বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৯

“রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০১৯



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৮১তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -৪০ , ”আম নিয়ে বিড়ম্বনা”-২

ভদ্রলোক স্যার দুলাল সাহেবের সাথে আলাপ শুরু করলেন।
- রাজশাহীর আম বুঝি। বেশ টসটসে ,হিমসাগর না?
-জি, মানে ?
-ও হিমসাগর বুঝলেন না ? আপনাদের ও দিকে বোধ হয় ক্ষীরশাপাত বলে। ( ভদ্রলোক স্যারের এ বক্তব্য অবশ্য সঠিক ছিল না। কারণ বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা ও উৎকৃষ্টতা দুই দিক থেকেই হিমসাগর আম অনেক এগিয়ে। ক্ষিরসাপাত আমের সাথে এর অনেক মিল রয়েছে। দেখতে প্রায় একই রকমের। তবে স্বাদে কিছুটা হলেও ভিন্নতা আছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিখ্যাত সুস্বাদু জাত ল্যাংড়ার মিষ্টতা ১৭ থেকে ১৯ শতাংশ কিন্তু ক্ষীরশাপাতির মিষ্টতা ১৯ থেকে ২০ শতাংশ । সাম্প্রতিক কালে জামদানী শাড়ী ও ইলিশ মাছের পর দেশের তৃতীয় ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে জিআই নিবন্ধন পেয়েছে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাত আম’।)
দুলাল সাহেব দ্বিধান্বিত হয়ে মাথা নাড়লেন। দুলাল সাহেবের আমের জ্ঞান যে কম ,ভদ্রলোক স্যার শুরুতেই তা বুঝে গেলেন। তিনি বললেন -দেখেন আম নিয়ে মানুষের আগ্রহ এত কম কেন বুঝিনা।বাঙালি শিশুর অক্ষর পরিচয়ের শুরুই তো আম ফলের হাত ধরে। ঐ যে অ-তে অজগর আসছে তেড়ে; আ-তে আমটি আমি খাবো পেড়ে।একটি নয়, তিনটি দেশের মানে পাকিস্তান, ভারত আর ফিলিপাইনের জাতীয় ফল এই আম। আর বাংলাদেশের জাতীয় বৃক্ষ হলো আম গাছ। আম গাছ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে খুব পবিত্র । তাদের মতে বুদ্ধ তাঁর সঙ্গী সন্ন্যাসীদের নিয়ে শান্তিময় এক আম বাগানে বসে ধ্যানরত ছিলেন। সেখানে তিনি বিশ্রাম নিয়েছিলেন।এরপর থেকে বৌদ্ধদের কাছে আম গাছ পবিত্র । হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধদের বিভিন্ন মঙ্গলানুষ্ঠানে আম ও আম পাতার ব্যবহার যুগ যুগ ধরে শুভ চিহ্নরূপে স্বীকৃত হয়ে আসছে। আমের সব ইতিহাস আমি জানি। মোগল সম্রাট আকবর তাঁর শাসন আমলে ভারতের লাখবাগের দারভাঙা এলাকায় প্রায় এক লাখ আমগাছ রোপণ করেছিলেন। এটিকে বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় আমবাগান। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে আম গাছ। আপনি কি তা জানেন ?
দুলাল সাহেব সমান্তরাল ভাবে মাথা নাড়িয়ে তার অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। স্যার আবার বলা শুরু করলেন-বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে পলাশীর আমবাগানে , ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় , মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় বৈদ্যনাথতলার আম বাগানে , আমাদের জাতীয় সংগীতে আমগাছের কথা আছে। ঐ যে ‘ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে”। দুলাল ভাই অবশ্য এসব জানতেন। কিন্তু তখন মুখ খোলা বোকামী হতে পারে ভেবে চুপ করে থাকলেন।
এর পর স্যার উঠে গিয়ে ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে বললেন আজ জুন মাসের ২০ তারিখ। বাজারে আর গোপাল ভোগ আম থাকার কথা নয় , কারণ এ আম মে মাসের ২০ তারিখের পর থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। গোপাল ভোগ মহিলাদের খুব পছন্দের আম। গোপালভোগ ও গুটি জাত বাজারজাত করণের মাধ্যমেই আমাদের দেশে আমের বাজারগুলো খুলে যায়। উন্নত মানের আমসত্ত্ব তৈরী করা যায় শুধুমাত্র গোপালভোগ আম থেকে। এ আমসত্ত্ব একটু খটখটে বটে তবে দুধে ফেললে বা চাটনিতে পড়লে তার স্বাদ গন্ধে পাগলপারা না হয়ে উপায় থাকে না। পশ্চিম বঙ্গের মালদহ জেলায় এ আমের একফুট করে লম্বা আমসত্ত্ব সব সময় পাওয়া যায়।

এখন তো আর গোপালভোগ পাওয়া যাবেনা , তাই এ সব বলে আর লাভ নাই। তবে আমার পছন্দ হিমসাগরই।কারণ এতে বিন্দু পরিমান আঁশও নেই । আবার দেখেন আমের এ জাতটি সবচেয়ে সুস্বাদু। সবচেয়ে বেশী উৎপাদিত হয়। দেশে ও বিদেশে এর কদরও সবচেয়ে বেশি। দেশে উৎপাদিত মোট আমের প্রায় ২৫ ভাগই হিম সাগর, ঐ আপনারা যাকে ক্ষিরসাপাত বলেন আর কি।
-জী স্যার ,জী স্যার। দুলাল সাহেব যেন দায়মুক্ত হয়ে মাথা নাড়লেন।

-আমি চাঁপাই -রাজশাহীর আমের সব খবর রাখি। “কানসাট আম বাজার” শুধু বাংলাদেশ নয় এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় আম বাজার । আমি সেখানেও আম কেনার জন্য গিয়েছিলাম। এ ছাড়া শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, আলীনগর, রহনপুর এলাকার আমের বড় বাজারগুলিও আমি ঘুরে এসেছি। এখন হিমসাগর আমের মৌসুম চলছে ,না ? আসলে আমের রাজা ল্যাংড়ার পরেই জনপ্রিয় আম হলো এই খিরসাপাত বা হিমসাগর। তবে আপনাকে একটা কথা বলি -জুন মাসের ১৫ তারিখের আগে কখনোই এই আম কিনবেন না। অপরিপক্ক থাকে।ঢাকায় প্রতারণা করে -জুন মাসের ১৫ তারিখের আগেই অপরিপক্ব হিমসাগর আম বিক্রী হয়। কেউ কিচ্ছু জানে না ,বুঝলেন ? দেদারসে সবাই কিনে। বিজ্ঞতার আভায় ভদ্রলোক স্যারের মুখ রঙীন হয়ে উঠলো। তারপর আবার বলা শুরু করলেন -

আচ্ছা, বাজারে এরপর আসবে ল্যাংড়া আম। তখন কি কিছু আম দিতে পারবেন? আমার মেয়ে আবার ল্যাংড়া আম পছন্দ করে? গাছপাকা ল্যাংড়া আম, দুধ দিয়ে চটকে খেলে এর সুঘ্রাণ হাতের তালুতে লেগে থাকে সারা দিন।
-পারবো স্যার। এবার সফলতার আভায় ভদ্রলোক স্যারের মুখ রঙীন হয়ে উঠলো। জোরসে হাঁক দিলেন এই কে আছো ? গেষ্ট কে একটু চা-নাস্তা দাও। তারপর আবার আমের প্রসংগে ফিরে গেলেন। বাজারে কিন্তু ল্যাংড়া আম এসেই গেছে । ১৫ জুনের পর থেকেই এ আম পাওয়া যায়।
-ঠিক আছে স্যার আমি পরের সপ্তাহেই ল্যাংড়া আম নিয়ে আসবো।
-, আনবেন। অসুবিধা নাই-জুলাই মাসের দিকেই আসলে এই আম পাকতে শুরু করে আর বাজারে বেশী পাওয়াও যায়। এ আমকে ছোটো ছোটো টুকরো করে খাবার মজাই আলাদা। কাঁচা অবস্থায় কিন্তু এ আমটি প্রচন্ড টক হয়। তবে কাঁচা অবস্থায় যতই টক হোক না কেনো পাকলে কিন্তু অসাধারন মিষ্টি। আবার তার রং ও গন্ধের তুলনা হয় না। তবে মনে রাখবেন জুন মাসের ১৫ তারিখের আগে ল্যাংড়া আম বাজারে এলে সেই আম কখনোই কেনা উচিত নয়। এই দামি আম অপরিপক্ব অবস্থায় বেশি পয়সা খরচ করে কেনার কোনো মানে হয়না।
চা নাস্তা এসে গেল। ভদ্রলোক স্যার বললেন -নেন খান। আমি নাস্তা করেছি। দুলাল ভাই খাচ্ছেন । ওদিকে স্যার বলেই চলেছেন।
- দেখেন আমার এক নাতনি আছে। সে আবার শুধু ফজলি আম পছন্দ করে। বড়বড় কিনা? ঐ সময় বড় বড় কিছু আম দিবেন। দেখেন ল্যাংড়া আম সবচেয়ে সুস্বাদু-ঘ্রাণ সুন্দর, হিমসাগর মিষ্টি বেশি তবে বড়বড় ফজলি আমের কদরই আলাদা। ম্যাডাম আবার জ্যাম ও আচার তৈরীর জন্য ফজলি আম বেশী পছন্দ করেন। এ আম আধাসের থেকে একসের বা তার বেশী ওজনের হয় । আপনি বড়গুলিই দিবেন। ফজলি জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে বাজারে পাওয়া যায় এবং থাকে জুলাই এর চতুর্থ সপ্তাহ পর্যন্ত ।
আর সবশেষে দিবেন অসময়ের আশ্বিনা আম। উৎপাদনের দিক থেকে দেশে একক ভাবে প্রথম স্থানে রয়েছে আশ্মিণা। দেশের আমের ২৮ ভাগ হয়ে থাকে আশ্মিণা। যার প্রায় পুরোটাই চাঁপাইনবাবগঞ্জ এবং রাজশাহীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আগষ্ট সেপ্টেম্বর জুড়ে এ আম পাওয়া যায়।
এ পর্যন্ত কাহিনী প্রথমদিন দুলাল সাহেবের মুখে শুনে আমার মনে হয়েছিল – আম বিশেষজ্ঞ এ স্যার ১০০% খাঁটি এক জন আম খাদক। কিন্তু আমার কথা থাক। সেদিনের কাহিনীতেই আবার ফিরে যাই।
এ সময় এক ম্যাডাম ট্রলিতে ৩ বাটি আম নিয়ে আসলেন। দুলাল সাহেবের বুঝতে বাকি রইলো না যে ইনিই স্যারের স্ত্রী। উঠে ছালাম দিলেন। স্যার পরিচয় করে দিলেন ।. আপনি তো খুব ভাল আম এনেছেন বলে ম্যাডাম সবার হাতে আমের বাটি গুলি ধরিয়ে দিলেন।
-স্যার আপনি তো দেখছি সব আমের খবরই রাখেন স্যার। আমকে অনেক ভালবাসেন। আম খেতে খেতেই দুলাল সাহেব বললেন।
-আপনি তা বুঝতে পেরেছেন ? স্যার ম্যাডামের দিকে তাকিয়ে কেন জানিনা এবার রহস্যের হাসি হাসলেন। আম্পায়ারের কাছে দীর্ঘ আবেদন জানিয়ে সফল হলে বোলার যেমন করে মাথা নাড়ে তিনি তেমন করে মাথা নাড়লেন তবে উল্লাস প্রকাশ করলেন না। বিজ্ঞতার আভায় স্যারের মুখ আবারও রঙীন হয়ে উঠলো। মাহবুব সাহেবের দেয়া আম খেয়ে খালি বাটি ট্রলিতে রাখার সময় দুলাল সাহেবের মনে একপ্রকার অপরাধ বোধ কাজ করতে লাগলো। কিন্তু এখন তো আর কিছু করার নাই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন বগুড়ায় যেয়ে এ তিন ঝুড়ি আমের দাম তিনি মাহবুব সাহেবকে দিয়ে দিবেন। বেচারা মাহবুব সাহেবের কথা ভেবে ভেবে তিনি বোধ হয় অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলেন ,স্যারের একটা আচমকা প্রশ্নে সম্বিত ফিরে পেলেন।
- ভাল আমের নাম ল্যাংড়া কেন হলো ? জানেন সে কাহিনী ? বলি তবে শোনেন- স্যার সে কাহিনী শুরু করার জন্য একটু কেশে গলা পরিস্কার করে নিলেন। এতক্ষণ পর্যন্ত আমের বিভিন্ন তথ্য শুনে শুনে ও আমের বিভিন্ন ফরমায়েস নিতে নিতে ক্লান্ত দুলাল সাহেবের কাছে মনে হলো ”ভাল আমের নাম ল্যাংড়া হবার কাহিনী “ টা হয়তো মজাদার হতে পারে। মজার কিছু পেলে দুলাল সাহেব আবার জগতের সবকিছু ভুলে যায়। তাই কাহিনীটি শোনার জন্য তিনি নড়েচড়ে বসলেন। কিন্তু এ সময় ম্যাডাম ভীষণ জোরে এবং বিশ্রীভাবে গলাখাঁকারি দিয়ে আমপ্রাপ্তি নিশ্চিত না করে এ কাহিনী অবতারণা করার অপ্রাসঙ্গিকতা বোঝাতে স্যারের দিকে ভীষণ অবজ্ঞার দৃষ্টিতে তাকালেন। দুলাল সাহেব ভড়কে গেলেন। স্যারকেও কেমন যেন ভীত –সন্ত্রস্ত মনে হল। স্যারের মুখ এই প্রথম সাদা কালো হয়ে উঠলো । দুলাল সাহেবের এ কাহিনী শোনার আশাভঙ্গ হলেও ভাবলেন এ কাহিনী তিনি তো পরে অন্য কারো কাছ থেকেও জেনে নিতে পারবেন। ভদ্রলোক স্যার ”ভাল আমের নাম ল্যাংড়া হবার কাহিনী “ আর শুরু না করে সাথে সাথে প্রসঙ্গ পাল্টালেন। (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ৯:৩২:০৯   ৫০৭ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #