রবিবার, ১৯ মে ২০১৯

আম্রপালী আমের নামকরণের ইতিহাস (শুরু থেকে ২৩ টি পর্ব একত্রে):জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » আম্রপালী আমের নামকরণের ইতিহাস (শুরু থেকে ২৩ টি পর্ব একত্রে):জালাল উদদীন মাহমুদ
রবিবার, ১৯ মে ২০১৯



 জালাল উদদীন মাহমুদ

 

আম্র পালী আমের নাম করণের ইতিহাস –এ পর্যন্ত সূচনা ছাড়াও ২৩ পর্বে প্রকাশিত হয়েছে। পর্বগুলি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলেও অনিয়মিত ছিল। তাই অনেকের পক্ষেই হয়তো সবগুলি পর্ব পড়া সম্ভব হয় নাই। কেউ কেউ কিছু পর্ব মিস করায় “আম্র-পালী ” সংক্রান্ত সব পর্ব একত্রে দিতে অনুরোধ এসেছে। নীচে সূচনা সহ ২৩টি পর্ব একত্রে দিলাম। পাঠকদের জন্য বিভিন্ন সময়ে আমার লেখা থেকে এগুলো একত্র করেছেন স্নেহের কৃষিবিদ নুর-এ-আল মুক্তাদির তানিন, এসপিও / ব্যবস্থাপক, অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড, পল্লবী শাখা, ঢাকা। তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।
****************************

একটি নতুন জাতের আম যা যশোর, সাতক্ষীরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, নড়াইল, মাগুরা ওপার্বত্য এলাকায় বেশী উৎপাদিত হয় , তার নাম কি ? তার নাম আম্র-পালী ।

আম্র পালী - আমের সাথে জড়িত আছে এক অপরুপা সুন্দরী মহিলার নাম। তিনি এখন থেকে ২৫০০ বছর আগে জন্মেছিলেন । ২৫০০ বছর আগে জন্ম নেয়া ভারতের সেই শ্রেষ্ঠ নর্তকীর নাম ছিল আম্র পালী। তার রূপে আগুন জ্বলতো | সেই আগুনে ঝাঁপ দিতে চায় সবাই |

ঘন আমবনে গাছের নিচে এক পরিত্যক্ত কন্যাশিশুকে খুঁজে পেয়েছিল এক নিঃসন্তান বিত্তহীন দম্পতি | তারা তার নাম রাখেন আম্রপালী।আমগাছের নিচে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন বলে এই নামই রাখা হয়েছিল | সংস্কৃতে আম্র মানে আম এবং পল্লব হল পাতা | অর্থাত্ আমগাছের নবীন পাতা | সেই বালিকা কৈশোরে পা দিতে না দিতেই নিদারুণ সমস্যায় পড়লেন তার বাবা মা | সমস্যার কারণ মেয়ের রূপ । আম্রপালী কে নিয়ে রিতীমত যুদ্ধ বেধে যায়| খ্রিস্টের জন্মের ৫০০-৬০০ বছর আগে | ভারতবর্ষের বৈশালী রাজ্যে (বর্তমান বিহার রাজ্য)| গ্রামের মহাজন, শহরের বণিক, জনপদের রাজা সবাই তাকে পেতে চায় ? সাধারণ মানুষ তাকে এক নজর দেখার জন্য অস্থির । কি হবে আম্র পালীর ?

আম্র পালীর রুপে-গুণের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে তাকে বিবাহ করার জন্য বহু রাজপুত্র উদগ্রীব হয়ে উঠলেন,ক্রমে তাঁরা পরস্পরের মধ্যে কলহে প্রবৃত্ত হতে লাগলেন। তা দেখে আম্র পালীর পিতা চিন্তিত হয়ে পড় লেন ,কারণ কণ্যার পাণিপ্রাথীদের মধ্যে যাঁকেই তিনি বিমুখ করবেন তিনিই হয়ে উঠবেন তার ঘোরতর শক্র। উপায়ান্তর না দেখে তখন আম্র পালীর পিতা শহরের গণ্য-মান্য ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শের জন্য এক সভা আহ্বান করলেন। সেই সভায় আম্রপালীর বিবাহ প্রসঙ্গ উপস্থাপন করা হলে সভাস্থ ব্যক্তিবর্গ আম্রপালীকে সভায় উপস্থিত করানোর জন্য আম্র পালীর পিতাকে অনুরোধ জানালেন। পিতার আদেশে কন্যা আম্রপালী সভায় উপস্থিত হয়ে-সমাজপতিদের চাপে যে সিদ্ধান্ত নিল তা জানাব কিনা ভাবছি। বিষয়াবলী অশ্লীল মনে হতে পারে। তবে সব কিছু বিবেচনা করতে হবে সে সময়ের প্রেক্ষাপটে।

আম্রপালী বাস করতেন বৈশালী শহরে । বৈশালী ছিল প্রাচীন ভারতের একটি শহর। এটি বর্তমানে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বিহার রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রত্নক্ষেত্র । গৌতম বুদ্ধ একাধিকবার বৈশালীতে এসেছিলেন। তাঁর সমসাময়িক কালে বৈশালী ছিল একটি সমৃদ্ধ ও বর্ধিষ্ণু শহর। চীনা পর্যটক ফাহিয়েন (খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতাব্দী) ও হিউয়েন সাংয়ের ভ্রমণবিবরণীতে বৈশালী শহরের কথা উল্লিখিত হয়েছে।
বৈশালীতে তৎকালীন প্রচলিত নিয়মানুসারে সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণী বিবাহ করতে পারতেন না তিনি হতেন গণভোগ্যা। অতএব সর্বাঙ্গসুন্দরী রমণীরুপে স্বীকৃতা আম্রপালীকেও এই প্রচলিত নিয়ম শৃঙ্খলে আবদ্ধা হতে হবে। সমাজপতিরা বিধান দেয়, আম্রপালী কোনওদিন বিয়ে করতে পারবেন না | কারণ এত রূপ যৌবন নিয়ে তিনি কোনও একমাত্র পুরুষের ভোগ্যা হতে পারেন না |

সেদিনের সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, আম্রপালী হবেন বৈশালীর নগরবধূ ( অনেকে বলেন নগরবধূর ইংরেজী courtesan. courtesan মানে a woman, usually with a high social position, who in the past had sexual relationships with rich or important men in exchange for money. | অর্থাত্ বহু পুরুষের ভোগ্যা ) | বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থে তাঁকে জনপদকল্যাণী বলেও উল্লেখ করা হয়েছে | এই জনপদকল্যাণী বা নগরবধূ কিন্তু সামান্য গণিকা বা দেহপসারিণী নন | তিনি হবেন নৃত্যগীতে পারদর্শী, অভিজাত আদবকায়দায় রপ্ত এক সুন্দরী | উচ্চবংশের পুরুষই পেতে পারবেন তাঁর সঙ্গসুখ | জনপদকল্যাণী নিজেই নিজের সঙ্গী নির্বাচন করতে পারবেন | কিন্তু বিয়ে কোনওদিনও নয় | তাঁকে লক্ষ্য করে সে আমলে বৈশালীতে নতুন আইন তৈরি হয়ে গেল, অনিন্দ্য সুন্দরী নারী কখনও পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হতে পারবেন না। জনসাধরণের আনন্দের জন্য তাঁকে উৎসর্গ করা হবে।

এইসব সিদ্ধান্ত সেদিনের সভায় গৃহীত হলে আম্রপালীর পিতা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ও বিচলিত হয়ে পড়লেন,কিন্ত সভায় গৃহীত এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো রকম প্রতিবাদ করতেও সাহসী হলেন না। স্নেহময় পিতার মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে আম্রপালী তখন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে সভায় এই সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় শিরোধার্য করে নিলেন। আম্রপালীর উক্ত শর্তগুলি ভীষণ অশ্লীল মনে হবে। সে গুলি জানাব কিনা বুঝতে পারছি না।
বিচারকেরা রায় দিলেন, ‘আম্র-পালীকে নিয়ে লড়াইয়ের দরকার নাই। ও সকলের হবে । রাস্ট্রের নির্দেশে দেহ ব্যবসার ঘটনা পৃথিবীতে এই একটিই।

আম্র-পালী তখন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে তাকে বহুভোগ্যা নগরনটী করার সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় শিরোধার্য করে নিলেন।

আম্রপালীর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ
(ক) নগরের সবচেয়ে মনোরম স্থানে তাঁর গৃহ নির্মিত হবে।
(খ) একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশাধিকার পাবেন।
(গ) তাঁর দর্শণী হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(ঘ ) শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে সপ্তাহ অন্তে মাত্র এক দিন তাঁর গৃহে অনুসন্ধান করা যাবে।
(ঙ) তাঁর গৃহে আগত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না।

আম্রপালীর উক্ত পাঁচটি শর্তই উক্ত বিচারকদের সভা কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল।

এরপর বারবিলাসিনীরূপে আম্রপালীর জীবনের নতুন অধ্যায় আরম্ভ হল। কালক্রমে তিনি প্রচুর অর্থ-সম্পদের অধিকারিণী হলেন। রাজাদের থেকে কম ছিল না আম্র-পালীর সম্পদ | জনপদকল্যাণী হওয়ার সুবাদে তিনি ছিলেন বৈশালীর রাজনর্তকী | সুবিশাল উদ্যান, মর্মর অট্টালিকা ছিল তাঁর সেবায় নির্মিত ।
আম্রপালী বিভিন্ন স্থান থেকে দক্ষ চিত্রশিল্পীদের আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসেন এবং তাঁদের দ্বারা তখনকার রাজা,মন্ত্রী, সম্ভ্রান্ত নাগরিক এবং ধনাঢ্য ব্যাক্তিগণের প্রতিকৃতি নিজ গৃহের প্রাচীরে অম্কিত করিয়েছিলেন।এই সকল প্রতিকৃতির মধ্যে মগধরাজ (বর্তমানে ভারতের বিহার) বিম্বিসারের(৫৫৮ খ্রিঃপূঃ – ৪৯১ খ্রিঃপূঃ) প্রতিকৃতি দেখে আম্রপালী মোহিত হন এবং মগধরাজের সহিত মিলনের জন্য অধীর হয়ে ওঠেন। অপরপক্ষে মগধরাজ বিম্বিসারও আম্রপালীর অপ্সরীতুল্য রূপের খ্যাতি শুনে তাঁকে দেখার জন্য অত্যন্ত আগ্রহী হন।

আম্রপালীর রূপের আগুনে ঝাঁপ দিতে চাইলেন মগধরাজ বিম্বিসার । রাজা বিম্বসার ছিলেন মগধের (বিহারের) প্রথম ঐতিহাসিক রাজা।

কবি জীবনানন্দ দাসের ”বনলতা সেন ” -কবিতাটির প্রথম স্তবকের তৃতীয় লাইনে কিন্তু এই বিম্বিসার –এর নাম লেখা আছে।
আমি বুঝতে পারছি না রাজা বিম্বিসার ও আম্র-পালীর সে প্রেমকাহিনী লিখব না সরাসরি আম্র-পালী আমের বিষয়ে চলে যাব। সন্মানিত পাঠকবৃন্দ ,দয়া করে কি আপনাদের মতামত জানানো যাবে?
“বনলতা সেন’ কবিতাটি সম্ভবত বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক পঠিত বাংলা কবিতাগুলোর একটি।

”বনলতা সেন ” -কবিতাটির প্রথম স্তবকে যে বিম্বিসার –এর নাম লেখা আছে সেই রাজা বিম্বিসার – এর সাথে কিন্তু আম্র পালীর প্রেম হয়েছিল।তবে বিম্বিসার-এর বিবাহ-প্রস্তাব হেলায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আম্রপালী | বিম্বিসার-এর পুত্র অজাতশত্রও আম্রপালীর রুপে মুগ্ধ হয়েছিল। সে কাহিনী পরে বলা হবে।

‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,

সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে

অনেক ঘুরেছি আমি;

বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে

সেখানে ছিলাম আমি;

আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;

আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,

চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,

আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

ব্যাখ্যাঃ-কবিতাটির প্রথম স্তবকে কবি হাজার বছর ব্যাপী ক্লান্তিকর এক ভ্রমণের কথা বলেছেন । তিনি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে ফিরেছেন;- যার যাত্রাপথ সিংহল সমুদ্র থেকে মালয় সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত। তার উপস্থিতি ছিল বিম্বিসার ও অশোকের জগতে যার স্মৃতি আজ পুরাতন তাই ধূসর। আরো দূরবর্তী বিদর্ভ নগরেও স্বীয় উপস্থিতির কথা জানাচ্ছেন কবি। এই পরিব্যাপ্ত ভ্রমণ তাকে দিয়েছে অপরিসীম ক্লান্তি। এই ক্লান্তিময় অস্তিত্বের মধ্যে অল্প সময়ের জন্য শান্তির ঝলক নিয়ে উপস্থিত হয়েছিল এক জন রমণী। কবি বলেছেন তিনি নাটোরের বনলতা সেন। বিম্বিসার ও আম্রপালীর সে প্রেম -কাহিনী আগামী পর্বে ।

প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসের শুরু খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে। এর আগেও যে প্রাচীন ভারতে রাজনৈতিক ইতিহাস ছিল না তা নয়, তবে সেই ইতিহাস আজও তেমন স্পষ্ট নয়।

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে প্রাচীন ভারতে ষোলোটি স্থানীয় রাজ্য গড়ে উঠেছিল । প্রাচীন বৌদ্ধ গ্রন্থসমূহ ও প্রাচীন জৈন গ্রন্থ সমূহে এ ১৬ টি রাজ্যের উল্লেখ আছে। এই ১৬ টি রাজ্যের মধ্যে মগধ ছিল অন্যতম। এই মগধের (বর্তমানে ভারতের বিহার) রাজা ছিলেন বিম্বিসার । বিম্বিসার মাত্র পনেরো বছর বয়সে মগধের রাজা রূপে অভিষিক্ত হনেএবং ৫৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মগধ শাসন করেন।

অন্যদিকে এই ১৬টি রাজ্যের মধ্যে অন্যতম ছিল বজ্জি রাজ্য। এই রাজ্যের রাজধানী ছিল বৈশালি। এই বৈশালিতেই বাস করতো সুন্দরী আম্র-পালি। আম্র-পালির রাজ্যের রাজার সাথে বিম্বিসারের ভীষন শত্রতা ছিল।

তাহলে তারা কিভাবে একে অপরের কথা জানতে পারলো ?
কিভাবে তাদের দেখা হলো?
কিভাবে বা প্রেমই হলো ?

সে এক বিশাল কাহিনী । এ বিশাল কাহিনী শোনার ধৈর্য্য কি সবার হবে ?

প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যের রাজা ছিলেন বিম্বিসার । তিনি রাজ্য বিস্তার করে সাম্রাজ্য গঠনের উদ্দেশ্যে বহু বিবাহ করেছিলেন । স্ত্রীর সংখ্যাটা শুনে যেন কেউ ভয় না পায় । তার স্ত্রীর সংখ্যা ১০০ নয়, ২০০ নয়- , ৩০০ নয় , ৪০০ নয় , ৪৫০ও নয় ৪৯৯ও নয় । তার চেয়েও বেশী । সংখ্যাটা একটু পরে জানাব।

না , সংখ্যাটা এখনই জানাই । তার স্ত্রীর সংখ্যা ছিল ৫০০ ! হ্যাঁ, পাঁচশ ।

উপরের অংশটি পড়লে সবারই বিম্বিসারের চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারনা সৃষ্টি হবে । মনে হবে, লোকটি কেবল তার নিজের কামনা-বাসনাকে চরিতার্থ করেছেন। তার জীবনে কি প্রেম-ভালবাসা ছিল ? এত স্ত্রী থাকতে তাঁর জীবনে প্রেম –ভালবাসা আসার কোনও প্রয়োজনই নাই । তার পক্ষে ভালবাসা প্রেম কি- এসব বোঝাও সম্ভব নয় ।

অথচ বিম্বিসারের জীবনে প্রেম এসেছিল । তিনি এক সুন্দরী নর্তকী এর প্রেমে পড়েছিলেন । সেই সুন্দরী নর্তকীই হলো আমাদের আলোচ্য আম্র-পালী। আম্র-পালীর জীবনে তো নিত্য নতুন পুরুষের আনাগোনা । তার জীবনেই বা আ্বার প্রেম কেন ? এ সব প্রশ্নের জবাব মিলবে আগামীতে। কাহিনীটি ‘গল্প’ আকারে বলার চেষ্টা করবো।

শুনবেন তো ?

সম্রাট বিম্বিসারকে রাজ্য রক্ষা বা রাজ্যবিস্তারের প্রয়োজনে অনেক যুদ্ধ করতে হয়েছিল। এমনি এক যুদ্ধে তিনি জয়লাভ করেছে প্রাসাদে ফিরলেন। রাতে প্রাসাদের নাচ-গানের আসর জলসা শুরু হলো। আগে থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সুন্দরী সুন্দরী রাজ-নর্তকীদের হাজির করা হয়েছে । চারদিকে আনন্দ- উল্লাস , চারদিকে বাদ্য-বাজনা , চারদিকে নাচ- গান । রাজা বিম্বিসার তার মন্ত্রী ও সভাসদদের নিয়ে তাদের নৃত্যগীত উপভোগ করছেন ।

একজন নর্তকীর নাচে মুগ্ধ হয়ে তিনি তার পাশে বসা মন্ত্রী গোপাল কে বললেন – এ নর্তকী সারা পৃথিবীর মধ্যে সেরা।

গোপাল মৃদুস্বরে বলে উঠলো, ‘মহারাজ ! এইমাত্র যে নাচ আপনি দেখলেন তা বৈশালীর রাজনর্তকী আম্র-পালীর নখেরও যোগ্য না ।

মহারাজ গোপালকে খুব বিশ্বাস করতেন। তাছাড়া গোপাল বৈশালীরই এক রাজার পুত্র ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নিজ রাজ্য ত্যাগ করে রাজা বিম্বিসারের দরবারে আসলে বিম্বিসার তাঁকে মন্ত্রীত্ব প্রদান করেন । তাঁর মেধা ও সততায় রাজা বিম্বিসার বরাবরই মুগ্ধ ছিলেন । গোপালকে অবিশ্বাস করার কোন কারনই ছিল না । রাজা অবশ্য সেদিন বৈশালীর রাজনর্তকী আম্র-পালী সম্পর্কে মন্ত্রী গোপালকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলেন না। কিন্তু আম্র-পালীর চিন্তা মন থেকে মুছে ফেলতেও পারলেন না। কয়েকদিন পরের ঘটনা। মহারাজ বিম্বিসার গোপালের কাছে আম্র-পালীর কথাটা তুললেন‘গোপাল !

আমি ভাবছি সামনের কোন এক উৎসবে তোমাদের বৈশালীর সেই রাজনর্তকীকে নিয়ে আসবো ।’

‘তাতো কোন ভাবেই সম্ভব নয় মহারাজ ।’

‘কেন সম্ভব নয় ?’

‘বৈশালী ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়া আম্রপালীর জন্য ,শুধু নিষেধই নয় একধরনের অপরাধ ।’

আমি প্রয়োজনে বৈশালীরাজকে বলবো। ‘সম্রাট বিম্বিসার স্বয়ং বৈশালীরাজকে বললেও অসম্ভব ?’ কেন ?

“মহারাজ ! এই নারীর জন্য বহু রক্তপাত হয়েছে । বহু রাজা, রাজপুত্র বণিক , ধনাঢ্য ব্যাক্তি কেবল এক নজর চোখের দেখার জন্য তার বাড়ির সামনে দিনের পর দিন তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা করে । যতক্ষণ পর্যন্ত আম্র-পালীর আগ্রহ না জন্মে, কেউ তার বাড়িতে ঢুকবার অনুমতি পর্যন্ত পায় না …’তাছাড় ?

-তাছাড়া আবার কি মন্ত্রী ?

-বৈশালীরাজ তো আমাদের শত্রু , আপনাকে সেখানে ঢুকতে হলে যুদ্ধে জয়লাভ করেই ঢুকতে হবে।

রাজা চিন্তিত মুখ করে বললেন, ‘কি যেন নাম বলেছিলে এই নারীর ?’

‘এই নারীর নাম আম্রপালী ,মহারাজ।’

‘এমন অদ্ভুত নাম আগে কখনও শুনেছি বলে তো মনে পড়ে না। আমি আম্রপালীর সম্পর্কে সবকিছু জানতে আগ্রহী । তারপর সিদ্ধান্ত নিব। গোপাল তুমি এর সব বৃত্তান্ত আমাকে শোনাও !’

গোপাল বেশ কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন। তারপর আম্রপালীর গল্প শুরু করলেন । প্রথমে তার অতীত জীবন বললেন।

আম্রপালীর সে অতীত জীবনের গল্প সবাইকে তো জানায়েছি । আর জানানোর দরকার আছে কি? আমি সরাসরি তাদের “প্রেম-কাহিনী” তে যেতে চাই । তবে পাঠকদের মতামত চাই - মন্ত্রীর বলা আম্র-পালীর সে “অতীত –কাহিনী” শুরু করবো নাকি সরাসরি আম্র-পালী ও বিসিম্বারের “প্রেম-কাহিনী” তে চলে যাব?

মন্ত্রী গোপাল রাজা বিম্বিসারকে আম্রপালীর সে অতীত জীবনের গল্প একে একে শোনানো শুরু করেন।

কাহিনীর প্রয়োজনে প্রসঙ্গক্রমে সে গল্প আবার পাঠকদের আমাকে বলতে হচ্ছে। তবে সবার আগে বলি আম্রপালীর রাজ্য বৈশালী পৃথিবীতে জন্ম নেয়া প্রথম প্রজাতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক রাস্ট্রগুলির একটি। বৈশালী প্রজাতন্ত্র -এ অধিকাংশের ভোটে রাজ্যের সমস্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হতো। আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের পূর্ব পর্যন্ত এসব প্রজাতন্ত্র এর অস্তিত্ব ছিল।

এই বৈশালীর ”শ্রাবস্তী” নামক শহরে মহানমা নামে সামন্ততান্ত্রিক সমাজের একজন বসবাস করতেন । (আশাকরি পাঠকগণ শ্রাবস্তী- নামের সাথে পরিচিত আছেন) ঐ যে কবি জীবনানন্দ দাশ এর বনলতাসেন কবিতার একটি লাইন, ‘মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য’ । প্রাচীন সুন্দর শহর বলেই বোধ হয় কবি বনলতার সাথে প্রাচীন শ্রাবস্তী নামক শহরের তুলনা করেছিলেন। মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য,কথাটির অর্থ তারও মুখ জুড়ে সুদূর অতীতের অন্ধকার ঐশ্বর্য।

আজ থেকে প্রায় ৮৫ বছর আগে ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ কবিতা ‘বনলতা সেন’। কে ছিলেন এই বনলতা সেন? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর পাওয়া যায়নি। এই কবিতাটি লিখে সে সময়ে জীবনানন্দ দাশ ব্যাপক হৈচৈ ফেলে দিয়েছিলেন।

যা হোক ,কবিতার সে লাইন গুলি আবার দেখুন।
”চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে-নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।”)

শ্রাবস্তী বর্তমানে গঙ্গার নিকটবর্তী নেপাল- উত্তর প্রদেশ সীমান্তের কাছকাছি একটি জেলা। গৌতম বুদ্ধ শ্রাবস্তী এসেছিলেন। ধ্যান করেছিলেন, দান করেছিলেন এবং এভাবে শ্রাবস্তী নগরীকে তিনি অমর করে রেখেছেন। শ্রাবস্তীর রাজকুমার জেত অসম্ভব ধনাঢ্য ছিলেন; তিনি বুদ্ধকে আঠারো কোটি স্বর্ণ মুদ্রা দান করেছিলেন।

যা হোক , মন্ত্রী আম্রপালীর সে অতীত জীবনের গল্প একে একে রাজাকে শোনানো শুরু করলেন।

বৈশালী রাজ্যের এই শ্রাবস্তী নামক স্থানে মহানামা নামের যিনি বসবাস করতেন তিনি একদিন এক কন্যা শিশুসন্তানকে ক্রন্দনরত অবস্থায় একটি আমগাছের নীচে পড়ে থাকতে দেখেন । মহানামা তাকে কুড়িয়ে পেয়ে নিজের বাসায় নিযে যান। স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করে এ নিঃসন্তান দম্পতী তাকে নিজের সন্তান হিসেবে লালন-পালন করবার সিদ্ধান্ত নেন । তার নাম রাখা হয় ‘আম্রপালী’ । আম্রবাগনে কুঁড়িয়ে পাওয়াতেই এই নাম ।

যত বয়স বাড়তে লাগলো আম্রপালী তত বেশী রূপবতী হয়ে উঠতে লাগলো । আম্রপালীর বয়স যখন এগারো /বার বছর, মহানমা তখন আম্রপালীর বিয়ের জন্য পাত্রের সন্ধান শুরু করেন। আম্রপালীকে বিবাহ করার জন্য জনপদের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কোন্দল বেঁধে গেল । আশে-পাশের বহু দেশের রাজা , রাজপুত্র, মন্ত্রীপুত্র, ধনাঢ্য ব্যবসায়ী, কাফেলার দলপতি , শহরের বণিক, গ্রামের মহাজন,আম্রপালিকে বিয়ে করতে চাইলেন । সাধারণ মানুষ তো একবার তার দর্শন পেলেই কৃতার্থ হয়ে যায় | আম্রপালীর রূপে সবাই এতটাই মুগ্ধ যে একে অন্যের বিরূদ্ধে যুদ্ধ করে হলেও প্রত্যেকেই আম্রপালীকে নিজের করে নিতে রাজী ছিলেন ।

আম্রপালীকে নিয়ে এই বিতর্ক বৈশালী প্রজাতন্ত্রের হর্তাকর্তা গণের কানে গিয়ে পৌঁছুলে তারা তাদের এ বিষয়টিকে নিয়ে বিধানসভাতেই আলোচনা শুরু করেন । পিতা সহ আম্রপালীকে সভায় ডাকা হয় । এতোদিন তারা আম্রপালীর অসামান্য যে রূপের কথা কেবল লোকমুখে শুনে এসেছেন তা এই প্রথম তারা সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করলেন । সবাই মুগ্ধ । স্বর্গের অপ্সরাও বুঝি আম্রপালীর তুলনায় নগন্য । সবাই উত্তেজিত হয়ে মত দিল আম্রপালী কারো একার হতে পারেনা। তার ঐশ্বরিক সৌন্দর্য উপভোগের অধিকার সবার । চাঁদ কারও একার হতে পারে না । তাই আম্রপালীকে একজন পুরুষের সঙ্গে বিবাহের অধিকার দেয়া ধর্মসম্মত নয়। একে প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক পুরুষের স্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে ‘নগরবধূ’ করে রাখা হোক ।’

সে যুগে রূপবতীর সতীত্বের মূল্য সমাজপতিদের কাছে ছিল না । আম্রপালী আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ।আম্রপালীর পালক পিতা মহানমা আম্রপালীর মনের কথা বুঝলেন । তিনি আম্রপালীর মাথায় স্নেহ মাখা হাত রেখে বললেন, ‘মাগো ! তুমি হয়তো আজ আত্মহত্যা করে মুক্তি পেয়ে যাবে । কিন্তু আমি আর তোমার মা রাজদন্ড মতে শূলবিদ্ধ হবো । এমন শাস্তি আমাদের দিও না ।’ আম্রপালী সেদিন তখনকি ভেবেছিলেন আজ আর জানার উপায় নাই। একজন পুরুষের পক্ষে তা বোঝাও হয়তো সম্ভব নয় ।

আম্রপালী তার পালক পিতা-মাতার মুখের দিকে চেয়ে আত্মহননের চেষ্টা থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন। । তাকে ‘নগরবধূ’ ঘোষনা করা হলো। নগরের সবচেয়ে সুন্দর স্থানে প্রাসাদ নির্মাণ দেয়া হলো । প্রাসাদের নাম দেয়া হয়েছিল ‘আম্রকুঞ্জ’ ।
আম্র-পালী তখন কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে তাকে বহুভোগ্যা নগরনটী করার সিদ্ধান্ত স্বেচ্ছায় শিরোধার্য করে নিলেন।
আম্রপালীর শর্তগুলি ছিল নিম্নরূপঃ
(ক) নগরের সবচেয়ে মনোরম স্থানে তাঁর গৃহ নির্মিত হবে।
(খ)একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশাধিকার পাবেন।
(গ)তাঁর দর্শণী হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা
(ঘ)শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে সপ্তাহ অন্তে মাত্র এক দিন তাঁর গৃহে অনুসন্ধান করা যাবে।
(ঙ)তাঁর গৃহে আগত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না।
আম্রপালীর উক্ত পাঁচটি শর্তই বিধানসভা কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছিল।

‘পতিতা’ হিসেবে আম্রপালীর নতুন জীবন শুরু হয় । আম্রপালীর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সে বৈশালীর রাজনর্তকী পদ প্রাপ্ত হন

মন্ত্রী গোপালের মুখে পুরো ঘটনা শোনার পরে মহারাজ বিম্বিসার অস্থির হয়ে পড়লেন। বললেন, ‘এই নারীকে এক নজর না দেখতে পেলে তো আমার জীবন ব্যর্থ হয়ে যাবে ! গোপাল ! আমার সৈন্যবাহিনীকে এখনই প্রস্তুত হতে বলো । আমি আজই বৈশালী রাজ্য আক্রমন করতে চাই । বৈশালী জয় করেই বীরের বেশে আমি আম্রপালীকে আমার মগধ রাজ্যে নিয়ে আসতে চাই !’

গোপাল বলল, ‘মহারাজ দয়া করে অস্থির হবেন না । অনুগ্রহ পূর্বক শান্ত হোন। কেবল একজন সামান্য পতিতা নারী আম্রপালীর জন্য যুদ্ধের আয়োজন করা শোভনীয় নয় ।”

রাজা বিম্বিসার তখন মন্ত্রী গোপালকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন। রাজা:- গোপাল দেখ , আম্র-পালী কিন্তু নিজের ইচ্ছায় পতিতা হয নাই। তাকে জোর করে বেশ্যা পেশায় জড়ানো হয়েছে। দুর্ভাগ্য তার।
মন্ত্রী:-দুর্ভাগ্যই হোক ,আর যাই হোক সে এখন একজন পতিতা। এটাই এখন বাস্তব।

রাজা:-মন্ত্রী গোপাল , তুমি যাই বল আমি একবার তার সাথে দেখা করতে চাই। শত্রুরাজ্য বৈশালী আক্রমণ করে তা দখল করা ছাড়া তো আর উপায় দেখিনা।

মন্ত্রী:- দেখা করার জন্য বৈশালী আক্রমনকে আমি কোনভাবেই সমর্থন করতে পারছি না।

রাজা:- তা হলে কিভাবে দেখা করবো?

মন্ত্রী:-মহারাজ ,আপনি যদি চান তো আপনার সাথে তার দেখা করানোর একটা ব্যবস্থা করা যেতে পারে ।

রাজা:-কিভাবে ?

মন্ত্রী:- আগামী কাল সন্ধ্যায় প্রস্তুত থাকবেন , মহারাজ । বাদবাকি ব্যবস্থা আমিই করবো।

রাজা:- কিন্তু কিভাবে ? তাতো আগে বলবে?

মন্ত্রী:- বিষয়টি আমার উপরই ছেড়ে দেন মহারাজ।

রাজা:- তুমি কি করবে ? তাছাড়া আম্র-পালীর রাজ্য বৈশালী তো আমার চরম শত্রু। তারা আমার অনুরোধে আম্র-পালীকে আমার রাজ্যে পাঠাবেনা। আর আমাকে তাদের রাজ্যে দেখতে পেলে তারা আমাকে মেরে ফেলবে।

মন্ত্রী:- মহারাজ কি আমার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। কাল সন্ধ্যায় প্রস্তুত থাকবেন । আমি সব ব্যবস্থা করে রাখবো। বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয় –এমন কি আজ আপনাকেও তা জানানো যাবেনা।

মন্ত্রী গোপালের উপর রাজা বিম্বিসারের গভীর আস্থা ছিল। তবু রাজা বুঝতে পারলো না আম্রপালীকে আনয়নের জন্য মন্ত্রী কি ফন্দি করছেন।মন্ত্রীকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না বটে , কিন্তু নানা প্রকার চিন্তা তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো । মন্ত্রী তাকেই বা সবকিছু বলছে না কেন? গোপনীয়তার জন্য ? না অন্য কিছু। সে কি আম্রপালীকে অপহরণ করে আনতে চায় ? তা কিভাবে সম্ভব ? সেখানে তো পাহারা আছে। তাকে রেডী থাকতেই বা বলছে কেন? না কি আম্রপালীর বদলে অন্য কাউকে হাজির করবে ? এতদুর সাহস কি সে পাবে ? নাকি বিপদে ফেলে আমার রাজ্য মন্ত্রী নিজেই দখল করতে চায়। আরো হাজার কথা ভাবলেন কিন্তু রাজা কিছু অনুমান করতে পারলেন না। পাঠকবর্গ আপনারা কি কিছু অনুমান করতে পারছেন ? অনুমান করতে না পারলে আমি তো আছিই। তবে মন্ত্রী কি ফন্দি করেছিল –এটা কিন্তু আজ জানা যাবেনা । জানা যাবে পরের পর্বে।

স্থান:-বৈশালী রাজ্যের আম্র-পালীর রাজপ্রাসাদ “আম্রকুন্জ”।

সময়:-প্রত্যুষ।

দুজন মুসাফির দুটি তেজী ঘোড়ায় বণিকের ছদ্মবেশে বৈশালী রাজ্যের আম্রপালীর প্রাসাদের সামনে এসে থামলো।নিখঁুত ছদ্মবেশের কারণে কারো পক্ষে বোঝা সম্ভব নয় তারা কারা।আমরা কিন্তু জানি,ঘোড়ার সওয়ারী একজন সম্রাট বিম্বিসার । আর অপরজন মন্ত্রী গোপাল । সারা রাতের যাত্রা শেষ করে খুব সকাল সকাল তারা আম্রপালীর প্রাসাদের সামনে এসে পৌঁছায়েছে।

রাজা বিম্বিসার আম্রকুঞ্জের (আম্রপালীর প্রাসাদের নাম)প্রাঙ্গনের দৃস্টিপাত করলেন। সারি সারি তাবুঁর সারি। আম্রপালীর সাক্ষাৎ প্রার্থীরা এ সব তাঁবুতে অবস্থান করছেন।এমন কি আম্রপালীকে শুধু এক ঝলক দেখার জন্য বিভিন্ন দেশের রাজ-রাজারা আম্রকুঞ্জের উঠানে তাবু টাঙিয়ে অপেক্ষায আছেন ! গোপাল সারাদিন ধরে অনেক চেষ্টা-তদবীর করে ও টাকা-পয়সার লেনদেন শেষ করে আশ্বাস পেল যে নব আগন্তক তথা ছদ্মবেশী রাজা বিম্বিসার দুদিন পর আম্রপালীর দেখা পেতে পারেন। নিজের চোখে এসব কান্ড-কারখানা না দেখলে বিম্বিসার মন্ত্রী গোপালের আম্রপালী সম্পর্কে বলা কথা বিশ্বাসই করতেন না ।

তারপর শুধু অপেক্ষা আর অপেক্ষা। মন্ত্রী জানালো আম্রপালী অনেক সময় নির্ধারিত সিডিউল রক্ষা করতে পারে না। দুদিন কেটে গেল অপেক্ষায় অপেক্ষায় ।কেউ তাদের সাথে যোগাযোগাও করছে না। ও দিকে বৈশালীর রাজার প্রহরীদের এ দিক ঘুরতে দেখা গেল। তাহলে কি রাজা বিম্বিসার ধরা পড়তে যাচ্ছে।মন্ত্রী গোপাল তো এ রাজ্যেরই লোক। তাকে কি সবাই চিনতে পেরেছে ? নাকি গোপালই তাকে ধরে দিতে পরিকল্পনা করেছে।
এ জীবনে বুঝি আর আম্রপালীর সাথে দেখা হলো না নিজ রাজ্যেও ফিরে যাওয়া হলোনা। এমন সময় মন্ত্রী গোপাল হন্ত-দন্ত হয়ে ফিরে আসলো।

অবশেষে প্রতীক্ষার পালা শেষ হলো । মন্ত্রী হন্ত-দন্ত হয়ে এসে রাজাকে জানালো আম্রপালীর প্রাসাদে রাজার ডাক পড়েছে। দুদিনের অপেক্ষায় ক্লান্ত-শ্রান্ত মহারাজ ধীরে ধীরে আম্রপালীর প্রাসাদে প্রবেশ করলেন । ”
আম্রকুঞ্জ ” প্রাসাদ সম্পর্কে এতদিন তিনি যা শুনেছেন তা বুঝি কম-ই ! মনে হচ্ছে তার সম্রাজ্ঞীবৃন্দের মহলও ”আম্রকুঞ্জ ’ এর তুলনায় অতিক্ষুদ্র ! প্রবেশদ্বার পেরোতেই দেখা মিললো অপূর্ব সব পোর্ট্রেট এর। ছবির নীচে নাম লেখা। এদের বেশিরভাগকেই বিম্বিসার চিনতে পারলেন । এদের সবাই হয় নামকরা সম্রাট, নয়তো প্রসিদ্ধ কবি অথবা প্রথিত যশা শিল্পী । আগেই বলেছি আম্রপালী চিত্রকলার ভক্ত ছিলেন। তিনি বিভিন্ন দেশের নামকরা চিত্রকরদের উপযুক্ত অর্থের বিনিময়ে এসব নিঁখুঁত ভাবে ছবি তৈরী করবার কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। । হয়তো এই পোর্ট্রেট এর ব্যাক্তিবর্গ সবাই আম্রকুঞ্জে কোন না কোন সময় প্রবেশ করেছে । চিত্রকরের সামনে স্বয়ং বসে না থাকলে এমন নিঁখুত ছবি তৈরী করা কোন চিত্রকরের পক্ষেই সম্ভব নয় ।

চিত্রকর্ম দেখতে দেখতে একটু অন্যমনস্কভাবে বিসিম্বর এক সময় অন্দর মহলে পৌছেঁ গেলেন। সামনে তাকাতেই তার চোখ যেন ঝলছে গেল।

বিম্বিসার অন্দরমহলে প্রবেশ করলেন। সামনে তাকিয়ে দেখলেন একটি মেয়ে তাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। তার চোখ ঝলসে গেল । যে মেয়েটি তাঁকে অভিবাদন জানাচ্ছে সে এ মাটির পৃথিবীর কোন নারী হতে পারে না । এ নিশ্চয়ই স্বর্গের কোন অপ্সরী । সম্রাট এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। চোখ ফেরাতে পারলেন না । চোখ ফেরাতে পারেন তো মন ফেরাতে পারেন না। চোখ ফেরানো যায় গো তবু মন ফেরানো যায় না। কেমন করে রাখি ঢেকে মনের খোলা আয়না।–এই হলো মহারাজের অবস্থা। আম্রপালী মুগ্ধ মহারাজাকে হাত ধরে তাকিয়াতে বসারেন। সমগ্র বিকেল জুড়ে ক্লাসিকাল সঙ্গীত ও নিজের অপূর্ব নৃত্যকলায় আম্রপালী সম্রাটকে মুগ্ধ করে রাখলেন । সঙ্গীত ও নৃত্যকলায় অসাধারণ দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে মহারাজ বুঝতে পারলেন আম্রপালীর ব্যাপারে গোপালের প্রশংসা অতিরঞ্জিত তো ছিলই না বরং গোপাল আসলে কম-ই বলেছিল । শুধুমাত্র মুখের কথায় আম্রপালীর রুপের বর্ণনা দেয়া অসম্ভব। মহারাজ উঠে দাঁড়ালেন ।
মহারাজ মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন। একসময তিনি আম্রপালীর হাত থেকে সেতার টেনে নিলেন। নিজ হাতের আঙুল সেতারের তারের ওপর চলে গেল কখন যেন । সেতারের তারে যেন ঝড় বইতে লাগলো । সেই ঝড়ের সঙ্গে সম্রাটের সুমধুর কন্ঠ এবার আম্রপালীকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলল । আম্রকুঞ্জে সবাই আম্রপালীর রুপ-রসে অবাক হতেই আসে, আম্রপালী অবাক করতে নয় । আজ এই নবাগত মুসাফির বণিক তাকে অবাক করে দিয়েছে । আম্রপালীর মনে হল এ মুসাফির সাধারণ কেউ নয়।
সম্রাটের কাছে এসে আম্রপালী হাতজোড় করে বললেন, ‘ হে মুসাফির ! সত্য করে বলুন দেখি। কে আপনি ?’ কোন বা দেশে থাক গো মুসাফির কোনবা দেশে ঘর ? ‘মগধ দেশে থাকি গো আমি ,সম্রাট বিম্বিসার আমার নাম। হে রুপের রাণী ! বিম্বিসার আমার নাম। মন্ত্রীর মুখে তোমার রুপ- সৌন্দর্য ও গুণের বর্ণনা ও প্রশংসা শুনে আমার এখানে আসা । এ দেশে তোমার ওপর যে অবিচার করা হয়েছে তা আমি শুনেছি ।’ তোমাকে জোর করে পতিতা বানানো হয়েছে।
সে সব কথা থাক মহারাজ ! আপনি কি জানেন মহারাজ , আমি আপনাকে বহু আগে থেকেই অনেক অনেক ভালবাসি। মহারাজ কথাটা বিশ্বাস করতে পারলেন না। বললেন ,হে নারী ! তোমরা ছলনাময়ী জানি। কিন্তু তোমাকে আমি তা মনে করেনি। কিন্তু আমি কিভাবে বিশ্বাস করি যে তুমি আমাকে না দেখেই ভালবেসে ফেলেছো ? আম্রপালী কিছুক্ষণ মৌণ থাকলেন তার পর বলে উঠলেন , আমাকে বিশ্বাস করলেন না মহারাজ। তবে আমার সাথে আসেন। আম্রপালী সম্রাটের হাত ধরে টেনে ধরে চলতে শুরু করলেন। মহারাজ আম্রপালীর পিছনে পিছনে চলা শুরু করলেন।কক্ষের পর ক্ক্ষ পেরিয়ে তারা এক দরজা বন্ধ করা ঘরের সামনে পৌঁছিলেন। আম্রপালী রহস্যভরা কণ্ঠে বলে উঠলেন “ নিজ হতে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলুন মহারাজ!” মহারাজ দরজা খুলে হতবাক হয়ে গেলেন। তিনি স্বপ্নেও এটা কল্পনা করেন নাই। মনের অজান্তেই তিনি আম্রপালীর হাত চেপে ধরলেন।

আম্রপালীর অনুরোধে মহারাজ ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে তাজ্জব বনে গেলেন।সম্রাট অবাক হয়ে দেখলেন তাঁর বিশ বছর বয়সের একটি বিশাল ছবি দেয়ালে টানানো । । আম্রপালী ছবির দিকে ইঙ্গিত করে ব্যাকুল কন্ঠে বললেন, ‘ছবির এই রাজপুত্রই কি আপনি ?’ । মহারাজ বললেন এ ছবি আমারই। এ কথা শুনে আম্রপালী আকুল হয়ে বললো, ‘ধন্য আমি মহারাজ আমি আজ ধন্য হলাম । আপনার শৌর্য-বীর্যের কথা অনেক শুনেছি । আপনি অনেক রাজ্য জয় করেছেন। আপনার রাজ্য জয়ের প্রায় সমস্ত কাহিনী আমার মুখস্ত । আমি আপনাকে না দেখেই আপনার ভক্ত হয়ে আছি। মনে মনে ভাল বেশেও ফেলেছি। আজ আপনার সঙ্গীত-সুরেও আমাকে মুগ্ধ করলেন । কোন সম্রাট যে এতো মধুর করে গাইতে জানে ,বাজাতে জানে এ আমার ধারনাতেই ছিল না । আপনার গলায় সুর। হাতে সেতার আবার অন্য হাতে তরবারী । কি নেই আপনার? আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, সম্রাট বিম্বিসার আজ স্বয়ং আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । মহারাজ আম্রপালীর কথায় মোহিত হলেন। একান্তভাবে কাছে টেনে নিলেন। হঠাৎ করেই তার মনে হলো এই অপ্সরী ছাড়া পৃথিবী সবকিছুই তার কাছে নিরর্থক । তিনি আম্রপালীকে নিজ বাহুবন্ধনে জড়িয়ে ফেললেন । আর আম্রপালী তো তার ছোঁয়ায় মোমের মত গলেই গেছেন। ভুলে গেলেন তারা জগতের সবকিছূ।
কিন্তু জগতের তো অন্যরুপও আছে। আম্রপালীর রাজ্য বৈশালীতে জানাজানি হয়ে গেল শত্রু রাজ্যের মগধ রাজ তিন দিন ধরে আম্রকুঞ্জে আছেন । খবরটি বৈশালীর রাজাদের কানেও পৌঁছে যায়, গুপ্তচরের মাধ্যমে। তাঁরা বিম্বিসারকে গ্রেফতারের সিদ্ধান্ত নেয় ।

বিম্বিসারকে গ্রেফতার করতে এসে রাজার সেনাপতি বিপাকে পড়ে যায়। আম্রপালীর দ্বার রক্ষক আম্রপালী “নগর বধূ”হবার সময় রাজ্যের সাথে সম্পাদিত চুক্তির শর্ত দেখায়।
শর্তে লেখা ছিল- (ক) নগরের সবচেয়ে মনোরম স্থানে তাঁর গৃহ নির্মিত হবে। (খ)একবারে মাত্র একজন তাঁর গৃহে প্রবেশাধিকার পাবেন। (গ) তাঁর দর্শণী হবে প্রতি রাত্রির জন্য পাঁচশত স্বর্ণমুদ্রা (ঘ) শক্র বা কোনো অপরাধীর সন্ধানে সপ্তাহ অন্তে মাত্র এক দিন তাঁর গৃহে অনুসন্ধান করা যাবে। (ঙ) তাঁর গৃহে আগত ব্যক্তিগণের সম্বন্ধে কোনো অনুসন্ধান করা চলবে না। ৭ দিন আগে তাদের আর আম্রপালীর গৃহে ঢোকার সুযোগ নাই। নিজেদের শর্তে নিজেরাই আটকা পরে তারা আম্রকুঞ্জে ঢুকতে ব্যর্থ হয় । তারা আম্রকুঞ্জে প্রবেশের ব্যাপারে ৭ দিন আগে কোনই অনুমতি নেয় নি । শর্ত অনুসারে তাদের অনুসন্ধানের কোনও সুযোগও নাই। সেনাপতি তখন আম্রকুঞ্জের বাইরে সিপাহী মজুদের নির্দেশ দেন । আম্রকুঞ্জের বাহিরে সৈন্য মোতায়নের বিষয়টি ভিতরে অবস্থানরত বিম্বিসারও জানতে পারেন। তিনি তাড়াতাড়ি মন্ত্রী গোপালকে গোপনে ডেকে পাঠান।

আম্রকুঞ্জের বাহিরে সৈন্য মোতায়নের বিষয়টি ভিতরে অবস্থানরত বিম্বিসার টের পেয়ে গোপালকে ডেকে মগধে দ্রুত যাওয়ার নির্দেশ দেয় । বৈশালী আক্রমণ করে তা দখল করা ছাড়া রাজার আর গত্যন্তর নাই। মগধ থেকে সেনা নিয়ে এসে বৈশালী আক্রমণ করাই তার মূল উদ্দেশ্য ।
আম্রপালীর প্রেমে তিনি এই কদিন জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন । তার খেসারত হয়তো এখন দিতে হবে। অন্যদিকে আম্রপালীও রাজার প্রেমে বিভোর। কিন্তু এ সময় প্রেমের চেয়ে তার দেশ প্রেমই বড়ও হয়ে উঠলো। শুধু তার জন্য বৈশালী শক্তিশালী মগধরাজার অধীনে চলে যাবে –এটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। একদিকে মহারাজা বিম্বিসারের প্রেম অন্যদিকে বৈশালীর স্বাধীনতা । প্রেম বড় না দেশ বড় ? কি করবে এখন আম্রপালী ?
বিম্বিসার একথা জানতে পেরে গোপালকে ডেকে দ্রুত মগধে যাওয়ার নির্দেশ দেয় । মগধ থেকে সেনা নিয়ে এসে বৈশালী আক্রমণ করাই তার মূল উদ্দেশ্য । আম্রপালীর প্রেমে তিনি জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিলেন । কিন্তু, শত হলেও বৈশালী আম্রপালীর মত গোপালেরও নিজ জন্মভূমি । তিনি নিজ জন্মভূমির প্রতি যুদ্ধ-বিগ্রহ চাননা। গোপাল অনেক কষ্টে অনেক যুক্তিতর্ক ও অনুনয়-বিনিনয়ের মাধ্যমে সম্রাটকে শান্ত করতে চেষ্টা করলো এবং সমর্থ হলো। বৈশালী থেকে পালিয়ে চলে যাওয়ার জন্য আম্রপালি সম্রাটকে অনুরোধ করলো । বৈশালী আক্রমন মানেই সাধারণ মানুষের প্রাণ ক্ষয় । চারদিকে ধংস লীলা। আম্রপালী তা চায় না । কিন্তু বিম্বিসার কাপুরুষের মত পালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানায়। অনেক যুক্তি-তর্কের পর শেষ পর্যন্ত রাজা গোপাল ও আম্রপালীর কথা মেনে নেয় । অবশেষে তারা সম্রাটকে বোঝাতে সক্ষম হয় । সম্রাট পালিয়ে যেতে রাজী হয়। রাজার প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে অতি কষ্টে পালিয়ে যেতে সক্ষমও হয়। পরবর্তীতে আম্রপালীর জন্যে বৈশালী অভিমুখে বিম্বিসার কোন যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন কিনা সেকথা কোথাও লেখা নাই। রাজা বিম্বিসারের পর এবার আম্রপালীর জীবনে আসার চেস্টা করে অজাতশত্রু। অজাতশত্রু আবার রাজা বিম্বিসারের পুত্র। কিশোর বয়সেই অজাতশত্রু আম্রপালীর প্রতি তার পিতা বিম্বিসারের তীব্র আসক্তির কথা জানতে পারে। আম্রপালীর দৈহিক সৌন্দর্য্য নিয়ে তার মনে তীব্র কৌতুহলের সৃস্টি হয়। বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে আম্রপালীকে বিবাহ করার বাসনা তার মধ্যে তীব্রতর হয়ে উঠে। তিনি তার পিতা রাজা বিম্বিসারকে হত্যা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

এখন অজাতশত্রুর কাহিনী শুরু করবো নাকি এর পর সরাসরি আম্রপালী আম নিয়ে কথা বলা শুরু করবো , বুঝতে পারছি না। সন্মানিত পাঠকবৃন্দ ,প্রাপ্ত ইতিহাসের আলোকে অজাতশত্রুর কাহিনী কি শুনতে চান ?

গৌতম বুদ্ধের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন অজাতশত্রু ।কিন্তু বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন অজাতশত্রু এর পিতা মহারাজ বিম্বিসার । গৌতম বুদ্ধের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ অজাতশত্রু বিম্বিসারকে হত্যার চেষ্টা করেন। বুদ্ধের অহিংসা মতাদর্শে বিশ্বাসী বিম্বিসার এই ঘটনার পরও তাঁর পুত্র অজাতশত্রু কে ক্ষমা করে দেন। ক্ষমা পাবার পরে অজাতশত্রু আরো ভয়ংকর হয়ে উঠেন। অজাতশত্রু তার পিতা মহারাজ বিম্বিসার ও তাঁর উপদেষ্টামণ্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের (বিহারের)শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন। ৪৯১ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৃহবন্দী অবস্থায় বিম্বিসারের মৃত্যু ঘটে। এই সময় অজাতশত্রু গৌতম বুদ্ধকেও হত্যার চেষ্টা করেন। কথিত আছে অজাতশত্রু তাঁর পিতা মহারাজ বিম্বিসারকে কারাগারে প্রেরণ করার পর তিনি পিতার হাত-পা কেটে তাতে নুন এবং অম্ল মাখিয়ে কষ্ট দেন। এরপর তাঁকে কয়লার আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেন। এই শোকে তাঁর মা মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আগেই বলেছি অজাতশত্রু এর পিতা বিম্বিসার ছিলেন গৌতম বুদ্ধের ভক্ত। বিম্বিসারতাঁর অন্তঃপুরে বুদ্ধের পায়ের নাখ ও চুলের উপর একটি স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন। অজাতশত্রু বিম্বিসার এর মৃত্যুর পর এই স্তূপে পূজা বন্ধ করে দেন। তিনি এই ঘোষণা দেন যে, বুদ্ধের প্রতি কেউ শ্রদ্ধা নিবেদন করলে তার শিরশ্ছেদ করা হবে। একদিন দাসী শ্রীমতী এই আদেশ লঙ্ঘন করে স্তূপ ধুয়ে সেখানে প্রদীপ জ্বালিয়ে দেন। রাজার আদেশে তার শিরশ্ছেদ করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত “পূজারিণী” কবিতায় এ ঘটনাটি বর্ণনা করা আছে।
বুদ্ধকে পূজার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করার এই কাহিনি নিয়েই রবীন্দ্রনাথ রচনা করেছেন ‘নটীর পূজা’। মূল কাহিনির শ্রীমতীই রবীন্দ্রনাথের নটী। বিম্বিসার এখানে স্বেচ্ছায় সিংহাসনত্যাগী এবং ছেলের কাছে রাজ্যভার অর্পণকারী। পিতৃহন্তারক অজাতশত্রু এই নাটকে কেবলই রাজা। “পূজারিণী”কবিতাটির মূল ভাব অবলম্বন করে নটীর পূজা নৃত্যনাট্য টি রচনা করা হয়। পরে রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর নটীর পূজা এর কাহিনি অবলম্বনে সিনেমাও বানান।এটি ছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচালিত একমাত্র চলচ্চিত্র।
পূজারিণী কবিতা নিয়ে ‘শেষ আরতি’ নামেযাত্রা পালাও রচিত হয়। ইতিহাসকুখ্যাত এ্ অজাতশত্রু আক্রমণ করেছিলেন বৈশালী | তাঁর হাতে বন্দি হন আম্রপালী | বন্দিনী নগরবধূর রূপে মুগ্ধ অজাতশত্রু পুড়িয়ে দিয়েছিলেন গোটা বৈশালী | শুধু আম্রপালীর কারাগার বাদ দিয়ে | নগরবাসীর এই অবস্থা দেখে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন বৈশালীর রাজ নর্তকী আম্রপালী | কিন্তু তিনি মগধ রাজাদের কুক্ষিগত হননি | অজাতশত্রু প্রজাদের গৌতম বুদ্ধের কাছে যাওয়া নিষেধ করে দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি পিতাকে হত্যা করার জন্য দারুন মনোকষ্টে ভুগতেন। এই পরিতাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি বুদ্ধের সাথে দেখা করেন। তিনি গৌতম বুদ্ধের সাথে দেখা করে দীর্ঘ আলাপ করেছিলেন । পরিরিশেষে তিনি বুদ্ধের কাছে পিতৃহত্যার কথা স্বীকার করে তার প্রতিকার প্রার্থনা করেছেন। থাক সে সব কথা। আম্রপালীর কথাতেই ফিরে আসি- আম্রপালীর কাছে সবাই প্রেম-ভিক্ষা করতো । কেউ পেত কেউ পেত না। এই আম্রপালী একবার এক সাধারণ (সাধারন বলতে মন্ত্রী-রাজা নয়-অর্থাৎ ক্ষমতাশীন কেউ নয়) মানুষের কাছে প্রেম-নিবেদন করে ব্যর্থ হন। এ ঘটনা আম্রপালীর জীবনের মোড়ই ঘুরে দেয়। শুনবেন সে কাহিনী ? শুনুন তবে।

আম্রপালী এক বর্ষাভেজা দিনে তার ”আম্রকুন্জ “প্রাসাদের বরান্দা থেকে দেখলেন এক বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে | তাঁর রূপে মুগ্ধ হলেন বৈশালীর রাজনর্তকী | বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে খুব মনে ধরলো আম্রপালীর। ভাবলেন, যেভাবেই হোক একে বশ করতেই হবে। দেশ বিদেশের মন্ত্রী বা রাজাগন তাঁর পায়ের কাছে পড়ে থাকেন | আর এ তো সামান্য এক তরুণ সন্ন্যাসী | এখন প্রশ্ন হলো বর্ষাভেজা দিনে বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসী ”আম্রকুন্জ “ এর সামনে কেন ? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য রাজা বিম্বিসারের সম্পর্কে কিছু কথা বলতে হবে।
রাজা বিম্বিসারের রাজ্যে জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম উভয়েই সমসাময়িককালে বিকাশ লাভ করেছিল। মহাবীর জৈন, গৌতমবুদ্ধ এবং রাজা বিম্বিসার প্রায় সমকালীন ব্যক্তিত্ব। রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও জৈনধর্মসহ সে সময়ে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন।
সম্রাট বিম্বিসার গৌতম বুদ্ধ অপেক্ষা পাঁচ বছর ছোট ছিলেন। বোধিলাভের (বোধি অর্থ পরম জ্ঞান) সাত বছর পূর্বে গৌতমের সঙ্গে বিম্বিসারের সাক্ষাত ঘটে। সিদ্ধার্থ সাক্ষাতের সময় গৌতম নিজেকে শাক্য বংশ এর রাজকুমার হিসেবে পরিচয় দিলে বিম্বিসার তাঁকে তার রাজধানীতে বসবাস করার অনুরোধ করেন। গৌতম তা প্রত্যাখ্যান করেন । তিনি রাজা বিম্বিসারকে বলেন, ‘মহারাজ! আমি সুখপ্রার্থী নই। আমি কপিলাবস্তুর রাজা শুদ্ধোদনের পুত্র। বুদ্ধত্ব লাভের আশায় আমি সবকিছু ত্যাগ করে সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছি।’ রাজা বলেন, ‘বৎস! আপনার পিতা আমার পরম মিত্র। আপনার উদ্দেশ্য জেনে আমি খুব খুশি হয়েছি। যদি আপনি বুদ্ধত্ব লাভ করেন আমাকে একবার দর্শন দেবেন। আমি আপনার সেবা করব, আপনাকে বন্দনা করব।’ রাজা বিম্বিসারের কথায় সিদ্ধার্থ সম্মতি প্রদান করে সেখান থেকে বের হয়ে যান।
তবে তিনি বোধিলাভ (বোধি অর্থ পরম জ্ঞান) করতে পারলে বিম্বিসারের নিকট ফিরে আসবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন। সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে গৌতম বুদ্ধ বোধিলাভের দুই বছর পরে বিম্বিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় রাজা বিম্বিসারের বয়স হয়েছিল ঊনত্রিশ বছর।
সাক্ষাৎ এর দিনই বিম্বিসার বৌদ্ধ সংঘের সহস্রাধিক ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য বেণুবন নামক একটি উদ্যানটি গৌতম বুদ্ধকে প্রদান করেন। বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধ অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোসথ ব্রত পালনের বিধি প্রচলন করেন। আবার, বিম্বিসারের অনুরোধেই বুদ্ধ বর্ষাকালে পরিব্রাজন না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে ”সাধনার বর্ষাবাস “নামক রীতি প্রচলন করেন।
রাজা বিম্বিসারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন জীবক। তিনি খুবই বিখ্যাত চিকিৎসক ছিলেন। রাজার আদেশে তিনি বুদ্ধ ও ভিক্ষুসঙ্ঘের চিকিৎসা করতেন। তাঁদের স্বাস্থ্য পরিচর্যার বিষয়ে তিনি সর্বদা সচেতন থাকতেন। ভিক্ষুরা আগে পুরাতন ও পরিত্যক্ত কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে সেলাই করে পরিধান করতেন। এতে ভিক্ষুদের অনেক রকম রোগ হতো। চিকিৎসক জীবক ভিক্ষুদের নীরোগ জীবন চিন্তা করেন এবং নতুন কাপড় পরিধানের বিধান দিয়েছিলেন। এরপর থেকে রাজা বিম্বিসারও ভিক্ষুদের নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নতুন কাপড় দান করতেন। এভাবে রাজা বিম্বিসার বৌদ্ধধর্মের প্রচার-প্রসারে অবদান রাখেন।
যা হোক রাজা বিম্বিসারের পরামর্শে গৌতম বুদ্ধ ও তার অনুসারীরা বর্ষাকালে কোথাও ভ্রমণ করতেন না।বর্ষায় তাঁরা পরিব্রাজন করতেন না।| আশ্রয় নেন কোনও নগরের উদ্যানে, নগরবাসীর গৃহে ।
সেবার বর্ষায় আম্রপালীর বাসস্থান বৈশালী নগরীতে এসেছেন বৃদ্ধ তথাগত (গৌতম বুদ্ধ কে তথাগত বলা হয়) | সঙ্গে কয়েকশো শ্রমণ(অল্প বয়সী বৌদ্ধ ভিক্ষুকে শ্রমণ বলা হয়)। বর্ষার চারমাস এখানেই কাটাবেন তাঁরা । আজ এক তরুণ সন্ন্যাসী আম্রপালীর দরজায় ভিক্ষা প্রার্থী । বৌদ্ধ তরুণ সন্ন্যাসীকে খুব মনে ধরলো আম্রপালীর। ভাবলেন, যেভাবেই হোক একে বশ করতেই হবে। দেশ বিদেশের মন্ত্রী বা রাজারা তাঁর পায়ের কাছে পড়ে থাকেন | আর এ তো সামান্য এক তরুণ সন্ন্যাসী । আম্রপালী নিজে তাঁকে ভিক্ষা দিলেন । এত বছর আম্রপালী শুধু আহ্বান পেয়েই এসেছেন । তার সামান্য দর্শন পেলেই সবাই ধন্য হয় সেই আম্রপালীই কিনা এ তরুণ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে আহ্বান জানালেন তাঁর প্রাসাদে অবস্থান করে বর্ষা অতিবাহিত করতে। কিন্তু সন্ন্যাসী বা বৌদ্ধ শ্রমণদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের কোন অনুমতি তাঁদের ছিল না। তথাগত (গৌতম বুদ্ধ) তাদের সে অনুমতি দেন নাই। কিন্তু সুন্দরী রমণীর তাও আবার যেনতেন সুন্দরী রমণী নয় আম্রপালীর মত সুন্দরী রমণীর এ আহবান কেমনে অবহেলা করবে এ তরুণ সন্ন্যাসী ?
এ তরুণ সন্নাসী কি পেরেছিল রুপে যার আগুণ জ্বলে সেই আম্রপালীর মত সুন্দরী রমণীর এ আহবান উপেক্ষা করেতে ?

বৈশালীতে যে বাড়িতে আতিথ্য নিয়েছিলেন তথাগত বুদ্ধ, সেখানে গিয়ে তরুণ শ্রমণ (অল্প বয়সী বৌদ্ধ ভিক্ষুকে শ্রমণ বলা হয়) | তাঁর কাছ আম্রপালীর প্রাসাদে ৪ মাস অবস্থানের জন্য অনুমতি চাইলেন | বুদ্ধের সামনে উপস্থিত সবাই তরুণ শ্রমণের বোকামী দেখে অবাক হয়ে গেলেন। কারন সবাই জানেন তথাগত (গৌতম বুদ্ধ) কোনও দিনও একজন পতিতার বাড়ীতে এ তরুণ শ্রমণ (ভিক্ষু) কে অবস্থানে অনুমতি দিবেন না। কিন্তু সবাইকে বিস্মিত করে তথাগত (গৌতম বুদ্ধ) অনুমতি দিলেন । এই নিয়ে বৌদ্ধ সঙ্ঘে রীতিমত আলোচনা-সমালোচনা শুরু হল | আম্রপালী নামের এক পতিতার বাড়িতে থাকবেন বৌদ্ধ শ্রমণ ? বুদ্ধ তাঁদের বললেন, এই শ্রমণের চোখে তিনি কোনও কামনা -বাসনা দেখতে পাচ্ছেন না । তথাগত (গৌতম বুদ্ধ) সবাইকে বললেন বর্ষা শেষ হলে এই শ্রমণ নিষ্কলুষ হয়েই যে তাঁর কাছে ফিরবেন , এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। সবাই বললো এ শ্রবণের জন্য এবার এটা হবে অগ্নিপরীক্ষা । সবাই বললো আম্রপালীর কাছ থেকে নিষ্কলুষ অবস্থায় ফেরা অসম্ভব। কিন্তু তথাগত জানালেন তিনি নিশ্চিত যে এতে জয়ী হবেন শ্রমণই । উপস্থিত কেউ নিশ্চিত হতে পারল না।
বর্ষার চার মাস সময় গত হয়ে গেল। বৈশালীতে যাঁরা ছিলেন তারা সবাই একে একে সমবেত হলেন বুদ্ধর কাছে | কিন্তু আম্রপালীর প্রাসাদে আশ্রয় নেয়া সেই তরূণ শ্রমণের দেখা মিলছে না যে। বর্ষার গত ৪ মাস ধরে আম্রপালীর প্রাসাদে অবস্থান করে সে কি আম্রপালীর রুপের আগুনে গলে গেল। তথাগতের শিক্ষা কি ব্যর্থ হয়ে গেল ?

অবশেষে প্রতীক্ষার পালা শেষ হলো। তথাগতের সামনে এসে দাঁড়ালেন সে সেই তরুণ ভিক্ষু ।নগরবধূর প্রাসাদে তিনি চার মাস কাটিয়েছেন | কিন্তু আছেন আগের মতোই নিষ্কলুষ |তিনি এখন তথাগত(গৌতম বুদ্ধ) এর সামনে ।
বর্ষা শেষ হয়েছে । বর্ষা শেষে শ্রমণ (ভিক্ষুগণ) সবাই সমবেত হয়েছে , তাদের নতুন গন্তব্যের দিকে যাত্রা করতে হবে। কিন্তু তরুণ শ্রমণও এসেছে । কিন্তু তার পিছনে পিছনেঐ মহিলা কে ? | যাঁর গায়ের রং ছিল দুধে আলতাতে মিশানো । পাতলা ঠোঁট বেদানার মতো লাল, লাল আভাযুক্ত কপোল। হরিণ হরিণ নয়ন। সমুদ্রগভীর নাভিদেশ, মরালগ্রীবার ভঙ্গিমা দেখার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন রাজপুরুষরা | রূপযৌবনে পরিপূর্ণা সেই মহিলার পরনে হলুদ রংগের বস্ত্র | আরে ! এ যে আম্রপালী । চাঁপাফুলের মতো আঙুল জড়ো করে তিনি প্রণাম করলেন তথাগত বুদ্ধকে | জানালেন, তিনি তরুণ শ্রমণকে প্রলুব্ধ করতে কোনও চেষ্টা বাকি রাখেননি | কিন্তু এই প্রথম কোন পুরুষকে বশ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বৈশালীর নগরবধূ আম্রপালী | উল্টো আম্রপালীকেই বশ করেছেন সর্বত্যাগী তরুণ শ্রমণ | আজ, সর্বস্ব ত্যাগ করে তথাগত বুদ্ধের চরণে আশ্রয় চান আম্রপালী | বাকি জীবন কাটাতে চান প্রব্যজ্যা নিয়ে | নগরবধূ আম্রপালীর সঙ্ঘে যোগদানের আগে তাঁর উদ্যানে অতিথি হয়ে তাঁর হাতে অন্নগ্রহণ করেছিলেন তথাগত বুদ্ধ | রক্ষণশীল সমালোচকদের মুখের উপর জবাব দিয়ে | নিজের সব সম্পত্তি, প্রাসাদ, উদ্যান বৌদ্ধ সঙ্ঘে দান করে দিয়েছিলেন আম্রপালী | মোহমুক্ত হয়ে বাকি জীবন উত্সর্গ করেছিলেন বৌদ্ধ সঙ্ঘারামে | তিনি তথাগতকে বলেন ভিক্ষুণীদেরও সঙ্ঘে নিতে | কিন্তু ভিক্ষুদের মনসংযোগ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় রাজি ছিলেন না বুদ্ধ | তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করেন আম্রপালী | বৌদ্ধ শ্রমণদের মনসংযোগ এতই ঠুনকো যে এক নারীর জন্য তা ভেঙে পড়বে ? এরপর আর রাজি না হয়ে পারেননি বুদ্ধ তথাগত | মাতা গৌতমী, স্ত্রী যশোধরাও তাঁকে একই অনুরোধ করেছিলেন | জীবনের অর্ধাংশ বৌদ্ধ সঙ্ঘেই অর্পণ করেছিলেন আম্রপালী |
১৯৭৮ সালে ভারতের আম গবেষকরা দশোহরি ও নিলাম-এই দুটি আমের মধ্যে সংকরায়ণের মাধ্যমে পৃথিবীর বিস্ময়কর আম্রপালি আমের জাত উদ্ভাবন করেন। আম্রপালি তার পিতৃ ও মাতৃ গুণের (দু’সেহরী ও নীলম) চেয়ে অনেক উন্নত ও ভিন্ন। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা আমটির নামকরণ করে এখন থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে জন্ম নেয়া “আম্রপালি”-কে অমরত্ব দান করেছেন। আমটি বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথেও মানিয়ে যায়। আমি এর আগে ল্যাংড়া , ফজলী ও হাঁড়ি ভাঙ্গা আমের নামকরণের কাহিনী লেখার চেষ্টা করেছি। আম্রপালী আমের নামকরণের ইতিহাস লিখার কাজও আজ শেষ করলাম।
আম্রপালীর জীবন কাহিনী জানতে অনেকের মধ্যে আগ্রহ দেখেছি। এ আগ্রহ কাউকে কাউকে বিস্মিত করেছে । আমার মনে হয় বিখ্যাত এ আমের নাম আজ থেকে ২৫০০ বছর আগে জন্মনেয়া যে এক নারীর (তাও আবার সমাজের চোখে নগর বধু তথা বহু ভোগ্যা) নামে হয়েছে তার জীবন কাহিনী জানতে আগ্রহী থাকাটাও স্বাভাবিক । ভুলে গেলে চলবে না ,এ নারীর সাথে দেখা হবার পর স্বয়ং গৌতম বুদ্ধও তাঁর নীতিমালা কিছুটা সংশোধন করেছিলেন।

……………………..
টীকা ঃ -১.বিম্বিসার ৫৪২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৯২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মগধ (বর্তমানে বিহার) শাসন করেন । বিম্বিসার বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এবং জৈন ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় উত্তর ভারতে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার সম্ভব হয়েছিল। বিম্বিসার গৌতম বুদ্ধ অপেক্ষা পাঁচ বছর ছোট ছিলেন।বিম্বিসারের অনুরোধে বুদ্ধ অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোস ব্রত পালনের বিধি প্রচলন করেন। আবার, বিম্বিসারের অনুরোধেই বুদ্ধ বর্ষাকালে পরিব্রাজন না করে একটি নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে সাধনার বর্ষাবাস নামক রীতি প্রচলন করেন। (সূত্র : ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।)

টীকা ঃ -২ প্রাপ্ত ইতিহাসের মূল পয়েন্টকে ক্লু হিসেবে ধরে সম্ভাব্য ঘটনা ও সংলাপ কল্পনা করে “আম্রপালী আমের নামকরণের ইতিহাস ” অধ্যায় রচিত হচ্ছে। বিস্তারিত জানতে রেফারেন্স হিসেবে জৈন ধর্মগ্রন্থ , তিব্বতীয়ান গ্রন্থাদি ,অশ্বঘোষের ‘বুদ্ধচরিত’ , বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ,হিউইয়েন সাং এর বর্ণনা , The age of imperial unity, পালি ভাষায় লেখা আম্বপালিকাসূত্র , ইন্টারনেট দেখা যেতে পারে। এছাড়াও ১৯৬৬ সালে হিন্দী ভাষায় মুক্তিপ্রাপ্ত লেখ ট্যান্ডন পরিচালিত ‘আম্রপালী’ নামক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। আচার্য চতুর্সেনের ‘বৈশালী কি নগরবধূ’ ও অনুরাগ আনন্দের ‘The legend of Amrapali’ তাঁকে নিয়ে রচিত দুটি বিখ্যাত উপন্যাস ।(শেষ)

বাংলাদেশ সময়: ১৭:২১:৩৯   ৪২৮৮ বার পঠিত