শনিবার, ১৯ জানুয়ারী ২০১৯
ভারতে গরু পাচারে জড়িত সিনিয়র অফিসারদের বদলি করা হচ্ছে
Home Page » আজকের সকল পত্রিকা » ভারতে গরু পাচারে জড়িত সিনিয়র অফিসারদের বদলি করা হচ্ছেবঙ্গ-নিউজঃ ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) সিনিয়র ও মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গত ২০১৮ সালের ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, বাহিনীর নতুন মহাপরিচালক ১৯৮৪ ব্যাচের আইপিএস অফিসার রজনী কান্ত মিশ্র বাহিনীর মধ্যে শুদ্ধি অভিযানে নেমেছেন। সিনিয়র সরকারি সূত্র জানিয়েছে, মিশ্র এরই মধ্যে বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তা- যাদের মধ্যে ইন্সপেক্টর জেনারেল পর্যায়ের কর্মকর্তারাও রয়েছেন - তাদেরকে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় গরু পাচারের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে অন্য জায়গায় বদলি করে দিয়েছেন।
এই ‘নীরব’ বদলির আগে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেন মিশ্র। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বিএসএফ প্রধানের দায়িত্ব নেন তিনি। সিবিআই ডিরেক্টর অলোক ভার্মার পদত্যাগের সাথে এই বিষয়টির পরোক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। সেন্ট্রাল ভিজিলেন্স কমিশন (সিভিসি) অলোক ভার্মার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল যে, তিনি বিএসএফ কর্মকর্তা এবং গরু পাচারকারীদের মধ্যে সম্পর্ক গড়তে ‘সহায়তা’ করেছিলেন।
ভার্মার বিরুদ্ধে অভিযোগের যে তালিকা দেয়া হয়েছিল সেখানে নিচের দিকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুতর হিসেবে রয়েছে এই অভিযোগ: “বিএসএফের কমান্ডেন্ট-গরু পাচারকারীদের সাহায্য করা”। দুটি ছাড়া, অন্যান্য অভিযোগ এবং সুনির্দিষ্ট এই অভিযোগটিও ‘ভিত্তিহীন বা মিথ্যা’ প্রমাণিত হয়েছে।
উচ্চ পর্যায়ের ওই কমিটির সদস্যরা হলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিরোধী দলীয় নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং প্রধান বিচারপতির মনোনীত বিচারপতি এ কে সিক্রি। খাড়গে ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি হাই-পাওয়ার্ড কমিটির জন্য যে ছয় পাতার নোট তৈরি করেন সেখানে সিভিসির অভিযোগ ও অনুসন্ধানের বিস্তারিত রয়েছে এবং বিরোধী দলীয় নেতার নিজের মন্তব্যও সেখানে রয়েছে। নোটটির কপি সাউথ এশিয়ান মনিটরের কাছে রয়েছে। খাড়গের মতে, “সুপ্রিম কোর্ট যেমনটা বলেছে যে, শুধু অভিযোগ বা পরোক্ষ প্রমাণ দিয়ে কাউকে দোষি সাব্যস্ত করা যায় না”।
সিবিআই বিশেষ ডিরেক্টর রাকেশ আস্তানা গত বছর সিভিসির কে ভি চৌধুরির কাছে লেখা এক চিঠিতে যে অভিযোগগুলো উল্লেখ করেছিলেন, তার মধ্যে এগুলোও ছিল। সাউথ এশিয়ান মনিটরের তদন্ত ও সরকারের সিনিয়র সূত্রগুলোর সাথে কথোপকথনে বেরিয়ে এসেছে যে, বিএসএফের সাবেক কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা এবং ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কর্মকর্তা এতে জড়িত ছিলেন, যাদের নাম প্রকাশ করেছেন জিবু ডি ম্যাথিউ। সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ৮৩ ব্যাটালিয়নের সাবেক কমান্ডেন্ট ম্যাথিউকে সে সময় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে গরু পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে পশ্চিম বঙ্গের মুর্শিদাবাদের রোশানবাগে বদলি করা হয়েছিল। ম্যাথিউয়ের উল্লেখিত কর্মকর্তারা পরে ভার্মার সাথে দেখা করে ‘মামলাটি তুলে নিতে বলেন’। এটা শোনা গেছে যে, এই সিনিয়র কর্মকর্তাদের সবাই ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) সাথে জড়িত এবং মামলা তুলে নেয়ার জন্য তারা ভার্মাকে তিন কোটি রুপি দেয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সিবিআই চিফ তাদের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন।
সরকারি সূত্রগুলো জানিয়েছে ভার্মা যখন তাদের প্রস্তাবে রাজি হননি, তখন এই সিনিয়র বিএসএফ ও আইবি কর্মকর্তারা আস্তানার সাথে যোগাযোগ করে, যিনি পরে সিভিসির কাছে অভিযোগ করেন। ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি ট্রেনে (শালিমার এক্সপ্রেস) করে নিজ রাজ্য কেরালা যাওয়ার পথে ম্যাথিউকে গ্রেফতার করে সিবিআই। এর পর থেকে মামলার দায়িত্ব তারাই নিয়েছে। ট্রেনে ম্যাথিউ ৪৫ লাখ নগদ রুপি নিয়ে যাচ্ছিলো। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, এই অর্থ মূলত গরু পাচারকারীদের কাছ থেকে নেয়া ঘুষ, যেগুলো সে রোশানবাগ এলাকার পাচারকারীদের থেকে নিয়েছে। ওই এলাকাটি তার দায়িত্বের অধীনে ছিল।
কেরালার আলাপ্পুঝা এলাকা থেকে ধরা হয় ম্যাথিউকে। ২০১৬ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত রোশানবাগ এলাকার কমান্ডেন্টের দায়িত্বে ছিল সে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, কোলকাতার কুখ্যাত গরু, মাদক ও অস্ত্র পাচারকারী বিশু শেখের সাথে তার নিয়মিত যোগাযোগ ছিল।
সিনিয়র বিএসএফ কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, আইজি এবং ক্যাডার কর্মকর্তা পর্যায়ের অনেকে গরু পাচার থেকে সুবিধা পেয়েছেন, যারা মূলত দক্ষিণ বঙ্গ এবং ত্রিপুরা ফ্রন্টিয়ারে দায়িত্বরত ছিলেন। বিএসএফের সাবেক দুই মহাপরিচালক গরু পাচারকারীদের কাছে থেকে টাকার ভাগ পেতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাবেক বিএসএফ প্রধানদের একজনের ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যের কয়লা খনিতে শেয়ার রয়েছে বলেও জানা গেছে।
এই ধরনের রিপোর্টও শোনা গেছে যে, দিল্লীর কাছে উত্তর প্রদেশের কোন একটি জেলার এমপি, কেন্দ্রীয় সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রীর ছেলে এই গরু পাচার চক্র থেকে ব্যাপক উপকৃত হয়েছেন। যে সব রাজ্য থেকে গরু পাচার হয়, উত্তর প্রদেশ তার অন্যতম। তবে এ রিপোর্টের সত্যতা যাচাই করা যায়নি।
পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরায় ২০১৬ থেকে ২০১৮ সাল সময়কালে দায়িত্ব পালনকারী বিএসএফের অন্তত চারজন আইজি পর্যায়ের কর্মকর্তাকে নীরবে বদলি করে নন-অপারেশনাল দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ম্যাথিউ তাদের নাম প্রকাশের পর এই পদক্ষেপ নেয়া হয়। সাউথ এশিয়ান মনিটর এই কর্মকর্তাদের নামের তালিকা পেয়েছে কিন্তু আইনি কারণে সেগুলো প্রকাশ করা যাচ্ছে না। এই আইজিদের একজন যিনি অন্ধ্র প্রদেশের বাসিন্দা, তাকে মুর্শিদাবাদ-মালদা সেক্টরের বেরহামপুর/ফারাক্কা এলাকায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
আইপিএস কর্মকর্তা ছাড়াও ম্যাথিউ বেশ কিছু বিএসএফ ক্যাডার কর্মকর্তার নামও দিয়েছেন, যাদের মধ্যে তিনজন ডেপুটি ইন্সপেক্টর-জেনারেল পর্যায়ের যারা বাহিনীর গোয়েন্দা শাখায় কাজ করতেন। এই ডিআইজিদের একজন যিনি “গরু পাচার উসকে দেয়ার সাথে গভীরভাবে জড়িত” ছিলেন, ম্যাথিউয়ের দেয়া তালিকায় নাম আসার পরপরই তিনি স্বেচ্ছা অবসরে যান এবং পরে তিনি কানাডায় চলে যান।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতা গ্রহণের পর এবং উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু রাজ্যে গরু ও ষাঁড় জবাই নিষিদ্ধ করার পর গরু পাচার বহুগুণে বেড়ে গেছে। গরু জবাই নিষিদ্ধ করার কারণে বিভিন্ন রাজ্যের পাচারকারী চক্র বাংলাদেশে চারগুণ বেশি গরু পাচার করেছে।
বিএসএফের কিছু কর্মকর্তা এই সুযোগটা নিয়েছে, যাদের কেউ কেউ পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার গরু পাচার চক্রের মাফিয়াদের সাথে হাত মিলিয়েছে, যাদের অন্যান্য রাজ্যের সাথে যোগাযোগ রয়েছে, যেখান থেকে গরু আনা হবে। যদিও দাবি করা হয়েছে যে, পাচার ঠেকানোর জন্য ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তের প্রায় পুরোটাই ১,০৯০ কিলোমিটার (পশ্চিম বঙ্গের সাথে ২,২১৬.৭ কিলোমিটার এবং ত্রিপুরার সাথে ৮৫৬ কিলোমিটার) জায়গা বেড়া দেয়া হয়েছে। এরপরও পাচারের হার এই পরিমাণ বেড়েছে। মজার ব্যাপার হলো, গরু পাচার যেখানে “সক্রিয় রয়েছে এবং বাড়ছে”, সেখানে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ২০১৭-২০১৮ সালের বার্ষিক রিপোর্টে এ বিষয়টি উল্লেখই করা হয়নি।
ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকায় বেশ সক্রিয় বাংলাদেশের ন্যারকোটিক্স কনট্রোল ডিপার্টমেন্ট-এর সূত্র জানিয়েছে, এমন ঘটনা তারা দেখেছেন যেখানে স্বর্ণ ছাড়াও মাদক ও অন্যান্য নেশাজাতীয় দ্রব্য পাচারের সাথে বিএসএফ কর্মকর্তা এবং জওয়ানরা জড়িত ছিল। নেশাজাতীয় দ্রব্যগুলো মূলত ভারতীয় সীমান্ত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে আর স্বর্ণ বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করে।
বাংলাদেশী এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ‘এগুলোর কোনটাই রিপোর্টে উল্লেখ করা যায় না। তবে বিশেষ করে সেক্টর পর্যায়ে বিএসএফ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠকের সময় আমরা মৌখিকভাবে আমাদের উদ্বেগ ও গোয়েন্দা তথ্য তাদের কাছে জানিয়েছি’। সূত্র : সাউথ এশিয়ান মনিটর।
বাংলাদেশ সময়: ৮:২৪:০১ ৫৭০ বার পঠিত