বুধবার, ১৬ জানুয়ারী ২০১৯

“রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “ -জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “ -জালাল উদদীন মাহমুদ
বুধবার, ১৬ জানুয়ারী ২০১৯



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৬৩ তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -২২ -অপূর্ব ভোজন -৩।

জীবনে একবারো যারা স্যারের মত ঝাল মরিচ খাওয়ার অভিজ্ঞতা পেয়েছেন , তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন ঝাল মরিচ কতটা ঝাল । আমার মনে হয় আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্ম মিষ্টির পরিবর্তে দিন দিন ঝালের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। স্যারের ঝাল খাবার সে ঘটনা স্মরণ ও নতুন প্রজন্মের ঝালের দিকে ঝোঁক- আমাকে মরিচের ঝাল সম্পর্কে নতুন করে তত্ত্ব –তালাশ করতে উৎসাহিত করে তোলে।
অনেকে মনে করেন, একটি কাঁচা মরিচের সবচে ঝাল অংশটি হচ্ছে এর ভেতরে থাকা বীচিগুলো। আসলে কিন্তু তা না। এর ভেতরকার নরম ফাঁপা অংশ টুকুই হচ্ছে সবচে বেশি ঝাল। নরম ফাঁপা অংশের ভেতরে থাকে ‘ক্যাপসাইসিন’ নামের রাসায়নিক উপাদান।‘ক্যাপসাইসিন’ আমাদের মুখে এমন অনুভূতি তৈরি করে যেন মুখের ভেতর আগুন জ্বলছে। একটি মরিচ মুখে দেয়ার পর ‘ক্যাপসাইসিন’নামক ওই রাসায়নিক উপাদান আমাদের মুখের লালার সঙ্গে মিশে যায় এরপর মুখ এবং জিহ্বায় থাকা একধরণের রিসিপটরের সঙ্গে একত্রিত হয়ে মস্তিষ্কে সঙ্কেত পাঠায় এবং মস্তিষ্ক আমাদের বোঝায় যে আমাদের মুখে আগুন জ্বলছে।
একটা গাছে যখন মরিচ ধরে, তখন প্রথমেই মরিচের মধ্যে ‘ক্যাপসাইসিন’ নামের উপাদানটি তৈরি হয়। এর ফলে মানুষ ,গরু বা ছাগলের মতো স্তন্যপায়ী প্রাণিদের ভক্ষণ থেকে এটা প্রাথমিকভাবে রক্ষা পায়। আমার মনে হয় মরিচ যদি মিষ্ট স্বাদের হতো তবে শুরুতেই মানুষ বা অন্য প্রাণীরা তা খেয়ে সাবাড় করে দিত। কারন মরিচ গাছগুলো ছোট ছোট তাই সবার নাগালের মধ্যে। মরিচ কিন্তু এক প্রকারের ফল যা মসলা হিসাবে ঝাল স্বাদের জন্য রান্নায় ব্যবহার করা হয়। মরিচই কিন্তু একমাত্র ফল যা কামড়ালে এটাও পাল্টা কামড় দেয়।
রফিক বলেছিল পাখিরা প্রচুর মরিচ খায়। পাখিরা কেমন করে এত ঝাল মরিচ খায়? ওদের মুখে কি ঝালের অনুভূতি সৃষ্টি হয় না? আগেই বলেছি হয় না। কারণ স্তন্যপায়ী প্রাণিদের মতো পাখির জিহ্বায় ঝাল সনাক্ত করার মত রিসিপটর নেই। তাই ঝালের অনুভূতিও পাখিদের থাকে না।

আকার, আকৃতি, রঙ যাই হোক না কেন- সব কাঁচা মরিচেই একটা বিশেষ গুণ থাকে তা হলো মুখটাকে জ্বালিয়ে দেয়ার গুণ। শুধু মুখ বলছি কেন, চোখসহ শরীরের অন্য অঙ্গগুলোতে এর ছোঁয়া লাগলে সেখানেও মনে হয় যেন পুড়ে যাচ্ছে।
ক্যাপসাইসিন অণুকে মরিচ থেকে সরিয়ে ফেলা সম্ভব হলে ঝাল থেকে বোধ হয় রেহাই পাওয়া যেত। মনে হয় গবেষণা করে ক্যাপসাইসিনবিহীন মরিচের জাত উদ্ভাবন করা সম্ভব । পৃথিবীতে যথারীতি বিভিন্ন মাত্রার ঝালের মরিচ উদ্ভাবন করা হয়েছে। ক্যাপসিকামে ঝাল নেই তার কারণ এটিতে ক্যাপসাইসিন অণু নেই। স্যার নাগা মরিচের কথা বলেছিলেন । এই নাগা মরিচ পৃথিবীর সবচেয়ে ঝাল মরিচ হিসেবে চিহ্ণিত । স্যার ঝাল দুর করার জন্য সেদিন পানি খাবার চেষ্টা করছিলেন। আমরা সবাই জেনে গেছি -মরিচ ঝাল লাগার কারন মরিচের ভিতর ‘ক্যাপসাইসিন’ নামক জৈব পদার্থের উপস্থিতি। ক্যাপসাইসিন’ জৈব পদার্থ হবার কারনেই মরিচের ঝাল পানি দিয়ে হাজার বার ধুলেও তা প্রশমিত করা যায়না।

স্যারকে অবশ্য সেদিন কিছু তথ্য জানান সম্ভব হয় নাই যেমন যারা প্রচুর পরিমাণে ঝাল মরিচ খান তাদের মৃত্যুর হার ১৩ শতাংশ কম। এছাড়াও কাঁচা মরিচ খেলে হজম ক্ষমতার উন্নতি ঘটে,রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার উন্নতি ঘটে , ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়, সাইনাসের সমস্যা দুর হয়, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে,ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসে,হার্টের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
কাচা মরিচ অন্ততঃ তিনটি ক্ষেত্রে ম্যাজিক দেখাতে পারে। কাঁচা মরিচে থাকা কিছু উপকারি উপাদান দেহে প্রবেশ করামাত্রই এমন ম্যাজিক দেখাতে শুরু করে যে কোনও ধরনের শরীরের যে কোন যন্ত্রণা কমতে সময়ই লাগে না। এছাড়াও কাঁচা মরিচ খাওয়া মাত্রই শরীরে এক প্রকার হরমোনের ক্ষরণ বেড়ে যায়, যার প্রভাবে স্ট্রেসের প্রভাব ম্যাজিকের মত যেমন কমা শুরু করে, তেমনি তাৎক্ষণিকভাবে মন-মেজাজ চাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকে । এ ছাড়া কাঁচা মরিচ খাওয়া মাত্রই শরীরে ভিটামিন সি-এর মাত্রা বৃদ্ধি পায় ।
যে সকল ভদ্র মহিলাগণ বিউটি পার্লার ও ত্বকের ডাত্তারের কাছে বেশী দৌড়াদৌড়ি করেন তাদের বলি কাঁচা মরিচ খান। কারণ মরিচে রয়েছে প্রচুর মাত্রায় ভিটামিন সি এবং বিটা-ক্যারোটিন। এই দুটি উপাদান শরীরে প্রবেশ করার পর এমন ম্যাজিক দেখায় যে মুখের বলিরেখা গায়েব হতে শুরু করে। কিছুদিনের মধ্যেই ত্বকের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে একেবারে চোখে পড়ার মতো। পাশাপাশি চুলও ভাল থাকবে। এ ছাড়াও ভিটামিন সি এবং বিটা-ক্যারোটিন দৃষ্টিশক্তির উন্নতি ঘটাতেও কার্যকরী । কাঁচা মরিচ খেলে কমলা আর না খেলেও চলবে। তাই আমার সাথে এক্ষুণি প্রতিজ্ঞা করুন প্রত্যহ অন্ততঃ একটা করে কাঁচা মরিচ খাব। তবে পেট ব্যথা এবং গ্যাস্ট্রিক বা ঝাল-সমস্যা থাকলে কম খাওয়া ভাল।

আবার খাবার পর্বে ফিরে আসি । এ পর্যায়ে,সবার পাতে এবার দেয়া হলো কাতলা মাছের ঝোল। বিশাল মাছের মাথাটা পড়লো স্যারের পাতে। স্যার আৎকে উঠলেন , বিশাল মাথাটা তার পাত থেকে সরিয়ে নিতে বার বার অনুরোধ করতে লাগলেন। এবার রফিক অভয় দিয়ে বললো পারবেন স্যার, পারবেন। মরিচ খাওয়াতে উৎসাহিত করা আর লবণসহ গোটা চামচটাই স্যারের মুখে ঢুকিয়ে দেয়ার জন্য এমনিতেই স্যার রফিকের উপর চরম নাখোশ ছিলেন ,এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন- বেকুব! এ মাথা খাওয়া শেষ করতে হলে আজ সন্ধ্যা হয়ে যাবে। খাবার হলো আল্লাহর নেয়ামত, নষ্ট করবো আমি? বহু বছর পরে আজ যখন সেদিনের অপূর্ব ভোজন পর্বের বর্ণনা লিখছি তখন হঠাৎ মনে হচ্ছে সেদিন রফিককে স্যারের দেয়া এ বেকুব উপাধি হয়তো অবাস্তব ছিল না।
যা হোক ,রফিক আপাততঃ চুপ মেরে গেল, স্যারও খাবার দিকে মনোযোগ দিলেন। এমন সময় হঠাৎ সবার পাতে সরাসরি বয়াম থেকে ঘি ঢেলে দেওয়া হলো। স্যার এবার বিরক্ত হয়ে বললেন, এসব কি? কিছু দেবার আগে জিজ্ঞাসা তো করতে হয়? পরিবেশনকারী হাসতে হাসতে বললেন বাড়ীতে বানান ঘি, চেখে দেখেন। বোঝেন এখন। পোয়া খানেক ঘি দিয়েছে শুধু চেখে দেখার জন্য। মুখ ভর্তি ভাত নিয়ে রফিক বলে উঠলো- এখানে কেউ জিজ্ঞাসা করে দেয় না স্যার, আরো কত কিছু যে দিবে। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে কিছু ভাত ছিটকে পড়লো। রফিকটার যদি কান্ড জ্ঞান থাকতো। আগে মুখের ভাত শেষ কর। তারপর কথা বল। মনে মনে ভাবলাম আমি। আমার ভাবনা শেষ না হতেই সবার পাতে পড়লো এবার ঝোলসহ বাগাড় মাছের বিশাল এক টুকরা। বলা নেই-কওয়া নেই কোন দিক থেকে পাতে হঠাৎ করে দিয়ে বসে – বোঝাও মুশকিল। জ্ঞানী লোকের মত রফিক বললো- স্যার কাছেই যমুনা আর বাঙালী নদী। নদীর মাছ স্যার। বাগাড় মাছ খেয়ে দেখেন স্যার , স্বাদ গরুর মাংসের মতো। পোড়াদহের মেলায় একশো কেজি ওজনের বাগাড় মাছ পাওয়া যায়। আপনাকে একবার নিয়ে যাব স্যার।
স্যার রফিকের দিকে চোখ তুলে এবার মোলায়েম স্বরেই বললেন আপনিই বেশি করে খান। আমাকে বললেন - এসবের চেয়ে ছোট মাছ আর শাক দিলেই ভাল হতো। আরাম করে খেতে পারতাম। রফিক পানি খাচ্ছিল। পানি ঠিক মতো না গিলেই অস্ফুট স্বরে মোটা গলায় বললো ওসব গরিব মানুষের খাবার। এ এলাকার ইস্টি কুটুম্ব কে কেউ ছোট মাছ আর শাক দেয় না। ভর্তাও না। আরো কিছু সে বলতে চাচ্ছিল- কিন্তু বিষম উঠায় কথা শেষ করতে পারলো না। আমি বাম হাত দিয়ে তার পিঠ থাবড়াতে থাবড়াতে পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য বললাম- বেশী করে পানি খা।
একটা গামলায় পাংগাশ মাছ দেখে- স্যার কঠিন গলায় বললেন আর কোন মাছ যেন না দেয়া হয়। তাকিয়ে দেখলাম স্যারের থালা ভর্তি রুই মাছের বিশাল মাথা তখনও শেষ হয় নাই। বাগাড় মাছের পিসতো আস্তই পড়ে আছে। যা হোক অনেক কসরৎ শেষে একসময় খাওয়া শেষ করে সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। একজন এসে প্লেট গুলো ধুয়ে আবার কেন জানি সামনেই রাখলো। ভাবলাম মিষ্টি তো আগেই খেয়েছি- তাহলে এখন বোধ হয় দৈ দিবে। কারন বিশাল এক দৈ এর ভান্ড আমার নজরে এসেছে। কিন্তু পেটে তো আর জায়গা খালি নাই। শুনলাম এতক্ষণ ধরে বাড়ীর ছোট ছেলে পরিবেশন করছিল। এখন যিনি এসেছেন তিনি বাড়ির মেঝ ছেলে। মুরুব্বী তাকে দেখাইয়ে দিয়ে গর্ব করে বললেন হামার মেজ ছাওয়াল।
মেজ ছাওয়াল আসার সাথে সাথে বাড়ীর ভিতর থেকে বৈঠক খানায় গামলাকে গামলা মাংস আসতে থাকলো। (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২১:৫৮:১৪   ৬৩৫ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #