখন বউ হয়ে জামানদের বাড়ি এসেছিল তখন ফয়সালের বয়স দুই কি তিন বছর। বছর তিনেক পরে জামানদের মা মারা যায়। আর বাবা মারাগেছে আরো এক বছর আগে। বাবা মারা যাওয়ার সময়, জামানের বয়স পঁচিশ। দর্শণে মাস্টার্স শেষ করে একটা চাকরিতে ঢুকেছে। ফয়সাল ঐ অতটুকু কাল থেকে ভাবী’র কাছেই মানুষ হয়েছে। আফরোজ ওকে মায়ের মত আদর- সোহাগ-আল্লাদ-ভালবাসা দিয়ে এতবড় করেছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকে ছোট্ট ফয়সাল এই ভাবী আফরোজ কে মা হিসাবেই পেয়েছে। মায়ের কথা তার কিছু মনে নেই। আফরোজকে সে ভাবী-মা বলে ডাকে। কিন্তু আফরোজের শুধু মা ডাকটাই শুনতে ইচ্ছে করে। বড় হয়ে গেলে ফয়সালকে আফরোজ অনেক সময় রাগ করে বলেছে, ‘এই ভাবী-মা কিরে? শুধু মা ডাকতে পারিস না’? কিন্তু ফয়সাল পারে না। অভ্যাস হয়ে গেছে তো। ছোট কালের অভ্যাস। এই ভাবী-মা ডাকটাই তার জিহ্বার আগায় সব সময় লেগে থাকে। এটা কংক্রিটের মত স্থায়ী হয়ে গেছে। আফরোজের মাতৃত্বের সমস্ত আবেদনের ধারা এই ফয়সালকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে আজ প্রায় বিশ-বাইশ বছর। শত-সহস্র ডাক্তার কবিরাজ করে করে যেদিন প্রায় স্থির হলো যে, আফরোজ কোনদিন মা হতে পারবে না, সেদিন আফরোজ ও ঠিক করে নিয়েছিল যে, ফয়সালই তার সন্তান।ও-ই তার ছেলে। তার আর পেট থেকে বাড়তি কোন সন্তান উৎপাদনের দরকার নেই। যেহেতেু আল্লাহর তাতে সায় নেই ।
জামানও ফয়সালকে প্রানাধিক স্নেহ করে। আফরোজের মত সন্তানের চোখেই দেখে তাকে। তবে ও’র ব্যাপারে কোনদিন কোন কিছু নিয়ে এতটুকু ভাবতে হয়নি জামান কে। সব করে তার ভাবী-মা, আফরোজ। সেই ছোটকালে শৌচানো থেকে শুরু করে, গোসল করানো, ভাত মেখে নিজ হাতে খাওয়ানো, কোলে করে এ বাড়ি ও বাড়ি ঘুরায়ে নিয়ে বেড়ানো, মেলায় নিয়ে গিয়ে ঘুরে ঘুরে এক বোঝা খেলনা কিনে বাসায় ফেরা- সব করেছে আফরোজ একা হাতে। ফয়সাল যে তার সন্তান সে কথাটা যেমন সে অনুভব করে, বিশ্বাস করে, তেমনি একথা সে বাইরের লোকজনকেও নির্দ্বিধায় ঘোষণা করে শুনিয়ে দেয়। দূরাত্মীয়-নিকটাত্মীয় সবাইকেই শুনিয়ে দেয়। সেই ছোট কাল থেকে আফরোজ বাপের বাড়ি গেলে কোনদিনও ফয়সালকে বাড়ি রেখে যায়নি; সাথে করে নিয়ে যেত। বাপের বাড়ির দিকের সকল আত্মীয়-পরিজন ফয়সাল কে তা জানতে চাইলে সে সর্বদায় উত্তর করতো, ‘এটা আমার ছেলে। আমার একমাত্র ছেলে। এর পরে আমার আর কোন সন্তান হয়নি।’
এ সমস্তই জামানের জানা।তার সামনেই এগুলো আফরোজ করেছে। বলেছে। কিন্তু আফরোজের মাতৃত্বের লেনদেনের প্রতিষ্ঠিত প্রবাহ হঠাৎ তার নিজের কাছেই কেন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠলো সে গল্প তো পুরোটাই শুনে শেষ করতে হবে। তাই জামান আফরোজকে বলল-
“ও আচ্ছা এই ব্যাপার? এ আর এমন কি মারাত্মক ঘটনা হলো যে, তা একেবারে অপরাধের পর্যায়ে ফেলে তুমি চোখের জলে নদী বইয়ে দ্চ্ছি? পাগলি আমার। ফয়সাল কি তোমাকে কম ভালবাসে? দেখবে ঠিকই তোমার কাছে আবার ফিরে আসবে। হয়তো সেই সময় মন খারাপ হয়েছিল তাই অভিমান করে চলে গেছে। মা-ছেলের মধ্যে এমন হয় না বুঝি? তুমি খামখা এটা নিয়ে ভেঙে পড়েছ, আফরোজ? আচ্ছা তুমি ছাড়া ও’র আর কে আছে যে তার কাছে যাবে? কান্নাকাটি ছাড় তো। এটা খুবই সামান্য একটা ব্যাপার। আহামরী কিছু হয়নি।”
“আরে কি সব আবোল তাবোল বলছ? আমি তো এর মধ্যে অন্যায়ের কিছু দেখলাম না। বাদ দাও তো। আচ্ছা ঠিক আছে তোমার যখন খুব খারাপ লাগছে, তো আজ শহরে ও’র হোস্টেলে গিয়ে দেখা করে আসো আর টাকা পয়সা দিয়ে আসো।”
-“না আমি পারবনা। আমি ও’র সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবনা। আমি অপরাধী।”
“ আফরোজ, মারবো কষে এক চড়। অন্যায়-অপরাধ বলে বলে একেবারে জিকির তুলে দিয়েছে। কীসের অপরাধ? করসের অন্যায়? মা ছেলেকে বকে না? দুনিয়ার আর কোন মা কি এরকম করে না? অপরাধ করলে তোমার ছেলে করেছে? অন্যায় করলে ও করেছে। মা’র কথা না শুনে ও অন্যায় করেছে।”
“না । সবটা শুনলে তুমি বলবে যে, আমি কতবড় অন্যায় করেছি।”
“তো ঠিক আছে। দেরী করছ কেন? বল তোমার সবটা। শুনি দেখি।”
“ফয়সাল চলে যাবার পর আরিফ এসেছিল।”
আফরোজের ছোট ভায়ের নাম আরিফ। ফয়সালের বয়সের। শহরে থেকে পড়াশুনা করে। একই কলেজে। তবে আরিফ থাকে মেসে আর ফয়সাল থাকে কলেজ হোস্টেলে।
“হু। আরিফ এসেছিল। ভালো কথা। সেটা তো অপরাধ না।”
“ও এসে বলল ও’র দু’হাজার টাকা লাগবে। ওরা ডিপার্টমেন্ট থেকে পিকনিকে যাবে। কথায় কথায় বলল যে, ফয়সালদের ডিপার্টমেন্ট ও নাকি আজ পিকনিকে যাচ্ছে। সবাই পিকনিকে গেছে। শুধু আমার ফয়সাল বোধ হয় টাকার অভাবে…”
এইটুকু বলে আফরোজ আর বলতে পারলো না। আবার কান্না জুড়ে দিল।
“আমি ভাইকে তো ঠিকই একবার চাইতেই টাকাটা দিয়ে দিলাম। আর আমার ছেলের বেলায় …”
কান্নায় তার বুক দিবীর্ণ হতে লাগলো, গলা চেপে আসতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে তার অপরাধের ধরণ-প্রকৃতি বর্ণনা করতে লাগলো এভাবেঃ
“আমি কেন একবারে তার টাকাটা দিয়ে দিলাম না? আমি কোনদিন ও’র কোন আবদার অাহ্লাদ অপূর্ণ রাখিনি। সবাই যখন পিকনিকে আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠেছে, তখন আমার ছেলেটা নিশ্চয় হোস্টেলে একা পড়ে কাঁদছে। খুব দুঃখ পাচ্ছে হয়তো। আমি সত্যিই ও’র মা হতে পারিনি, জামান। তুমি আমাকে ক্ষমা কর। আমি গলায় দড়ি নিয়ে মরবো। ফয়সালকে বলো ও যেন তার এই অযোগ্য মাকে ক্ষমা করে দেয়।”
এ কথা বলে যেই আফরোজ বিছানা থেকে নেমে দৌঁড়ে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করলো, তখন জামান তাকে জড়ায়ে ধরে থামালো। বলল…
“কিন্তু আমি তো শুনেছি ভিন্ন কথা।”
জামানের কথা শুনে আফরোজ বিস্মিত হল। গলাকাটা মুরগি যেমন ছটফটানির পর শেষ নিঃশ্বাস গেলে শান্ত হয়ে আসে, জামানের কথাটা শুনে আফরোজ ও যেন সেরকম করে শান্ত হয়ে গেল। তার চোখে মুখে বিস্ময় ও কৌতূহল স্পষ্ট হয়ে উঠলো। জামানের দিকে তাকিয়ে সে জানতে চাইলো-
“তুমি শুনেছ ভিন্ন কথা? মানে? কী শুনেছ তুমি?”
জামান বলল যে, গতকাল ফয়সাল তার অফিসে গিয়েছিল। সচারচার য়ায় না। হঠাৎ ফয়সাল কে দেখে জামান জিজ্ঞাস করেছিল, “কিরে মনি,তুই? আমার অফিসে? কোন সমস্যা?’ ফয়সাল বলেছিল, ‘না কোন সমস্যা নেই। এই তো বাড়ি গিয়েছিলাম। আগামীকাল পিকনিকে যাচ্ছি তো তাই ভাবী-মার কাছে টাকা আনতে গিয়েছিলাম।’ হাসান বলল, ‘তো ভাবী-মা টাকা দিল?’ উত্তরে সে বলল, ‘হ্যাঁ’। এরপর জামান বলল, ‘তো ঠিক আছে’। খেয়েছিস তো দুপুরে?’ উত্তরে ফয়সাল বলেছিল, ‘তুমি কি মনে কর ভাবী-মা না খেয়ে আমাকে বাড়ী থেকে আসতে দেবে?’ এ হয় কখনো?’
এর পর জুতা আর প্যান্ট কিনতে হবে বলে বড় ভাই এর কাছ থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে ফয়সাল অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। এ ঘটনা শুনে আফরোজ জামানের একেবারে বুকের মধ্যে ঢলে পড়লো এবং পুনর্বার কাঁদতে আরম্ভ করল। তার অন্যায়টা যে ছোট নয়, সামান্য নয় তা তার স্বামী জামানকে বোঝাতে আফরোজের কান্নার সাথে আরো গুটি কয়েক যুক্তি জড়ো করতে লাগলো এভাবে-
“দেখেছো, ও ঠিকই মা’র কথাটা ভেবেই মিথ্যে বলে তোমার কাছে আমাকে ছোট হওয়া থেকে কীভাবে বাঁচিয়েছে, বলো? বলো তুমি? ও আমার সত্যি সত্যি ছেলে হয়ে উঠেছে অথচ দেখ আমিই কেবল ও’র ভাল মা হতে পারলাম না। ওকে আমি জন্ম ও দিতে পালাম না, ও’র সত্যিকারের মাও হতে পারলাম না।”
এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে আফরোজ। জামান সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ঝাড়া মেরে জামানের হাত ছাড়িয়ে ঘরের এক কোণে দাঁড়ায়ে আঁচল দিয়ে যত চোখ মুছতে লাগলো ততই অশ্রুজল তার অবিরাম চোখ-মুখ গড়িয়ে মাটিতে পড়তে লাগলো। অপরাধের ধরণ, অন্যায়ের গভীরতা অনুধাবন করে জামান কিছুই বলল না। আস্তে করে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ফয়সালকে মোবাইলে বলে দিল-
“হ্যালো ফয়সাল, তোর ভাবী-মার আজ খুব দুঃখ রে, যেখানেই থাকিস ভাই, পারলে তার সাথে ফোনে দুটো কথা বলিস।”

সাঈফ আলম
প্রভাষক, ইংরেজি বিভাগ,
ইউনিভার্সিটি ওফ ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, চট্টগ্রাম।
সাঈফ আলম

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৫৫:১৬   ১৩৩৬ বার পঠিত   #  #  #  #