শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী ২০২০
কোটা বৃত্তান্ত ও মেধাবীদের অপমৃত্যু
Home Page » সংবাদ শিরোনাম » কোটা বৃত্তান্ত ও মেধাবীদের অপমৃত্যু
স্বাধাীনতার প্রায় ৫০ বছরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আজও দেশটিতে একটি শ্রেনীকে লালন পালন করে সমাজে টিকিয়ে রাখতে হচ্ছে এই লজ্জ্বা দেশের না কি এই দেশে জন্ম নেয়া দুর্ভাগা মেধাবীদের তা আমার বোধগম্য নয়।
এই পোষ্য তথা পালিত পদ্ধতির ইতিহাসটা একটু দেখে নেয়া যাক।ইতিহাস ঘেঁটে যদ্দুর জানা যায়,
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য উপহার হিসেবে ১৯৭২ সালে কোটা চালু করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তখন মুক্তিযুদ্ধাদের বিশেষ সম্মানার্থেই এই কোটাটি চালু করেছিলেন তিনি।তখন সরকারি কর্মচারী নিয়োগে মেধা কোটা ছিল ২০ শতাংশ। এছাড়া ৪০ শতাংশ জেলা কোটা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ১০ শতাংশ ছিল যুদ্ধাহত নারী কোটা। ১৯৭৫ এর পরিবর্তন আসে কোটায়। ১৯৭৬ সালে মেধা কোটায় বরাদ্দ হয় ৪০ শতাংশ, জেলা কোটায় ২০ শতাংশ ও আগের মতোই মুক্তিযোদ্ধা কোটা রাখা হয় ৩০ শতাংশ।
১৯৮৫ সালে আবারও পরিবর্তন আনা হয় কোটা ব্যবস্থায়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ শতাংশ, জেলা কোটায় ১০ শতাংশ ও নারীদের জন্য ১০ শতাংশ পদ সংরক্ষণ করা হয়। আর প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য রাখা হয় ৫ শতাংশ কোটা।
১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য বিশেষ সম্মাননা হিসেবে আবার কোটা চালু করেন। আর সমাজের পিছিয়ে পড়াদের জন্য কোটা পদ্ধতি তো চালু আছেই। সবশেষ ২০০৯ সালের ২০ ডিসেম্বর জেলা ভিত্তিক কোটা নির্ধারণ করা হয়।
ভারতীয় উপমহাদেশে কোটার প্রচলন প্রথম শুরু হয় ১৯১৮ সালে। সিভিল সার্ভিসে ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় ভারতীয়দের জন্য আলাদা কোটার ব্যবস্থা করা হয় তখন থেকে। পরবর্তী সময়ে শিক্ষায় অনগ্রসর মুসলমানদের জন্যও আলাদা কোটা রাখা হয়। পাকিস্তান আমলে পিছিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) মানুষদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে চালু করা হয় প্রদেশ ভিত্তিক কোটা। স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সংস্থাপন সচিবের এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে বাংলাদেশে।
বর্তমানে দেশে প্রথম শ্রেণীর চাকরি বাদে সকল কিছুতেই মুক্তিযোদ্ধার ছেলে ও মেয়ে, নাতি-নাতনি কোটা, জেলা কোটা, উপজাতি কোটা, পোষ্য কোটা, নারী কোটাসহ বিভিন্ন কোটা বিদ্যমান।
এই হচ্ছে কোটা তথা পালিত কোটার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।বিস্তারিত লিখলে ২০০০ শব্দেও কোটা বৃত্তান্ত শেষ হবেনা।সেদিন নিজের চিকৎসার জন্য ওসমানী হাসপাতালে গেলাম এক্সরে রিপোর্ট আনতে। সেখানে লাইনে দাঁড়িয়েও দেখলাম বিশেষ কোটাভিত্তিক লাইন।মাত্র দুজনের লাইন। দু ঘন্টা দাঁড়িয়ে আমার সুরাহা নাহলেও ওরা ঠিকই ১ ঘন্টা পরে এসেও ১ ঘন্টা আগে রিপোর্ট নিয়ে চলে গেলো,শুধুই দেখলাম আর নির্বাক মনে নিজেকে বুঝ দিলাম এই ভেবে যে কোটা যুক্ত বিশ্বে যতটুকু আছি এমন ভালো থাকাটাই তো ভাগ্যের ব্যাপার।আমিতো নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান জন্মে এই দেশে!
উপরে কোটা প্রেক্ষিত এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন।ধরুণ আপনার সন্তানকে বার বার হাত ধরে হাঁটা শেখাচ্ছেন। তার পরো হাঁটা না শেখায় বাঁচ্চার জন্য একজন মানুষ রেখেছেন তাকে হাটানো জন্য।এটা আপনার দায়িত্ব। ঠিক সেটাই ছিল মুলত কোটা ব্যবস্থা।সেটাই করে গিয়েছিলেন আমাদের মহান স্থপতি জাতির পিতা। কিন্তু এই ভাবে যদি ১০ বছরেও বাঁচ্চাটি হাঁটতে না শেখে তাহলে বুঝে নিতে হবে এই বাঁচ্চার হাঁটার ইচ্ছেই নেই অতএব তাকে হুইল চেয়ারের ব্যবস্থা করলেই উত্তম। আর দির্ঘমেয়াদী হেল্পের কারনে সে ভাবতে শিখেছে যে একজন লোক নিয়ত তাকে হাত ধরে হাঁটাবেই এটা তার অধিকার এবং এটা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। তাই কোন সময় কেউ এসে তাকে হেল্প না করলে সে চেঁচিয়ে উঠে।ঠিক তেমনি আগে কোটা করে অনগ্রসরদের অগ্রাধিকার দেয়া যুক্তি যুক্ত হলেও স্বাধীনতার ৪৯ বছরে এসে কোটা রাখা অনেকটা সেই পালিত বাঁচ্চার মতোই হচ্ছে।অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে ওদের আর অগ্রসর হওয়ার ইচ্ছেটাই নেই। ওরা কখনোই তো দাঁড়াতে শিখবেই না বরং যখনই একটু সুযোগ হারাচ্ছে তখনই তারা ঐ বাঁচ্চা ছেলের মতই চেঁচামেচি করছে যা প্রাথমিকের ফল নিয়ে রিট করার মধ্য দিয়ে প্রমানিত।অনগ্রসর জাতি বা গোষ্ঠির প্রতি বিশেষ নজর নিঃসন্দেহে সরকারের প্রসংশনীয় উদ্যোগ।তবে সেটা কি কেবল চাকরি দিয়েই বাস্তবায়ন করতে হবে? সরকার চাইলে ওদেরকে বিনা শ্রমেও তো বেতন দিতে পারেন তাহলে তো ওদের সম্মান আরো বাড়বে।কাজ করিয়ে বেতন দিয়ে এমন কি ক্রেডিট রয়েছে যে ওদেরকে বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে? অপরদিকে অফিস আদালতে যোগ্য ব্যক্তির দরকার হয়,শিক্ষকতায় যোগ্য ব্যক্তির দরকার হয়,সেখানে বিশেষ সুবিধা দিয়ে অযোগ্যদের পদায়ন করা মেধাবীদের সাথে রীতিমত মস্করা নয় কি? তাহলে রাত -দিন খাটুনি করে পড়া লেখা করার কি-ই বা অর্থ থাকলো।আর এভাবে হতাশ হয়ে অনেক মেধাবীর অপমৃত্যু হচ্ছে যা নতুন মেধাবী সৃষ্টির অন্তরায়।ড. শহীদুল্লাহ বলেছিলেন “যে দেশে গুণীজনের কদর নেই,সেদেশে গুণীজন জন্মায় না” তাহলে আমরা তো ঠিক সেদিকেই যাচ্ছি! সময় থাকতে বিষয়গুলো ভাবতে হবে নতুবা অসময়ে পস্তাতে হবে সকলকেই।মহান মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারকে সম্মানিত করতে কি চাকরিটাই যথেষ্ট? যারা জীবন ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করে এই দেশটা স্বাধীন করেছে তারা তো এদেশের মালিক,ওদের সন্তানরা তো দেশের মালিক পক্ষ।তাই মালিকদের কি সাধারণের সাথে এসে মজুরি ভুক্ত হওয়াটা খুব বেশি সম্মানের! তার চেয়ে বরং মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের প্রতিটি সন্তানের জন্য বিনাশ্রমে একটি স্ট্যন্ডার্ড মানের চাকরির ভাতা দিয়ে দিলে কি দেশের খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে? বরং মেধাবীরা দেশ চালালে দেশ দ্রুত উন্নতির শিখরে যাবে।ফলে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীর সেনানী ও তাঁদের উত্তরসুরীদের বীরের মতই এদেশে রাখা যাবে,চাকরির নামে চাকরের মত সুযোগ দেয়াটা কি খুব বেশি সম্মানের?।সময় এসেছে এখন এগুলো ভাববার,পর্যালোচনার।
একটা সময় ছিল মানুষ কোন কিছু উপরন্তু পাওনাকে “করুণা” হিসেবে দেখতো।কারো থেকে কিছু নেয়াকে নিজের অসহায়ত্ব মনে করতো।আজকাল আর তা মনে হয়না। জাতি হিসেবে আমরা আজ নির্লজ্বের স্বর্গভূমের দিকেই যাচ্ছি দিন দিন।করুণায় কিছু পাওয়াকে আমরা এখন আর দান হিসেবে দেখিনা বরং অধিকার হিসেবেই দেখি।ভিক্ষুক ও এখন দুটাকা পাওয়াকে করুণা মনে করে না বরং দুটাকা তো দূরের কথা ন্যূনতম ৫ টাকা না দিলে হাতেই নেয়না।আরো বেশি চায়।মনে হয় ভিক্ষায় কিছু পাওয়াটা তার জন্মে জন্মান্তরের অধিকার।
প্রসঙ্গক্রমেই এসে যায় সদ্য ঘোষিত প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ব্যাপারটি।কিছু সংখ্যক পোষ্য কোটাধারী রিটকারির আবেদনে উত্তীর্ণ ১৮০০০ মেধাবীর নিয়োগ প্রক্রিয়াটি প্রায় থমকে গেছে।অথচ কর্তৃপক্ষ বলছে তারা কোটা অনুসরন করেই নিয়োগ দিয়েছেন।কিন্তু যোগ্য না পাওয়ায় তারা পুরুষ প্রার্থীদের নিয়োগ দিয়েছেন।তারপরও কোটাধারিরা ক্ষ্যান্ত নন।তারা আইনি লড়াইয়ে যাচ্ছেন বলে হুমকি অব্যাহত রেখেছেন।কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা মানুষকে অন্ধ করে তুলবে এটাই স্বাভাবিক।
এখানে কোটাধারীদের প্রতি একটা প্রশ্ন ধরুণ আপনার একটা কোম্পানি রয়েছে।আপনি সেখানে ১০০ জন লোক নেবেন সেখানে ৬০ জন মহিলা ৪০ জন পুরুষ নেয়ার ইচ্ছা আপনার।কিন্তু নিয়োগ পরীক্ষার পর আপনি দেখলেন পুরুষ প্রার্থী ৮০ জন পেয়েছে ৭০% নম্বর আর মহিলা ২০ জন পেয়েছে ৬০% নম্বর বাকি মহিলারা ২০% নম্বর পেয়েছে।তাহলে আপনি একজন কোম্পানির মালিক হয়ে ঐ নিয়োগটিতে কতজন পুরুষ আর কতজন মহিলা নিয়োগ দিতেন? নিশ্চই বাধ্য হয়েই অধিক পুরুষ নিতেন আপনার কোম্পানীর লাভের জন্য।ঠিক তেমনি রাষ্টযন্ত্র তার উন্নতির জন্য কিছু যোগ্য পুরুষ নিয়োগ দিতেই পারেন। আর তাতেই আপনাদের গাঁ জ্বলে উঠলো? নিজের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটলে বুঝি এমনই হতে হয়? খুব বেশি অন্যায় করে ফেলেছে বুঝি সরকার! আর তাই রিট করে বসলেন দল বেঁধে।নিজেকে দুর্বল,পালিত ভাবতে ন্যূনতম বাঁধেনা।একটা বিশেষ শ্রেণী সমান অধিকারের জন্য সারা জনম আন্দোলন করলেও অদ্ভুত ব্যাপার স্বার্থের বেলায় তারা বেশি অধিকার না পেলে, অন্যের সমান হলেও তারা আবার ক্ষেপে যান।সত্যি সেলুকাস!ছাত্র জীবন থেকে এই সার্কাস দেখতে দেখতে এখন আর কিছু বলতে ইচ্ছে করেনা।কবে আপনারা নিজেকে বুদ্ধিতে, জ্ঞানে অন্যদের সমান করবেন নাকি এভাবেই নিজেকে ধন্য মনে করেন জানিনা।নিজেকে সমাজের বিশেষায়িত প্রাণী না ভেবে অন্যদের মতই ভাবুন তাহলে নিজেও উন্নতি করবেন,নিজের বংশধররাও উন্নতি করতে পারবে।নতুবা সারা জনম ওদেরও রিট করতে করতেই সারা জনম যাবে।
এটা কি ধরনের মানসিকতা যে আমি উচ্চ পর্যায়ের চাকরি করলেই আমার সন্তান কে বিশেষায়িত ভাবে উচ্চ চেয়ারে বসাতে হবে? তাহলে ঐ চেয়ারে বসতে যে কঠোর রাস্তা পাড়ি দিতে হয় তার কি মর্যাদা থাকলো? তাছাড়া চেয়ারের মর্যাদা, উপযুক্ততা সেটা কি ঐ বিশেষায়িত অযোগ্য ব্যক্তিটি বুঝবে? আরে ভাই কোটা নেবেন আর নিজের অযোগ্যতাটি আপনি স্বীকার করবেননা এটা কি ধরনের মানসিকতা?এটা কি ধরনের এটিচিউটড আপনার?
আর এই পালিতদের জন্যই দেশে মেধাবীরা মার খাচ্ছে বার বার । দেশ থেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে অনেকে। আমি কোন চাকরি প্রার্থী নই।তার পরও আজকের এই অত্যাধুনিক যুগে আমার চাওয়া আগামী প্রজন্ম কোটা মুখাপেক্ষতা থেকে মুক্তি পাক,মুক্তি পাক কোটার অভিশাপ থেকে,জয় জয়কার হোক মেধাবীদের।রইলাম কোটামুক্ত জন্মভুমির অপেক্ষায়।সংশ্লিষ্টদের কাছে আমার জোড় অনুরোধ।
লেখক
জীবন কৃষ্ণ সরকার
কবি ও প্রাবন্ধিক
সভাপতি, হাওর সাহিত্য উন্নয় সংস্থা (হাসুস) বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ সময়: ১৭:৩৩:২৭ ১১৫৫ বার পঠিত