শুক্রবার, ৪ জানুয়ারী ২০১৯

টাংগুয়ার হাওর ও একটি প্রস্তাবনা—:রাসেল আহমদ

Home Page » জাতীয় » টাংগুয়ার হাওর ও একটি প্রস্তাবনা—:রাসেল আহমদ
শুক্রবার, ৪ জানুয়ারী ২০১৯



রাসেল আহমদ বঙ্গ-নিউজঃ হাওর সতন্ত্র ধরনের এক  নিচু প্রতিবেশ এলাকা বা জলাভূমি। ধারনা করা হয় ১৮৮৭ সালে প্রলয়ংকারী বন্যা ও ভূমিকম্পের পর ব্রহ্মপুত্র নদের গতি পরিবর্তন ও ভারতের  মেঘালয় রাজ্য সংলগ্ন বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা বরাবর ডাউকি চ্যুতি’র কারনে দেশের উত্তর -পূর্বাঞ্চলে এই হাওর এলাকার সৃষ্টি হয়।এই অঞ্চল আশেপাশের স্থলভাগ থেকে অনেকখানি নিচু।বর্ষাকালে এই অঞ্চল গুলো ১০-১৫ ফুট পানির নিচে চলে যায়।হাওর অঞ্চল গুলোর গড় উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ট হতে ২.০০-৪.০০ মিটার। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের সাতটি জেলার ৪৮ টি উপজেলা নিয়ে বিস্তীর্ন হাওর অঞ্চল।। আয়তনের দিক থেকে এটি সমগ্র বাংলাদেশের আয়তনের ছয়ভাগের একভাগ(২৪,০০০ বর্গ কিলোমিটার প্রায়)।সুনামগঞ্জ জেলা একটি শতভাগ হাওর অধ্যুষিত এলাকা।এই জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুর উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ৯,৭২৭ হেক্টর এলাকায় ৩০ টি ছড়া যা মেঘালয়ের পর্বতমালা থেকে উৎপত্তি,১২০ টি বিল নিয়ে টাংগুয়ার হাওরের অবস্থান।

শোষনীয় মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী নির্যাতনের প্রতিচ্ছবি ‘ইজারা পথা’..…..
হেমলাল সরকার নামক একজন ইজারাদারের আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে চল্লিশের দশকে টাংগুয়ার হাওরে সর্বপ্রথম ইজারাধারী ব্যাবস্থার প্রর্বতন হয়।ক্রমান্বয়ে পিয়ারী চৌধুরী, সাগর বাবু,সৌমবাবু,নির্ঘুম বাবু ইজারাদার টাংগুয়ার হাওর নিয়ন্ত্রণ করেন।পাক ওর্য়াডার নামক এক বিশেষ আইনের আওতায় টাংগুয়ার হাওরে নিয়ন্ত্রণ চলে যায় পশ্চিমা কাবুলীওয়াদের কাছে।পরতবর্তীতে মহানন্দ বাবু থেকে শুরু করে বাংলাদেশ আমলের সমর বাবু,অদুদ মিয়া,নিজাম উদ্দীন নামক ইজারাদারদের অধীনে ছিল এই হাওরটি।কালের পরিক্রমায় ওয়াটার লর্ড খ্যাত জয়নাল আবেদীন একাধারে নয় বছর শাসন শোষন করে টাংগুয়ার হাওরটি।এর পর হাছন আলী চেয়ারম্যান দীর্ঘদিন ইজারাদার ছিলেন এই হাওরটির। পরবর্তী কালে আবার জয়নাল আবেদীন ও ভাষান পানি আন্দোলনের শীর্ষনেতা কমরেড নজির হোসেন একক ও যৌথভাবে শাসন শোষন করেন।
রক্তরাঙা টাংগুয়ার হাওর….
ইজারাদারী ব্যাবস্থার ভয়াবহ রুপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে হাছন আলী চেয়ারম্যান, জয়নাল আবেদীন ও কমরেড নজির হোসেন প্রমুখ ইজারাদারদের আমলে। পাখির মতো মানুষ হত্যা,মধ্যযুগীয় বর্বর নির্যাতন, মিথ্যা মামলায় মানুষকে হয়রানী,ক্ষমতার শিকার হতে থাকেন নিরীহ সাধারন জেলে  ও আন্দোলনরত জেলে কৃষক। ১৯৯৭-৯৮ সালে ইজারাদারী ব্যাবস্থার নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয় ১১ জন নিরী সাধারন মানুষ। এ সকল হত্যাকান্ডের অধিকাংশের বিচার আজ পর্যন্ত সমপন্ন হয়নি।

খোকা ঘোমালো পাড়া, পাড়া জোড়ালো, রামসারা এলো দেশে……
ইরানের রামসার শহরে ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে (Convention on Wetlands on International Importance especially as Waterflow Habitat. 1997) সম্মেলনে প্রথম পৃথীবির জলাভূমি বিষয়ে বিশ্ব মনোনিবেশ করে। এই সম্মেলনের মূল উদ্দেশ্যে ছিল জলাভূমি এলাকায় জলচর পাখিদের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে টিকিয়ে রাখা। যার প্রথম শর্ত্য হচ্ছে, চুক্তিভূক্ত সদস্য রাষ্ট্রপক্ষ রামসার ঘোষনা এলাকার মানুষ এবং তার পরিবেশের আন্তঃসম্পর্ককে বিবেচনা করবে ও গুরুত্ব দেবে।বাংলাদেশ রামসার ঘোষনার স্বাক্ষকারী একটি দেশ। টাংগুয়ার হাওর একমাত্র রামসার হাওর।২০০০ সালে ১০ জুলাই বাংলাদেশ সুন্দরবনের পর দেশের দ্বিতীয় রামসার এলাকা হিসেবে টাংগুয়ার হাওরকে ঘোষনা করে। প্রায় ৬০ বছরের অধিকাল ধরে প্রচলিত ইজারাধারী ব্যাবস্থাপনার  বিলুপ্তির মধ্য IUCN,CNRS,ERA  সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রনে কো ম্যানেজম্যান্ট  সিস্টেম নামে এক নতুুন ধরনের ব্যাবস্থার প্রর্বতন করে টাংগুয়ার হাওরে।যার ফলে মাছ ও পাখি শূন্য হয়ে পড়েছে হাওরটি।এই বিষয়ে হাওর পারের মানুষের ঘটেছে ব্যাপক মানবতা ও নৈতিকতার স্থলন।লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করে টাংগুয়ার হাওরের ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক যারা হাওর তীরবর্তী কৃষি জমিতে বর্ষায়  মাছ ধরে যারা সুদীর্ঘকাল যাবত শত নির্যাতন সহ্য করে জীবিকা নির্বাহনকরে থাকেন তারাও আখ্যায়িত হয়েছেন কতিত চুরাজাউল্যায়। কো ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেমের নিয়ন্ত্রনে,দূর্গম বিল ভবেরজান, রকমারি নামে একশ্রেনীর গ্রামীণ টাউট বাটপারদের জেলে আখ্যায়িত করে বিল শুকিয়ে মাছ ধরা, রাতের আঁধারে ব্যাপক কারেন্ট ও খনা জালের মাধ্যমে টাংগুয়ার হাওরকে মৎস্য শূন্য করা মহোৎসবে মেতে ওঠে।

হাওরবাসীর মানববন্ধন ২০১৩….
টাংগুয়ার হাওরে লুটপাট ও দূণীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমেছিল হাওর পারের মানুষ। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম এই বিষয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহন করে ‘আমরা হাওরবাসী’নামক সংগঠন।সাংগঠনিক সমস্যা ও সংকটের কারনে আমরা হাওর বাসীর এই আন্দোলনটি স্থগিত হয়ে গেলেও,সাম্প্রতিক কালে টাংগুয়া হাওরের বিগত ১৩ বছরের অব্যাবস্থাপনার বিরুদ্ধে সরকারী বেসরকারী পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা মুখ খোলতে শুরু করেন।টাংগুয়ার ব্যাবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে প্রকাশ পায় নতুন নতুন প্রস্তাবনা ও ধারনাপত্র।

সেই পুরুনো শুকুন…….
ভয়াবহ আশংকার বিষয় হচ্ছে এই যে পূর্বের ইজারাধারী ব্যাবস্থাপনায় ফিড়িয়ে নিতে একশ্রেনীর বর্নচোরা,তত্ববিদ তাদের  ধারনাপত্র তথা প্রস্তবনায় ইনিয়ে বিনিযে টাংগুয়ার হাওরের হারানো ঐতিহ্য ফেড়াতে ইজারাদারী ব্যাবস্থাপনা প্রবর্তনের পক্ষে যুক্তি তুরে ধরার অপচেষ্টায় লিপ্ত।

মাদার ফিশারী টাংগুয়ার হাওর…..
টাংগুয়া হাওর প্রতিবেশ ব্যাবস্থা দেশের অনান্য হাওর থেকে একটু ভিন্ন ধরনের। জীববৈচিত্রের আধার এই হাওরটিতে মাছের বেড়ে ওঠা ও বিভিন্ন প্রজাতির দীর্ঘমেয়াদি টিকে থাকার পরিবেশ বিদ্যমান।বাংলাদেশের মিঠা পানির সর্ববৃহৎ আশ্রয়স্থল টাংগুয়ার হাওর দেশ বিদেশে মাদার ফিশারী হিসেবে বিখ্যাত।

ভাতে মাছে বাঙ্গালী…..
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টরের অবদান অপরসীম।আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যে প্রাপ্ত প্রানীজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ যোগান দেয় মাছ।জিডিপির ৩.৬৫ শতাংশ মৎস্য খাত থেকে আসে যা কৃষিজ আয়ের একচতুর্থাংশ।দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় এগারো শতাংশের অধিক লোক এই সেক্টরে বিভিন্ন কার্যক্রমে প্রত্যক্ষ বা প্ররোক্ষভাবে নিয়োজিত থেকে জীবিকা নির্বাহ করে।

টাংগুয়ার হাওর ও একটি মৌলিক প্রস্তাবনা…
এক ফসলী এই হাওর জনপদের জনজীবনের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, বিলুপ্ত প্রজাতির মাছ সমুহের বিজ্ঞান ভিত্তিক কৃত্রিম প্রজনন পোনা উৎপাদনে দেশীয় মৎস্য খাতে শিক্ষিত ও দক্ষ জনবল তৈরি।টাংগুয়ার হাওরে পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যাবস্থা অনন্য বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি বিষয় সমূহের গুরুত্ব বিবেচনায় সমগ্র টাংগুয়ার হাওরকে কেন্দ্র করে একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা যেতে পারে। এর অভ্যন্তরে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একটি প্রশাসনিক পুলিশ থানা স্থাপন করা যেতে পারে।

সমকালীন প্রস্তাবনা তথা ধারনাপত্র সমূহের মধ্যে টাংগুয়ার হাওর ব্যাবস্থাপনায় স্বার্থন্বেষী মহলের ব্যক্তির স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত করার অতি কৌশলগত অপচেষ্টা রুখে দাঁড়ানোর পাশাপাশি টাংগুয়ার হাওর তীরবর্তী তথা সমগ্র দেশের হাওর অঞ্চলের জনসাধারণের শিক্ষা ও জীবনমান উন্নয়নে এবং রাষ্টীয় অর্থনীতিতে মৎস্য সম্পদকে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক উৎস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে উল্লেখিত প্রস্তাবনাটিকে সমৃদ্ধ করে বাস্তবায়নের দিকে নজর দেওয়ার জন্য বিজ্ঞজন ও সরকার সহ সর্বস্তরের জনসাধারনের প্রতি আহবান রইলো।

লেখকঃ
রাসেল আহমদ, কার্যকরী সমন্বয়ক আমরা হাওরবাসী
ইমেইল-raselahmed1980bk@gmail.com

বাংলাদেশ সময়: ২১:৩৭:২৯   ৬৬১ বার পঠিত