বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০২০
কোচিং সেন্টার ট্রেডলাইসেন্স,শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের চূড়ান্ত ধাপ
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » কোচিং সেন্টার ট্রেডলাইসেন্স,শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণের চূড়ান্ত ধাপ
সদ্য চূড়ান্তকৃত শিক্ষানীতিমালায় সকল প্রকার প্রাইভেট কোচিং বন্ধ ঘোষণা করলেও অনুমতি দেয়া হয়েছে বানিজ্যিক কোচিং সেন্টার। যেটাকে শিক্ষা বাণিজ্যিকীরণেরই চূড়ান্ত ধাপ হিসেবেই দেখছেন দেশের শিক্ষাপ্রেমী সমাজ।তাও আবার কোন স্কুল কলেজের শিক্ষকরা ওখানে শিক্ষকতা করতে পারবেনা।তার মানে দাঁড়ালো অশিক্ষক দ্বারাই পরিচালিত হবে এসব কোচিং সেন্টার।আর এখানেই আমার প্রশ্ন, যত বড় শিক্ষিতই হোক একজন মানুষ, তাই বলে পেশাগত দক্ষতাকে কি তিনি ডিঙ্গাতে পারবেন? মনে রাখা উচিত শিক্ষিত হওয়া আর শিক্ষক হওয়া এক নয়।কারন অনেক সাধনা করে একজন শিক্ষক পেশাগতভাবে দক্ষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেন।তাই যদি না হতো তাহলে মাননীয় কর্তা ব্যাক্তিদের কাছে আমার প্রশ্ন হাজার হাজার শিক্ষককে হাজার হাজার টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণের দরকার আছে কি যদি সেই অশিক্ষকরাই যোগ্য হয়ে যায়? তাছাড়া সরকারে দ্বিমুখী নীতিতে বিভ্রান্ত হচ্ছে সকলেই। যেমন একদিকে বলা হচ্ছে সকল প্রকার প্রাইভেট কোচিং বন্ধ,অপরদিকে বলা হচ্ছে বানিজ্যিক কোচিং চলবে তাও আবার বলা হচ্ছে পেশাদারি কোন শিক্ষক ওখানে শিক্ষকতা করতে পারবেনা।তাহলে জনগণ কোনটা বুঝবে? হয় এটা বলা হোক কোচিং বৈধ, চলবে, তবে স্কুল কলেজের শিক্ষকরা থাকতে পারবেনা কারন ওদের কোন উন্নতি হোক, সামাজিক সম্মান পাক তা আমরা চাইনা নতুবা বলা হোক কোচিং অবৈধ।এটা সস্পূর্ণ রূপে বন্ধ।মাঝখানে আবার নাকো নাকো ভাবে চলবে চলবেনা এই দ্বৈতনীতির কি দরকার বলুন? আমি একজন শিক্ষক হিসেবে বলতে চাই কোচিং সেন্টার বন্ধ হলেই ভালো কারন কোচিং করে সব শিক্ষক লাভবান নয় গুটি কয়েক ছাড়া। অধিকন্তু প্রশ্নফাঁস,ছাত্রদের নম্বর কম দেয়া,মানসিক হেনস্থা করা সহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে কোচিং ও কোচিংবাজ শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।অতএব সরকারের কোচিং নিষিদ্ধের ব্যাপারটিকে আমি ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি।এমনকি কোচিং এ জড়িত থাকার সম্ভাবনা যে সব শিক্ষক যেমন গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজী বিষয় সংশ্লিষ্ট,আমি তাঁদেরই একজন (গনিত শিক্ষক) হিসেবে বলছি কোচিং নিষিদ্ধ হোক (শিক্ষকতা করতে আসছি,মহৎ পেশায় আসছি ব্যবসা করতে নয়) কারন কোচিং নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মাঝে অন্তর কোন্দল পর্যন্ত দেখা দেয়।যার চড়া মূল্য দিতে হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। তাই বলে বানিজ্যিক কোচিং চলবে এটা মেনে নিতে পারিনা।আমাদের ছাত্রগুলো কোন অশিক্ষকের হাতে নিরাপদ মানতে বা ভাবতেই পারিনা।এর প্রধান কারনগুলো হলো-
১।বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারে শিক্ষার্থীরা শিক্ষককে ভাই বলে যেটা শিক্ষা জগতের কলংক।কারন শিক্ষার্থীরা বেয়াদব হওয়ার জন্য এটাই প্রধান ধাপ।ওইখানে ভাইয়ের সাথে আড্ডা দিয়ে বিদ্যালয়ে এসেও একই আচরন করে বা করতে চায়।
২।ওই সব কোচিং এ শিক্ষার্থীদের পড়ার বদলে বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা হয় বেশি যাতে করে শিক্ষার্থীরা আকৃষ্ট হয় বেশি।কারন তারা শিক্ষার্থীদেরকে ক্লায়েন্ট হিসেবে দেখে,শিক্ষার্থী হিসেবে নয়।কে শিক্ষিত হলো আর হলোনা এটা তাদের বিবেচ্য নয়।কারন শেষ হিসেব তাদের উপর ম্যানেজিং কমিটি বা শিক্ষা কর্মকর্তা কেউ ভর্তাবেনা।
৩।পাঠ্য পুস্তক না পড়িয়ে কেবল পরীক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয় ফলে পাঠ্যবই বিমুখ হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা।
৪।কোচিং আসক্ত ৮০% শিক্ষার্থীই স্কুল বিমুখ হয় কারন সময় মেইন্টেইন করতে পারেনা যা বিদ্যালয়গুলো নৈমিত্তিক কার্যকলাপে বিরুপ প্রভাব পড়ে।
৫।কোচিং এ কৌশল করে গার্ডিয়ান খুশি করতে সব বিষয় পড়াতে গিয়ে গণিত ও ইংলিশ দুটি বিষয়েই শিক্ষার্থীরা দুর্বল হয়ে পড়ে।যে কারনে দুটো বিষয়েই খারাপ ফল করে।
৬। কোচিং এর শিক্ষকরা টেম্পরারি হওয়ায় পাশের দায়বদ্ধতা তারা নিতে চায়না।ফলে অনেকটা গাঁ ছাড়া ভাবে শিক্ষাদান করেন তারা।
৭। কোচিং এর কারনে শিক্ষার্থীরা নিয়মিত স্কুলে না আসায় ছাত্র শিক্ষক শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় ফলে স্কুলে আন্তরিক ক্লাস নেয়া সম্ভব হবেনা।
৮।শিক্ষার্থীদের রটেশনে অনুপস্থিতির দরুণ শিক্ষক ক্লাসে নিরুৎসাহবোধ করে ফলে উপভোগ্য পাঠদান সম্ভব হয়না।
৯।এমন অনেক নজির রয়েছে কোচিং সেন্টার দিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে কয়েক বছর পর অধিক লাভের আশায় একাডেমি খুলে প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান করে ফেলেছে।কোচিং এর ট্রেড লাইসেন্স পেলে ওরা আরো বেপরোয়া হয়ে প্রচার প্রচারনা চালাবে এবং পূর্বের কাজটি আরো করবে ফলে শিক্ষা বানিজ্যিকিকরনের ষোলকলা পূর্ণ হবে এবং সরকারি/বেসরকারি স্কুল/কলেজগুলো ছাত্র শূন্যতায় বন্ধের উপক্রম হবে।ফলে শিক্ষানীতি সহ সকল পরিকল্পনা বঙ্গোপসাগরে পতিত হবে।
১০। বর্তমানে শিক্ষকদের যা বেতন স্কেল ফলে অধিক লাভের আশায় অনেক দক্ষ শিক্ষক চাকরি ছেড়ে কোচিং ব্যবসা শুরু করতে পারে। ফলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ১২ টা বাজার পথ দ্রুত সুগম হতে পারে।
১১।কোচিং পড়োয়া স্টুডেন্টরা ক্লাসে অমনোযেগি হয় কারন তারা মনে করে কোচিং এ সব শিখে ফেলবে। এই ধান্দায় স্যারের কথা সে শুনতে চায়না এবং অন্যদের সাথে গল্পগুজব করে।ফলে নিজেতো নষ্ট হয়ই বরং আরো ১০ টাকে নষ্ট করে।
১২।কোচিং এর অদক্ষ শিক্ষকরা অনেক সময় ভুল শিক্ষা দেন কারন বর্তমান সৃজনশীল বইগুলো বেশ দুর্বোধ্য।আর প্রশিক্ষণ বিহীন এসব শিক্ষক নিজে না বুঝে বাচ্চাদের অনেকাংশে ভুল শেখান যা জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেবার জন্য যথেষ্ট।
অতএব, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমার আকুল আবেদন, কোচিং যদি বৈধতাই দিতেই হয় তাহলে শিক্ষক সংশ্লিষ্ট কোচিংকেই দেন।প্রয়োজনে যেটা করতে পারেন কোন শিক্ষক কোচিং এ নিজের বিদ্যালয়ের একটি ছাত্রকেও পড়াতে দেবেননা।তাহলেই শিক্ষার্থী হয়রানির মত অভিযোগগুলোও আসবেনা এবং সামগ্রিক ফলাফল আপগ্রেড হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।তা না হলে অশিক্ষক দিয়ে কোচিং বৈধতা দিলে হয়তো সরকার কয়টাকা ট্যাক্স পেতে পারে তবে শিক্ষার্থীদের কোন উপকার তো হবেই না অধিকন্তু অভিভাবকরাও টাকা গুনতে গুনতে দিশেহারা হতে হবে সেই সাথে অতিশখের শিক্ষানীতির স্থান হবে ভাগারে।
লেখক
জীবন কৃষ্ণ সরকার,
কবি ও প্রাবন্ধিক
সভাপতি,হাওর সাহিত্য উন্নয়ন সংস্থা (হাসুস) বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ২০:০৭:৪৫ ১৬৫২ বার পঠিত