বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন”-জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন”-জালাল উদদীন মাহমুদ
বুধবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮



 

জালাল উদদীন মাহমুদ

৪৭ তম কিস্তি— “
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া ৭ম পর্ব।

বর্ষাকালে যেদিন প্রচন্ড বৃষ্টি হতো, পথচারীগণ আশ্রয়ের জন্য ব্যাংকের প্রশ্স্থ বারান্দায় প্রচন্ড ভীড় জমাতো আর আমি কাজের ফাঁকে জানালা দিয়ে স্কুলের মাঠ পার হয়ে ফসলের ক্ষেত পার হয়ে দুরের গাছগুলোর হাওয়াই মাতামাতি দেখতাম। পৃথিবীর এ আবছা উজ্জ্বল রুপ আমার খুব ভাল লাগতো। ঘন কালো মেঘের পটভূমিতে সবুজ সবুজ গ্রামের দৃশ্য দুই নয়নে মুদ্রিত হলে মস্তিস্কের বোধ হয় অলস হতে ইচ্ছে করে। তখন এটা বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে চকচকে রুপই পৃথিবীর আসল রুপ নয় আবছা ধূসর রুপের সৌন্দর্য্যই তার আসল চেহারা । যা কিছু স্পষ্ট তা মন ভোলায় ক্ষণিকের তরে , যা কিছু অস্পষ্ট তার আবেদন স্থায়ী , সে আহ্বান করে অসীমের দিকে। সচরাচর চেনা জানা জগৎ থেকে এ যে আলাদা।
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে
জানি নে, জানি নে কিছুতে কেন যে মন লাগে না ॥
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ওই বলাকার পথ খানি নিতে চিনে॥
মেঘমল্লার সারা দিনমান।
বাজে ঝরনার গান।
মন হারাবার আজি বেলা, পথ ভুলিবার খেলা– মন চায়
মন চায় হৃদয় জড়াতে কার চিরঋণে॥

না, রবীন্দ্রনাথ এ গান ব্যাংকারদের জন্য লেখে নাই। দৈনন্দিন কাজ ছাড়াও ব্যাংকে অনেক কাজ করতে হতো । কাজে মন লাগাতেই হবে। হাজার রকমের স্টেটমেন্ট। ব্যাংকারদের ঝরো ঝরো বরষায় অন্যদিকে মন দেবার সুযোগ কোথায়? মন না চাইলেও মাঠ সহকারীদের ঋণ আদায়ে বের হতে হবে ।
কাজের ফাঁকে চেয়ে চেয়ে দেখতাম স্কুলের সবুজ মাঠে হয়তো খাড়া হয়ে বৃষ্টি পড়ছে অমনি উদাম রসিক হওয়া এসে তাকে দোল খাওয়ায়ে দিচ্ছে। পথচারী বৃষ্টি বুঝেই ছাতা ধরে। আর বৃষ্টি হাওয়ার মতলব বুঝেই দিক পরিবর্তন করে। চালাক পথচারী ছাতা ধরার কৌশলে বৃষ্টিকে আটকে দেয় কিন্তু বন্ধু বাতাসের তা সইবে কেন সে ছাতাকেই উল্টে দেয় । বৃষ্টিকে বলে দেখলিতো আমার কেরামতি। ওদিকে হয়তো সন্ধ্যা হতে দেরী নাই। উদোম গায়ে একদল ছেলে এসে স্কুল মাঠে শুরু করে দিল ফুটবল খেলা। মাঠের অন্য প্রান্তে হা-ডু-ডু খেলাও শুরু হলো। দেখতাম কেউ আছাড় খেলে তাদের মজা দ্বিগুন বেড়ে যায়।

তখনও ডেমাজানিতে নদীর উপর ব্রীজ হয় নাই। আমরা খেয়া ধরার জন্য বের হবার আগে রাজকুমারকে পাঠাতাম নৌকা নদীর কোন ধারে তা দেখতে। তাতে অবশ্য তেমন একটা লাভও হতো না। সে খবর দিতে দিতে নৌকা ছেড়ে দিত। ঘাটটা ব্যাংক থেকে বেশ কিছুটা দুরে। ঘাট পার হবার পরেও ছাতা -ব্যাগ -জুতা হাতে নিয়ে পা টিপে টিপে প্রায় মাইল খানেক রাস্তা পার হয়ে আড়িয়া বাজারে এসে বাস ধরতাম। মাঝখানে ছিল মজার খেয়া পারাপার। ব্যাংকে সরাসরি আসার কাঁচা রাস্তা বর্ষাকালে সাধারনতঃ ব্যবহার করতাম না। আমি একা নই, সেকেন্ড অফিসার জামাল সাহেব সর্বদাই সঙ্গী। কারন গন্তব্যও আমাদের একই দিকে। আবার সকাল বেলা যখন রওনা দিতাম অফিস পানে তখন মনের মাঝে গুণগুণ করতো রবীন্দ্র নাথের গান-
কিন্তু জামাল সাহেব তাগাদা দিত , দ্রুত যেতে হবে। দু জনের কাছেই যে ভোল্টের চাবী আছে। যদিও ঘরের বাহিরে না যাবার জন্য রবীন্দ্রনাথের আহ্বান মনে পড়তো-

বাদলের ধারা ঝরে ঝর - ঝর,
আউশের খেত জলে ভর - ভর,
কালী - মাখা মেঘে ও পারে আঁধার
ঘনিয়েছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ভেবে যে বাদলা দিনে ঘরের বাহিরে বের হতে বাঙালীদের নিষেধ করেছিলেন তা অবশ্য বুঝতে পারতাম না। হয়তো গ্রামে গন্জে ব্যাংকের তখন বিস্তৃতি ঘটে নাই-। বিপুল সংখ্যক ব্যাংকার পাঠকও তখন ছিল না । আজকের দিন হলে উনি হয়তো আমার জোনাল হেডের নির্দেশনাটিই এভাবেই লিখতেন-
বাদলের ধারা ঝরে ঝর - ঝর,
আউশের খেত জলে ভর - ভর,
জলে- মাখা গায়ে কাস্টমার ঐ
জমিয়েছে দেখ্ চাহি রে।
লেট করিস না আর যেতে ঘরের
বাহিরে।
পরপর যখন বৃস্টি চলতো , তখন নির্মলেন্দু গুনের মত করে ভাবতাম-

“আকাশ এত কাঁদছে কোন
কেউ কি তারে গাল দিলো?
ছিচ কাদুনে মেঘের সাথে
গাছ গুলি কি তাল দিলো”

রাস্তার একপাশে ছিল সার ধরে কয়েকটি কদম ফুলের গাছ। না ,বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল অবশ্য কেউ দান করে নাই। তবে একজন হৃদয় দান করতে চেয়েছিল , চিঠি লিখে। নেইনি। থাক সে কথা।
বর্ষার কথা বলবো আর খিচুড়ি ও ইলিশের কথা আসবে না ,তা কি হয়? ছুটির দিনে যেদিন আকাশ কালো করে ঝুম বৃষ্টি নামতো বাড়ীতে বায়না ধরতাম খিচুড়ি ও ইলিশের।

আষাঢ় মাস আবার নাইওরির মাস। গ্রামের বাড়ীতে নাইওরি আসার ধুম পড়ে যেত। স্বামী যেতে দিতে চায়না । বউয়ের আবার মন মানে না। সে নানা ছলে বাপের বাড়ী যেতে চায়। লোককবি শাহ আব্দুল করিম গানে গানে বিষয়টি ফুটিয়ে তুলেছেন—

পুরুষ :-খালি বাড়ি থইয়া নাইওর যাইতে দিব না ।
নারী :- তুমি ইতা কিতা কও আমি কিছু বুঝি না
আষাঢ় মাসে নাইওর যাইতে কে করে মানা ।।
আদিল কিলা কথা কইলে গায়ে আমার আগুন জ্বলে
জ্যৈষঠ আষাঢ় মাস আইলে কোনো বেটি নাইওর যায় না ।
আষাঢ় মাসে নাইওর যাইতে কে করে মানা ।।
পুরুষ:- তুমি আমি দুইজন ঘর ভরা জিনিষ
মোরগরে কে গুড়া দিত আমি ইতা পারিনা ।
খালি বাড়ি থইয়া নাইওর যাইতে দিব না ।।
নারীঃ- আম খাইমু কাঠাল খাইমু নয়া একখান কাপড় পাইমু
ভাই বোনরে দেইখ্যা আইমু আমার কি মনে চায় না
আষাঢ় মাসে নাইওর যাইতে কে করে মানা ।।

বর্ষাকালের ফল কাঁঠাল নিয়ে দু কথা না বললেই নয়।কাঁঠাল আমাদের জাতীয় ফল। আকারের দিক থেকে ফলের মধ্যে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়। পুষ্টি ও স্বাদে কাঁঠাল কিন্তু অতুলনীয়। বিশাল এ ফলটির কোনো অংশই ফেলনা নয়। অন্য ফলের চেয়ে এটি দামে বেশ সস্তা। তাইতো কাঁঠালকে বলা হয় ‘গরীবের ফল’। গ্রামাঞ্চলের মানুষ নানাভাবে কাঁঠাল খেয়ে থাকেন। অনেকেই নরম কোষকে চটকিয়ে রস বের করে দুধ-ভাত কিংবা মুড়ি দিয়ে খায়। কেউ পান্তাভাত দিয়ে খায়। কেউ আবার এমনিতেই খেতে পছন্দ করেন। কাঁচা কাঁঠালের তরকারি নিরামিষভোজীদের প্রিয় আহার। এর বিচি মাছ-গোশতের সাথে রেঁধে, ভর্তা করে এবং ভেজে খাওয়া যায়। কাঁঠালের মোথা উৎকৃষ্ট গোখাদ্য। কাঁঠাল দিয়ে তৈরি করা যায় জুস, জেলি, স্কোয়াশ, জ্যাম এমনকি কাঁঠালসত্ব।কাঁঠাল গাছের মূল্যবান কাঠ দিয়ে আসবাবপত্র তৈরি করা হয়। কাঁঠাল গাছের পাতা ছাগল এবং গৃহপালিত প্রাণীর কাছে খুব প্রিয় খাবার। সর্বোপরি বলা যায় কাঁঠালই একমাত্র ফল যা কাঁচা-পাকা সর্ব অবস্থায়ই সব অংশ ব্যবহৃত হয়।কাঁঠালের যত দোষ তার আঠার। খেতে গেলে জড়িয়ে যায়, লাগলে সহজে ছাড়েনা। তাই পছন্দের হলেও অনেকে খেতে চান না, এদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল। কিন্তু তাই বলে পিরিতির সাথে কাঁঠালের আঠার তুলনা ?
“ও যে পিরিতি কাঁঠালের আঠা,
ও আঠা লাগলে পরে ছাড়বে না ।”
যা হোক সে সময় আষাঢ় মাসে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্যের অভাব পূরণ করতো এই কাঁঠাল।
ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক ও রম্যলেখক জনাব আতাউর রহমান দৈনিক প্রথম আলেোতে কাঁঠাল নিয়ে একটি মজার রঙ্গ লিখেছিলেন-
জনৈক পাঠান আমাদের দেশে এসে কাঁঠাল খেয়ে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর বন্ধুর কাছে প্রশ্ন করেছিল, ‘ইয়ার, বাঙাল মুল্লুকমে এক আজীব ফুরুট (আশ্চর্য ফল) খায়া। বাহারমে খাদরা-খাদরা, আন্দরমে লাবড়া-লাবড়া (বাহিরে শক্ত, ভেতরে নরম), আওর অন্দরমে এক ডাণ্ডা ভি হ্যায় (এবং ভেতরে একটি ডান্ডাও আছে)। খোদা কা নূর খারাপ কর দিয়া, অর্থাৎ তাঁর দাড়িতে কাঁঠালের আঠা লেগে বিতিকিচ্ছি ব্যাপার ঘটে গেছে।
সাধে কি আর আফগান লোকটি বলেছিল, বাঙালমে আয়া। কাঁঠাল খায়া, ইয়া গজব খায়া! জয় হোক তাই বাংলাদেশে কাঁঠালের।

একটি আষাঢ়ে গল্প দিয়ে আজকের লেখা শেষ করবো।এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে বলছে, জানিস, আমার দাদার না বিশাল লম্বা এক গুদাম ঘর ছিল। মাইলের পর মাইল লম্বা সেই গুদাম। দ্বিতীয় বন্ধুও চট জলদি জবাব দিল, তুই জানিস আমার দাদার না বিশাল লম্বা এক মই ছিল, সেটা বেয়ে একদম চাঁদে চলে যাওয়া যেত। এখন প্রথম বন্ধু তো বুঝে গেল তার বন্ধু তাকে মিথ্যে বলছে। সে রেগে মেগে জবাব দিল, আষাঢ়ে গল্প করার আর জায়গা পাও না? তোমার দাদা সেই লম্বা মইটা রাখত কোথায় , বলোতো দেখি শুনি ? চালাকিতে দ্বিতীয় বন্ধুও কম যায় না। সে সাথে সাথে জবাব দিল, কেন তোমার দাদার সেই মাইলের পর মাইল লম্বা গুদামে।(ক্রমশঃ)

বাংলাদেশ সময়: ১৮:৫৯:২৩   ৬৩২ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #