রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯
জীবন সংগ্রামে হারনামা একজন সাজু মিয়া
Home Page » বিবিধ » জীবন সংগ্রামে হারনামা একজন সাজু মিয়াপ্রতিবন্ধী শব্দটির সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত।প্রতিবন্ধী বলতে এমন এক ব্যক্তি যিনি জন্মগতভাবে বা রোগাক্রান্ত হয়ে, দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বা অপচিকিৎসায়, অন্য কোনো কারণে দৈহিকভাবে বিকলাঙ্গ বা মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন এবং উক্তরুপ বৈকল্য বা ভারসাম্যহীনতার ফলে স্থায়ীভাবে আংশিক বা সম্পুর্ণ কর্মক্ষমতাহীন এবং স্বাভাবিক জীবনযাপনে অক্ষম”।
তেমনি একজন জীবন সংগ্রামে হারা না মানা মানুষ সাজু মিয়া।একদিন আমাদের মোহাম্মদ আলীপুর বাজারে সাজু মিয়ার সাথে আমার ছোটভাই সাংবাদিক আল-আমিন আহমেদ সালমান এর সাথে দেখা। এক পা নেই, তবে কোনও গাড়ি বা অন্যকিছু ব্যবহার করে না। দুটি খাঁচার (লাঠি) উপর ভর করে হাঁটে ।আমার ভাই জিজ্ঞেস করল ‘আপনার সন্তানাদি আছে?’
বললেন, ‘হ্যাঁ আছে, আল্লাহর মাল তিন ছেলে।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনার মা-বাবা আছে?’
— না।
– আপনার বাড়ি কোথায়?
আমার পিতৃনিবাস গড়াকাটা।বর্তমানে থাকি দাতিয়াপাড়া গ্রামে ।
সে বসবাস কর সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর থানার বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়নের দাতিয়াপাড়া গ্রামে।তার পিতৃনিবাস একই ইউনিয়নের গড়াকাটা গ্রামে।তার বাবা মৃত কালাচাঁন মিয়া।সাজু মিয়ার মতো বহু বিকলাঙ্গ মানুষ বাংলাদেশের ৬৪ জেলার সব গ্রাম ও সব জেলাশহরেই দেখা যায়। তাদের মধ্যে অনেকের সহায়সম্বল আছে, আবার অনেকের-ই নেই। যাদের সহায়সম্বল আছে, তাদের পরিবার পরিজনরা বিরক্তির মাঝেও তাদের দেখে। যাদের সহায়সম্বল নেই, তারা তাদের পরিবারপরিজনের কাছে ও সমাজের মানুষের কাছে সর্বাদাই অবহেলিত। তারা তাদের অবহেলিত জীবন বাঁচানোর তাগিদে, বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে। কেউ নিজের জন্মভূমি ছেড়ে অন্য জেলাশহরে চলে যায়। শহর বন্দরে গিয়ে প্রথমে কোনও রেললাইনের পাশে, না হয় কোনও বস্তিতে আশ্রয় নেয়। এরপর জীবন বাঁচানোর জন্য শুরু করে দেয় ভিক্ষাবৃত্তি।
যাইহোক বলছিলাম, সাজু মিয়ার কথা।সালটা ঠিক মনে নেই তার । তবে ২০-২২ আগে দাতিয়াপাড়া গ্রামের ফুলজান বিবির সাথে মাত্র ২০ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। বিবাহের ১০ বছর পর থেকেই শশুর বাড়ি দাতিয়াপাড়া গ্রামেই বসবাস শুরু করেন সাজু মিয়া।শশুর বাড়িতে তার পরিবার নিয়ে সুখেই ছিল।তার বড় ছেলে সুজন, মেঝো ছেলে স্বপন এবং ছোট ছেলে রিপন।বড় ছেলে বিয়ে করে তার সংসার থেকে আলাদা।
বছর তিনেক আগে জমিতে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ করে তার পা কিছু একটার মধ্যে লেগে কেটে যায়।কাটা স্থানটি ঔষধ খাওয়ার পর সেড়ে গেলেও, মাস তিনেক পরে আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটিতে ঘা হয়ে যায়।প্রচণ্ড ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে বিভিন্ন জায়গায় ডাক্তার ও কবিরাজের সম্মুখীন হন। কিন্তু কারোচিকিৎসায় সাজু মিয়ার ভালো হয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।অবশেষে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিশেজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হলে ডাক্তার তার পা অপারেশন করে কেটে ফেলে দেওয়ার পরামর্শ দেয়।সাজু মিয়ার বাবার রেখে যাওয়া কিছু জায়গা জমি ছিল তা বিক্রি করে কোনোমতে তার চিকিৎসা হয়।তারপর ঘরে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে অনেক দিন। সন্তান ও স্ত্রীর মুখে তুলে দিতে হবে খাবার এই নিয়ে সে খুব চিন্তিত। তবুও সে হাল চাড়েনি।যেভাবেই হোক তার স্ত্রী ও ছেলেদের মুখে দুবেলা দুমোঠো খাবার তুলে দিতেই হবে।সেই চিন্তায় যেন সাজু মিয়ার রাতদিন পার হয়না।সুস্থ হয়ে ওঠার পর জীবন সংগ্রামে হার না মানা সাজু মিয়া একজনের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেশী মোরগ সংগ্রহ করে বাজারে বাজারে বিক্রি করা শুরু করে।অসুস্থ হওয়ার আগে সে মাঝে মাঝে সবজির ব্যবসা করত।সল্প আয়েই তার সংসার কোনো রকম চলে।
সাজু আলাপকালে অশ্রুসিক্ত নয়নে জানান,আমি বিকলাঙ্গ হওয়ার পর যখন দুচোখে অন্ধকার দেখছিলাম।তখন অভাবের তাড়নায় আমি কারোও কাছে হাত পাতিনি।আমাদের ইসলাম ধর্মে ভিক্ষা ভিত্তিকে নিষেধ করা হয়েছে এবং জীবিকাকে হালাল করা হয়েছে।তাই আল্লাহর রহমতে আমি সম্মানজনক ভাবে বাঁচতে চেয়েছি।যার ফলে আমি আমি সল্প পুঁজি নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেশী মোরগ সংগ্রহ করে বাজারে বাজারে বিক্রি করা শুরু করি।এভাবেই তিন বছর ধরেই আমার সংসার ও দুই ছেলের পড়াশোনার খরচ চলছে।
তবে কিছুদিন আগে বংশীকুন্ডা দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আজিম মাহমুদ তাকে একটি বাংলাদেশ সরকারের পঙ্গু ভাতার কার্ড করে দিয়েছে।
এসব অসহায় বিকলাঙ্গ ও প্রতিবন্ধী মানুষগুলো বাঁচতে চায়। আর বেঁচে থাকার জন্য আমাদের কাছে কিছু চাইতেই পারে। চলতে পারে না, অনেক কষ্ট করে ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে কিছু চায়। কেউ দেয়, আবার অনেকেই দেয় না। অনেকে হাসিমুখে কিছু দেয়, অনেকে আবার কালামুখ করে তাদের কাছে মাফ চায়। কেউ আবার দুরদুর করে তাড়িয়েও দেয়। তা একেবারে অনুচিত বলে আমি মনে করি। তাদের আদর যদি কেউ না-ই-বা করতে পারে, অন্তত ঘৃণা না বা দুরদুর না করা উচিৎ নয়। তারাও আল্লাহর প্রেরিত সেরা জীব মানুষ। আমরাও সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। আল্লাহর প্রেরিত সকল জীবের প্রতি সম্মান দেখানোই আমাদের উচিৎ। অঙ্গহীন বা বিকলাঙ্গ মানুষগুলো, সমাজ বা কারোর মাথার বোঝা নয়। কারোর ঘৃণার পাত্রও তারা কেউ নয়। তারা তাদের ভাগ্যের উপরেই নির্ভর করে বেঁচে থাকে। যেমন বেঁচে আছি, আমি আমরা।
পরিশেষে কবি’র সেই বিখ্যাত কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে গেল ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তার উপরে নাই।
লেখক //
গুলশান আরা রুবী, কবি ও কথাসাহিত্যিক,gulshanarauddin@gmail.com
বাংলাদেশ সময়: ১৯:৪৮:৩৭ ১০৯৫ বার পঠিত