বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮

“রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন”- জালাল উদদীন মাহমুদ

Home Page » বিনোদন » “রঙ্গে ভরা আমার ব্যাংকিং জীবন”- জালাল উদদীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০১৮



 

লৎফর রহমান সরকার

৪১ তম কিস্তি— “
ডেমাজানি শাখা ,বগুড়া-১ম পর্ব।
ক্যান্টনমেন্ট শাখায় আমার চাকুরী কাল মাস আষ্টেক স্থায়ী হয়েছিল। ১৯৮৬ সালের ফেব্রয়ারী মাসে যোগদান করলাম লুৎফর রহমান সরকারের স্মৃতিধন্য করতোয়া নদী পারের ডেমাজানী শাখায়। প্রথমে সেকেন্ড অফিসার হিসেবে পরে ম্যানেজার হিসাবে মোট সাড়ে তিন বছরের মত ছিলাম সেখানে।
দেখলাম, ডেমাজানি শাখাটি স্কুল ভবনের একটা বড়রুমে অবস্থিত। পাশে স্কুলের বিশাল মাঠ। এই স্কুলেই লুৎফর রহমান সরকার পড়াশোনা করেছেন , এই মাঠেই তিনি ফুটবল খেলেছেন। ১৯৩৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি এখানকার ফুলকোট নামক গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। অগ্রণী ব্যাংক ভবনের ৫ম তলা তার নামে (এল আর সরকার, এক্সিকিউটিভ ফ্লোর )নামকরণ করা হয়েছে। দরজার সামনে তার বিশাল ছবিও আছে। নতুন প্রজন্মের অনেকেই হয়তো তার সম্পর্কে তেমন কিছু জানে না। তাই তার সম্পর্কে কিছু লেখার প্রযোজনীয়তা অনুভব করছি।

মোঃ লুৎফর রহমান সরকার (এল. আর. সরকার)ছিলেন বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের ষষ্ঠ গভর্ণর। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ব্যাংকার এছাড়াও দেশের একজন বরেণ্য সাহিত্যিক ও বিশিষ্ট রম্য লেখক হিসেবেও তিনি সুপরিচিত ছিলেন। ব্যাংকিং খাতে উদ্ভাবনী ও সৃজনশীলতার জন্য তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হন। লুৎফর রহমান সরকার ১৯৫৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পাস করেন। রেডিও পাকিস্তান দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও পরে তিনি যোগ দেন করাচির হাবিব ব্যাংকে। ১৯৫৭ সালে অগ্রণী ব্যাংকের পূর্বসূরী হাবিব ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে তার ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু হয়। পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হয়েছিলেন। তিনি হাবিব ব্যাংক,অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এবং প্রাইম ব্যাংক লিমিটেড এর প্রধান নির্বাহীসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালে অগ্রণী ব্যাংকের এমডি হন তিনি এবং এই বছরেই সোনালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে যোগদান করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে লুৎফর রহমান সরকারের হাতেই আধুনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার প্রবর্তন ঘটে । প্রায় ৫০ বছর যাবৎ তিনি ব্যাংকিং পেশায় ছিলেন ।এ সুদীর্ঘকালে তিনি বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকিং খাতে নানা রকম উদ্ভাবনী ধারণার প্রবর্তন করেছেন। তাকে বাংলাদেশের “গণমুখী ব্যাংকিংয়ের জনক” বলে অভিহিত করা যায়। সীমিত আয়ের মানুষের কথা বিবেচনায় এনে তিনিই প্রথম ব্যাংকিং প্রোডাক্ট হিসেবে মাসিক সঞ্চয় প্রকল্প, মাসিক মুনাফা প্রকল্প, দ্বিগুণ বৃদ্ধি আমানত প্রকল্পসমূহ সার্থকভাবে প্রচলন করেন। দেশীয় ব্যাংকগুলোতে ডিপোজিট পেনশন স্কিম, আজীবন পেনশন স্কিম, কনজুমার ক্রেডিট, হোম লোন, হায়ার পারজেস, লিজ ফাইন্যান্স, ক্যাপিটাল মার্কেট অপারেশন, নারী উদ্যোক্তা ঋণ চালু করেন । তার উদ্ভাবিত ডিপোজিট পেনশন স্কিম (ডি পি এস) যে কত জনপ্রিয় হয়েছিল সে সময় -তা এখন কল্পনা করাও কঠিন। সে সময় সামর্থ্যবান এমন কেউ ছিলেন না যিনি ডি পি এস খোলেন নাই।গ্রাহকদের জন্য তা অনেক লাভজনক হয়েছিল। এ টাকা জমিয়ে অনেকে জমি কিনেছেন , মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। আমার তো মনে হয় এই একটা স্কীম, বাঙালীকে সঞ্চয়ী হতে শিখিয়েছিল। শুধু ডি পি এস নয় তিনি ছিলেন দেশের ব্যাংকিং সেক্টরে একের পর এক নব নব আধুনিক আইডিয়ার প্রবর্তক ।

ইসলামী ব্যাংকের উপদেষ্টা থাকাকালে তিনিই দেশে প্রথম ভোগ্যপণ্য ঋণ প্রবর্তন করেন । কিস্তিতে পরিশোধযোগ্য এ ঋণ পরবর্তীতে অন্য ব্যাংক ব্যাপকভাবে অনুসরণ করে। এই ভোক্তা ঋণ (বর্তমানে বিভিন্ন ব্যাংক বিভিন্ন নামে প্রবর্তন করেছে) পরবর্তীকালে আমাদের দেশের খুবই জনপ্রিয় এবং লাভজনক এক ব্যাংকিং সেবা হিসেবে টিকে যায়।

সব সময় তিনি স্বল্প ও মধ্যম আয়ের মানুষের কল্যাণের জন্য বিভিন্নভাবে সচেষ্ট থেকেছেন। উদ্যমী মেধাবী বেকার তরুণদের কথা ভেবেছেন। সোনালী ব্যাংকে তাই তিনি চালু করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্মসংস্থান প্রকল্প ‘বিকল্প’ নামের যুগান্তকারী কর্মসূচির।

সে সময় শিক্ষিত যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানমূলক ‘বিকল্প’ খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে । সারা দেশের বেকার শিক্ষিত যুবকরা এই প্রকল্পের আওতায় সদস্য হতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংকাররা সধারনতঃ ব্যবসায়ীদের ঋন দিতে বেশী সাচ্ছন্দ্য অনুভব করেন।নতুন উদ্যোক্তাকে ঋণ দিলে তাতে ঝুঁকি থেকে যায় এবং ঋণ আদায় না হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকার দায়ী হয় বিধায় ব্যাংকাররা এ ক্ষেত্রে ঋণ প্রদানে বেশী সতর্কতা অবলম্বন করে।এ প্রসংগে ব্যবসায়ী (Businessman): এবং উদ্দোক্তা (Entrepreneur) এর মধ্যে কি পার্থক্য তা একটু আলোচনা করা যেতে পারে।
একজন ব্যবসায়ী হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি, যিনি পুরাতন ও পরীক্ষিত কোন কাজ দিয়ে তার ব্যবসা শুরু করেন। এক্ষেত্রে একজন ব্যবসায়ীর ঝুঁকি কম থাকে অন্যদিকে লাভ তুলনামূলক বেশী হবার সম্ভাবনা থাকে। উদাহরণ হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্পের নাম বলা যেতে পারে। তিনি একজন ব্যবসায়ী, কারণ তিনি তার রিয়েল স্টেট এর ব্যবসা বাবার নিকট থেকে পেয়েছেন। তার ব্যবসার এই ধরণটা বাবার কাছ থেকে পাওয়াই হোক বা অন্য কারোর কাছ থেকে পাওয়া হোক, রিয়েল স্টেট এর ব্যবসার ধারণাটা অনেক পুরাতন এবং পরীক্ষিত , তাই এখানে তেমন ঝুঁকি নাই । তাই ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ব্যবসায়ী। অন্যদিকে উদ্যোক্তা হচ্ছেন সেই ব্যাক্তি যিনি সম্পূর্ণ নতুন একটা ধারণাকে প্রতিষ্টিত করে কোন প্রতিষ্ঠান দাঁড় করান বা নিজে নতুন ব্যবসা করা শুরু করেন। উদ্যোক্তার ব্যবসার ধরণটা হয় সম্পূর্ণ unique. এবং তার ব্যবসায়ীক ধারণাটাও পরীক্ষিত নয়। একারণে তার ঝুঁকির সম্ভাবনা বেশী। উদাহরণ হিসেবে মাইক্রো সফটের এর প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস, ফেসবুকের সহ প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জুকারবার্গ, অ্যপেলের স্টীপ জবস ,গুগলের সহ প্রতিষ্ঠাতা ল্যারী পেজ সহ অনেকের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। এখানে উল্লেখ্য যে, উদ্যোক্তারা দীর্ঘ সময় পর ব্যবসায়ীতে পরিণত হয়ে যান।
বাংলাদেশে নতুন নতুন উদ্যোক্তা গড়ে তোলার অপরিহার্যতা লুৎফর রহমান সরকার ভাল করেই বুঝেছিলেন। তাই ব্যাংকিং পেশায় তিনি সর্বদাই গুরুত্ব দিয়েছেন সৃজনশীল সম্ভাবনাময় উদ্যোক্তার প্রতি। দেশের নতুন নতুন খাতে, নতুন নতুন উদ্যোক্তাসৃষ্টির জন্য তিনি ছিলেন সদা তৎপর।অনেক নতুন নতুন উদ্যোক্তা আসতেন তার চেম্বারে । আগত উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে, বাজার বিশ্লেষণের ক্ষমতা ,চিন্তার দৃঢ়তা ,সংযম – সততা ও উদ্যম দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ঝুঁকি নিয়ে ঋণ দিয়েছেন।নতুন নতুন সেক্টরে ঋণ দিতে তখন কেউ এগিয়ে আসেন নাই কিন্তু মেডিক্যাল ডায়াগনস্টিক সেক্টরে, সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিতে, স্থাপত্যকলার মত সেক্টরে লুৎফর রহমান সরকার ঋণ সহায়তা দিয়েছেন। সেই ব্যাংকিং সহায়তার নিয়েই তাদের অনেকেই আজ নিজ নিজ আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। দেশের প্রথিতযশা উদ্যোক্তা হয়েছেন।
স্বাধীন বাংলাদেশের তৎকালীন উদীয়মান অর্থনীতি , আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, জনমানস, সংস্কৃতি সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে নৈতিকতা বজায় রেখে ও সততার সাথে প্রচলিত ব্যাংকিং সেক্টরে আধুনিক এসব ধারণা তাকে কিম্বদন্তীতূল্য করে তোলে। এসব উদ্যোগ এখনও সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশের ব্যাংকিং জগতে লুৎফর রহমান সরকার তাই এক প্রাতঃস্মরণীয় নাম।

শুধু তাই নয়, ব্যাংকিং সেক্টরে উন্নততর মানবসম্পদ তৈরির চিন্তা থেকেই বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অগ্রণী । তারই নেতৃত্বে গঠিত হয় পেশাদার ব্যাংকারদের সংগঠন ‘ব্যাংকার্স ক্লাব’ যা এখন ‘এসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স’ নামে পরিচিত।

রাজনৈতিক চাপে, ঋণখেলাপিদের দাপটে, অনৈতিকতার শক্তিতে বাংলাদেশের শিল্প সাম্রাজ্যের ক্ষমতাধররা অনেক অনিয়ম করতে সমর্থ হয়েছেন কিন্তু এ রকম সবাই থেমে গেছেন লুৎফর রহমান সরকারের নৈতিকতার সামনে। ঋণখেলাপিদের তালিকা সংবাদপত্রে ছেপে গোটা জাতির সামনে তাদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচন করেছিলেন তিনি।(ক্রমশঃ)

জালাল উদদীন মাহমুদ

বাংলাদেশ সময়: ১০:৪০:৪৫   ৫৮৬ বার পঠিত   #  #  #  #  #  #