শুক্রবার, ১১ জানুয়ারী ২০১৯

“রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
শুক্রবার, ১১ জানুয়ারী ২০১৯



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৫৮ তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -১৭।

শাখায় উনি ঢাকার স্যার বা হেড অফিসের স্যার নামেই পরিচিত ছিলেন। হাটে কৃষিঋণ আদায়ের প্রচারনা চালানোর কাজে হাটবারে আমাদের কাজ শেষ হতে হতে প্রায়ই গভীর রাত হতো। এরপরেও কেউ রাতে খাবার জন্য দাওয়াত দিলেও ধর্মপরায়ণ স্যার সাধারনতঃ না করতেন না। বলতেন দাওয়াত দিলে না করতে নাই। ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে দাওয়াত কবুল করার একটা সম্পর্ক আছে। হাদীস শরীফে আছে ……যে ব্যক্তি দাওয়াত কবুল করে না, সে আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সাঃ) এর সঙ্গে নাফরমানী করে। তো একদিন স্থানীয় হাট শেষে নগর গ্রামে দাওয়াত খেতে চলেছি। রাত ১০টা কি ১১টা হতে পারে। অনেক রাত ধরে হাটে হাটে ঘুরার কারণে হাটেকয়েক রাত ধরে ঘুমের তেমন সময়ই পাচ্ছিলাম না। ঘুম ঘুম চোখে গ্রামের সরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে মটর সাইকেল চালাচ্ছিলাম , ধীরে ধীরে। স্যার যথারীতি পিছনে বসে আছেন। গিয়ার থাকা অবস্থায় মটর সাইকেলের গতি খুব কম থাকলে হঠাৎ স্টার্ট অফ হয়ে যায়।আমার বেলাতেও তাই হলো। স্টার্ট অফ হয়ে গেল। তখন আমাকে রাস্তার কিছুটা কিনার দিয়ে যেতে হচ্ছিল। কারন রাস্তার কিছু অংশ খারাপ ছিল। তখন আব্রেকবে ব্রেক ধরলাম । মাটিতে দু পা নামিয়ে ব্যালান্স করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বাম পায়ের নীচের মাটি পায়ের চাপে হঠাৎ সরে গেল। মটর সাইকেল রাস্তায় পড়ে যাচ্ছে দেখে স্যার কিছু না বলেই মটর সাইকেল থেকে প্রায় লাফ দিয়ে রাস্তার খারাপ দিকটাই নামলেন। আমিও নামার জন্য রাস্তার কিনারের দিকে পা দিলাম। কিন্তু তাল সামলাতে না পেরে নীচের ধান ক্ষেতে গড়িয়ে পড়ে গেলাম। মটর সাইকেল রাস্তাতেই পড়ে থাকলো। তখন বোধহয় বৈশাখ মাস ছিল। বিকেলে হঠাৎ বেশ বৃষ্টিও হয়েছে। মাটি তখনও ভেজা ভেজা। গরমের দিনে শীতল বিছানার মতো। রাতের বেলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাথার উপর সূর্য্য নেই। দুদু’চোখে তন্দ্রা লেগেই ছিল। ঘুমিয়ে পড়ার সব পটভূমি প্রস্তুত। বেশ কয়েক মিনিট অসাড়ের মত পড়ে থাকার পর মনে হলো জগতে যা ঘটার ঘটুক- আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। সত্যিসত্যিই ওখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সেদিন। ঘুমানোর আগ পর্যন্ত ঢাকার স্যারের চিৎকার শুনছিলাম-জালাল! জালাল! জোর করে উঠার চেষ্টা না করি। আমি লোকজন ডেকে আনছি। ভয়ের কোন কারন নেই।

কতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই । ঘুমের ঘোরেই অনেকক্ষণ ধরে একটা শোরগোল শুনছিলাম।  মনে হলো আস্তে আস্তে ঐ শোরগোলের শব্দ নিকট থেকে নিকটতর হচ্ছে। আমি কিন্তু ঘুমের ঘোরেই। হঠাৎ চোখের উপর টর্চের তীব্র আলো। না জেগে উপায় নাই। জেগে গেলাম। দেখি, টর্চধারী চিৎকার করছে - এই যে, এই যে পাওয়া গেছে। রাস্তা থেকে নীচের ধানক্ষেতে সকলের পক্ষে নামা খুব সহজ নয়।  অনভ্যস্থ স্যার তাই রাস্তার উপর থেকেই বলছে,জালাল ভয় না করি, আমি লোকজন ডেকে এনেছি। লোকজনকে তো আমি দেখতেই পাচ্ছি। হাতে হাতে হ্যারিকেন, চেরাগ। একজনের হাতে টর্চ, সে তো আমার সামনেই। টর্চের আলোয় এক ঝলকে দেখলাম দুজন লোকের হাতে লম্বা লাঠি-দড়ি-তক্তা। কিন্তু কেন? যা হোক নিজেই উঠে দাঁড়াতে পারতাম । কিন্তু অতি উৎসাহী লোকজনের কারনে তাদের কাঁধে ভর দিয়ে উঠে দাড়াঁলাম। দেখলাম, ভেজা মাটিতে গা-প্যান্ট-শার্ট মেখে যাওয়া ছাড়া আর কোন সমস্যা নাই । মটর সাইকেলও ওকে। সামনের পাড়াতেই দাওয়াৎ। দাওয়াৎ প্রদানকারীও আগত লোকজনের সাথেই ছিল। তার বাসায় পৌঁছে তাদের লুঙ্গি-গামছা-নিয়ে টিউবয়েলের পানিতে আচ্ছা মতো গোসল সেরে নিলাম। লুঙ্গি পরেই খাওয়াও শেষ করলাম। প্যান্ট-শার্ট যতদূর সম্ভব পরিষ্কার করে বাসার পথ ধরলাম। মটর সাইকেলে আমার পিছন থেকে স্যার জানালেন-তিনি নাকি খুব ভয় পেয়েছিলেন। আমি ভয় পেয়েছিলাম কিনা জানতে চাইলেন।আমি বললাম- আমি তো ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ভয় পাইনি। আমি যে অজ্ঞান হয়ে যাই নাই বরং ঘুমিয়ে ছিলাম স্যার তা অনুধাবণ করেছেন-তাই এ নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয়। ঘটে যাওয়া ঘটনার কারনেই হোক বা ক্লান্তির কারনেই হোক স্যার হঠাৎ চুপ চাপ হয়ে গেলেন। আমি এক সময় নীরবতা ভেঙ্গে বললাম- লোকজন বাঁশ-দড়ি-তক্তা নিয়ে এসেছে দেখে ঘাবড়িয়ে গেছলাম। এখনও বুঝতে পারছি না বাঁশ-দড়ি-তক্তা কেন ? এবার স্যার বিজ্ঞ - হাসি হাসলেন। বললেন- আমার একটা দায়িত্ব আছে না। তোমাকে যদি হাসপাতালে নিতে হয় তাহলে ঐ লোকজন যেন তক্তায় শোয়ায়ে কাঁধে করে নিয়ে যেতে পারে, সে ব্যবস্থাও করে রেখেছিলাম। আমাকে তো সবকিছুই ভাবতে হয়েছে। স্যারকে ভীষণ দূরদর্শী মনে হলো।

সুদুর অতীতে ঘটে যাওয়া এ ঘটনা যখন লিখতে বসেছি তখন হঠাৎ একটা গল্প মনে পড়ে গেল- আফ্রিকার কোন একটা দেশে সেনাবাহিনীর একটা কনভয় পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চলেছে। ঝামেলা হলো -অধিনায়কের লুজ মশান হয়েছে। পথে একটা স্বাস্থ্যকেন্দ্র পড়ায় একজন সৈনিককে সেখানে পাঠানো হলো-ঔষধের জন্য। সৈনিক ঔষধ নিয়ে এসে স্যালুট দিয়ে অধিনায়কের হাতে দিল। বললো- ৬ ঘন্টা পর পর একটা করে ক্যাপসুল খেতে হবে।
অধিনায়ক-খাবার আগে না পরে?
সৈনিক- তা শোনা হয় নাই স্যার (স্যালুট)।
অধিনায়ক-এ ঔষধে কাজ না হলে কি করতে হবে?
সৈনিক- তা শোনা হয় নাই স্যার (আবার স্যালুট)
অধিনায়ক- সব প্রকার খাবার খেতে পারবো কিনা?
সৈনিক- তা শোনা হয় নাই স্যার। (পুনঃস্যালুট)
অধিনায়ক- ইডিয়ট-যাও সব শুনে এসো।
(সৈনিকের প্রস্থান এবং ঘন্টা খানেক পরে পুনঃ আগমণ এবং সব তথ্য প্রদান)
অধিনায়ক-(সব তথ্য নেবার পর) তোমার হাতে ওটা কিসের কাগজ?
সৈনিক-ডেথ সার্টিফিকেট।
অধিনায়ক- ডেথ সার্টিফিকেট ! কার?
সৈনিক- (স্যালুট করে) আপনার স্যার। আপনি সব কিছু শুনে আসতে বলেছিলেন তাই ডাক্তার কে বললাম, এ অসুখে হঠাৎ স্যার যদি রাস্তায় মারা যান তাহলে কি করতে হবে? উনি বললেন একটা ডেথ সার্টিফিকেট লাগবে তখন। । আমি ডাক্তার কে বললাম তাহলে একটা ডেথ সার্টিফিকেট দিন।
অধিনায়ক- আর সাথে সাথে ডাক্তার তা দিয়েও দিলেন ?
সৈনিক- (হাসি মুখে স্যালুট করে) উনি সহজে দিতে চাননি স্যার। আমি আপনার কথা বলে ভয় দেখালাম – আর সাথে সাথে দিয়ে দিলেন।
অধিনায়ক এবার চিৎকার করে বলে উঠলেন, “বেকুফ-বেআক্কেল”। বেকুফ-বেআক্কেল” উনি সৈনিক কে না ডাক্তার কে বলেছিলেন- তা অবশ্য জানা যায় নাই।
তবে স্যারের মতই সৈনিকটিকে আমার দূরদর্শী মনে হয়।
ডেমাজানী শাখায় কৃষি ঋণ আদায়ে গিয়ে আমি আর একবার মটর সাইকেল দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম। সে কাহিনী শুনলে মনে দ্বিধা হবে -এটা হাস্যকর না রোমাঞ্চকর ? (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২৩:১৯:৫৬   ৮৫৬ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #