মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারী ২০১৯

“রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন “-জালাল উদদীন মাহমুদ
মঙ্গলবার, ১ জানুয়ারী ২০১৯



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৫১ তম কিস্তি—
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া ১১তম পর্ব।

কালিদাস (৩৭০-৪৫০) প্রাচীন যুগের ভারতীয় কবি। তিনি সংস্কৃত ভাষার শ্রেষ্ঠ কবিরূপে পরিচিত। এখন থেকে দেড় হাজারেরও বেশী বছর আগে ঋতুসংহার নামে তিনি একটি কাব্য লেখেন। ঋতুসংহার কাব্যে ছয়টি অধ্যায় আছে, প্রতিটি অধ্যায়ে ভারতের এক একটি ঋতুকে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়টি গ্রীষ্ম ঋতুবিষয়ক। পরবর্তী অধ্যায়গুলিতে বর্ণিত হয়েছে যথাক্রমে বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শিশির (শীত) ও বসন্ত ঋতু। তার এই ঋতুবর্ণনার একটি বৈশিষ্ট্য হল এগুলি দুই প্রণয়ীযুগলের সম্পর্কের আলোকে বর্ণিত হয়েছে। তাই ঋতুসংহার একটি আদিরসাত্মক কাব্য । নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের ইচ্ছায় যে অনুরাগের সৃষ্টি হয় তাকেই আদিরস বলে। প্রাচীন শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, মানুষের মধ্যে নয়টি মৌলিক রস (emotion) বিদ্যমান । আদিরস ছাড়া আর ৮ টি রস হলো হাস্য রস ’ করূণ রস, রুদ্র রস , বীর রস , ভয়ানক রস , বীভৎস রস ,অদ্ভুত রস ও শান্ত রস ।
কবি কালিদাসকে নিয়ে এত কথা বলার কারণ ঋতু নিয়ে সামান্য কিছু লিখতে হলেও কবি কালিদাসকে স্মরণ করা ছাড়া উপায় নেই। মহাকবি কালিদাস এর শরৎ বন্দনা ইতোপূর্বেই আমি উল্লেখ করেছি। তার ‘ঋতুসংহার’-এ ষড়ঋতুর বন্দনায় শীতের প্রসঙ্গ শুরু করেছেন কবি এভাবে , ‘হে সুন্দরী, এবার শীত ঋতুর কথা শ্রবণ করো। এই ঋতু শালিধানের (আমন ধান) প্রাচুর্যে মনোহর। এখানে-ওখানে উপবিষ্ট ক্রৌঞ্চের (কানিবক বা কোঁচ বক) নিনাদ (ডাক) এখন মধুর। এই ঋতুতে কাম রক্ত প্রবল। এ কাল রমণীদের বড় প্রিয়।। শীতকাল নিয়ে কবি আলাওল (৯১৬০৭-১৬৮০) ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের ‘ষট-ঋতু বর্ণন’ খন্ডে শীত ঋতু বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘সহজ দম্পতি মাঝে শীতের সোহাগে/ হেমকান্তি দুই অঙ্গ এক হইয়া লাগে।’ এ চরণটিতে কবি দেহ মিলনের মধুর এক চিত্র বর্ণনা করেছেন।

কালিদাসের প্রায় দেড় হাজার বছর পর লেখা রবীন্দ্রনাথের গীতবিতান-এ অসাধারণ ঋতু-বন্দনা রয়েছে। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ ও বসন্তের বর্ণনায় তিনি উচ্ছ্বসিত। কিন্তু শীতের বর্ণনায় তিনি সেরুপ উচ্ছ্বসিত নন।’ এর কারণ কবির মন শীতে পদ্মায় নৌকা ভ্রমণের সময় উচ্ছ্বসিত হয়নি । শীতের পদ্মায় জেগে ওঠা ভূমির শূন্যতা তাঁর কাছে আনন্দদায়ক তো নয়ই বরং অস্বস্থিকর মনে হয়েছে। এর ব্যাখ্যা হিসেবে কবি লিখেছেন, শীতের সন্ধ্যাবেলায় সমস্ত প্রকৃতিকে বাইরে ফেলে, দরজা-জানালা বন্ধ করে বোটের ছোট পরিসরে নিজের মনটাকে মেলে ধরা যায় না। তখন ‘নিজের সঙ্গে নিজেকে বড়ো বেশি ঘেঁষাঘেঁষি-ঠাসাঠাসি করে থাকতে হয়।’ সম্ভবতঃ এসব কারনেই রবীন্দ্রনাথ শীত নিয়ে গীতবিতান-এ গান লিখেছেন অনেক কম (মাত্র ১২ টি)। শীত নিয়ে কম গান বাঁধলেও শীত নিয়ে লেখা তার গানের সেই ম্যাজিক লাইন শীত আসলেই আমাদের মনে পড়ে-” শীতের হাওয়ার লাগল নাচন আম্লকির এই ডালে ডালে।।’

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, সকল বয়সেরই একটা কাল আছে…। যৌবনের যেমন বসন্ত, বার্ধক্যের যেমন শরৎ, বাল্যকালের তেমনি বর্ষা। কবি কিন্তু শীতের কথা উল্লেখ করেননি। শীত তাঁর কাছে বরাবরই উপেক্ষিত । অন্যদিকে জীবনানন্দ শীতকে আদর করে আপন ভেবে কাছে টেনেছেন। তিনি লিখেছেন, কার্তিকের নীল কুয়াশা, শিশিরের জল, ফসল কাটা মাঠ, চালতার পাতা থেকে টুপটুপ জ্যোৎস্নায় ঝরছে শিশির,/ কুয়াশায় স্থির হয়েছিল ম্লান ধানসিঁড়ি নদীটির তীর। সর্বশেষে লিখেছেন, ‘ধানসিঁড়ি নদীর কিনারে আমি শুয়েছিলাম—পউষের রাতে—কোনদিন আর জাগব না জেনে—’ জীবনানন্দ ছাড়া আর কোন কবি শীতকে এমন নিবিড় করে অনুভব করেন নাই।
আমাদের জাতীয় কবির কবিতায়ও শীতের অনুষঙ্গ বর্ণিত হয়েছে। বিদ্রোহী কবি হিসেবে খ্যাত কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) তাঁর ‘দোলনচাঁপা’ কাব্যে ‘পৌষ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘পউষ এলো গো।/ পউষ এলো অশ্র পাথার হিম পারাবার পারায়ে।’ পল্লীকবি জসীম উদ্দীন (১৯০৩-১৯৭৬) এর বহুল পঠিত ‘রাখাল ছেলে’ কবিতায় শীতের অনুষঙ্গ এভাবে ফুটে ওঠেছে, ‘ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির ঝরা ঘাসে/ সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।’
শীত ঋতুতে আমাদের পোশাকআশাকে ও খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আসে। কিন্তু কেউ কেউ খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন, আশ্রয়হীন হয়ে অতি কষ্টে কোনও রকমে বেঁচে থাকে। সেসব বিষয়েও অনেক কবিতা রচিত হয়েছে। কিন্তু খাদ্যহীন বা বস্ত্রহীনেরা সেসব পড়ে দেখে না। কারণ- তারা তো পড়তে জানে না। দুঃখ নিয়ে জীবন চললেও কাব্য চলে না।

শীতকালে নদীতে পানি কমে গেলে নদী পারাপারের জন্য বাঁশের সাঁকো বসানো হত। শুধু পাকা রাস্তাদিয়ে যাওয়া আসার জন্য দিনে ৪ বার করতোয়া নদী পার না হয়ে মটর সাইকেল যোগে কাঁচা রাস্তা দিয়ে সরাসরি আসাই শ্রেয় মনে হতো। বর্ষাকাল ছাড়া প্রায়ই কাঁচা রাস্তা দিয়ে যাওয়া-আসা শুরু করলাম। যাতায়াতের ৩/৪ মাইল রাস্তা পুরাটাই গ্রামের কাঁচা রাস্তা । খানিকটা পথ আবার করতোয়া নদীর ধার ঘেঁষে। শীতকালে যেদিন সকালে ঘন কুয়াশা পড়তো সে সব দিনে মাথায় হেলমেট দিয়ে সকাল সকাল মটরসাইকেল নিয়ে অফিসে আসতে খুব ভাল লাগতো।

শীতের সকাল বাংলার এক অন্য রুপ। শিশিরে সিক্ত হিম হিম শীতের সকাল এক অনন্য বৈশিষ্ট্য বহন করে। গাছের পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ার টুপটাপ শব্দ আর পাখিদের কলরব আন্দোলিত করে গ্রামীণ জীবনযাত্রাকে। এত সকালে গাছিরা খেজুর গাছ থেকে রসের কলস নামাতো। দিনের রস সংগ্রহের জন্য আলাদা ছোট পাতিল ঝুলাতো । দিনের এ রস জ্বাল দিয়ে লালি বানাতো। ঘন লালি দিয়ে দুধ ভাত খাবার আনন্দই আলাদা ছিল। তারপর চারদিকে যখন সর্ষে গাছে হলুদ ফুল ধরতো বাংলায় প্রকৃতি তখন আবার অন্যরুপে সকালের হলুদ রোদের স্পর্শে মোহনীয় হয়ে উঠতো। শনি ও মঙ্গলবার ছিল স্থানীয় দুবলাগাড়ি হাটের দিন। সচরাচর নির্জন এ রাস্তা হাটের দিনে হাটুরেদের পদভারে প্রকম্পিত হতো। মটরসাইকেল নিয়ে সন্ধ্যার প্রাক্কালে অফিস থেকে ফিরতে হর্ণের পর হর্ণ দিতে হতো।

শীতকাল এলাকার জনপদের দৈনন্দিন জীবনে একটা বড় পরিবর্তন নিয়ে আসতো । গরমকাল বা বৃষ্টির সময় যা সম্ভব নয় ,শীতকালে তাই ঘটতো।
উত্সব ছাড়া মানুষ সাধারণত এক জায়গায় মিলিত হয় না । শীতকাল কোন উৎসব ছাড়াই কুয়াশায় ঢাকা ভোরে গ্রামাঞ্চলের ঘুমভাঙা মানুষেরা বাড়ির আঙিনায় ,উঠানে, রাস্তার ধারে, চা দোকানের সামনে, পুকুর বা নদীর পারে একত্রিত হয়ে রোদ পোহাতে বসতো। শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবা, নারী-পুরুষ,বুড়ো-বুড়ি সবাই। সকালের মিষ্টি মিষ্টি রোদের উত্তাপ নিতে নিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মেতে উঠতো নানা গল্পগুজবে।
বেলা গড়ায়, দুপুর হয় । যতই কাজ থাকুক, বাড়ির বউ-ঝি, এমনকি পুরুষরাও গোসল করতে পাশের করতোয়া নদীতে নামার আগে কিছুক্ষণ নদীর পাড়ে বসে আড্ডা দেবেই। আবার গোসল শেষেও রোদে বসে সেই একই আড্ডা। পানি শুকিয়ে যেত বিধায় এলাকায় তেমন পুকুর ছিলনা।
সন্ধ্যা নামলে গ্রামাঞ্চলের উৎসবটা অন্যরকম হতো। খড়কুটো, শুকনো ডাল পালা, লতাপাতা জ্বালিয়ে বা লাকড়ির স্তূপ বানিয়ে সবাই গোল হয়ে আগুন পোহাতে বসতো।
এ ছাড়া গ্রামবাংলার লোকায়ত সংস্কৃতির যত আয়োজন আছে, সবই আয়োজিত হতো শীতের রাতে। কোনো কোনো যাত্রাপালা অভিনীত হতো গ্রামের সাধারণ মানুষেরই উদ্যোগে। গ্রামের সাধারণ মানুষ যেমন কৃষক, কুমার,কামার, জেলে, ছোট ছোট ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষ নিজেরাই যাত্রায় অভিনয় করতো।
শীতকালে পরিবর্তন আসতো খাবার তালিকাতেও। পিঠা ছাড়া শীতের সকালটাই যেন মাটি। শীতকালে খেজুরের রস ছিল খাবারের ক্ষেত্রে একটি বাড়তি উপাদান। কেউ কেউ খেজুরের রস বিক্রি করতে নিয়ে যেত হাটে-বাজারে। রাতে চিতই পিঠা তৈরি করে তা খেজুরের জ্বাল দেয়া রসে ভিজিয়ে সকালে খাওয়াটা একমাত্র শীতকালেই সম্ভব।

শীতকালে গ্রামের বিস্তীর্ণ জমিতে শীতকালীন শাক-সবজির ক্ষেতের দৃশ্য চোখে পড়ে। বছরের অন্যান্য সময় বাজারে টাটকা সবজি কম পাওয়া গেলেও শীতকালে বাজারে প্রচুর পরিমাণ শীতকালিন শাক-সবজি পাওয়া যায়। করতোয়া নদীর পাড়ের উচুঁ ভিটে জমিতে সর্বপ্রকার ফসল ফলতো। ক্ষেতের পর ক্ষেত আলু, বেগুন,ফুলকপি, বাঁধাকপি,সিম, মুলা, গাঁজর, ঢেঁড়স, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, করলা, চিচিঙ্গা, ঝিঙ্গা, বরবটিসহ সর্বপ্রকার শীতকালীন সবজিতে ভরপুর থাকতো । এছাড়াও মুলা শাক, পালং শাক, লাল শাকসহ নানা জাতের টাটকা শাকও জন্মাতো এ এলাকায়। ঘরে ঘরে নতুন চাল, বাজারে শাকসবজি, বিলঝিলের মাছ সব মিলে শীত কিন্তু গ্রামাঞ্চলে সমৃদ্ধির ঋতুই।

সে সময় এত উন্নত রাস্তা-ঘাট ছিলনা তবে শীত কালে দিগন্তজোড়া মাঠ গাঁয়ের মানুষের কাছে চলাচলের উপযোগী হয়ে যেত যা বর্ষায় সম্ভব ছিলনা। দিগন্তজোড়া সরিষার ক্ষেতের পাশ দিয়ে খটখটে পায়ে চলার পথ বা কাঁচা সড়ক ধরে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেতেও এ সময় সমস্যা হতো না। গ্রামের মানুষের চলাচল কিন্তু বেড়ে যেত এ সময়। কূটুমের বাড়িতে যাওয়া-আসা ও দূর গাঁ থেকে বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসা বধূর দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটায় শীত ঋতু। ঘরে ঘরে বাপের বাড়ি নাইওরি হয়ে আসে গাঁয়ের বধূরা। গাঁয়ের হাট বাজারগুলোও এ সময় জমজমাট হয়ে ওঠে। পায়ে হাটার পথ ধরে চারদিকে ইচ্ছামতো বেড়ানোর সুযোগে গ্রামবাংলা এ সময় প্রকৃতপক্ষেই উত্সবমুখর হয়ে ওঠতো।
এই সময়টাতে মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটা স্বচ্ছল থাকার কারণে গ্রামে গ্রামে বিয়ের উৎসব অন্যান্য মাসের তুলনায় বেশী হতো।
গ্রামেও শীতকালে পোশাক আশাকের ক্ষেত্রেও বৈচিত্র্য আসতো। অন্যদিকে এ ঋতুর কমলা, কুল, সফেদা, জলপাই ইত্যাদি ফল মুখের স্বাদ বাড়িয়ে দিত।

বাড়ীতে শেষ রাতে জেগে শুনতাম টিনের চালে শিশির ঝরার টুপটাপ মৃদু শব্দ। উত্তর বঙ্গের শীতের বিছানা চুম্বক সম আকর্ষন নিয়ে ধরে রাখতে চাইতো। কিন্তু আমি যে দেখতে চাই পাতায় পাতায় নিশির শিশির। আমি যে পেতে চাই কুয়াশার হিম হিম গন্ধ।

“পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয়রে চলে আয় আয় আয়।”

সে ডাকে সাড়া দিতে সকাল সকাল টিউবওয়েলের একটু উষ্ণ পানিতে গোসল সেরে মটর সাইকেলটা নিয়ে বের হতাম অফিসের উদ্দেশ্যে। মনে হতো ঠাণ্ডা বাতাস, শক্ত মাটি আর মৃতপ্রায় গাছ-গাছালিতে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে বাংলার প্রকৃতি।

সে সময় গ্রামে যারা বাস করে বলতে গেলে তারা প্রায় সবাই গরিব প্রকৃতির ছিল। শীতের সকালেও খালি পায়ে থাকতো অনেকে। শীত নিবারণের জন্য তেমন কোনো গরম কাপড়ও তাদের ছিলনা। পুরাতন গরম কাপড় তখন মিলতো না। যে কারণে শীতের সকালে প্রতিটি বাড়ির আঙিনাতেই ছোট-বড় সবাইকে ডাল-পালা ,খড় -কুটা জ্বালিয়ে শরীর থেকে শীত তাড়াতে দেখা যেত। অনেকেই একটা লুঙ্গি পরে অন্য একটা লুঙ্গি চাদরের মত করে গায়ে দিয়ে থাকতো , গামছা দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতো। এখন গরম কাপড় সহজ লভ্য হয়ে গেছে। গরীব মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বেড়েছে। কেউ আর শীতে আগের মত কষ্ট পায় না। তবে আগের মত এখনও শীতের সময় যেন পোশাকের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় শহরবাসীর মধ্যে।

সেসময় শীতের সকালে গরীব মানুষেরা রাতের বাসি পানিবিহীন কড়কড়ে ভাত খেত মরিচ , পিয়াঁজ,রসুন , সরিষার তৈল দিয়ে। সকালে রুটি খাওয়ার প্রচলন তখন ছিল না। যারা খুবই গরিব একমাত্র তারাই খেতেন রুটি।

শীতের সময় মাঝে মাঝে মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা অনুভূত হতো। এ সময় ঘন কুয়াশায় ঢেকে থাকতো প্রকৃতি। জানুয়ারি আমাদের দেশের সব থেকে শীতলতম মাস। এখন আমরা জানি এমাসে এক থেকে তিনটা তীব্র শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যায়। শৈত্যপ্রবাহ শব্দটি তখনও জনগনের মধ্যে তেমন পরিচিতি পায় নাই। ঘূর্ণিঝড়ের সময় কত নং বিপদসংকেত চলছে তা নিয়ে আগ্রহ থাকলেও কি ধরনের শৈত্য প্রবাহ চলছে তা নিয়ে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে বর্তমানেও তেমন আগ্রহ দেখা যায় না । এমন কি অফিসে -বাসা-বাড়ীতে গরম নিবারণের জন্য বা বৃষ্টির উৎপাত ঠেকানোর জন্য বিবিধ ব্যবস্থা থাকলেও শীত নিবারনের জন্য তেমন পূর্ব প্রস্তুতি মাথায় রেখে কাঠামো বানানো হয় না।
তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রীর নিচে নামলে শৈত্যপ্রবাহ বলে গণ্য করা হয়। তীব্র শৈত্যপ্রবাহের সময় তাপমাত্রা নেমে আসে ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আর মাঝারি শৈত্যপ্রবাহে তাপমাত্রা থাকে ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ ছাড়া মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের শৈত্যপ্রবাহ (৮ থেকে ১০ ডিগ্রি সে.) বয়ে যায়। তীব্র শৈত্যপ্রবাহ গরীব মানুষের জীবনে বয়ে আনতো সীমাহীন দুর্ভোগ। দিনভর বৃষ্টির সঙ্গে হাড় কাঁপানো শীতও মোকাবেলা করতে হতো। মাঘ মাসের তীব্র শীতের দিনগুলোতে,টানা কয়েকদিন সূর্যের দেখা মিলতো না। তবে আমাদের ১০ ডিগ্রি তাপমাত্রা মানে বিলেতের শীত নয়, বড়জোর বিলেতের অটাম বা হেমন্ত’।
কখনও কখনও মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত মাঝারী থেকে ঘন কুয়াশা পড়তো এবং কোথাও কোথাও তা দুপুর পর্যন্ত চলমান থাকতো। মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশার কারণে মানুষের স্বাভাবিক কর্মঘণ্টা বিনষ্ট হতো। দরিদ্র জনগোষ্ঠির আয়-রোজগার কমে যেত।
ব্যাংকের পক্ষ থেকে শীতকালের শেষে বা বসন্তকালের শুরুতে একবার পিকনিকের আয়োজন করা হতো। শীতের সময়ে গ্রামে গ্রামে অবশ্য পিকনিক খাওয়ার ধুম পড়ে যেত। গ্রামের বিভিন্ন বয়সী ছেলেরা চাঁদা তুলে মাইক বাজিয়ে খোলা বিলে কিংবা মাঠে পিকনিক উত্সবে মেতে উঠতো। সারা রাত মাইকে গান বাজতো- সে যে কেন এলো না (এ ছাড়া রংবাজ ছবির প্রায় সব গান),শুধু একবার বলে যাও আমি যে তোমার কতো প্রিয়’ তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়,অনেক সাধের ময়না আমার বাঁধন ছিড়ে যায়’ ‘প্রেমের নাম বেদনা সে কথা বুঝিনি আগে’ আয়নাতে ওই মুখ দেখবে যখন, কপোলের কালো তিল পড়বে চোখে’ ‘যদি বউ সাজোগো বড় সুন্দর লাগবে’ ‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান যেন ভুলে যেওনা’ ‘ও পাখি তোর যন্ত্রণা আর তো প্রাণে সয়না’ ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া’ ‘ইটুস খানি দেখো, একখান কথা রাখো, ভালোবাইসা একবার তুমি বউ কইয়া ডাকো,‘আরে ও প্রাণের রাজা, তুমি যে আমার, কাছে কাছে থেকো চাই না কিছু আর’ ‘আমি একদিন তোমায় না দেখিলে; তোমার মুখের কথা না শুনিলে, ‘বেদের মেয়ে জোসনা আমায় কথা দিয়েছে’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এ ছাড়াও অবিশ্রান্ত ভাবে বাজতো আব্দুল আলীমের পল্লী গীতি ।

মাঝে মধ্যেই দেখতাম ঝরা পাতা বা খড় বা শুকনো ডালে আগুন দিয়ে তার পাশে লোকজন জড়ো হয়ে বসে আছে। আগুনের দিকে দু হাত প্রসারিত করে দিয়েছে। ক্ষেত থেকে ছোলা গাছসুদ্ধ উঠিয়ে আগুন দিয়ে ছোলা পোড়া (হুড়া) খাবার প্রচলন ছিল। সবার মন যে আজকে আগুনকে ছুঁতে চায়। বাসায় আমার বৃদ্ধ দাদু একটা মাটির পাত্রে সারা রাত তুষের আগুন জ্বালিয়ে রাখতো। সকাল বেলা তার উপর হাত দুটো মেলে ধরতো। সে শীত যে এখন কই গেল।
অফিসে যেতে যেতে দেখতাম ঘাসের উপর শিশির বিন্দু। খুব ভোরে সূর্ষ্যকে অসহায় লাগতো। একটু আলো ফুটলে যখন তা শিশির বিন্দুর উপর প্রতিফলিত হতো তখন শিশির বিন্দু মুক্তার মত জ্বলজ্বল করে উঠতো।

যারা কর্মজীবন শেষ করে অবসরে আছেন বা জীবনের হেমন্ত বেলায় পৌঁছে গেছেন বা যারা অতীত স্মৃতি রোমন্থন করতে ভালবাসেন শীতকাল এলেই এ ধরনের সব মানুষের কম বয়সে কাটানো শীতের কথা মনে পড়বেই । সেই শীতের ভোরে মুখ দিয়ে ধোঁয়া ওঠার দৃশ্য ,পরীক্ষার শেষে ছুটির দিনের খিল-খোলা আনন্দ, দেশি সার্কাস / যাত্রা দেখার প্রথম উত্তেজনার স্মৃতি স্মৃতি,ঘুরে বেড়ানোর মাহেন্দ্রক্ষণ,খেজুরের রস, খেজুর গুড়, কোঁচাভর্তি মুড়ি-মুড়কি, পিঠা-পায়েস, খড়-পাতার আগুন তাপানো, গমের ক্ষেতে পাখি-তাড়ানো, লেপ-কম্বলের কাঁথার উত্তাপ, শীতের মিঠে রোদ, কুয়াশার চাদর, উঠোনের কোণে মাটির চুলায় রান্না, চুলার পাশে বসে বসে হাতের তালু গরম করে নেয়া, পিছিয়েপড়া মানুষগুলোর উদাম শরীরের শিরশির কাঁপুনি, চায়ের কাপের সাদাটে ধোঁয়া, হলুদের ডালি বিছানো সষের্র মাঠ- আর হিম হাওয়ায় ঠাণ্ডা-কাশি তো আছেই। শীতে ত্বক শুষ্ক হতো, ত্বক ফেটে যেত -ব্যবহার করতাম তিব্বত পমেট। অনেকেই সারা গায়ে মাখতো খাঁটি সরিষার তেল (প্রিয় পাঠক-পাঠিকাবৃন্দ এ প্যারা পড়ার পর কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করে আপনার বাল্যকালের শীতের স্মৃতি স্বরণ করবেন। আমি লিখিনি অথচ আপনার স্মৃতিতে আছে এমন কিছু পেলে কমেন্টে লিখে জানাবেন। আমি চেষ্টা করবো সে গুলি আমার প্রকাশিতব্য বইয়ে অন্তভূর্ক্ত করতে।) এখানে একটু বলে রাখি আমার এ এলাকায় পরিযায়ী পাখি আসতো না, তাই এ নিয়ে আমার কোন স্মৃতিও নাই।

আমাদের সময়ের তুলনায় বর্তমানে শীতকালে যে পরিবর্তনটি বিশেষভাবে নজরে পড়ে তা হলো প্রকৃতিতে শীতের আগমনী বার্তার সাথে সাথে আমাদের দেশের পর্যটন এলাকাগুলো মুখরিত হয়ে উঠে। আমাদের সময়ে এত ভ্রমণসুবিধা ছিল না। বিশেষ করে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে শীত মৌসুমে পর্যটকদের আনাগোনা বেড়ে যায়। পর্যটনশিল্পের সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা এই মৌসুমটার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। হোটেল-মোটেলগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। প্রকৃত অর্থেই ভ্রমণের জন্য শীতকালের বিকল্প নেই। শীতকালে রাস্তাঘাট শুকনো থাকে আর আকাশ থাকে মেঘমুক্ত ঝকঝকে।অন্যদিকে এ সময় ঝড়বাদল-বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের ভয় নেই; তাই সবাই ভ্রমণের জন্য এ সময়টাকেই বেছে নেয়। সাজেক,নীলগিরি , থানচি,বগালেক বিরিশিরি ,রাঙ্গামাটি ,কক্সবাজার, ,টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, নিঝুমদ্বীপ, সুন্দরবন, কুয়াকাটা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে শীতকালে যে পরিমাণ পর্যটক যায়, অন্য কোনো ঋতুতে সে পরিমাণ যায় না। যেন ভ্রমণের জন্যই শীতের আগমনন। ভ্রমণ মানেই তো উত্সব আনন্দ। ভ্রমণপ্রিয় লোক জনের জন্য এই ঋতু উত্সবের বার্তাও নিয়ে আসে।

শীতকালে আমাদের দেশে যেটা দেখা যায় না –তা হলো স্নো বা তুষারপাত । বর্তমানে আমাদের দেশের ভ্রমণপিয়াসীরা সবচেয়ে কাছে তুষারপাত দেখতে সিকিম বা দার্জিলিং যাচ্ছে। আমি যখন ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের একদম শেষ দিকে বসে এ লেখা লিখছি তখন শুনলাম দার্জিলিং শহরেও এ সময় বরফ পড়ছে। এতদিন দার্জিলিং-এর আশেপাশে বরফ পড়লেও দার্জিলিং শহরে প্রায় এক দশক পরে এ সময়ে (শেষ ডিসেম্বরে ) আবার বরফ পড়ল । এ ছাড়াও বরফ পড়ছে সিকিমের গ্যাংটকেও। অন্যদিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানেও মরশুমের প্রথম তুষারপাত হয়েছে এ সময়। সেকারণে গোটা দেশে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। কারণ ভুটানবাসী মনে করেন প্রথম তুষারপাত মঙ্গলবার্তা নিয়ে আসে। সিকিম, লাদাখ , অরুণাচল প্রদেশ কিংবা হিমাচল প্রদেশের লাহুল-স্পিটি বা কিন্নর উপত্যকার মতো যেসব এলাকা এতদিন বাংলাদেশী পর্যটকদের জন্য নানা বিধিনিষেধে ঘেরা ছিল, সেসব জায়গায়ও এখন অতি সহজে ও বিনা পারমিটে তারা যেতে পারবেন বলে ভারত সরকার এ বছর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভারতে এখন অবশ্য সবচেয়ে বেশি বিদেশি পর্যটক আসে বাংলাদেশ থেকেই; সংখ্যাটা বছরে ১৬ থেকে ১৮ লাখের মতো।
আমার যাতায়াতের কাঁচারাস্তার দু ‘পাশের ধানের মাঠগুলি শীত কালে ফসল শূণ্য -রিক্ত হয়ে থাকতো। গ্রামীণ জনপদের চারদিকে তাকালে বোঝা যেত শীত এক রিক্ত ঋতুও বটে। বুক জুড়ে তার নিঃস্বতার নিদারুণ হাহাকার , সদ্য কেটে নেওয়া ফসলের শূন্যতা । চারদিকের কুয়াশা দেখে মনে হতো শীত যেন কুয়াশার চাদর দিয়ে শূন্যতাকেই ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কুয়াশা গায়ে দিয়ে বৈরাগ্যের বেশ ধরেছে সে। সব ঋতুর মধ্যে শীতরই কেবল শূন্য হাতে আগমন ঘটে । দুটি হাত তার রিক্ত, যেন কিছুই দেওয়ার নেই তার । অন্যসব ঋতু বাঙালীর দুয়ারে কোন না কোন উপহার নিয়ে হাজির হয়। গ্রীষ্ম আনে ফুল আর ফল । বর্ষা আনে আকাশভরা বৃষ্টি। শরৎ আনে আলোভরা আকাশ আর শুভ্র সাদা মেঘ । হেমন্ত আনে শস্য । আর বসন্ত তো ঋতু রাজ।

শীতের সময় কুয়াশা মোড়া ভোরের গ্রামকে রহস্যময় মনে হতো। শীত চলে যাওয়ার পরও গ্রামে গ্রামে কুয়াশা এবং মাঠের পর মাঠ সবুজ ক্ষেত ফোঁটা ফোঁটা শিশির বিন্দুতে ঢেকে থাকার দৃশ্য অনেক দিন থেকে যেত ।
আমাদের জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে এই শীত ঋতু। ডিসেম্বরের এক শীত বিকেল বয়ে এনেছিল আমাদের বহু প্রতীক্ষিত মুক্তির বার্তা।(ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ২২:৩১:৩৬   ৬৭৩ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #