বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী ২০২০
দিল্লিতে কী হচ্ছে -গোলাম দস্তগীর লিসানী
Home Page » এক্সক্লুসিভ » দিল্লিতে কী হচ্ছে -গোলাম দস্তগীর লিসানী
বঙ্গ-নিউজ: দিল্লিতে কী হচ্ছে আসলেই কি জানেন?
এর ফলে কী হবে, সেটা?
এই বিপদে, অথবা এই বিপদ কেটে যাবার পর এমন যে কোন বিপদে আমাদের করণীয় কী?
—–
(বড় লেখা, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ঠান্ডা মাথায় পড়া দরকার। সোর্স ছাড়া একটা কথাও বলিনি। বানোয়াট গল্প নেই। বীভৎসতা ভাললাগেনা তাই ছবি ও ভিডিওগুলো দিচ্ছি না।)
আমি দু’মাস আগে একটা কথা বলেছিলাম, ভারতের মুসলিমরা, ইউরোপ আমেরিকা চলে যাওয়া শুরু করুন। এখনো বলছি, যদি বিন্দুমাত্র সুযোগ থাকে, যদি সম্পদ থাকে, ইউরোপ আমেরিকা চলে যাওয়া শুরু করুন। সময় পাল্টালে ভারতে ফেরত যাবেন। এখন থাকার কোন মানে হয় না। আপনি বেঁচে থাকলে, আপনি টিঁকে থাকলে, আপনি উন্নতি করলে উম্মাহ্’র লাভ। আপনি ক্ষতিগ্রস্ত হলে উম্মাহ্’র ক্ষতি।
কিছু ভিডিও দেখলাম, পুলিশ ঢুকছে অলিগলিতে, পেছনে পেছনে ঢুকছে বিজেপির দাঙাবাজরা। এরপরই সেসব অঞ্চল জ্বলা শুরু। নারীদের সম্ভ্রম লুট করা শুরু। পুলিশ পিটিয়ে রাস্তায় শুইয়ে দিয়ে ভারতের জাতীয় সংগীত গাওয়াচ্ছে, তারপর সেটা পুলিশই ভিডিও করছে, তারপর উল্লাস করছে, ‘স্বাধীনতা’ বলে! এমনভাবে গুলি করেছে, আহতের কোন হিসাব নিকাশ নেই।
কীসের ১৯ জন নিহত? বুলশিট! ১৭ ঘন্টা আগের খবর, দিল্লির একটা হাসপাতালেই ৩৫ টা লাশ। কত লাশ এখনো হাসপাতালে পৌছায়নি? আর কয়টা হাসপাতালে কয়টা লাশ আছে? নতুন করে কয়টা লাশ পড়ছে?
মেয়েদের উপর হচ্ছে অত্যাচার। কনফার্মড নিউজ। ঘরে ঘরে ঢুকে এ কাজ করা হচ্ছে। হিন্দু বাড়িগুলোর অনেকগুলোতেই দরজায় গেরুয়া পতাকা টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে। যেসব বাড়িতে গেরুয়ঢা পতাকা নেই, সেসব বাড়ি অ-বিজেপি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। দলে দলে দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ছে হেলমেট পরা লাঠি হাতে উগ্রবাদীরা। কেউ কেউ বলছে মেয়েদের বাঁচানোর একটাই পথ, শাখা সিঁদুর পরিয়ে দাও আপাতত।
মুসলিমদের বাড়ির পর বাড়ির পর বাড়ি পুড়ছে। ঘর পুড়ছে। এত বেশি পরিমাণে, এত বেশি ছড়ানো এলাকাজুড়ে যে, দেখলে অসম্ভব মনে হয়। এমনকি বাড়িঘর পোড়ার দৃশ্যটাও সহ্য করা সম্ভব না। এত বিস্তৃত অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন বাড়ি একই সাথে পোড়া কখনোই সম্ভব না- যদি না রাস্তা বিজেপির কর্মীদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়।
মসজিদ পুড়ছে। মসজিদের মিনারে উগ্রহিন্দুত্ববাদের পতাকা উড়ছে। মসজিদের ইমামদের মুআজ্জিনদের মেরে ফেলার মত করে পেটানো হচ্ছে।
মাজার ধ্বংস করা হচ্ছে। ধ্বংস করা হচ্ছে একের পর এক পাবলিক কবরস্থানও। রেহাই নেই। বাদ যাবে না কোন শিশু।
বিবস্ত্র করে রাস্তায় হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার আগে পিটিয়ে আধমরা করা হয়েছে। সেই বিবস্ত্র দেহ পিচের সাথে ঘষটে ঘষটে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। এইটা একটা মেসেজ। না পাবার কী আছে। এটা একটা মেসেজ। মেজরিটি যখন এটা সেলিব্রেট করে, তখন সুস্থতা আসা অনেক দূর।
একদিকে পুলিশ ঘোষণা দিয়েছে ‘দেখামাত্র গুলি’ অপরদিকে পথঘাট সব উগ্রবাদিদের দখলে। পথে যাকেই দেখছে তাকেই ‘জয়শ্রীরাম’ নিশ্চিত করতে বলছে। দাঁড়ি বা টুপি বা পাঞ্জাবি দেখলেই রক্তাক্ত।
গণপিটুনি থেকে হিন্দু পরিচয় নিশ্চিত করার পর অনেকে দ্রুত রেহাই পাচ্ছে।
শুধু কি মাঠে? অনলাইনে? টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউবে? সুস্পষ্টভাবে দেশছাড়া করার কথা, সুস্পষ্টভাবে বিনাশ করে দেয়ার কথা বলছে মোদিবাদিরা। কিছু পড়লাম, কিছু দেখলাম।
দিল্লিতে স্রেফ প্র্যাকটিস হচ্ছে। দিল্লিতে যে ঘরগুলো জ্বলছে, যে মসজিদ-মাদ্রাসা-মাজার-কবরস্থান ধ্বংস হচ্ছে, যে নারীদের সম্ভ্রমহানি হচ্ছে, যে মানুষরা মারা যাচ্ছে- এটা প্রতীকমাত্র। সংখ্যায় অনেক, কিন্তু প্রতীকমাত্র। এটা দাঙা নয়। এটা পুলিশের ছায়ায় সাম্প্রদায়িক বিলোপ। দাঙা হল দু’দল পরস্পরকে মারবে। পুলিশের ছায়ার তলে যখন গলিতে গলিতে বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে যায়, সেটাকে দাঙা বলে না।
পুলিশকে পাশে রেখে কীভাবে মুসলিমদের ধ্বংস করতে হয়, সেটার সফল ট্রায়াল তো মোদি গুজরাতের মূখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ই দিয়েছে। আবার সেই ট্রায়ালের দ্বিতীয় মহড়া হচ্ছে দিল্লিতে।
আমাদেরকে জিনিসটা ঠিকভাবে চিনতে ও বুঝতে হবে।
এটা একটা মেসেজ।
মেসেজটা হল, তুমি মুসলিম, তোমার নিজের কোন ঘর নাই। মসজিদেও তুমি নিরাপদ না। মাজারেও না। কবরস্থানেও না। কবরের ভিতরেও না। নিজের বাপ দাদা চোদ্দ গুষ্টির নিজস্ব এলাকার ভিতরেও না।
যদি বসে থাকো, মরবে।
যদি মারতে ওঠো, আরো বেশি করে মরবে।
যদি ভারতে থাকো, যেখানেই থাকো, মরবে।
আমরা বিজেপিরা এটা করবো এবং তোমার এলাকায় তোমার জন্মস্থানে ঢুকেই করব। তোমার চোদ্দ পুরুষের ভিটায় ঢুকেই করব। সংঘাত বাঁধবে, আমি মরব না, তুমি মরবে। পুলিশ আমার সাথে, তোমার সাথে নাই। মোদি আমার সাথে, তোমার সাথে নাই।
ওদের ক্লিয়ার মেসেজ, কোনও ঘরে যেহেতু নিরাপদ থাকতে পারবা না, বাংলাদেশ বা পাকিস্তান চলে যাও। দেখতেই পাচ্ছো, মসজিদ-মাজার বা নিজের ঘর কোথাও তুমি নিরাপদ না। বাংলাদেশ বা পাকিস্তান চলে যাও।
তারা কারা? সাধারণ ভারতিয়দের একটা দলই তো? খুব ঠান্ডা মাথায় তারা ভিডিওতে বলছে, আমরা মসজিদ-মাজার-মাদ্রাসা-ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছি। আমরা আমাদের দেশকে ভালবাসি। করেছি, আরো করব। সিম্পল বিষয়। ভিডিওতে বলছে, ‘কোপ খেতে খেতে হলেও মুসলিমরা রামের নাম নিবে।’
টাইম ইজ দ্য বেস্ট হিলার।
মোদির দল এখন সারা ভারতে এটা বাস্তবায়ন শুরু করতে চাচ্ছে। যে কোন মূল্যে।
এদের এই সুযোগ দেয়া যাবে না। যদি এই সুযোগ দেয়া হয়, তবে তারা সারা ভারতে এটাই করবে।
এখন যদি তারা এটা করার সুযোগ না পায়, সামনে দিন পাল্টেও যেতে পারে। সামনে তাদের ক্ষমতা নাও থাকতে পারে।
এখন টিঁকে থাকার সময়।
মুসলিম পরিচয় নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় না।
এখন প্রাণ বাঁচানোর সময়। একটা মুসলিম প্রাণ বাঁচা মানে ভারতে একটা মুসলিম বেশি থাকা। একটা ভোট বেশি থাকা। একটা কণ্ঠ বেশি থাকা। এক জোড়া হাত বেশি থাকা। শহিদ হওয়াই সব নয়।
প্রয়োজনে দাঁড়ি চেঁছে ফেলুন। কুর্তা লুকিয়ে শার্ট প্যান্ট পরে ফেলুন। প্রয়োজনে মুসলিম চিহ্নগুলো লুকিয়ে ফেলুন। ঈমান আপনার অন্তরের ভিতরে। ওটা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। ভারতের আপনাকে প্রয়োজন। বিশ্বমানবতার আপনাকে প্রয়োজন। মুসলিমদের আপনাকে প্রয়োজন। আপনি চলে গেলে একজন কমে গেল। এটাই আপনার শত্রু চায়। তার পারপাস সার্ভ হতে দেবেন না।
এখন আমাদের যে কোন মূল্যে ভারতে টিঁকে থাকতে হবে। টিঁকিয়ে রাখতে হবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকেও। আমরা ভারতে টিঁকে থাকতে পারলে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে টিঁকিয়ে রাখতে পারলে উগ্রবাদ বিনষ্ট হবে। আমরা যদি টিঁকে থাকতে না পারি, ভারত যাবে, বাংলাদেশ যাবে, পাকিস্তান যাবে।
বাংলাদেশকে টিঁকিয়ে রাখার পদ্ধতি একটাই। এটাই ভারতের মুসলিমদের এবং অ-মুসলিমদেরও টিঁকিয়ে রাখার পদ্ধতি।
বাংলাদেশে, মুসলিম নয়, এমন কারো উপর হামলা না করা। অমুসলিমদের কোনও স্থাপনার উপর হামলা না করা। যদি কেউ বাংলাদেশে অমুসলিমদের স্থাপনা, সম্পদ ও প্রাণের উপর হামলার ডাক দেয়, তাকে দ্রুত নিরস্ত করা, প্রয়োজনে পুলিশে ইনফর্ম করা। ভারতে, প্রতিহামলা না করা। এই লড়াইকে ধর্মীয় রূপ দিলে আমরা টিঁকতে পারব না, এই সত্য কথাটা আমাদের মাথার গোবরের ভিতর পুঁতে দেয়ার সময় এসেছে।
এই তিনটা দেশতো নামমাত্র।
মানুষ যাবে।
নামে না ভারতিয়, বাংলাদেশি, পাকিস্তানি- কাজে তো এই অঞ্চলের মানুষ। এদের শেষ হতে দেয়া যাবে না।
নিশ্চিত থাকুন, কেউ লাঠি নিয়ে মোদি-অমিতকে তেড়ে আসবে না। সৌদরা না, আম্রিকা না, ইজ্রায়েল না, চীন না, রাশা না- কেউ না। না জাতিসংঘ না ওপেক না ওআইসি- কেউ কিছু করবে না। স-ব তাদের। নিশ্চিত থাকুন, মোদিরা যে পরিমাণ উপযুক্ত মাঠ পেয়েছে, এই পরিমাণ উপযুক্ত মাঠ পেলে এমন উগ্রবাদিরা কখনো সুযোগ ছাড়ে না।
এখনার বাস্তবতায়, যদি কেউ এটা ঠেকাতে পারে, তো ভারতের সাধারণ জনগণ ঠেকাতে পারে। আর কেউ না। বাকী রইল বাংলাদেশ বা পাকিস্তান- পারার প্রশ্নই ওঠে না। কোনও জঙ্গিবাদি দল পারার প্রশ্নই ওঠে না।
বাস্তবতাটা আমাদের বুঝতে হবে।
ধৈর্য্য ধরুন। প্রস্তুত থাকুন। আল্লাহ্’র উপর ভরসা রাখুন এবং মাথা ঠান্ডা রাখুন। সম্ভব হলে ভারত থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করুন। সবচে ভাল অপশন ইউরোপ আমেরিকা। প্রতিবেশী ও পরিচিতদের মধ্যে আন্তরিক হিন্দুর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুন। শিখদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুন। খ্রিস্টানদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুন। বিপদে তাদের বাসায়, গুরুদুয়ারায়, গির্জায় আশ্রয় নিন। যখন একটা দেশের পুলিশ ও সেনাবাহিনি র্যাডিকালাইজড হয়, তখন আপনারা সিভিলিয়ানরা আপরাইজ করে কিছু করতে পারবেন না। হ্যা, মা-বউ-বোনকে ঝুঁকিতে রেখে ‘শহিদ’ হয়ে যেতে পারবেন। এই শহিদি কী পারপাসটা সার্ভ করল? আপনি শহিদ হলেই কি একটা দেশের ট্রেইন্ড সেনাবাহিনি ও পুলিশের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবেন? বিশেষত পুলিশের ঠিক পেছনের কাতারেই যখন তারা আপনার ঘরে ঢুকবে, যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট দিয়ে জেনেশুনে মোদি অমিতকে এনেছে? পারবেন না।
আমাদেরকে বোধের পুণ:সংজ্ঞায়ন করতে হবে। ‘হয় আমি, নাহয় তুমি’ চলবে না। উগ্র হিন্দুরা যেমন পুরো ভারত থেকে মুসলিম বিনাশ করতে পারবে না, উগ্র মুসলিমরাও তেমনি পুরো ভারত থেকে হিন্দু বিনাশ করতে পারবে না। এর কোনটাই হয় না। আমরা সেই বিপদের ভিতর দিয়ে এখন যাচ্ছি, মধ্যযুগে যে বিপদের ভিতর দিয়ে ইহুদিরা গিয়েছিল। তারা তখন যদি টিঁকে গিয়ে থাকতে পারে, এবং এখন নিয়ন্ত্রণশক্তিতে পরিণত হয়ে থাকতে পারে, আমাদের পক্ষেও যে কোন বিপদে টিঁকে যাওয়া সম্ভব এবং ভবিষ্যতে কল্যাণপ্রভা ছড়ানো সম্ভব। চরম বিপদে কীভাবে টিঁকতে হয়, সেটা ইতিহাস আমাদের বারবার শিক্ষা দিয়েছে। ইতিহাসে যা ঘটে, তা বারবার ঘুরে ঘুরে ঘটে। তখন কে কোন্ স্টেপ নিয়ে টিঁকে গিয়েছিল, আর কে কোন্ ভুল পদক্ষেপ নিয়ে ভেসে গিয়েছিল- সে শিক্ষাটা নেয়াই শুধু বাকি, আমাদের মনে রাখতে হবে এটুকু।
আমরা পুড়ব, মরব, ভাঙব, প্রয়োজনে বিবর্তিত হব, প্রয়োজনে লুকিয়ে যাব, প্রয়োজনে নিজের পরিচয় পর্যন্ত লুকিয়ে ফেলব, প্রয়োজনে দেশান্তরি হব- কিন্তু ফুরাবো না, কেউ ফুরিয়ে দেয়ার ছুতো পাবে, সেটাও হতে দিব না। এটাই আমাদের অস্তিত্ব-সূত্র।
গোলাম দস্তগীর লিসানী
লেখক ও গবেষক
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৫২:০৪ ৮৫০ বার পঠিত #Golam Dastagir Lisani #গোলাম দস্তগীর লিসানী