রবিবার, ১৭ মার্চ ২০১৩

পাপ -যাকিয়া মুসান্না মুন্নী

Home Page » সাহিত্য » পাপ -যাকিয়া মুসান্না মুন্নী
রবিবার, ১৭ মার্চ ২০১৩



157037_3938626683671_215014602_n.jpgআকাশে খুব ঘন করে মেঘ জমেছে, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকিয়ে নিকষ কালো রাতটিকে হঠাৎ আলোয় ভাসিয়ে নিচ্ছে। রাস্তার কুকুরগুলো তারস্বরে চিৎকার করেই যাচ্ছে। বছরের প্রথম বৃষ্টি হবে। চৈত্রের তাপদাহে শহরটা উষ্ণতার সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। দূরে কোথাও বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যে, ফেইসবুকে স্ট্যাটাসে বৃষ্টিরই আগমনী বার্তা। এখন তো কিছু একটা হলেই হয় সাথে সাথে ফেইসবুকে চলে আসে।এই ঘোর অন্ধকারে আমি একা ছাদের রেলিঙের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখে জল। শরীরে পাপ! ভীষণ অশুচি নিয়ে রেলিঙের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে ভয়ঙ্কর কিছু চিন্তা করছি। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা করলেও গলা দিয়ে কোন স্বর বের হচ্ছে না। এই ঝড় বৃষ্টির রাতে আমি যদি ছাদ থেকে পড়েও যাই কেউ জানবে না। টুপ করে একফোটা বৃষ্টি ঝরে পড়লো…এরপরে আরো কয়েক ফোটা… এরপরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। পাপ এবং তাপ শরীরে শিহরণ জাগিয়ে ঝরে পড়ছে… কী শীতল বৃষ্টির ফোটাগুলো! আকাশের দিকে মুখ বাড়িয়ে দিলাম… চোখের জল আর বৃষ্টির ফোটা মিলেমিশে একাকার হয়ে যাক… এই বৃষ্টি কি পারবে আমার সকল পাপ ধুয়ে মুছে নিতে?

সেই সন্ধ্যাটিও এমন ঝড়ের ছিলো। তবে তা প্রকৃতির ঝড় নয়, মনের ঝড় কিংবা বলা চলে শরীরের ঝড়। আমি আর সে… আমার খুউব কাছের(!) মানুষ। হ্যাঁ কাছের মানুষটিই তো। ওর চাইতে আমার এত্ত কাছের, এত্ত আপন কে ছিলো? সেইদিন ওর জন্মদিন ছিলো। আমার আপনের জন্মদিন। আমার সবচে’ সুন্দর শাড়িটা সেইদিন আমি পরেছিলাম। চোখে ঘন করে কাজল আর কপালে কালো টিপ! অনেকদিনের জমানো টাকা দিয়ে আপনের জন্য গিফট কিনে ওর বাসায় গেলাম। ও বলেছিল ওর সব বন্ধুরা আসবে। কিন্তু বাসায় গিয়ে দেখলাম আপন ছাড়া বাসায় আর কেউ নেই। শূন্য বাড়িতে আপন আমাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বললোঃ

- “তোমাকে পরীর মত সুন্দর লাগছে… তুমি যে এত্ত সুন্দর আগে কখনো বুঝিনি…”

আমি লাজুক হেসে বললাম- “হুহ হইছে ঢং করতে হবে না… ছাড়ো আমাকে… আর গেস্ট কোথায় সব?”

- “ওরা কেউ আসবে না… আজকে তুমি আর আমি। তুমি রান্না করবে, তোমার হাতের রান্না তো কখনো খাইনি। দেখি আমার বৌ কেমন রাঁধে…”

আমার শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। সব সময়েই যায়। যখন আপন আমাকে “বৌ” বলে ডাকে আমার ভেতরে এক অন্যরকম ভালো লাগায় আমার সমস্ত হৃদয় ভরে যায়। আমিও বেশ গৃহিনী গৃহিনী ভাব নিয়ে বললাম- “হুম… রান্নাঘর দেখিয়ে দাও, আর বলো কি কি খেতে চাও?”

আপন আমাকে রান্নাঘর দেখিয়ে দেয়। আমি কোমড়ে আচল গুঁজে পাক্কা গৃহিনী বনে যাই। ক’দিন আগে মায়ের কাছে ভুনা খিচুড়ি বানানো শিখেছি, সাথে গরুর মাংস ভুনা। রান্না চড়িয়ে দিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে আপনের পাশে এসে বসি। কিছুটা অভিমানের স্বরেই বলি- “আমি একা একা রান্না করছিলাম তুমি তখন কি করছিলে? একবারও তো উঁকি দিয়ে দেখলে না বৌটা কি করছে?”

-বাব্বা আমার বৌটা অভিমান করলে দেখি তাকে আরো সুন্দর লাগে! চোখ বন্ধ করো তো…

- কেন? চোখ বন্ধ করব কেন?

-আহা করোই না… আচ্ছা দাঁড়াও আমি চোখ বেঁধে দিচ্ছি তোমার।

এই বলে আপন আমার দু’চোখ বেঁধে দিয়ে উঠতে বলে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। অন্ধের মতো করে চোখ বেঁধে আপন আমাকে অন্য ঘরে নিয়ে আসলো। চোখের বাঁধন খুলে আমি তো অবাক। এত সুন্দর করে সাজিয়েছে ঘর! ঘরের চারিদিকে মোমবাতির দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বেলুন আর ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে ঘরটা সাজানো।

- “ও এতক্ষণ ধরে তাহলে আপনি এই করছিলেন!” ঠোঁট টিপে হেসে বললাম।

- “হুম, শুধু তোমার জন্য। কেমন হয়েছে বলো তো?” এই বলে আপন পিছন থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে।

এই স্পর্শে কি ছিলো আমি জানি না। কিন্তু প্রবল ঘোরের অতলে আমি তলিয়ে যাই। কখন আপন আমাকে কোলে তুলে নিলো আমি টের পাইনি। তখন শরীরে আমার ঝড় বইছে। প্রবল ঝড়… এই ঝড় পৃথিবীর সব কিছু লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। আমার স্বম্বতি ফিরে আসে তখন যখন আমি একটু শীত শীত বোধ করি। আপন তখন আমাকে ঘিরে রেখেছে বলেই আমি আমার অবয়ব দেখতে পেলাম না, কিন্তু স্পষ্টতই বুঝতে পারলাম কি হচ্ছে। আপনকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলাম।

- “আপন কি করছো এইসব? ছাড়ো আমাকে, আমি বাসায় যাবো”। এই বলে খাটের পাশে পড়ে থাকা বালিশ দিয়ে নিজেকে আড়াল করলাম।

- “নিহা, আমি তোমাকে ভালোবাসি” আপন কাতর কন্ঠে বলে উঠল।

- “আমিও তোমাকে ভালোবাসি আপন। অনেক বেশি। কিন্তু ভালোবাসার মানে কী এটা?”

- “নিহা, তোমার ভালো লাগবে, ট্রাস্ট মি। ট্রাই ইট ফর ওয়ান ডে” আপনের কন্ঠে আরো অনেক বেশি কাতরতা।

- “নাহ প্লিজ আপন। এখন না। তুমি ভালোবাসার পবিত্রতা নষ্ট করো না। আমি এসব পছন্দ করি না”

আপন শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। প্রায় কেঁদেই দিলো… “নিহা, ইউ ডোন্ট বিলিভ মি?”

-”দেখো এখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের কিছু নেই। এটা ঠিক না এটাই আমি জানি শুধু। প্লিজ ছাড়ো আমাকে। আমার সময় নেই” এই বলে আমি আপনকে কিছুটা জোড়েই ধাক্কা দেই। ও খাটের কর্ণারে গিয়ে বাড়ি খায়। আর গলগল করে ঠোঁট থেকে রক্ত পড়তে থাকে। আমি অসম্ভব চমকে ওকে নিজেই জড়িয়ে ধরে বলি- “স্যরি আমি তোমাকে ব্যথা দিতে চাইনি… দাঁড়াও এক্ষুনি বরফ এনে লাগাচ্ছি…”

ফ্রিজ থেকে বরফ এনে আপনের ঠোঁটে লাগিয়ে রক্ত পড়া বন্ধ করি। গভীর মমতায় ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদি। আমি ভাবতেও পারিনি কখনো ওকে আঘাত করবো।

আপন বারেবারে বলছিলো “কিচ্ছু হয়নি, ব্যাপার না… আমি যেন মন খারাপ না করি…” কিন্তু আমি কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছিলাম না। অবশেষে আপন আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমার মুখের খুব কাছে মুখ এনে বললো- “বোকা মেয়ে, দেখো এইতো আমি ঠিক আছি। এত্ত কাঁদতে হয় এইটুকুনেই?”

কিছুক্ষণ নীরবতায় কেটে গেল দুজন দুজনাকে আলিঙ্গন করেই। এরপরে কী হলো আমি বলতে পারবো না। আমার কিচ্ছু মনে নেই… শুধু মনে আছে কোন এক ভীষণ ঝড় উঠেছিলো। যে ঝড়ে সমস্ত পৃথিবী ওলটপালট হয়ে গেছে। তীব্র এক সুখের তরঙ্গে আমি ভেসে যাচ্ছিলাম।

এরপরে অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেছে। টার্ম পরীক্ষা দিলাম। খুব ব্যস্ত ছিলাম বলে আপনের সাথে সেইরকম কথা হতো না। পরীক্ষার সময় আমি কারো সাথে কথা বলতে পারি না। রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে শুধু বই নিয়ে পড়ে থাকা ছাড়া। আর আপনও ব্যস্ত ছিলো ওর বিজনেস নিয়ে।

হঠাৎ করেই টের পেলাম নিজের মাঝে আরো একটি অস্তিত্ব। প্রথমে খুব ভড়কে গেলেও পরে নিজেকে শান্ত করলাম। অশান্ত হলে হবে না এখন। এমনিতে আমার খুব ঠান্ডা মাথা, বিপদে আরো বেশি ঠান্ডা হয়ে যায়। আপনের সাথে যোগাযোগ করলাম। ওকে সব কিছু খুলে বলে যেনো কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেলাম।

আজ বিকালে আমাদের বিয়ে করার কথা ছিলো। মগবাজার কাজী অফিসের সামনে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পরেও যখন আপন আসলো না তখনও বুঝিনি আপন আর আসবে না! ফোনের পর ফোন, মেসেজের পর মেসেজ দিচ্ছিলাম। নো রিপ্লাই…

অতঃপর, মাগরিবেরও একঘন্টা পরে ওর একটা মেসেজ আসে… “গৌ হোম নিহা। লাইফ ইজ নট এ গেইম”

আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। “লাইফ ইজ নট এ গেইম” বলে আপন কি বুঝাতে চাইলো? অনেকবার ফোনে ট্রাই করার পরেও সে ফোন ধরলো না বরং ফোন অফ করে রেখে দিলো! আমি অসহায়ের মত কাঁদতে লাগলাম। তখনই আম্মু ফোন দিয়ে প্রায় ঝাঁঝালো কন্ঠেই বললো- “কি ব্যাপার নিহা, বাসায় আসছো না কেন? রাত কত হয়েছে দেখেছো?”

এরচেয়ে রাত করেও আমি মাঝে মাঝে বাড়ি ফিরি। প্রায় সময়ই আমার সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস থাকে বলে বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়! আম্মু কখনো এমন করে কথা বলে না আমার সাথে। তাহলে কি আম্মু জেনে গেছে তার মেয়ে একটা পাপী… কঠিন এক পাপ সে বয়ে বেড়াচ্ছে?

আমি রোধ হয়ে যাওয়া কন্ঠে বললাম- “আসছি আম্মু”

একটা রিক্সা ঠিক করলাম। আমার চেহারায় কি ছিলো তখন জানি না কিন্তু রিক্সাওয়ালা মনে হয় আঁচ করতে পেরেছিলো আমি ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি, তাই সে অবিশ্বাস্য কম ভাড়া বললো। আমিও বাকবিতন্ডায় না গিয়ে উঠে পড়লাম। সে যদি আমার কাছে বেশি ভাড়া চাইতো তাহলেও আমি কিছু বলতাম না। ভাড়া নিয়ে ক্যাঁচাল করার মত অবস্থা কই আমার?

বাসার কাছে আসতেই আকাশ ঘোর কালো রঙ ধারণ করলো, নবমীর চাঁদ আর তাকে ঘিরে থাকা অজস্র তারকারাজি ঢাকা পড়ে গেলো মেঘের আড়ালে। কিছু মেঘ যদি এমন করে আমাকেও ঢেকে দিতো…

পাপের ভারে নুব্জপ্রায় আমি টালমাতাল। কোনমতে সিঁড়ি ভেঙ্গে বাসায় এলাম। আম্মুর দিকে তাকাতে পারছিলাম না। নিজেকে অশুচি লাগছে। নিজের ঘরে এসে অনেকটা সময় নিয়ে গোসল করলাম। পানির স্রোত যদি আমার সমস্ত পাপ ধুয়ে নিতে পারে…

অতঃপর বেশ কিছুক্ষণ ধরেই ছাদে। শেষবারের মত আপনকে ফোন দিলাম। আপন ফোন কেটে দিয়ে মেসেজ পাঠালো- “আমাকে বিরক্ত কর না নিহা, তুমি যা ভাবছো তা হবার নয়। আর এখন আমি বিয়ের জন্য প্রস্তুতও নই। তুমি চাইলে আমি তোমাকে টাকা দিতে পারি, তুমি এবরশোন করিয়ে আসো। কিন্তু আমাকে বিরক্ত করো না। আর সেইদিন যা হয়েছে আমার একার ইচ্ছায় কিছু হয়নি”

প্রচন্ড অপমানবোধ আমাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেললো। আমি নীরবে রেলিঙের একদম কিনার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকালাম। কুকুরগুলো এখনও চিৎকার করেই যাচ্ছে। কী হয়েছে এদের? কেন অমন করে গগনবিদারি চিৎকার করছে ওরা? আজ চিৎকার করার কথা তো আমার… কই আমি তো করছি না!

-”নিহা, নিহা…”

মা ডাকছে… আমি জবাব দিলাম না। সে মনে হয় আমাকে খুঁজতে ছাদে চলে এসেছে। যা করার এই মুহুর্তেই করতে হবে। মোবাইলের সব মেসেজ আর কল লিস্ট ডিলিট করলাম। যাতে করে আমি যদি মরেও যাই আমার ফোন ঘেঁটে যেন কেউ বুঝতে না পারে কিছু। প্রবল বর্ষনের মাঝেও আমি মায়ের পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। আমি ধীরে ধীরে রেলিঙের ওপর উঠে দাঁড়ালাম। নিজেকে অনেক হাল্কা লাগছে। বিদ্যুৎ চমকের ক্ষণিক আলোতে এই সুন্দর পৃথিবীটা শেষবারের মত দেখে অশ্রু অথবা মুখ থেকে বৃষ্টির ছাট মুছলাম।

“আমি তোমাকে সত্যি ভালোবেসেছিলাম আপন… তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলাম…!”

পতনের ঠিক আগ মুহুর্তে কে যেনো খপ করে আমার হাত চেপে ধরলো।

- “মা?”

বাংলাদেশ সময়: ১:১৪:৫৬   ৭৯৭ বার পঠিত