শনিবার, ৪ এপ্রিল ২০২০

“রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদ্দীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদ্দীন মাহমুদ
শনিবার, ৪ এপ্রিল ২০২০



জালাল উদ্দীন মাহমুদ

৯২ তম পর্ব–(৩য় খন্ড-৭ম পর্ব)

সপ্তপদী মার্কেট শাখা ,বগুড়া —- ,

গোডাউন কিপার -বাকী বিল্লাহ (৫ -শেষ)
১৯৯৩ সালের মে মাসে সপ্তপদী মার্কেট শাখা থেকে আমি বগুড়া শহরের বাদুড়তোলা শাখায় ম্যানেজার হিসেবে বদলি হই। বাদুড়তোলা শাখায় বছর চারেক ছিলাম। এ সময় বাকীর সাথে বলতে গেলে তেমন ঘনিষ্ট যোগাযোগ ছিল না। কদাচিৎ দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে থাকলেও থাকতে পারে। তবে এরপর আমি যখন বাদুড়তোলা শাখা থেকে বগুড়া সেনানিবাস শাখায় ম্যানেজার হিসেবে বদলি হয়ে যাই –তখন কাজের চাপে আমি বাকী সহ অনেকের কাছ থেকেই খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।
বগুড়ায় সম্ভবতঃ ১৯৯৯ সালে রাসায়নিক সার গোডাউনের প্লেজ ঋণ নিয়ে বিশাল এক কেলেঙ্কারী হয়। শুধু বগুড়াতেই নয় সারা দেশের প্রায় সব ব্যাংকেই এক সময় প্লেজ ঋণ নিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে। আরব্য উপন্যাস আলিফ লায়লা ওয়া লায়লা এর কাহিনি একহাজার এক রাত পর শেষ হয়েছিল। কিন্তু প্লেজ গোডাউনগুলি নিয়ে যত ভীতিকর কাহিনির সৃষ্টি হয়েছে এবং ব্যাংকারদের যত চাপা কান্না এসব কাহিনির সাথে জড়িত হয়ে আছে সে ইতিহাস হাজার বছরেও শেষ হবে না।
অনেকে নিরীহ ব্যাংকার যোগ্যতা ও ভাগ্য গুণে প্লেজ ঋণের ফাঁদ থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে –কিন্তু হায়! বাকী বিল্লাহ পারে নাই।
গোডাউন কিপার বাকী বিল্লাহ -এর সে কাহিনি সংক্ষেপে এখন বলতে চাই।
যতদিন আমি সপ্তপদী মার্কেটের ঋণ বিভাগের ইনচার্জ ছিলাম ততদিন বাকী বিল্লাহর সাথে আমার অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। বাকী বিল্লাহ ছাড়াও সেখানে আর একজন গোডাউন কিপার ছিল। সে পরবর্তীতে ব্যাংকে স্থায়ী হয়েছে। বাকী বিল্লাহ অত্যন্ত সৎ, ধার্মিক, রসিক, সজ্জন ছিলেন। পরবর্তী আমি ঋণ বিভাগ ছেড়ে সপ্তপদী মার্কেটের জেনালেল ব্যাংকিং শাখার অন্য দ্বায়িত্বে গেলেও একই শাখায় ছিলাম বিধায় তার সাথে বেশ কথা বার্তা হতো। পরে আমি বাদুড়তোলা হয়ে সেনানিবাস শাখায় বদলি হলে বাকীর সাথে যোগাযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এ সব তথ্য একটু আগেই জানিয়েছি। হাসি-খুশী ,সদালাপী –ধার্মিক বাকীর জীবনে এক সময় মহাবির্যয় নেমে আসে ,অতি সংক্ষেপে এখন তা বলতে চাই।

সপ্তপদী মার্কেট শাখায় সারের বিপরীতে প্লেজ ঋণ দেয়া হয় এবং গোডাউনের দ্বায়িত্ব গোডাউন কিপার বাকীকে দেয়া হয়। সেই প্লেজ ঋণের বিপরীতে ঋণ গ্রহীতা (সে অসাধু নাকি পরিস্থিতির শিকার তা আমি নিশ্চিত নই) গোডাউনে ডলোমাইট, জিপসাম, ম্যাগনেসিয়াম সালফেট, লাল রঙের মাটি, বালু, সোডিয়াম সালফেটের মতো ক্ষতিকারক দ্রব্য দিয়ে তৈরী করা ভেজাল সার সংগ্রহকরে রেখে দিয়েছিল । জৈব পদার্থের সাথে, জিপসাম, ডলোমাইট ও কালো রং মিশিয়ে সেন্ট্রিফিউজ মেশিনের সাহাযো দানাদার আকারে ভেজাল টিএসপি সার নাকি তখন অনেক স্থানে তৈরী হতো । এ সব আমার শোনা কথা। এটা কি ঐ ঋণগ্রহীতা করেছে নাকি সে এরককম ভেজাল সার নিজের অজান্তে কিনে নিয়েছিল , তা জানা নাই। তবে যেটা জানা তা হলো এ রকম ভেজাল সার সনাক্ত করতে তখন নাকি কৃষকরাও ব্যর্থ হতো। এছাড়া বিদেশ থেকে আমদানি করা সব সারও নাকি তখন মান সম্মত ছিল না। এক প্রতিবেদনে দেখেছিলাম বিদেশ হতে আমদানীকৃত টিএসপি সারের নমুনায় ৪৬% মোট ফসফেটের পরিবর্তে ৩৫-৪১% এবং ৪০% পানিতে দ্রবণীয় ফসফেটের পরিবর্তে ৩২-৩৫% পানিতে দ্রবণীয় ফসফেট পাওয়া গিয়েছিল। ব্যাংকারদের পক্ষে এ সব সনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব। ঐ ঋণগ্রহীতার বিপক্ষের কিছু লোক নাকি তাকে হেনস্থা করার জন্য মাঠে নামে এবং বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে জানিয়ে দেয় যে তার গোডাউনে ভেজাল সার আছে।

আমি বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করি নাই । গবেষণার সুযোগও ছিল না। তবে এক প্রতিবেদনে দেখলাম -চট্টগ্রামের টিএসপি কারখানায় উত্পাদিত এসএসপি সারে ভেজাল দেয়া এবং এগুলো বিক্রির ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম হওয়ায় মন্ত্রণালয় দেশে এসএসপি সার বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে ২০০৯ সালে এ সারকে ‘ব্যান্ড আইটেম’ ঘোষণা করে। ঋণগ্রহীতা কি এ রকম সার রেখেছিল ? তাহলে তো এটা জাতীয় সমস্যা ছিল । ব্যাংকাররা ফেঁসে গেল কেমনে? অনেক সময় এমনও দেখেছি ব্যাংকাররাও নিজেদের মধ্যে দলাদলি করে এক দল আর এক দল কে ফাঁসাতে চায়।

কাকের মাংস কাকে খায় না কথাটির অর্থ স্বশ্রেণীর অনিষ্ট কেউ করে না। কাকের গায়ের বর্ণ কালো। কাক পাখি হলেও এ পাখিটিকে কেউ পোষা পাখি হিসেবে লালন-পালন করে না। কাকের অন্ততঃ ৩টি বৈশিষ্ট থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া দরকার । প্রথমতঃ কাক সাধারণত ময়লা-আবর্জনা থেকে তার খাবার সংগ্রহ করে। খাওয়ার ব্যাপারে কাকের তেমন একটা বাছবিচার নেই। তবে কোনো বাছবিচার না থাকলেও এক কাক অন্য কাকের মাংস খায় না। এ ব্যাপারে কাকের নীতিবোধ ও নৈতিকতা প্রবল। কাকের আর দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, এরা খুব বেশি সমব্যথী। যে কোনো দুর্ঘটনায় একটি কাকের মৃত্যু ঘটলে আশপাশের সব কাক সেটিকে ঘিরে কা কা রবে সমবেদনা জানাতে থাকে। আবার দেখা যায়, একটি কাক অন্য কোনো পাখি বা প্রাণী দ্বারা আক্রান্ত হলে অপরাপর কাক সম্মিলিতভাবে আক্রান্তের প্রতিরক্ষায় এগিয়ে এসে আক্রান্তকারীকে প্রতিহত করতে সমবেত ভাবে সচেষ্ট হয়।
কাকের মাংশ কাক না খেলেও কিছু কিছু ব্যাংকার কর্তৃক অন্য ব্যাংকারদের বিনা কারনে ক্ষতিসাধনের অপচেস্টা চালাতে আমি দেখেছি। চরম দলাদলি দেখেছি। এসব কারনেই কিনা জানি না পেশাজীবি শ্রেণী হিসেবে ব্যাংকারদের সমাজের যে স্তরে অবস্থান নেবার কথা তা এখনও হয়ে ওঠেনি।

যা হোক অসাধু বা অজ্ঞ ঋণ গ্রহীতার কারনে ঐ গোডাউনের মালিক ও ঋণ গ্রহীতা সহ শাখা ব্যবস্থাপক, ঋণ কর্মকর্তা, গোডাউন কিপার বাকী সহ কয়েক জনের নামে পুলিশী কেইস হয়। সবাইকে জেল- হাজতে যেতে হয়। পরিস্থিতির স্বীকার নিরপরাধ বাকীকেও প্রায় আড়াই -তিন মাস জেল -হাজতে থাকতে হয়। এ সময় সে অনেককেই নাকি ধরাধরি করেছে। পরে অবশ্যই নিস্কৃতি মেলে। ততদিনে যা ক্ষতি হবার তাতো হয়েই গেছে। অস্থায়ী গোডাউন কিপার বাকী সর্বশান্ত হয়ে গেছে। পুলিশী কেইসের কারণে বাকী কে বোধ হয় অনেকদিন আত্মগোপনেও থাকতে হয়েছিল।

পরে মাননীয় আদালতের নির্দেশে সবাই চাকুরি ফিরে পেলেও অস্থায়ি গোডাউন কিপার বাকী চাকুরি আর ফিরে পায় নাই।

আমার পেস্টিং সেসময় শহর থেকে দুরে সেনানিবাস শাখায়। আমার সাথে তার আর যোগাযোগও হয় নাই। তার এক আত্মীয়ের অগ্রণী ব্যাংকে চাকুরি করার সুবাদে মাস ছয়েক আগে তার মোবাইল নং আমি পেয়ে যাই। সাথে সাথে কথা বলি।
এ লেখার সময় তার সাথে মোবাইলে আবার কথা হলো। দেখা করতে বললাম। বললো - সে ছুটি পাবে না। হাউজিং সোসাইটির ম্যানেজারের চাকুরি , ছুটি নাই। তবে দেশে ফ্যামিলি থাকে বিধায় মাঝে মধ্যে কেবল বাড়ী যাবার জন্য ছুটি মেলে। দুই মেয়ে। বড় মেয়ে অসুস্থ। তার স্বামী বেকার। বাকী বিল্লাহ তার রাস্ট্র বিজ্ঞানে পড়া জামাইয়ের জন্য আমার কাছে চাকুরি প্রার্থনা করল। বলল- সরকারী চাকুরিতো আর দিতে পারবেন না স্যার, যে কোন কোম্পানীর চাকুরি হলেই চলবে। হায় ! কোম্পানীর চাকুরিই বা আমি এখন কোত্থেকে দেই বাকীর মেয়ের জামাইকে। তবুও তো আমাকে চেষ্টা করতে হবে। চেষ্টা করলাম। কেউ বলে কমার্স গ্র্যাজুয়েট হলে এ চাকুরি দেয়া যেত, অ্যাকাউন্ট্যান্ট হলে এ চাকুরি দেয়া যেত। কেমিষ্ট হলে চাকুরি হতো। যেটা সে নয় সেটাই উল্লেখ করে বলে সে যদি এটা পড়ত বা এ লাইনে যদি ৫/১০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকত তাহলেও না হয় একটা কথা ছিল। কেউ বলে মাস কয়েক আগে বললেও একটা ব্যবস্থা করতে পারতাম। আমি সবই বুঝতে পারলাম কিন্তু বাকীকে আমি কি বুঝ দিব। আমি এখন আরো যা একটু চেস্টা করতে পারতাম করোনাভাইরাস নিয়ে সৃস্ট সংকট সে পথও রুদ্ধ করে রেখেছে।

হঠাৎ মনে পড়ল আজ থেকে বছর ত্রিশেক আগে আমাকে বেদনা নাশক মরফিন ইনজেকশন দেবার প্রতিক্রিয়ায় আমি একদিন বাকীকে আমার সব সম্পদ দিতে চেয়েছিলাম। আর আমার মাথা খারাপ হয়েছে ভেবে বাকী ডাক্তার -নার্সের কাছে ছুটাছুটি করেছিল। আজ সেই বাকী সম্পদ নয় শুধু একটা চাকুরি চায়। আমি কার কাছে ছুটোছুটি করব এ জন্য। আমারতো চাকুরি দেবার ক্ষমতা নাই। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ দেখি এক ক্ষমতাধর ব্যক্তি এসে বাকীকে বলছে বাকী সাহেব, আপনার মেয়ের জামাইয়ের জন্য কি ধরণের চাকুরি চাই। ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। যা চাবেন তাই দিব। আমি খুশী। তার জন্য দোয়া করতে যাব হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেল। স্বপ্ন দেখা যত সোজা বাস্তব যদি তত সোজা হতো। বিছানায় উঠে বসলাম।
জানালা দিয়ে রাতের আকাশ দেখা যাচ্ছে। এলাকায় এখন কারেন্ট নাই। শতশত তারা জ্বলছে আকাশে। মনে হলো আকাশের একটা তারা ছিঁড়ে এনে বাকীর হাতে দিয়ে বলি বাকি আপনার জন্য তো কিছু করতে পারলাম না এ তারাটা শুধু দিলাম। নিজেকে বড় অক্ষম মনে হচ্ছে। নিজের চুল নিজে ছিঁড়লে আমি হয়তো শান্তি পাব কিন্তু বাকীর তো কোনও লাভ হবে না।

তাবৎ দুনিয়ার অন্য সবাই কি শুধু আমার মত স্বপ্নের জাল বুনতেই ওস্তাদ? জানিনা। শুধু জানি স্বপ্নটুকু আছে বলেই সব কিছু নতুন করে সাজাতে ইচ্ছে করে। এমনকি আমার অতীতকেও। অতীতে ফিরে যেয়ে যদি বাকীকে গোডাউনের সে বিপদ থেকে বাঁচাতে পারতাম ! আবার অসার স্বপ্ন! শুনেছিলাম “কিছু মানুষ স্বপ্নের জগতে বাস করে। কিছু মানুষ বাস্তবে বাস করে। আর কিছু মানুষ আছে, যারা স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে”। আমি বোধ হয় শুধুই স্বপ্নের জগতেই বাস করে গেলাম।

বাকীর জীবনটা কেন এমন হলো ? সপ্তপদী মার্কেট শাখার তার সমসাময়িক অন্য একজন গোডাউন কিপার কবেই স্থায়ী হয়েছে। ব্যাংকের ঋণে বাড়ী ঘর করে সুখেই আছে । আর সৎ - সিনসিয়ার বাকী আজ অন্যের বাড়ী ঘরের হিসাব রাখতেই ব্যস্থ। হায় ভাগ্য ! এক সাথে চলা শুরু করে আমরা অনেকেই বাকীর মত পিছনে পড়ে যাই। ফলে আমাদের পরিবার পরিজনও পিছনে পড়ে যায়। আবার আমাদের পিঠে পা রেখে অনেকে উপরে উঠার সিঁড়ি পেয়ে যায়। আমাদের দাবির কথা ঠিক মত বলতেও পারিনা। এ ভাবে আমরা একদিন অযোগ্য হয়ে পড়ি । ক্লান্তিতে পেয়ে বসে। আমাদের এ ব্যর্থতা কে ক্ষমা করবে ? রবীন্দ্রনাথের ভাষায় প্রার্থনা জানাই-
ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু,
পথে যদি পিছিয়ে পড়ি কভু।
এই-যে হিয়া থরথর
কাঁপে আজি এমনতরো
এই বেদনা ক্ষমা করো
ক্ষমা করো প্রভু।
এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু,
পিছন-পানে তাকাই যদি কভু ।  (ক্রমশ)

****************************************

বাংলাদেশ সময়: ২০:১৬:৩৭   ১০৩৪ বার পঠিত   #  #  #