মঙ্গলবার, ১২ মে ২০২০

করোনা ও প্রকৃতি- অধ্যাপক ড.মোজাম্মেল হক

Home Page » জাতীয় » করোনা ও প্রকৃতি- অধ্যাপক ড.মোজাম্মেল হক
মঙ্গলবার, ১২ মে ২০২০



 প্রকৃতি

মানুষ করোনা ভাইরাস নিয়ে ভীষণ আতঙ্কিত। গোটা বিশ্বের ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সোশ্যাল মিডিয়া করোনার তাণ্ডব নিয়ে নানারূপ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছে। আর সেগুলো দেখে, শুনে, বুঝে ও সেগুলোর নির্যাস তৈরি করে ভীতির প্রখরতা মানুষের মনে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অজানা ভয় থেকে গুটিয়ে যাওয়া মানুষ এখন খুঁজে বেড়ায় ভ্যাকসিন নামক কোন মিসাইল আবিষ্কৃত হলো কিনা, যা লক্ষ্যবস্তুকে নির্ভুল আঘাত করে নিমিষেই ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে এবং মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের জয়গান গেয়ে উলুধ্বনি দিতে পারে।

মানুষের আকুতি দেখে এটা নিশ্চিতভাবেই অনুমেয় যে করোনা অসুর প্রকৃতির কোন অপদেবতা। কোন জাত-পাত, ধর্ম বর্ণ এমনকি কোন কোন অঞ্চলের আগ্নেয় শক্তির দাম্ভিকতাকেও সমীহ না করে সে অবলীলায় মানুষের টুঁটি চেপে ধরছে। এর রূপ, রস ও গন্ধের সাথেও মানুষ পূর্বপরিচিত না। ফলে এর সাবলীল গতির কাছে মানুষ পরাস্ত হচ্ছে, অন্তরীণে নিজেকে আবদ্ধ করে স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিয়েছে। আর করোনাকে প্রতিনিয়ত অভিশাপ দিচ্ছে।

করোনা শতবর্ষীয় জীবাণু। শত বর্ষ পর পর নানা প্রয়োজনেই করোনার মতো নানা নামে এরা ফিরে আসে। মানুষকে আক্রান্ত করে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এরা এদের কাঙ্ক্ষিত জীবন হনন করে। এদের প্রতিরোধের মন্ত্র আবিষ্কারে ব্যস্ত মানুষকে অপ্রস্তুত রেখেই লোকালয় আর জনপদগুলোকে একে একে লোকশূন্য করে ফেলে এবং শেষমেশ আপন মহিমায়ই এরা এদের তাণ্ডব থামায়। আর তখন এদের নিয়ে তৈরি হয় নানা গল্প ও কল্প-কাহিনী। অত্যন্ত সম্মানের সাথেই এদের নাম লিপিবদ্ধ হয় বিশ্বকোষ বা গবেষণা গ্রন্থে।

প্রশ্ন উঠে করোনা অভিশপ্ত হওয়ার পাত্র কি-না বা জীবজগতের আর কোন কোন জীব ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে করোনাকে অভিশাপ দিচ্ছে। হরপ্পা সভ্যতার লোকেরা ইন্দ্রকে দেবতা হিসেবে মেনে নিতো না। ইন্দ্র ছিল গ্রামীন আর্যদের দেবতা। হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের দিকে নিজেদের অন্তর-কলহ ও অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়ে মাঝেমাঝেই গ্রামীন আর্যদের সম্পদ আর গবাদি পশু লুঠ-তরাজ করত। বেদে বহুবার উল্লেখ আছে যে, গ্রামীন আর্যরা ইন্দ্রের কাছে এ নিয়ে নালিশ করত এবং প্রার্থনা করত ইন্দ্র যেন তাদের লুণ্ঠিত পশুগুলোকে নগরের লোকদের কাছ থেকে উদ্ধার করে দেয়।
ভক্তদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইন্দ্র একের পর এক পুর/নগর ধ্বংস করে আর্যদের পশুগুলোকে উদ্ধার করে দেওয়ায় আর্যরা তাকে পুরোন্দর উপাধিতে ভূষিত করেছিল। এ কারণেই ইন্দ্র আর্যদের আরাধ্য দেবতা, হরপ্পীয় মানুষেরা যতই তাঁকে হেয় করে দেখুক না কেনো।

তেমনি মানুষ করোনাকে যেভাবেই দেখুক না কেনো মানুষ ছাড়াও এ পৃথিবীর স্বত্বাধিকারী আরো অনেকেই আছে। যেমন গাছ-পালা, পাখি, জীবজন্তু প্রভৃতি। মানুষের সাথে ভাগাভাগি করে বসবাসকারী এই অংশীদারদেরও অধিকার আছে এই পৃথিবীতে সমান সুযোগ পাওয়ার। মানুষ ছাড়া বাকিরা কি করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা অভিশাপ দিচ্ছে?

একটু বাইরে তাকালেই দেখা যাবে মানুষ ছাড়া অন্য সকলেই মনের অনাবিল আনন্দে চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও যেন তাদের নেই বাধা। মানুষের রাজনৈতিক সীমানাকে তারা মানে না। বরং মনে করে এগুলো মানুষের ছেলে-মানুষী। স্বার্থের প্রয়োজনে কিছুদিন ফিতা ধরে দাগ দেয় আবার স্বার্থ শেষ হলেই ফিতার দাগ থুথু দিয়ে মুছে ফেলে। মানুষের মত দাগ নিয়ে মারামারি তারা পছন্দ করে না। নিজেদের নিয়ন্ত্রণের জন্য কোন আইনি পুস্তক, আমলা, বাহিনী বা লম্বা পৈশাচিক শিকের কারাগারও তাদের প্রয়োজন নেই। নিজের আত্ম-সচেতনতাকেই তারা প্রাধান্য দেয়। অন্যকে আক্রান্ত করা তাদের স্বভাব নয়। সুন্দর পৃথিবীতে ভারসাম্যময় সহাবস্থানই তাদের ঐকান্তিক কামনা।

করোনার আগমনে বেদখল হওয়া লোভনীয় লোকালয়গুলো মানুষের অংশীদাররা ফিরে পেয়েছে। এই কারণে করোনা তাদের কাছে বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের ন্যায় অথবা হিন্দু দেবতা পশুপতি শিবের ন্যায় আরাধ্যেয়। রোজনামচা করে নিয়মানুযায়ী অর্ঘ্য প্রদানের রীতি তাদের জানা নেই। নেচে-গেয়ে বেড়ানো ও অবাধ বিচরণই করোনার প্রতি তাদের অর্ঘ্য। এই দখল কতদিন থাকবে তা তারা জানে না। হোক না তা ক্ষণিকের বা কয়েক বছরের। স্থানগুলোতে এদের সরব উপস্থিতি গৃহবন্দি মানুষকে কড়া নেড়ে জানিয়ে যাচ্ছে যে, এগুলো তাদেরই জায়গা ছিল। বুদ্ধি ও বাহুবলে বলীয়ান মানুষ এতদিন অন্যায়ভাবে এগুলো দখল করে তাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের প্রয়োজনেই শতবর্ষ পর পর করোনারূপী কোন না কোন জীবাণু এসে কিছু মৃত্যু ঘটিয়ে মানুষকে তার আগ্রাসী মনোভাবের জন্য শাসিয়ে যায়। মানুষকে থামাতে চায় তার অনাচার বৃত্তির জন্য, প্রকৃতির সাথে সহাবস্থানের জন্য, প্রকৃতির অপরাপর অংশীদারদেরকেও স্ব স্ব ন্যায্য হিস্যা প্রদানের জন্য।

শতবর্ষীয়ান জীবাণু কেনো বার বার পৃথিবীতে ফিরে আসে এটাও মানুষকে ভাবতে হবে। প্রকৃতির সকল সৃষ্টির মধ্যে একটা ভারসাম্য রয়েছে। পৃথিবীর রহস্য নিয়ে যারা কাজ করেন তারা সকলেই জানেন যে, পৃথিবী সৃষ্টির সময়ে ভীষণ উত্তপ্ত ছিল। ক্রমশ ঠাণ্ডা হয়ে প্রথমে উদ্ভিদ ও পরে প্রাণিদের আগমন ঘটে। তন্মধ্যে মানুষের আগমন ঘটে সবার শেষে। এরা একে অপরের ওপরে নানাভাবেই নির্ভরশীল। প্রধান নির্ভরশীলতা হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে সবার শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া। একজন অক্সিজেন নেয় ও কার্বনডাইঅক্সাইড ছাড়ে এবং অন্যজন কার্বনডাইঅক্সাইড নেয় অক্সিজেন ছাড়ে। এই অক্সিজেন ও কার্বনডাইঅক্সাইড এর মধ্যে ভারসাম্য রেখেই প্রকৃতি এই পৃথিবীকে সুন্দর, অনাবিল ও স্বপ্নিল করে তোলে- যা অবগাহন করে মানুষ মুগ্ধ হয়ে অবিরত জয়গান করে থাকে।

খাদ্যভ্যাসগতভাবে প্রাণিদের মধ্যে বৈচিত্র্য রয়েছে। কেউ তৃণভোজী, কেই মাংসাশী আবার কেউ সর্বভোজী। পৃথিবীতে উদ্ভিদের রাজত্বের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য প্রকৃতি তৃণভোজী প্রাণিদের সৃষ্টি করেছিল। তৃণভোজী প্রাণিরা যেন উদ্ভিদের উপরে এমনভাবে চেপে না বসে যে পুরো ভ্রমান্ডই উদ্ভিদ শূন্য হয়ে পড়ে সেকারণেই প্রকৃতি মাংসাশী প্রাণির আবির্ভাব ঘটায়। যাতে কিছু প্রাণি উজাড় করে প্রকৃতিতে ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। আবার উদ্ভিদ, তৃণভোজী আর মাংসাশী প্রাণির লাগাম টানাসহ সমন্বয় সাধন করার জন্য অনেকটা বিচারিক ক্ষমতা নিয়েই সর্বভোজী মানুষের পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল। যদিও প্রকৃতিই তার সকল সৃষ্টিকেই মাতৃরূপেই লালন-পালন করে, তথাপি বুদ্ধিমান মানুষের কাছে প্রকৃতির কাম্য ছিল যে মানুষ তার বিচার বুদ্ধি দিয়ে কিছুটা হলেও তার সমন্বয়িক দায়িত্বের সহায়ক হবে।

কিন্তু তা হয় নি, প্রকৃতির স্বপ্নে ছাই দিয়ে দিয়েছে মানুষ। একে একে উজাড় করেছে বন, নদী-নালা, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, বায়ুমণ্ডল। ধরণীর তাবৎ অঙ্গে অসংখ্য আঁচড় কেটে ক্ষতবিক্ষত করে একে রূপহীন করে দিয়ে মানুষকে প্রকৃতির মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

গত কয়েক শতকে মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা মানুষকে আরো বেশী আগ্রাসী করে তুলেছে। অসংখ্য উদাহরণের কতিপয় বিষয় তুলে ধরলেই মানুষের এই আগ্রাসী মনোভাবের স্বরূপ অনুধাবন করা যাবে। বিংশ শতকের গোড়ার দিকে মানুষ জীবন রক্ষাকারী টিকা আবিষ্কার করেছিল। এই আবিষ্কারের আগে কোনো দম্পতির ঘরে দশ বারোজন শিশু জন্ম নিলেও প্রকৃতির অদৃশ্য হস্তক্ষেপে মাত্র দু’তিনজন টিকে থাকত। ফলে এখন থেকে দেড়’শ দু’শ বছর আগে সারা পৃথিবীতেই ছিল প্রাকৃতিক নিয়মে পরিকল্পিত পরিবার এবং অতি ধীর গাণিতিক হারে সেই সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেতো। আধুনিক কালের পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দিয়ে যা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না, প্রকৃতি তার নিজস্ব বলয়েই অনায়াসে সেগুলো সম্পন্ন করতো। জীবন রক্ষাকারী টিকা আবিষ্কারের পর শিশু মৃত্যুহার প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে এবং ঘরগুলো সন্তান-সন্ততিতে ভরপুর হয়ে উঠে। জীবন রক্ষাকারী টিকার আবিষ্কার এখানে দায়ী নয়, দায়ী হচ্ছে এর প্রায়োগিক দিক। অর্থাৎ নৈতিকতা বিবর্জিত মানুষের সামনে প্রকৃতি প্রেম বিষয়ক কোন নৈতিক বিধান না রেখে এই আবিষ্কারের যথেচ্ছা প্রয়োগ করাই ছিল বিশ্ব মানবজাতির জন্য নিজের পায়ে কুঠারাঘাতের শামিল।

এক দেড়শ বছর আগে মানুষের বিশেষ আকুতি ছিল যেন অন্তত নাতী-নাতনীর মুখ দেখে মরতে পারে। মানুষের গড় আয়ুও ছিল তখন কম, ৪০/৪৫- এর নিচে। আধুনিক চিকিৎসার সুবাদে গড় আয়ু এখন ৬০/৭০-এ এসে ঠেকেছে। এখন আর নাতী দেখে যাওয়ার স্বপ্ন নয় বরং পুতি ও আরো পরের বংশধরও দেখে যেতে পারছে। ফলে পৃথিবীতে এখন জনসংখ্যার বিশাল এক বিস্ফোরণ ঘটেছে। ছোট এই পৃথিবীতে বিশাল মানবগোষ্ঠীর জায়গা কোথায়? আবার এই বিশাল বহর পালার রসদই বা করুণাময়ী পৃথিবী কিভাবে প্রদান করবে?

নৈতিকতা বিবর্জিত বিজ্ঞান; প্রকৃতির সাধারণ ক্ষমতাকে হেয় করে আবাসন হিসেবে নতুন নতুন নগরায়ন, আকাশচুম্বী অট্টালিকা এবং খাবার হিসেবে রূপ, রস ও গন্ধহীন উফশী ফসল উপহার দিয়ে বিশাল জনগোষ্ঠীকে যাদুকরী রূপকথার ন্যায় খাইয়ে, পরিয়ে, ভুলিয়ে রেখেছে। এর পরিণতিতে কৃষিক্ষেত্র হয়েছে সংকুচিত। আর উফশী ফসলের রাসায়নিক বিষ ও সারের কারণে নদী-নালা ও খাল-বিল এখন মাছ শূন্য। মানুষ যাবে কোথায়। বিজ্ঞান তাকে লোভ দেখায়, লোভী মানুষ তাতেই উৎফুল্ল হয়ে নেচে উঠে। একযুগ পরেই দেখে প্রকৃতি বিরুদ্ধ পরামর্শ শুনে লাভ তো দূরের কথা পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়াও তার পক্ষে কঠিন।

বড়রা যেমন শিশুদের নিয়ে খেলা করে, শিশুদের নির্বুদ্ধিতা দেখে মজা পায়। প্রকৃতিও তেমনি তার সকল সৃষ্টির সাথে ভালোবাসার খেলা করে, নির্বুদ্ধিতায় মজা পায়। অভিভাবকের মতই ভালোবাসে ও প্রয়োজনে শাসায়। জীবজগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দাবীকারী দাম্ভিক মানুষের পক্ষে প্রকৃতির এই খেলা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। প্রকৃতি অদৃশ্য তবে এটি দৃশ্যমান হয় তার ঋতু বৈচিত্র্যের মাধ্যমে। ষড়ঋতুর বৈচিত্র্যের আবহাওয়া তৈরি করে প্রকৃতিই তার সকল সৃষ্টির জন্য খাবারের যোগান দেয়। মানুষ অবুঝ তাই প্রকৃতির এই রঙ লীলা অনুধাবন করতে পারে না। মানুষ এটা বুঝে না যে শীতকালে যে ফসল সে ফলায় বর্ষায় তা ফলে না আবার বর্ষায় যে ফসল হয় শীতে তা জন্মে না। শীতের ফসল সবই বীজ জাতীয় আমিষ সমৃদ্ধ এবং এগুলোর মাধ্যমে মানুষের শরীরে উত্তাপ বৃদ্ধি করে মানুষকে শীত থেকে রক্ষা করে। আবার গ্রীষ্ম ও বর্ষার ফসল খনিজ সমৃদ্ধ পানি জাতীয়। গরমে মানুষের শরীর থেকে দূষিত পদার্থ বের করে মানুষকে সতেজ রাখার জন্য প্রকৃতি এসব কাজ নীরবে করে থাকে। প্রকৃতির এই নিয়মতান্ত্রিক পথের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মানুষ যখনই তার কৃতিত্ব জাহির করে অন্য খাবার নেয়, তখনই সে রোগ, জরার মুখোমুখি হয়। প্রকৃতির এই বৈচিত্র্যের ইশারা মানুষ ছাড়া সকল উদ্ভিদ ও প্রাণিরা কিন্তু ঠিকই বুঝে। একারণেই দেখা যায় বৃষ্টির লক্ষণ নেই অথচ চৈত্রের শেষে গাছেরা তাদের পুরানো পাতা ঝেড়ে ফেলে নতুন লিকলিকে কুঁড়ি বের করে দেয়। দেহের সঞ্চিত রস থেকে কচি পাতাগুলোকে দিন পনের টিকিয়ে রাখে। কারণ তারা জানে সামনে বৈশাখী ঝড়, জ্যৈষ্ঠের বাতাসে আদ্র জলকণা ও পরে আষাঢ়ের বৃষ্টির জলধারায় সেগুলোকে অবগাহন করিয়ে নব জীবন দিতে পারবে।

গাছের এই ইশারা অনুধাবন করে পাখি ও কীটপতঙ্গরাও পরবর্তী বংশবৃদ্ধির প্রস্তুতি নেয়। পাখিরা খড় কুটো দিয়ে আপন আপন নীড় তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কারণ তারা জানে যে মৌসুমি জলরাশিতে প্রকৃতিতে অফুরন্ত খাবারের যোগান হবে। আর সেই খাবার খেয়ে পাখিদের পরবর্তী বংশধর নীরবে বেড়ে উঠবে। গাছের লিকলিকে পাতায় কীটপতঙ্গরা ডিম পেড়ে দেয়। কীটেরাও বুঝে যে উড়তে শেখার আগে এই পাতা খেয়েই তাদের শূককীটেরা বেড়ে উঠতে সক্ষম হবে। জলজ মাছেরাও গাছের এই ইংগিত বোঝে। এসময় এরাও মুখে ও পেটে ডিম নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আষাঢ়ের জলধারা শুরু হলেই এরা তখন ডিম ছেড়ে দেয়। দীর্ঘ বর্ষায় মাছের পোনার জন্ম ও বেড়ে উঠে সম্ভব হয়। প্রকৃতির এই রূপ পরিবর্তনে উদ্ভিদ ও প্রাণি জগতের যে বিশাল আয়োজন, মানুষ তা একেবারেই বুঝতে পারে না বা বোঝার চেষ্টাও করেনা।

চৈত্র ও বৈশাখে একটু গরম পড়লেই মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠে। বৈদ্যুতিক পাখা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে ঢুকে পড়ে। আর প্রকৃতির দাবদাহকে অভিসম্পাত করতে থাকে। প্রকৃতি এই রঙ্গলীলা কেন করে বা এর প্রয়োজন আছে কিনা একবার ও মানুষ খুঁজে দেখার প্রয়াশ নেয়নি। যদি বুঝতো তাহলে অবশ্যই অনুধাবন করত যে চৈত্রের দাবদাহ দিয়ে প্রকৃতি সুজলা সুফলা মাঠকে পুড়িয়ে দিয়ে বর্ষাকালীন ফসলের জন্য মাঠকে উপযোগী করে এবং বর্ষায় টিকে থাকার মত ফসল ফলানোর জন্য মানুষকে তার অজান্তেই উদ্বুদ্ধ করে। অগ্নি মূর্তি ধারণ করে উদ্ভিদ ও প্রাণি কূলকে তার আশু পরিবর্তনের আভাসও জানিয়ে দেয় যেন তারা আশুমংগলের জন্য প্রস্তুত থাকে। মানুষের কাছে যেমন স্বর্ণ-রৌপ্য লোভনীয় সামগ্রী। উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের কাছে সেগুলো তুচ্ছাতিতুচ্ছ। প্রাকৃতিক পানিই তাদের সবিশেষ কাম্য। আর এই কামনাই তারা প্রকৃতির আরাধনা করে। ফলে চৈত্রের দাবদাহ মানুষের নিকট যতই বিরক্তিকর হোক না কেন উদ্ভিদ ও প্রাণিকূলের কাছে এই প্রখরতা সন্তানের প্রতি মায়ের রাগ বা অভিমানের মত। কারণ তারা জানে সাময়িক এই বিড়ম্বনার পরেই অভিমানী মায়ের মত প্রকৃতিও দেবীরূপে প্রথমে অল্প ও পরে অগাধ জলরাশি নিয়ে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে লালল পালন করবে, স্নেহ ও মমতা দিয়ে বড় করে তুলবে এবং জীব জগতের বংশ পরম্পরা টিকিয়ে রাখবে। একটু খেয়াল করলেই মানুষ বুঝতে পারবে যে বৈশাখে যে বৃষ্টি হয় তা সামান্য। এর কারণও আছে। কচি গাছের শিকড়গুলো বাচ্চাদের মতই আদুরে থাকে। তাতে শ্রাবণের মুষলধারা ঢেলে দিলে শিকড় পচে যাবে। একারণে অল্প পানিতে সিক্ত হয়ে সেগুলো সহজেই সতেজ হতে পারে। নির্বোধ মানুষ প্রশ্ন করতে পারে তাহলে ঝড়ের কি প্রয়োজন? ঝড় গাছের অযাচিত ফল ফেলে দেয় ও ডালগুলোকে ভেঙ্গে দিয়ে মূল গাছকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। গাছকে এপাশ ওপাশ দোল দিয়ে শিকড়কে আলগা করে দেয়। বজ্রপাতের মাধ্যমে বাতাসে বিরাজমান নাইট্রোজেন গাছের গোঁড়ায় পৌঁছে দেয় । যে খাবারের জন্য চাতক পাখির ন্যায় গাছেরা সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে। ফলে প্রকৃতির যেকোনো কর্মকাণ্ডই যে জীব জগতের সহায়ক এই সাধারণ কথাটাই সজ্ঞানে বা মূর্খের ন্যায় মানুষকে বুঝতে হবে।

মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বিরক্তি দেখা যায় জ্যৈষ্ঠ মাসের বৃষ্টিহীন আদ্র-জলকণার তীব্র দাবদাহ নিয়ে। এই সময়ে মানুষের শরীর থেকে বিনা পরিশ্রমেই দরদর করে ঘাম বের হতে থাকে। পরিধেয় বস্ত্র একদম ভিজে চুপসে যায়। প্রকৃতি কেন এমন একটি বিরূপ আবহাওয়া সৃষ্টি করে মানুষ তা জানেনা। পাকা আম যাতে পাখি খেতে না পারে এজন্য মানুষ আম পাকার পূর্বেই আম পেড়ে নিয়ে জাঁক দেয়। অর্থাৎ গরম ভাপ দিয়ে আম পাকায়। মানুষ মা হয় আমের লোভি এজন্য সে এটার পরিচর্যা করে। যে জঙ্গলে আম আছে অথচ মানুষ নেই সেগুলোর কি হবে? আম, জাম, কাঁঠাল ছাড়াও প্রকৃতিতে আরো অসংখ্য ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছ আছে, সেগুলোর যত্ন নিবে কে? একারণেই প্রকৃতি আষাঢ় মাসে জলধারা সৃষ্টির আগে একমাস আদ্র জলকণা ও তীব্র গরম দিয়ে এক ধরনের জাঁক দেওয়ার মত করেই গাছের ফলগুলো পাকিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। আষাঢ় ও শ্রাবণের জলধারা সেই ফলকে পচিয়ে বীজ বের করে দেয়। জলরাশি প্রাকৃতিকভাবেই সেই বীজকে কোন না কোন বৃষ্টির পানির নালায় আটকে তার উপরে মাটির প্রলেপ দেয় এবং অঙ্কুরোদগমে সাহায্য করে। মানুষ কি করবে এটা প্রকৃতির বিবেচ্য বিষয় নয়। প্রকৃতি তার নিজ সামর্থ্য ও যোগ্যতা দিয়েই তার জীবজগৎ রক্ষা করে। মানুষ প্রকৃতির এই চলার পথে সুবিধাভোগী। নিমকহারামের মত তারটি খেয়ে তাকেই গালি দেয়। মিথ্যে অহংকারে তার উপরে নিরন্তর অত্যাচার করে।

সর্বভোজী ও জ্ঞানীদের মধ্যে জ্ঞানী মানুষরা প্রকৃতির এই খেলাগুলো যে বুঝে না তা ঠিক না। আজ থেকে একশত বছর আগেও নাবিকরা ধ্রুব তারা দেখে রাতের পথ চলত, গাছ বা ঘরের ছায়া দেখে সময় নিরূপণ করত, থমকে যাওয়া বাতাস দেখে ঝড়ের পূর্বাভাস বুঝত। নৈতিকতা বিবর্জিত বিজ্ঞানের উপর নির্ভরশীল হয়ে মানুষ প্রকৃতির উপর কর্তৃত্ব করা শুরু করেছে। ফলে প্রকৃতি হয়েছে ভারসাম্যহীন। প্রকৃতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে বহু আন্তর্জাতিক সভা হয়েছে। অনেক দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশকে উন্নত দেশের কাছে মাথা নত করে ভিক্ষা করতে দেখা গিয়েছে। ভিক্ষালব্ধ অর্থ প্রকৃতির সেবা না করে এক শ্রেনীর আমলা ও ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদরা তসরুপ করে পকেট ভারী করেছে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলেই দান মারার আশায় এই শ্রেণীগুলোর চোখ আনন্দে লিকলিক করে উঠে। এসকল দেখে প্রকৃতিও ক্রুদ্ধ হয়ে একে একে মানুষের দিকে জীবাণু অস্ত্র ছুড়ে দেয়। প্রকৃতি জানে মানুষের কাছে পারমানবিক অস্ত্র, রাডার, ব্লাস্টিক মিসাইল প্রভৃতি আছে। এগুলোর সামনে সে খুবই নগণ্য ও অসহায়। এজন্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অণু দিয়ে গঠিত জীবাণুই তার ভরসা। নিজের সন্তানকে রক্তাক্ত দেখতে নিশ্চয়ই তার খুব খারাপ লাগে। সেজন্যই ছলে বলে কৌশলে সে মানুষের গলদেশে অনুপ্রবেশ করে টুটি চেপে ধরার কৌশল বেছে নেয় অথবা পাকস্থলীতে প্রবেশ করে পেট খারাপ করে মেরে ফেলে। শুধু মানুষ নয়, প্রাণি বা উদ্ভিদের ক্ষেত্রেও প্রকৃতি একই কাজ করে। যখনই উদ্ভিদ ও প্রাণি জগত প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে তখনই প্রকৃতি ভারসাম্য রক্ষার প্রয়োজনে আবির্ভূত হয় এবং অপ্রয়োজনীয় জীবনগুলোকে একে একে সংহার করে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে। প্রকৃতির জন্য এটা নৈমিত্তিক কাজ।

তবে প্রকৃতি যদি সাধারণদের আক্রমণ করত তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। বিত্তবানরা কোন না কোন ব্যাখ্যা দিয়ে একে জায়েজ করে নিত। সমস্যা হচ্ছে সামাজিক ও রাজকীয় প্রভাবশালীদেরও এই জীবাণু সমীহ করেনা। আর একারণেই প্রাকৃতিক এই নিয়ামক মানুষের কাছে ভীষণ ভীতিকর। মানব সমাজের যুদ্ধ রীতি যেমন প্রথমে সতর্ক করে, পরে প্রচলিত অস্ত্র ক্ষেপণ করে ও শেষে পারমানবিক মারণাস্ত্র ক্ষেপণ করে, প্রাকৃতিক জীবাণুগুলোও তেমনি করে সময়ে সময়ে আসে। যেমন প্রথমে সামান্য ফ্লুর মাধ্যমে জ্বর-কাশি দিয়ে মানুষকে সতর্ক করে , পরে ক্ষুদ্র পরিসরে হাম, যক্ষ্মা, কলেরা, আমাশয় জলোচ্ছ্বাস (প্রাকৃতিক দুর্যোগ) প্রভৃতি প্রচলিত জীবাণু দিয়ে মানুষকে শাসায় এবং সর্বশেষে লাখো লাখো মানুষ সংহারের ব্রত নিয়ে বিশ্বায়নী মহামারী জীবাণুগুলোকে প্রেরণ করে। মানুষ যদি প্রকৃতির এই ইঙ্গিতগুলোকে বুঝত অথবা নৈতিকভাবে সমীহ করত তাহলে আজকের এই সংকট উৎপন্ন হতোনা।

ধরে নেই যদি আজ থেকে দুইশত বছর আগে এই করোনা উহানে আসত, তাহলে কি হতো। তখন তো এখনকার মত যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। উড়োজাহাজ বা কোন যান্ত্রিকযানে করে একস্থান থেকে আরেক স্থানে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে এই জীবাণু ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব ছিলনা। জীবাণুদের ও একটা ধর্ম আছে। তারা নদী-নালা , পাহাড় –পর্বতকে সমীহ করে। কোন স্থানে এর প্রাদুর্ভাব হলে সে সেই স্থানের মানুষকেই আক্রান্ত করে। তারা নদী-নালা , পাহাড় –পর্বত ডিঙিয়ে অন্য জনগোষ্ঠীকে আক্রান্ত করা এদের নেশা বা পেশাও নয়। ফলে আজ থেকে দুশো বছর আগে করোনা হলে এর ব্যাপ্তি উহানেই সীমাবদ্ধ থাকত। আজ যে সারা বিশ্বে করোনার মাতম করা হচ্ছে এর জন্য তাহলে দায়ী কে? করোনা কি বলেছিল আমাকে বিশ্ব-পরিসেবায় নিয়োজিত করো? তবে করোনা জানে বিজ্ঞানের জোরে আধুনিক মানুষ অনেক বেশি দাম্ভিক। আপন মহিমায় তারা করোনাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেবে। মানুষের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উদ্ভিদ, প্রাণি ও পাখিরা নিরন্তর প্রকৃতির কাছে যে নালিশ দিয়ে আসছিল অবলীলায় তার প্রতিকার করা সম্ভব হবে। মানুষের সংখ্যা কমিয়ে পুনরায় প্রকৃতিকে নির্মল করা যাবে। শতবর্ষব্যাপি শিল্প কারখানার নামে মানুষ প্রকৃতিকে যেভাবে বিনষ্ট করে রেখেছে একবছর সময় পেলেই তা পুনরায় করা সম্ভব হবে।

দু’শ বছর আগে মানুষের কর্মহীন হওয়ার কোন সুযোগ ছিল না। মানুষ তখন ছিল প্রকৃতির সাথে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। এতো কর্ম হীন মানুষের অস্তিত্ব তখন ছিল না। এখন যেমন একটি নগরে যত লোক উপার্জনকারী প্রায় সমপরিমাণ লোক নিয়োজিত আছে তাদের সেবা প্রদানকারী হিসেবে। ভূমি থেকে বিচ্যুত এই মানুষেরাই করোনার আগমনে এখন উদ্বাস্তু। রাষ্ট্র ব্যবস্থা তার আরাম আয়েশের প্রয়োজনেই এদের নগরে টেনে এনেছিল। পুঁজিবাদী অর্থনীতির চাকচিক্যের আবরণে তাদের মোহিত করে ভুলিয়ে রেখেছিল। ভূমি কর্ষণের পেশা ত্যাগ করিয়ে ঘর মোছা, ঠ্যালা চালানো, রাস্তা পরিষ্কার করা, বাড়ি পাহারা দেওয়া, নিত্য-পণ্য সরবরাহ করা, রকমারি অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রি করা, আরো হাজারো প্রয়োজনে আয়েশিরা তাদের ব্যবহার করেছে। আজকের এই দুঃসময়ে আয়েশিরা তাদের পাশে নেই। এরূপ শ্রেনীগঠনে উৎসাহদাতা রাষ্ট্রও এখন তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ফলে নগরের চাকচিক্যে বিমোহিত কর্মহীন এই মানুষেরা করোনায় নয় বরং অনাহারে মৃত্যুর দিকে ঢলে পড়ছে। আর রাষ্ট্র এখন এর দায় করোনার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানব সমাজে ভয়াবহতা সৃষ্টিতে করোনার যতটা না ভূমিকা তারচেয়ে বেশি ভূমিকা হচ্ছে মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সমাজ কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় নিষ্ক্রিয়তা। বিশ্ব মহামারী সৃষ্টিতে এ পর্যন্ত যত জীবাণু পৃথিবীতে এসেছে তন্মধ্যে করোনাই প্রথমবারের মত এই উদ্বাস্তু শ্রেণির সাক্ষাৎ পেয়েছে। কর্মহীন এই মানুষের মৃত্যুর দায় মানুষকেই নিতে হবে, মানুষের কাছে করোনার এটাই বিশেষ আকুতি।

অধুনা সামাজিক মাধ্যমগুলোতে করোনার প্রতিকারে ধর্মগুলোর দিকে অঙ্গুলি দেখাচ্ছে। ধর্ম কেন বিজ্ঞানের দায় নেবে। এখনকার যে নগরায়ন, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি, উফশী ফসলের সমাহার, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল লুণ্ঠন করে পৃথিবীকে লেপটে দেওয়া, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করে মানুষকে দাম্ভিক করে তোলা, তার সবই তো হচ্ছে বিজ্ঞানের জোরে। বিজ্ঞান যদি তার বিশেষ জ্ঞানকে প্রকৃতি বান্ধব করে প্রয়োগ করত তাহলে সমস্যা ছিলনা। করোনা তো এসেছেই নৈতিকতা বিবর্জিত বিজ্ঞানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য। করোনার পূর্বে যে বিশ্বয়নী জীবানুগুলো এসেছিল সেগুলোর মোকাবেলা তো ধর্মীয় যাজকেরাই করেছিল। সেই সময়ের যাজকরা মানুষের সেবায় একে একে উপাসনালয়ের দুয়ারগুলো খুলে দিয়েছিল। যাজক ও তার শিষ্যরা গাজী অথবা শহীদী মনোভাব নিয়ে রোগীদের সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলেছিল। এখন যেমন কোনরূপ সৎকার ছাড়াই মৃতকে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়, এরূপ তারা করেনি। বরং মৃত ব্যক্তিকে নিজ নিজ ধর্মমতে তারা সৎকার করে সমাহিত করত। আজকের যে পিপিই তা স্পেনের মহামারীতে যাজকেরাই সূচনা করেছিল। মহামারী মোকাবেলায় তখন তাদের মধ্যে ছিল সুদৃঢ় মনোবল , নৈতিকতা ও মধ্যযুগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আদর্শিক চেতনা। ধর্মগুলো কৃষিভিত্তিক সমাজ ও অর্থনৈতিক ভিত্তির উপরে দাঁড়িয়ে মানুষের মধ্যে নৈতিক ভিত্তি গড়ে তোলে। আর পুঁজিবাদী অর্থনীতি মানুষকে নৈতিকতা বিবর্জিত বিজ্ঞানের উপর আস্থা তৈরি করে অনৈতিক সমাজ ও ব্যক্তিকে স্বার্থকেন্দ্রিক করে তোলে। একারণেই মহামারী মোকাবেলায় যাজকেরা যেমন স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে পীড়িতের পাশে ঝাঁপিয়ে পড়ত আধুনিক পেশাধারীরা তা করেনা। বরং নানারূপ প্রণোদনার দাবী ও অজুহাত তুলে মহামারীকে আরো বিভীষিকাময় করে তুলেছে। দু’শ বছর আগে যদি উহানে করোনা আসত তাহলে সেখানকার জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় যাজকেরাই ধর্মীয় অনুশাসনের আলোকে সমস্যার মোকাবেলা করত, নৈতিকতা সম্পন্ন মধ্যযুগীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকে লতাগুল্মের নির্যাস দিয়ে সেবা করত, সার্বক্ষণিক পাশে থেকে রোগীর মনোবল গড়ে তুলত ও ফুল চন্দন দিয়ে সাজিয়ে মৃত রোগীর সৎকার করে নিকট আত্মীয়দের কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ করত। মানুষ মৃত্যুকে ভয় পায় না, ভয় পায় পরিবার পরিজনহীন অনাদরের মৃত্যুকে। আর একারণেই মানুষ সন্তান-সন্ততী নির্ভর হয়ে বংশ বৃদ্ধি করে। বিদায়ক্ষণে আপনজনদের মুখাবয়াব ও অশ্রুসিক্ত নয়ন উভয়ের জন্য স্মৃতি হিসেবে জাগরুক থাকে। আবেগহীন শেষ বিদায়ের কারনে জীবিতরা এখন নিজেদেরকে অপরাধী ভাবছে। মানুষের মনের এখনকার আহাজারীর দায়িত্ব নেবে কে??

অধ্যাপক ড মোজাম্মেল হক

লেখক:
অধ্যাপক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগ বিশ্ববিদ্যালয়।

বাংলাদেশ সময়: ১:১১:৪৭   ১২১২ বার পঠিত   #  #