বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০১৯
মুজিবনগর দিবস ও বাংলাদেশ
Home Page » জাতীয় » মুজিবনগর দিবস ও বাংলাদেশবঙ্গ-নিউজঃ আজ ১৭ই এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। ৭০’সালের নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভকারী আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল গঠিত হয় সার্বভৌম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’, যা ‘বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার’ বা ‘মুজিবনগর সরকার’ নামেও পরিচিত। ১৯৭১-এর ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার মন্ত্রিপরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মপ্রকাশ করে বাংলাদেশের এই প্রথম সরকার। ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার’ হিসেবে পরিচিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতাযুদ্ধকালীন এই সরকারের দক্ষ নেতৃত্ব ও পরিচালনায় মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি লাভ করে স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের।
১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে শুরু হওয়া জনগণের প্রতিরোধযুদ্ধ তথা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠন ও সমন্বয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় এবং এই যুদ্ধে প্রত্যক্ষ সহায়তাকারী রাষ্ট্র ভারতের সরকার ও সেনাবাহিনীর সাথে সাংগঠনিক সম্পর্ক রক্ষায় মুজিবনগর সরকারের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। এই সরকার গঠনের সাথে সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধযুদ্ধ প্রবল যুদ্ধে রূপ নেয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত হয়।১৯৭১-এর ২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আক্রমণ শুরু করলে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১০ এপ্রিল প্রবাসে জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বিশেষ অধিবেশনে মিলিত হন। এই অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে গঠিত হয় বাংলাদেশ সরকার। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী থাকায় উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে করা হয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য নিয়োগ করা হয়। কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি ঘোষণা করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ প্রদান করেন।১৭ এপ্রিল ১৯৭১ সালে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় হাজার হাজার মানুষের সামনে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেন। দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০ সাংবাদিকের সামনে বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র পাঠ এবং মুক্তিবাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন আম্রকানন লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। আনন্দ-আবেগে উদ্বেলিত শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, গগন বিদারী স্লোগানে স্লোগানে আম্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। চৌকি পেতে তৈরি করা হয় শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ৬টি চেয়ার। আশপাশের বাড়ি থেকে চৌকি, চেয়ার ও বাঁশ আনা হয়। ওপরে শামিয়ানাও লাগানো সম্ভব হয়নি, ফলে খোলা আকাশেই মঞ্চ তৈরি করা হয়। বেলা ১টায় শুরু হয় শপথ অনুষ্ঠান।
শপথ অনুষ্ঠানে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের শুরুতেই কোরআন পাঠ করেন যুবক বাকের আলী। জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গেয়েছিলেন স্থানীয় মিশনারির শিল্পীরা, তাদের নেতৃত্ব দেন প্রভাষক আসাদুল ইসলাম (প্রয়াত)। তৎকালীন মেহেরপুরের এসডিপিও এসপি মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে আনসারের একটি দল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রীদের গার্ড অব অনার প্রদান করেন। যারা শপথ নেন তাদের পরনে ছিল সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি। অনুষ্ঠানে নেতাদের জন্য পাশের গ্রাম থেকে হাতলবিহীন কতগুলো চেয়ার আনা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এমএনএ (পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী)। বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হয়। অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। সেই ঘোষণাপত্র রচিত হয় ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার ভিত্তিতে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়
“যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হইয়াছিল।” এবং “যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিলেন।”
এবং “যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন।” এবং “যেহেতু আহূত এই পরিষদ স্বেচ্ছায় এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে।” এবং “যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলোচনাকালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন।”
এবং “যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখ-তা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।”“যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাহাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য সেইহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা, পূর্বাহ্নে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।“এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধানএবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী।
রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের ক্ষমতা থাকিবে। তাঁহার কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকিবে। তাঁহার গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও উহার অধিবেশন মুলতবি ঘোষণার ক্ষমতা থাকিবে। উহা দ্বারা বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হইবেন“আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।”
মুজিবনগরের আ¤্রকাননে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে বলেনÑ
“আজ এই মুজিবনগরে একটি স্বাধীন জাতি জন্ম নিল। বিগত ২৪ বছর যাবৎ বাংলার মানুষ তাঁর নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীরা তা হতে দেয়নি। তারা আমাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও তারা বাধার সৃষ্টি করে আমাদের উপর চালালো বর্বর আক্রমণ। তাই আমরা আজ মরণপণ যুদ্ধে নেমেছি। এ যুদ্ধে জয় আমাদের অনিবার্য। আমরা পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে বিতাড়ন করবোই। আজ না জিতি কাল জিতবো। কাল না জিতি পরশু জিতবোই। বাংলাদেশে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যার ঘটনা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রবর্গ আজ যে নীরবতা অবলম্বন করছেন তার জন্য আমি গভীরভাবে দুঃখিত। আমি প্রশ্ন করতে চাইÑ লক্ষ লক্ষ নিরীহ নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করাকে ইসলাম অনুমোদন করে কি? মসজিদ, মন্দির বা গীর্জা ধ্বংস করার কোন বিধান কি ইসলামে আছে? বাংলাদেশের মাটিতে আর কোন সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের মাতৃভাষাকে মুক্ত করতে যুদ্ধ করছে। নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামকে স্তব্ধ করা যাবে না। পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সংযোজন হল তা চিরদিন থাকবে। এমন কোন শক্তি নেই যে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে ফেলতে পারে।”
শপথ অনুষ্ঠানের পর বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ বলেনÑ
… … … ‘শেখ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরি অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণ-প্রশাসন বিভাগের কর্মচারিগণ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারিগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকে তারা ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকেরাও সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারো নির্দেশ মেনে চলবেন না।
এ অবস্থার মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হল। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলী সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সমাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলীর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল।’ এক নজরে মুজিবনগর সরকার,স্থাপিত : ১০ই এপ্রিল ১৯৭১শপথ গ্রহণ : ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১
অস্থায়ী সচিবালয় : মুজিবনগরক্যাম্প অফিস : ৮, থিয়েটার রোড, কোলকাতা
রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (পাকিস্তানের কারাগের বন্দী)উপ-রাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি),প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দিন আহমেদ
অর্থমন্ত্রী : এম. মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী : এম কামরুজ্জামান
পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী : খোন্দকার মোশতাক আহমেদ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গঠন : মন্ত্রণালয় ও দফতরসমূহ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নি¤œলিখিত মন্ত্রণালয়/বিভাগে সংগঠিত হয়Ñ (১) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় (২) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (৩) অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় (৪) মন্ত্রিসভা সচিবালয় (৫) সাধারণ প্রশাসন বিভাগ (৬) স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় (৭) তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় (৮) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (৯) ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় (১০) সংসদ বিষয়ক বিভাগ (১১) কৃষি বিভাগ (১২) প্রকৌশল বিভাগ।
মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল, যারা সরাসরি মন্ত্রিসভার কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত, যেমন (১) পরিকল্পনা কমিশন (২) শিল্প ও বাণিজ্য বোর্ড (৩) নিয়ন্ত্রণ বোর্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির (৪) ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি (৫) শরণার্থী কল্যাণ বোর্ড।
বিভিন্ন অঙ্গসংগঠন
মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হিসেবে লিখিত বেসরকারি সংস্থা, দল, গোষ্ঠী, সমিতি, বাহিনী ইত্যাদি ভূমিকা পালন করেছে (১) যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বোর্ড (২) বাংলাদেশ হাসপাতাল (৩) স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (৪) জয় বাংলা পত্রিকা (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র) (৫) বাঙলাদেশ বুলেটিন (৬) বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন (৭) বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (৮) স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল (৯) বঙ্গবন্ধু শিল্পী গোষ্ঠী (১০) বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গোষ্ঠী (১১) বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি (১২) বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ (১৩) নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ (১৪) বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, লন্ডন (১৫) লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া।
বাংলাদেশ সরকার দেশবাসীর প্রতি লিখিত নির্দেশাবলী জারি করে
পাক সরকার ও দখলদার বাহিনীকে কোন প্রকার সহযোগিতা করা চলবে না। সকল প্রকার খাজনা, শুল্ক পাক সরকারকে দেয়া চলবে না।
ক্স আঠারো থেকে ত্রিশ বছরের যুবকরা অবিলম্বে মুক্তিফৌজের অধিনায়ক বা প্রতিনিধির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করবেন।
ক্স পাটের পরিবর্তে আউস ধান চাষ করতে হবে।
ক্স গণধিকৃত দখলদার নিঃশেষ করতে হবে। সংগ্রামবিরোধী গোয়েন্দাদের নির্মূল করা প্রত্যেকটি বাঙালীর কর্তব্য।
ক্স মুক্তিফৌজের সাথে সর্বপ্রকার সহযোগিতা এবং দখলদার বাহিনীর প্রতিপদে বাধা দিতে হবে।
ক্স সকল সরকারী-বেসরকারী কর্মচারীদের পাক সরকারের অধীনে কাজে যোগ না দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে মুক্তি সংগ্রামের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
বাংলাদেশ পরিষদ সদস্যবর্গের সমাবেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে বলেন‘বন্ধুরা আমার, নির্বাচন উত্তর কালে রমনার রেসকোর্স ময়দানে আমাদের মহান নেতা আমাদেরকে শপথ বাণী উচ্চারণ করিয়েছিলেন। সেদিন সাক্ষী ছিল রেসকোর্স ময়দানের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী জনতা আর বাংলার নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ। আমি আজ গর্বের সঙ্গে বলব মহান নেতার হাত ধরে আমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সে প্রতিজ্ঞায় আমরা অটুট এবং অটল রয়েছি। আপনাদের অসীম মনোবল বিগত কয়েক মাস যাবৎ স্বাধীনতা সংগ্রামকে জিইয়ে রেখেছে। অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে এই কথা বলতে হবে আমাদের যে সমস্ত বীর সৈনিকেরা, মুক্তিফৌজের যে তরুণ সংগ্রামীরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছেন তাঁদের অপূর্ব বীরত্ব বাংলার মানুষের জন্য এক গর্বের বস্তু। আর ভবিষ্যৎ ইতিহাসের জন্য তা এক অপূর্ব বীর গাঁথা।’ ‘মূলতঃ এবং বাহ্যত বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী রেখে যান। আমরা জানতাম, বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেপ্তার হন, তবে স্বাধীনতা ঘোষণা তিনিই করে যাবেন। আর এই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে।প্রিয় বন্ধুরা আমার, ২৫শে মার্চের রাতের পরে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তাই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা করতে আমাদের একটু বিলম্ব হয়েছিল।
আমরা যে পাঁচজন শেখ সাহেবের পাশে ছিলাম এবং যাদের কাছে কথিত, লিখিত, অলিখিত সর্বপ্রকারের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়ে গিয়েছিলেন, ১০ই এপ্রিল তারিখে বাংলার পূর্ব অঞ্চলে সর্বপ্রথমে একত্রিত হলাম। পরিষদের সদস্যবৃন্দ যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সামনে সেদিন আমি আমার সহকর্মীবৃন্দের তরফ থেকে স্বাধীনতা কার্যকরী করার জন্য পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম। তখন যোগাযোগহীন অবস্থায় আপনাদের বেশীর ভাগই ছিলেন বাংলাদেশে শত্রুর দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরে। অথচ একটা সরকার গঠন না করলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরিচালনা করা যাচ্ছিল না। সেই হেতু সেদিনের উপস্থিত বন্ধুদের কাছেই আমরা পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আর একটি আম্রকাননে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি।
লেখক//
আল-আমিন সালমান,স্টাফ রিপোর্টার বঙ্গ-নিউজ।
বাংলাদেশ সময়: ৯:২২:৪৮ ৯৩১ বার পঠিত