শনিবার, ৫ জানুয়ারী ২০১৯

“রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
শনিবার, ৫ জানুয়ারী ২০১৯



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৫৫ তম পর্ব–
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া -১৪।

যত কৃষি ঋন বিতরন করা হবে, তত সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়বে এরুপ একটা ধারনা বোধহয় তখন প্রচলিত ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষিঋন বিতরনের একটা লক্ষমাত্রা নির্ধারন করে সরকারী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে জানিয়ে দিত। পরবর্তীতে ব্যাংকের শাখাসমূহের জন্য লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয়া হতো। তারপর শুরু হতো কৃষিঋণ বিতরনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য চাপাচাপি। ব্যাংকের প্রত্যেকটি আঞ্চলিক অফিসে শুধু কৃষিঋণ তদারকির জন্য একজন সিনিয়র কর্মকর্তাসহ বেশ ক”জন কর্মকর্তা এ কাজে নিয়োজিত থাকতেন। প্রতিটি ব্যাংকের হেড অফিসে তো রুরাল ক্রেডিট ডিভিশন বা এ ধরনের নাম দিয়ে একটি করে বিশাল ডিভিশন ছিল । এখনও এ সব পদ্ধতি বলবৎ আছে, তবে এন জি ও গুলো ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হবার ফলে গ্রামীণ ঋণ বিতরনে ব্যাংক সমূহের ভূমিকা অনেক হ্রাস পেয়েছে। পল্লী এলাকায় অবস্থিত শাখা সমূহে কৃষি ঋণ বিতরন এবং আদায়ের জন্য ২/৩ জন মাঠ সহকারী থাকতো। আমাদের ডেমাজানি শাখায় ৩জন মাঠ সহকারী ছিল। তাদের মধ্যে ১জন ছানাউল হক রঞ্জু র নাম আগেই বলেছি। রঞ্জু আমার সমবয়সী এবং ব্যাংক শাখার একদম নিকটেই তার বাড়ী। সত্যিকার অর্থেই লোকাল হিরো। কৃষিঋণ বিতরনে ঝামেলা হলে রঞ্জু সামাল দিতে সাহায্য করতে পারবে -এ বিশ্বাস আমি রাখতাম। কিন্তু তাকে যে একদিন তার প্রমান দিতে হবে তা ভাবিনি কোনও দিন।
সে সময়টাতে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের তোড়জোড় চলছিল। দিন- তারিখ-সময় মনে নেই তবে মাস দুয়েক পরেই নির্বাচন এবং তার জন্য পূর্ব প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে এ রকম একটা সময়। অটলের বাবা ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান পদ প্রার্থী। অটল আবার আমাদের মানে আমার ও রঞ্জু –উভয়েরই বন্ধু। গত দু ’মেয়াদেও তিনি চেয়ারম্যান ছিলেন। এবার তৃতীয় মেয়াদের জন্য লড়তে যাচ্ছেন। উনি এলাকায় অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। উনার নির্বাচনী কৌশলও বেশ চমৎকার ছিল। তবে এবার আমি এখানকার ম্যানেজার থাকার জন্যই বোধ হয় উনি তার বাড়ীর পাশের ব্যাংকটাকে তার নির্বাচনী কৌশলে একটু বেশী ব্যবহার করতে চাইলেন। আমার কাছে প্রত্যহ ৮/১০টি করে স্লীপ পাঠানো শুরু করলেন। প্রত্যেক স্লীপের বাহককেই ৫/১০ হাজার টাকা কৃষি ঋণ দেবার সুপারিশ করে সীল স্বাক্ষর করে দিতেন। তবে মৌখিকভাবে কোনদিন ঋণ দেবার ব্যাপারে কিছু বলতেন না। যা হোক আমি ¯স্লীপ গুলি নিতাম তারপর স্লীপের বাহককে বলতাম দেখি কি করা যায়। দিন শেষে সে গুলি আবার কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ঝুড়িতে ফেলে দিতাম। চেয়ারম্যান সাহেব ঋণ দেবার জন্য কোন চাপাচাপি করতেন না । চাপাচাপি না করার কারণ তার স্বভাবগত না ব্যাংকের সবাই লোকাল সে ভয়ে তা অবশ্য বলা মুশকিল। তবে এটা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে উনি ব্যাংকে কৃষিঋণ প্রদানের জন্য স্লিপ পাঠাতেন অতিরিক্ত জনপ্রিয়তা পাবার লোভে।। তবে আমি কিন্তু কৃষি ঋণ দিতাম আমার নিজস্ব বিবেচনায়। কয়েক সপ্তাহ ধরেই এ রকম স্লীপ পাঠানের ঘটনা চলছিল। প্রতিদিন স্লীপ দেবার বিষয়টি একসময় এলাকায় জানজানি হয়ে গেল। প্রতিদ্বন্দ্বী চেয়ারম্যান পদ প্রার্থী আমার সাথে একদিন দলবল সহ দেখা করে বলে গেল যে বর্তমান চেয়্যারম্যন সাহেবের সুপারিশে যদি একটি ঋণও দেয়া হয় তবে সেও সুপারিশ করা শুরু করবে, সে মোতাবেক ঋণও দিতে হবে। বুঝলাম হাল্কা হুমকীও দিয়ে গেল। হাল্কা হুমকীর বিষয়টি নিয়ে রঞ্জু এর সাথে আলোচনা করলাম। রঞ্জু পরামর্শ দিয়ে বললো ঐ চেয়ারম্যানের স্লীপ আর নিবেন না। ফেরৎ দিয়ে দিবেন। তা হলে আর সমস্যা হবেনা, প্রতিপক্ষ চেয়্যারম্যান প্রার্থীও আর হুমকী দিতে আসবে না। তবে আমি ভাবছিলাম অন্য কথা। চেয়ারম্যান সাহেব তো চাপাচাপি করছেন না। শুধু ¯স্লীপ দিচ্ছেন। তবে তিনি অবশ্য জানতেনও আমাকে চাপাচাপি করে লাভও নাই। আমি আমার বিবেচনা মতই কাজ করবো। কিন্তু ব্যাংক ম্যানেজারকে তো অনেক কিছুই ম্যানেজ করতে হয়। রঞ্জু সাহেবের কথা শুনলে সাপটা হয়তো মরবে কিন্তু লাঠিটাও ভেঙ্গে যাবে। স্লীপ -বিষয়টি নিয়ে আমি অতিশয় বিরক্ত হলেও মনের চার দিকে ধৈর্যের একটি শক্তিশালী বাঁধ দিয়ে রাখলাম। কিন্তু হঠাৎ একদিন ধৈর্যের বাঁধটা ভেঙ্গে গেল। সে দিনেই কথাই এখন বলবো।
সেদিন অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হবার পর রাস্তায় এক পশলা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলাম। মটর সাইকেল চালিয়ে আসছিলাম। বৃষ্টিতে একটু ভিজে গেলাম। অফিসে পৌঁছে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতেই চাবী হাতে নিয়ে ভল্টের তালা খুলে দিতে গেলাম। প্রথমে ম্যানেজারকেই তালা খুলে দিতে হয়, তারপর সেকেন্ড অফিসার , তারপর ক্যাশিয়ার । দেখি ,সেকেন্ড অফিসার জামাল সাহেবও তালা খোলার জন্য স্ট্রংরুমের ভিতরেই দাঁড়িয়ে আছেন। ক্যাশিয়ারও তালা খুলতে এসেছে। তালা খোলার পর আমি তাদের সাথে আজকের ক্যাশ ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আলোচনা করছি। হঠাৎ কানে এলো আমার টেবিলের সামনে কে যেন একজন এসে বিরতিহীনভাবে আমাকে ডেকেই চলেছে। স্যার , একটু এদিকে আসেন, এদিকে আসেন, এখনই একটু আসেন। এর পর বাড়ীতে ডাকাত পড়লে যেমন ভাবে চিৎকার করে ঐ ভাবে চিৎকারের ভঙ্গিতে সে বিরতিহীন ভাবে ডাকাডাকি শুরু করলো। স্ট্রংরুম থেকে বেরিয়ে তার কাছে যাবার পথে রঞ্জু কানে কানে বললো যে আজ স্লীপ নিয়ে এসেছে সে একটা বাটপাড় আর টাউট। আমি আমার টেবিলের কাছে যেতেই সে চেয়ারম্যান সাহেবের একটি ¯স্লীপ আমার হাতে দিয়ে বললো আমার খুব জরুরী ,এ ঋণটি আজকের মধ্যেই দিতে হবে। আমি যথারীতি বললাম -পরে দেখা যাবে, যাচাই করে যদি দেখি আপনি লোন পাবার যোগ্য –তা হলে অবশ্যই পাবেন। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা ,বলে কিনা -চেয়ারম্যান চাচা লিখে দিয়েছেন। এখুনি দিতে হবে। চাচা লিখে দিয়েছেন , তা হলে আপনার লোন দিতে অসুবিধা কোথায়? সে আমার সাথে রীতিমত তর্ক শুরু করে দিল। আমি শান্ত গলায় আবারও বললাম- যাচাই না করে ঋণ দিতে পারবোনা।- পারবেন না! চেয়ারম্যান চাচা বলে দিয়েছে, তাও পারবেন না ? আমার খুব জরুরী। আজকেই লোন দিতে হবে । দিবেন কি না বলেন ? আমার ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটলো । আমি তখন বললাম- ব্যাংক চেয়্যারম্যানের না, আপনার যদি এতই জরুরী থাকে তবে তাকেই টাকা দিতে বলেন। ততক্ষণে রঞ্জু সাহেব আমার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে । সে লোকটাকে বললো – ব্যাংক চিৎকার –চেচাঁমেচির জায়গা না। আপনি যান এখন। তা না হলে কিন্তু জোর করে বের করে দেয়া হবে। তার পর টেবিল থেকে স্লীপটা নিয়ে ঐ লোকটির সামনেই সে ছিঁড়ে ফেললো। লোকটা হনহন করে বের হয়ে গেল। রোজকার মত চেয়ারম্যান সাহেব ব্যাংকের পাশের রেষ্টুরেন্টে সদলবলে বসে এসব ¯স্লীপ দিচ্ছিলেন। লোকটা বোধ হয় সবার সামনে চেয়ারম্যান সাহেবকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে কিছু বলে তাকে উত্তেজিত করে দিয়ে থাকবে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রাগে গজগজ করতে করতে চেয়ারম্যান সাহেব কয়েকজন সাগরেদসহ ব্যাংকে ঢুকলেন। দু’দিনের ছেলে হয়ে আমার সাথে বেয়াদবী করে ? এত বড় সাহস ?চেয়ারম্যান সাহেব দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে গর্জন করে উঠলেন। আমি অবশ্য শান্ত গলায় সালাম দিয়ে বিনীত ভাবে বসতে বললাম। সালামের উত্তর না দিয়ে তিনি টেবিল চাপড়াতে চাপড়াতে বললেন আমিই এ ব্যাংক এখানে এনেছি। আমার ছেলে অটলের বন্ধু হয়ে তুমি সবার সামনে এ ব্যবহার করলে। তোমাকে আমি দেখে নিব। এর পর চারদিকে তাকিয়ে বললেন আতহার আলী মন্ডলের ছেলে রঞ্জু কোথায় ? তাকেও আমি দেখে নিব। তারপর সাগরেদদের দিকে তাকিয়ে চুড়ান্ত ফয়সালা দিলেন। জানো আমার সাথে বেয়াদবীর পরিনাম, লাশ ভাসবে করতোয়ায়। সাগরেদরা এমন ভাবে মাথা দোলাতে লাগলো যেন এটাই আমাদের একমাত্র উপযুক্ত শাস্তি। অনেকক্ষণ ধরে বকাবকির পর্ব চলেছিল । সবকিছু আজ আর মনেও নেই। তবে আমি বা রঞ্জু বা অফিসের অন্য কেহই তার সাথে তর্কে জড়াইনি।
ওদিকে অবস্থা বেগতিক দেখে বুদ্ধিমান সেকেন্ড অফিসার জামাল সাহেব করেছেন কি, এক ফাঁকে গেটে তালা দিয়ে চুপিসারে গার্ডকে বাহিরে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তার হয়তো উদ্দেশ্য ছিল কেউ আমাদের অপমান করে সহজে বের হতে যেন না পারে অথবা বাহির থেকে আক্রমণের জন্য কেউ যেন ভিতরে ঢুকতে না পারে।
এদিকে চিল্লাচিল্লি হুমকী-ধামকীর শেষ করে আমি যেন চুড়ান্ত পরিনামের জন্য প্রস্তুত থাকি সে সব কথা বার বার জানিয়ে উনি সাথে আগত সবাইকে নিয়ে বের হবার জন্য দরজার কাছে যেয়ে দেখেন দরজা তালাবদ্ধ। বের হবার পথ রুদ্ধ। এই কে আছো তালা খুলে দাও। সেকেন্ড অফিসারের দিকে মুখ করে হুংকার ছাড়লেন তিনি। সবাই নিরুত্তর। ততক্ষণে তিনি বুঝে গেছেন যে তিনি ব্যাংকের মধ্যে আটকে গেছেন। আমার সামনে এসে বললেন- দরজা খুলে দিতে বলো। আমি জানালাম আমার কাছে চাবি নাই । চাবি গার্ডের কাছে। তাকে তো ব্যাংকের ভিতর দেখছি না। এ সময় জামাল সাহেব জোরে জোরে বলে উঠলো হৈচৈ-এ গার্ড ভয় পেয়ে তালা দিয়ে বাহিরে চলে গেছে। ওদিকে বাহিরে তখন অনেক লোকজন জমে গেছে। কলাপসিবল গেটের সামনে, ব্যাংকের চারটি জানলার সামনে অনেক উৎসুক লোকজন। গার্ড সোলায়মানকে অবশ্য দেখলাম না। শাখায় কোন টেলিফোন নাই যে বিষয়টি জোনাল অফিসে জানাবো। সামনে দাঁড়িয়ে চেয়ারম্যান ও তার সাগরেদরা বারবার দরজা খুলে দিতে বলছে, না দিলে যে পরিনাম কিন্তু আরো খারাপ হতে পারে তাও বারবার জানাচ্ছে। তবে বাহিরের জনতা কিন্তু চুপচাপ নীরব দর্শক। কাউকে তার পক্ষে কথা বলতেও দেখলাম না। বরং ২/৪ জনের সাথে আমার চোখাচোখি হতেই আমাকে নীরবে হাত তুলে সালাম দিল। দু’চার জন আবার আমার দিকে তাকিয়ে এমন মুখভঙ্গী করলো যে আমি তাতে বুঝলাম তারা আমাকে সাবাশ দিচ্ছেন। দোকানদার দুলাল টাকা জমা দিতে এসেছে, ক্যাশিয়ার দরজার সামনে এসে জমা নিয়ে গেল। এভাবে দরজা না খুলে দরজার ফাঁক দিয়ে চেক পেমেন্টও শুরু হলো।
ও দিকে বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে চলেছে। হঠাৎ দেখি পিছনের জানালার দিক থেকে কে যেন আমার নাম ধরে ডাকছে। দেখলাম চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে ও আমার বন্ধু অটল অনুচ্চ স্বরে ডাকছে ও হাত ইশারা দিচ্ছে। গেলাম জানালার ধারে, রঞ্জুও আসলো। তালা খুলে দেবার জন্যে সে হাত জোড় করে অনুরোধ করলো। শাখার সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমিও তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের মনের কথা পড়ার চেষ্টা করলাম। সবাই চায় ঝামেলা আর না বাড়িয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে বের হয়ে যাবার সুযোগ দিতে। কিন্তু চাবি তো গার্ড সোলায়মানের হাতে ,কিন্তু সে তো আবার লাপাত্তা।
সমাধান অবশ্য জানাই ছিল। জামাল সাহেব শুধু ঘোষণা দিল। কৃত্রিম আড়মোড়া ভেঙ্গে চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে সে বললো দেখি গেটের একটা ডুপ্লিকেট চাবি ছিল, খুঁজে পাই কিনা। এতক্ষণ ধৈর্য্য সহ দর্শক সেজে দরজা ও জানালার ধারে অপেক্ষমান জনতার মধ্যে থেকে কয়েকজন বলে উঠলো- দেখেন স্যার, দেখেন স্যার, দেখেন তো ডুপ্লিকেট চাবি পাওয়া যায় কিনা। সবাই সমাধান চায়। বাংলার জনগণ যে শান্তি প্রিয় তা আবার প্রমাণ হলো। আড়চোখে দেখলাম ’অটল’ মোনাজাতের ভঙ্গিতে দু’হাত একত্র করলো। চেয়্যারম্যান সাহেব কিন্তু নির্বিকার। ভাবখানা এরকম যে- জীবনে এ রকম কত ঘটনা মোকাবেলা করেছি, বেঁচে থাকলে আরো কত করতে হবে। সবেরই সমাধান আছে। এটারও সমাধান হবে। দরজায় তাকিয়ে দেখি জামাল সাহেবের তালা খোলা শেষ। যাদের বের হবার তারা বের হচ্ছে আর যাদের ঢোকার তারা ঢুকছে। সাথে গার্ড সোলায়মানকেও ঢুকতে দেখলাম। জামাল সাহেবের মত তার মুখেও বিজয়ের হাসি।
আমার মাথায় তখন অন্য চিন্তা ঢুকে গেছে। এ ঘটনাটা তো জোনাল হেড স্যারকে জানাতে হবে। অফিস শেষে গেলাম তার চেম্বারে। সব শুনে তিনি বললেন- সামান্য কটা টাকা তো ,লোন দিলেই পারতে। লোকাল চেয়ারম্যানের সাথে ঝামেলা পাকানো ঠিক না । স্যারের কন্ঠে ¯স্নেহমাখা সুর, স্যার আমাকে তালোড়া শাখা থেকে বদলী করে এনেছেন। এখন এখানে পোষ্টিং দিয়েছেন। আমার অনিষ্ট হোক-তা তিনি চাননা। তাই বোধ হয় এ আপোষ ফমূর্লা। আমি দৃঢ়তার সাথে বললাম, স্যার এটা সামান্য কটা টাকার ব্যাপার না। আজ আমি যদি তাকে একবার সুযোগ দেই, সে এরপর বার বার অন্যায় আবদার নিয়ে আসবে। তারপর আসবে অন্য চেয়ারম্যান পদ প্রার্থীরা। আমি আর তখন সামলাতে পারবোনা। তাছাড়া আপনিই তো বলেন স্যার- ”কিনতে না জিতলে বেঁচে লাভ করা যায় না। তেমনি ঋণ সঠিক ব্যক্তিকে না দিলে পরে আর তা আদায় করা যায় না।” তা ছাড়া এরূপ টাউট বাটপারদের ঋণ দিলে প্রকৃত কৃষকরা ঋণ থেকে বঞ্চিত হবে। স্যারের সামনে আজ একটা ভাষণই দিয়ে ফেললাম। ভাষনে কাজও হলো। স্যারও দ্বিগুণ দৃঢ়তার সাথে বললেন- তুমি ঠিকই বলেছো। এরপর চেয়ারম্যান যদি ব্যাংকে এসে কোনও ঝামেলা করে আমাকে জানাবে, আমি পুলিশ নিয়ে যাব। তাকে অ্যারেস্ট করাবো। মনে হয় এ সময় আমার চোখেমুখে কিছুটা ভয়ের ভাব ফুটে উঠেছিল । সেটা লক্ষ্য করেই বোধ হয় স্যার বলে উঠলেন- ভয় পাওয়ায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু ভয় পেয়ে পড়ে থাকলে চলবে না, তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হবে, ফাইট দিতে হবে, হেরে গেলে আবার নতুন উদ্যমে সব শুরু করার উদ্যম থাকতে হবে।স্যারের কথায় মনোবল ফিরে পেয়ে সন্তুষ্ট চিত্তে বাড়ী ফিরে আসলাম। আসতে আসতে শেখ সাদীর বিখ্যাত পংক্তি মনে পড়লো, ” হিংস্র বাঘের উপর দয়া করা নিরীহ হরিণের উপর জুলুম করার নামান্তর”।
জোনাল অফিসের পল্লী ঋণ বিষায়ক কর্মকর্তার কাছ থেকে জানতে পারলাম .পরের দিন নাকি চেয়ারম্যান সাহেব জোনাল হেড স্যারের কাছে আমার নামে নালিশ নিয়ে গিয়েছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আপনার কথা মত লোন দেয় নাই এছাড়া আর কোন কমপ্লেন আছে কিনা? কারো কাছ থেকে টাকা পয়সা নেয় কিনা? উনি নাকি বলেছিলেন আর কোন কমপ্লেন নাই।

অন্যদিকে রন্জুর কাছে শুনলাম যাকে ঋণ না দেয়া নিয়ে এত কাহিনী হলো সে হলো অন্য ব্যাংকের একজন চাকুরীচ্যুত গার্ড। তার চাল কেনার টাকা নাই। তাই ঋণ দরকার । রন্জুর মাধ্যমে তাকে একদিন ডেকে এনে বললাম- আপনার ঋণ নয়, সাহায্য দরকার। সবাই মিলে চাঁদা তুলে সাহায্য করলাম। সে খুব খুশী হলো। চেয়্যারম্যান সাহেব আমাকে যে প্রাণ নাশের হুমকী ধামকি দিয়েছে তা যে নিছক লোক দেখানো- এটা আমি বুঝেছিলাম , তাই আমি আমার নিরাপত্তার জন্য তেমন উদ্বীগ্ন ছিলাম না। তবে এ ঘটনার পর আমার যেন কোন বিপদ না হয় সে জন্য রন্জু সার্বক্ষনিক আমার দিকে নজর রাখা শুরু করলো।
চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে এ ঘটনার পর তার ছেলেরা সহ অনেকেই সমবেদনা জানাতে ব্যাংকে দেখা করতে আসলেন। কয়েকজন স্কুল শিক্ষক বলাবলি করতে লাগলো ম্যানেজার সাহেব ও চেয়ারম্যান সাহেব যদি এ স্কুল মাঠে সমাবেশ ডাকে তবে ম্যানেজার সাহেবের সমাবেশে বেশী লোক হবে। কথাটার সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ ছিল না। তবে মনে এই ভেবে তৃপ্তি পেলাম যে আমি হয়তো সঠিক পথেই আছি।
ঘটনাটির এত সুদুর প্রসারী এভাব পড়বে তা আমি তো ভাবিই নাই , চেয়ারম্যান সাহেবও বোধ হয় কল্পনাতেও ভাবেন নাই। এ এলাকায় এটাই একমাত্র ব্যাংক। তাও আবার নদীর ঘাটের কাছে। শহরে বা অন্য কোথাও যেতে হলে ব্যাংকের সামনে দিয়েই যেতে হয়। আমি আবার একটু মিশুক প্রকৃতির ছিলাম। এলাকার ভোটারদের প্রতি রঞ্জুরও অনেক প্রভাব ছিল। রঞ্জু ব্যাংকের মধ্যে এ রুপ দায়িত্বহীন কর্মকান্ডের বিষয়টি বোধহয় বেশ প্রচার করেছে। এলাকার ঋণ গ্রহীতা কৃষক,বেতন গ্রহীতা প্রাইমারী শিক্ষক সহ সর্বস্তরের লোকজন এদিকে ব্যাংকিং কাজেই আসুক আর অন্য কাজেই আসুক আমাকে সালাম দিতে বা আমার কাছ থেকে সালাম নিতে আমার কাছে আসতো। এতে অবশ্য শাখার কৃষিঋণ আদায় ও আমানত সংগ্রহ করা আমার জন্য অনেক সহজ হতো, যা আগেই বলেছি।
যা হোক আমার এ গণ যোগাযোগের জন্য প্রাপ্ত জনপ্রিয়তার কারনেই হোক বা সচেতন লোকজনের কারনেই হোক বা রন্জুর কারনেই হোক চেয়ারম্যানের জন্য বিরুপ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো। এ আলোচনা ব্যাংকে এত বেড়ে গেল যে, ‘‘ ব্যাংকে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনা নিষিদ্ধ”- এ রকম একটা ব্যানার আমি টাংগিয়ে দিলাম। কে শোনে কার কথা। লাঠিওয়ালার লাঠি ঠেকানো যায়, মুখওয়ালার মুখ ঠেকানো দায়। এলাকার গ্রাহকরা ব্যাংকে এলেই বিষয়টি সত্য কিনা জানতে চাইতো। সমবেদনা জানাতো। প্রতিদ্বন্দী প্রার্থী এ ঘটনাকে পুঁজি করে ফেললেন। তিনি প্রচার করা শুরু করলেন এ ঘটনার জন্য এলাকার একমাত্র ব্যাংক এ এলাকা থেকে এ জন্য অন্য এলাকায় চলে যেতে পারে। স্থানীয় জনগণ বিশেষ করে কৃষক ও শিক্ষকদের মধ্যে ভীষন বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো। এ সব কারনে কিনা জানিনা , শেষ পর্যন্ত বর্তমান চেয়ারম্যান সাহেব ভোটে ফেল করে বসলেন। তার ফেল করার কারন আমরা তখন আমাদের মত করে ভেবেছি। আগেই বলেছি তিনি এলাকায় জনপ্রিয় ছিলেন এবং অনেক উন্নয়নমূলক কাজও করেছেন। দাবী আদায়ে সদা সোচ্চার ও সাহসীও ছিলেন। এতগুণ থাকা স্বত্ত্বেও তার ফেল করার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে আজ আমার মনে হচ্ছে ব্যাংকে সংঘটিত ঘটনা ছাড়াও জনগণ বোধ হয় তখন একটা পরিবর্তন চাচ্ছিলেন।
আজ চুপি চুপি একটা কথা স্বীকার করে রাখি, এ ঘটনার পর আমি ম্যানেজারী ছেড়ে দেবার কথা ভেবেছিলাম। ঘটনার দিন বাসায় এসে বিষন্ন মনে একটা নোট বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলাম। এ শাখায় যোগদানের পর এ নোট বইয়ে আমি ফার্সি কবিদের বাণী লিখে মুখস্থ রাখার চেষ্টা করতাম।
নোট বইয়ে লেখা জালাল উদ্দিন রুমির (১২০৭- ১২৭৩) একটি পংক্তি চোখে পড়ে গেল, ”ঘষা খেতে যদি ভয় পাও, তাহলে চকচক করবে কিভাবে?” ম্যানেজারী ছেড়ে দেবার তদবীরে না যেয়ে চকচকে হবার লোভে ঘষা খাবারই সিদ্ধান্ত নিলাম। (ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২৩:৩২:২১   ৫৭২ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #