মঙ্গলবার, ২২ জানুয়ারী ২০১৯

“রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
মঙ্গলবার, ২২ জানুয়ারী ২০১৯



 

 জালাল উদদীন মাহমুদ

৬৯ তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -২৮ স্পেশাল টিপস-২ (শেষ)

আমি যখন এ প্রজন্মের কাছে খাবার বিষয়ে আমার সংগৃহীত সতর্ক বাণী সমূহ লিপিবদ্ধ করছিলাম-তখন হঠাৎ মনে পড়লো একজন আজ থেকে কুড়ি বছর আগে খাবার বিষয়ে আমাকে কিছু অমূল্য উপদেশ দিয়েছিলেন। আমি তখন সেসব গুরুত্ব সহকারে আমলে নেই নাই। ক”জন আর শুনে শুনে শিখতে চায় , বাঙালীরা শিখে ঠেকে ঠেকে। আমিও ঠেকে ঠেকেই শিখেছি। তবে কেউ যদি শুনে শুনে শিখতে চায় –শুধু তাদের জন্যই এখন লিখছি-

১৯৯৮ সাল। আমি তখন বগুড়া সেনানিবাস শাখার ম্যানেজার। মাসের প্রথম ১০ দিন এ শাখায় তখন দুপুরের খাবার অবসর তেমন সময়মত মিলতো না। তবে মাসের শেষ ১০ দিনে কাজ বেশ কমে যেত। তো তখন মাসের শেষ দশ দিন চলছিল। ব্যাংকে তেমন ভীড় নেই। সেদিন আমি আমার চেম্বারের টেবিলেই বসে দুপুরের খাবার খাচ্ছিলাম। খাবার শুরু করে ফেলেছি , এমন সময় একজন মেজর সাহেব রুমে ঢুকলেন। ব্যাচ দেখে বুঝলাম আর্মি মেডিক্যাল কোরের ডাক্তার।তাকে মনে হয় এর আগে দেখি নাই। তিনি নিজেই জানালেন এ ক্যান্টনমেন্টে তিনি নবাগত।সৌজন্যতার খাতিরে আমি তাকে আমার সাথে খাবার আমন্ত্রণ জানালাম। তিনি নো থ্যাংকস বলে মৃদ্যু হাসলেন।
খাওয়া শেষ হলে তিনি বললেন –আহার করলেন ম্যানেজার সাহেব ? তার “আহার” শব্দটি আমার ভাল লাগলো না। কাস্টমার ইজ কিং । তাই মুখে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে বললাম-আপনাকে বসিয়ে একটু খেলাম আর কি । আপনার জন্য কি করতে পারি?
তিনি জানালেন , তিনি সি, এম , এইচ-এ নতুন যোগদান করেছেন । তার স্ত্রীও এখানে একসাথে যোগদান করেছেন। তাদের উভয়ের বেতনের জন্য হিসাব খোলা দরকার। আমি নিজে উঠে গিয়ে দুটো হিসাব খোলার ফরম নিয়ে এসে তা ফিল আপ করার জন্য তার হাতে দিলাম। উনি কলম বের করলেন , কিন্তু লিখতে গিয়ে থেমে গেলেন। বললেন-আপনাকে কি কিছু প্রশ্ন করতে পারি।
-অবশ্যই , আমি জোর দিয়েই বললাম।
-ব্যাংকের বিষয়ে নয় , আপনার ব্যাক্তিগত বিষয়ে। এমনিতেই তো তার ”আহার ”শব্দটি ভাল লাগে নাই। আবার ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করতে চায়। ঐ যে কাস্টমার ইজ কিং। বললাম-জীঁ ,প্লীজ বলুন।
-থ্যাংক ইউ।আমি ,মানে আমি বলছিলাম কি , আপনি দুপুরে এত খাবার খান কেন? ডিম দেখলাম , মাছ দেখলাম আবার দুই বাটি ভাত।
-ব্যাংকে চাকুরী করি তো ।অনেক পরিশ্রম। তাই বাধ্য হয়ে একটু বেশী খেতে হয়।
-কি এমন পরিশ্রম করেন ? গা না ঘামলে তা আবার কিসের পরিশ্রম ? আপনি তো অন্যের রিযিক খাচ্ছেন ?
একে তো প্রথম পরিচয় ,তার উপর এমন গা জ্বালা সব কথা । একবার মনে হলো একটা যুৎসই উত্তর দেই। কিন্তু এবার মার্শাল ফিল্ড-এর সেই বিখ্যাত উক্তিটি মানস পটে ভেসে উঠলো- “রাইট অর রং, দি কাস্টমার ইজ অলওয়েজ রাইট”। মনের ক্ষোভ মনেই চেপে রেখে আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললাম-আমি নিজে চাকুরী করি।আমার স্ত্রীও চাকুরী করেন ।আমরা আমাদের নিজের রোজগারে চলি।অন্যের রিজিক খাই না। শেষের লাইন টি আমি জোর দিয়ে বললাম।
- ম্যানেজার সাহেব কিছু মনে করেন না। আমার একটা বদঅভ্যাস হলো আমি যেটা ভাল মনে করি বা যেটা অন্যের জানার দরকার আছে বলে মনে করি তা সরাসরি আই মিন ডাইরেক্ট বলা পছন্দ করি। আপনার কি আর একটু সময় হবে-দুটো কথা বলতাম।
-কিন্তু আগে আপনার হিসাব তো খুলতে হবে।
-সেটা নিয়ে ভাববেন না। আমি না হয় আরেক দিন আসবো। একজন ডাক্তার হিসেবে আমি আপনাকে দুটো পরামর্শ দিতে চাই।অবশ্য যদি আপনি জানতে চান।
এ সময় তাকে আমার পরোপকারী বলে মনে হলো। নিজের কাজ বাদ দিয়ে অন্যকে পরামর্শ দিতে চায়। দিক-না।বললাম কি বলতে চান বলেন প্লীজ। তবে তার আগে বলুন আপনাকে কি খাওয়াবো।
-না না আমাকে কিছু খাওয়াতে হবে না। তাছাড়া আমি এখনও লাঞ্চ করি নাই। তো যা বলছিলাম-দেখেন সৃষ্টিকর্তা আপনাকে কৃষক বা শ্রমিক বানাতে পারতেন? ঠিক কি-না ?
-হ্যাঁ ঠিক।
-আপনি যদি কৃষক বা শ্রমিক হতেন তখন আপনাকে অনেক বেশী শারিরীক- পরিশ্রম করতে হতো। ঠিক কি-না ?
-ঠিক । তবে আমি শারিরীক পরিশ্রম অতটা না করলেও অনেক মানসিক পরিশ্রম তো করি।
-হ্যাঁ , তা করেন। কিন্তু শারিরীক পরিশ্রম করলে যত ক্যালোরীর প্রয়োজন , মানসিক পরিশ্রমে তার চেয়ে তো অনেক কম ক্যালোরীর প্রয়োজন । জানেন তো ?
-জানবোনা কেন ? অবশ্যই জানি।
-কিন্তু আপনি এসব মানসিক পরিশ্রমের জন্য যতটুকু ক্যালরী প্রয়োজন , তার চেয়ে তো অনেক বেশী গ্রহন করছেন । এত বেশী ক্যালরী দরকার ঐ মাঠে-ময়দানে খেঁটে খাওয়া দিন মজুর -শ্রমিকদের ।ঠিক কি-না?
তার যুক্তি খন্ডন করার মত কোনও পাল্টা যুক্তি সে সময় মাথায় আসলো না।আমতা আমতা করে শুধু বললাম-তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।
-এ সেন্সেই আমি আপনাকে বলেছিলাম আপনি অন্যের ক্যালরী তথা রিজিক খাচ্ছেন। মনে হয় আপনি মাইন্ড করেছেন।
মাইন্ড করবো কিভাবে। তিনি তো জ্যামিতির সূত্রের মতই বিষয়টি প্রমান করেছেন। তাই আমি তার এ কথার কোন উত্তর দিলাম না। আমার মনে হলো , তার কথাগুলো আমার শোনা প্রয়োজন কিন্তু তাকে খালিমুখে আমি কতক্ষণ বসিয়ে রাখবো। তাকে অনন্তঃ চা-বিস্কুট খাবার জন্য পিড়াপীড়ি শুরু করলাম। তিনি এবার চা বিস্কুট খাবার জন্য রাজী হলেন।
চা-বিস্কুট খেতে খেতে উনি বললেন-প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমরা যে খাবার খাই-তা সাধারনতঃ ফ্যাট আকারে শরীরে জমা হয়।আমাদের ওজন বাড়ায়। ঘটায় নানা বিপত্তি। বয়স যখন বাড়তে থাকে তখন হাড়ে হাড়ে তা টের পাওয়া যায়। এ সময় অকস্মাৎ উনি প্রশ্ন করলেন-সব মানুষের রিজিক যে নির্দিষ্ট এটা মানেন কি না ?
-অবশ্যই মানি।
- দেখেন এ ব্যাপারে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তাধারা আছে। হয়তো তা ভুলও হতে পারে। জানি না, আপনিও তা মানবেন কি-না । না মানলে না মানবেন। তবুও আমি বলতে চাই। শ্রমিক-কৃষকের খাদ্যের চাহিদা ও রেজেকের মাধ্যমে তার যোগান আমার আপনার সাথে সমান হবার কথা নয়। আমরা যদি আমাদের নির্ধারিত রিজিকের বেশী অংশ জীবনের প্রথমেই খেয়ে শেষ করি , তাহলে জীবনের শেষ অংশে সেখানে ঘাটতি পড়তে পারে।কিন্তু তখন হয়তো আপনার হাতে অনেক টাকা তাই খাবারেরও কোন অভাব নাই। তা হলে আগে যে বেশী খেলেন তা অ্রাডজাস্ট হবে কি ভাবে ?
-জানি না । উপরআলাই জানেন।
-ঠিকই বলেছেন। দেখেন, আমাদের অনেকেরই এ সময় হাই ব্লাড প্রেশার ,ডায়াবেটিকস, ওবেসিটি ইত্যাদি হয়। সামর্থ্য থাকলেও খাবার আর সুযোগ থাকেনা।অটোমেটিক অ্যাডজাস্টমেন্ট আর কি । তিনি শব্দ করে হেসে উঠলেন।
- কিন্তু সে যদি আগেই মারা যায় –তা হলে তো সীমাবদ্ধ রিজিকের বিষয়টির সমাধান হতে পারে।
-কিন্তু হায়াৎ তো আবার নির্দিষ্ট ।
-তা হলে ?
-তা হলে আর কি , ঐ অসুখ-বিসুখ। যার মাধ্যমে খাওয়া কমে যাবে। সবকিছু অ্যাডজাস্ট হয়ে যাবে।
–চমৎকার যুক্তি।
- দেখেন , ম্যানেজার সাহেব , আমি ভাবি কি মহান সৃষ্টি কর্তা আমাকে -আপনাকে যে হালে রেখেছেন তাতে আশা করা যায় আমরা হয়তো আর খাবারের অভাবে মরবো না। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় বেশী বেশী খেয়ে আমরা কিন্তু নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছি ,এ সব অসুখে অনেকে মারাও যাচ্ছেন। তার মানে কি অতিরিক্ত খাবার মৃত্যুর একটা কারণ হয়ে যাচ্ছে। ফ্রাঙ্কলিন বলেছেন , না খেয়ে মানুষতে মরতে দেখেছি খুব কম কিন্তু অতিরিক্ত খেয়ে মরতে দেখেছি অনেককে।
-শুধু নিজে পেট পূর্তি খাবারের উপর ধর্মেও নিষেধাজ্ঞা আছে।
-তা হলে বোঝেন ধর্ম ও বিজ্ঞান কিন্তু এখানে মিলে গেল।
-কিন্তু আপনার থিউরী মানলে আমাদের খাদ্যের বিভিন্ন স্বাদ থেকে তো বঞ্চিত হতে হবে।আমি হাসতে হাসতে বললাম।
-না না ,আমি কাউকে খাবারের স্বাদ থেকে বঞ্চিত করতে এ পরামর্শ গুলি দিচ্ছি না। তা ছাড়া দেখুন খাবারের প্রচুর বৈচিত্র্য রয়েছে,আপনি হাজারো উপায়ে একটার সঙ্গে আরেকটা মিশিয়ে নানা কম্বিনেশনে খাবার গ্রহণ করতে পারেন।
উনি সেদিন আরো বলেছিলেন,- হঠাৎ করেই খাওয়া কমে দিতে পারবেন না। এজন্য কিছুটা মানসিক শান্তনাও দরকার।খাবার আগে পানি খাবেন। তাহলে খাবার আগ্রহও কমে যাবে। একটি গবেষণায় দেখেছিলাম খাওয়ার আগে পানি খেলে খাবার কম খাওয়া হয়। ফলে এ পদ্ধতি ওজন কমাতে সাহায্য করে। তাই খাবার আগে পানি পান করুন।দুপুরে রুটি নিয়ে আসবেন সংখ্যায় বেশী কিন্তু আকার –আয়তন-ওজনে প্রতিটি রুটি হবে ছোট। তাতে এ ভেবে মানসিক পরিতৃপ্তি পাবেন যে আপনি অনেকগুলি রুটি খেয়েছেন।অল্প-স্বল্প করে হলেও প্রতি দিনের খাবারে ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ কমানোর কৌশলগুলি কিন্তু আয়ত্ত্ব করতে হবে।কৌশলগুলি কি জানতে চাইলাম। উনি সেদিন অনেকগুলি কৌশল বলেছিলেন , কিছু কিছু মনে আছে। এই যেমন-অস্বাস্থ্যকর খাবার যখন আমাদের সামনে দেয়া হবে বা অস্বাস্থ্যকর খাবার স্বেচ্ছায় খেতে চাব তখন অন্ততঃ ছয় সেকেন্ড সে খাবারের নেতিবাচক দিক নিয়ে ভাবতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবার এড়িয়ে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে নিজেই নিজের মনকে প্রশিক্ষন দিতে হবে। আমরা অনেক সময় ভাবি ছোট-খাট অনিয়ম করলে আর কি হবে? কিন্তু মনে রাখতে হবে ছোট্ট পরিবর্তনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে যেটা জুরুরী তা হলো নিজের আগ্রহ কে নিয়ন্ত্রণ করা।
সেদিন তিনি আরো অনেক কথাই বলেছিলেন। শেষে তিনি বলেছিলেন-আমরা অনেক কিছুই জানি কিন্তু মানি না।

আমরা অনেক কিছুই জানি কিন্তু মানি না -তার এ কথাটা অন্যের বেলায় জানিনা আমার বেলায় কিন্তু একদম প্রমানিত সত্য । আমিও তার পরামর্শ গুলি সে সময় মানি নাই। ঠেকায় পড়ে একদিন খাবারের নিয়মকানুন মানা শুরু করলাম ঠিকই , কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে।
আমি এটাও জানি যারা এ লেখা পড়ে যা কিছু জানবেন তার অধিকাংশই কিন্তু মানা শুরু করবেন অনেক বিলম্বে । ততদিনে আমার মতই অনেক দেরী হয়ে যাবে। গোলাম হোসেন বোধ হয় ঠিকই বলেছিল বাঙালী দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যদা বোঝে না।

আমরা সব সময় বলি পরিবর্তন চাই । আজ যখন সেদিনের অমূল্য উপদেশগুলি স্মরণে আনছি তখন কেন জানি মনে হচ্ছে আমরা যেসব খাবারে আমাদের প্লেট ভরিয়ে তুলি, সেখানেও এখনি বড় ধরণের পরিবর্তন আনা শুধু জরুরী নয়, বিশেষ জরুরী।
শুধু কি নিজের জন্য বিশেষ জরুরী? না, শুধু নিজের জন্য নয়। সারা দেশের এমনকি সারা বিশ্বের হত দরিদ্র মানবকুলের তিন বেলা ভরপেট খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য মানুষের খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে শুধু প্রয়োজনীয় ক্যালরী গ্রহনের বিষয়টি বিশেষ জরুরী । কারন -কৃষিজমিতে বসতবাড়ী নির্মান , শিল্পায়ন ও নগরায়নের ফলে আবাদযোগ্য জমির পরিমান দিন দিন যে কমে যাচ্ছে। অতিরিক্ত খ্যাদ্যের যোগান আসবে কোথা থেকে ? আমাদের অতিরিক্ত ক্যালরী গ্রহনের ফলে অন্যকে যে অভুক্ত থাকতে হবে।(ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২২:৫৬:১১   ৪৫৫ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #